!!৮৫!!
চাঁদ কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কি বলবে সে? কি বলার আছে?
-এই চাঁদ বল না। আলাদা করবি না।
-এসব কি করছেন আপনি? আপনি আমার বড়। তাছাড়া আপনি একজন সম্মানিত লোক এসব আপনাকে মানায় না। আমাকে ছোট করবেন না এসব করে।
আবির পা ছাড়েনা। বিড়বিড় করে,
"আমার কিছু চাইনা। ক্যারিয়ার, সম্মান, চাকুরী কিছু না। শুধু তোকে চাই। আমার দুইটা সন্তানকে চাই।"
চাঁদ আবিরের মাথা ছুঁয়ে দেখলো গরম। একেবারে হাত পুড়ে যাওয়ার মতো গরম। আবির তখনো জ্বরের ঘোরে বকবক করছে। চাঁদ দাড়োয়ান আনোয়ার চাচাকে ডাক দিয়ে বললো,
-চাচা, আমাকে একটু সাহায্য করেন দয়াকরে।
আনোয়ারের সহায়তায় আবিরকে ফ্ল্যাটে নিয়ে এলো চাঁদ। আবিরের ভিজা কাপড় শুকিয়ে গিয়েছে। রত্না অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
-ওঁর কি হয়েছে।
চাঁদ চোখের ইশারায় জানালো,
"পরে বলছি"
আবিরকে বিছানায় শোয়ানো হলো। পাশেই আহির আর মৃদুলা ঘুমাচ্ছে। আনোয়ারকে একশ টাকা দিয়ে ধন্যবাদ জানালো চাঁদ। তিনি খুশি হয়ে চলে গেলেন। আবির ঘুমিয়ে পড়েছে।
ড্রয়িং রুমে রাখা টিভি কেবিনেটের ড্রয়ারে থার্মোমিটার খুঁজতে ব্যস্ত চাঁদ। রত্না পিছনে এসে দাঁড়ালেন। চাঁদের কাঁধে হাত রাখলেন। চাঁদ ছলছল চোখে পিছনে তাকিয়ে কেঁদে দিলো।
-মা ওঁর গায়ে প্রচুর জ্বর মা। ও কেন এমন পাগলামি করছে মা। কেন আমার নরম জায়গায় আঘাত করছেন তিনি।
রত্না মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
-এসব কথা বাদ দে এখন। ডাক্তার হাসানের নাম্বার আছে না?
চাঁদ মাথা নাড়ায়। যার মানে তার কাছে আছে। চাঁদ দৌঁড়ে এসে আবিরের জ্বর মেপে দেখলো ১০৩° ফারেনহাইট। তৎক্ষনাৎ ফোন লাগালো ডাক্তার হাসানকে। ডাক্তার হাসানের বলা ঔষধ আর আবিরের জন্য জামা আনতে চাঁদ বাইরে বেরিয়ে যায়। যাওয়ার আগে রত্নাকে বলে গেলো তিনি যেন আবিরের মাথায় জলপট্টি দেন।
!!৮৬!!
রত্না মাত্রই জলপট্টি দেওয়া শেষে বেরিয়েছেন। আবির সেই যে চোখ বুজেছে আর খুলেনি। হঠাৎই বুকের উপর ভারী কিছুর অনুভবে ঘুম ভেঙে যায় তার। চোখ খুলে দেখতে পায় তার বুকের উপর একটা ছোট মেয়ে বসে। ঠিক যেন তার মতো দেখতে। গালগুলো ফোলা ফোলা। কেমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। আবির ভেজা কন্ঠে ডাক দেয়,
"মা"
মৃদুলা কি বুঝলো কে জানে। আবিরের পুরো মুখে নিজের মুখের লালা ভরিয়ে দিলো। আবিরের নাকে কামুড় দিলো। গালে চার পাঁচটা আঁচড় দিলো। চুলে টান দিলো। অতঃপর খুশিতে গদগদ হয়ে ডাকলো,
-পাপা। পাপা।
আবির এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো নিজের মায়ের দিকে। ঠোঁটে তার হাসি। মেয়েটা কি তার মতো স্বভাব পেলো নাকি। নিজের গালে আরেকটা ছোট হাতের ছোঁয়া পেয়ে পাশ ফিরে তাকালো আবির। আহির চুপ করে বসে আছে। আবির ডাকলো,
"বাবা"
আহির আবিরের গাল ছুঁয়ে আবার হাত সরিয়ে নিলো।
-পাপা, গলম। তোমাল গাল গলম।
আবির ছেলের কথা শুনে মৃদু হাসলো। তাঁর বিশ্বাস হচ্ছে না এই দুইটা পুতুল তার। একদম নিজের। খুশিতে দুফোঁটা জল বেয়ে পড়লো তার চোখ দিয়ে।ছেলেকে জিজ্ঞেস করলো,
-আমার বাবার নাম কি?
-আমাল নাম আহিল।
আবির অবাক। আহিল মানে কি আহির? তার নামের সাথে মিলিয়ে নাম রেখেছে চাঁদ! মেয়েটা গাল ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে বললো,
-পাপা, আমাল নাম শুনো। আমাল নাম শুনো।
আবির হেসে জিজ্ঞেস করলো,
-আমার মায়ের নাম কি?
-মিদুলা।
বাবাকে কাছে পেয়ে দুষ্টুমিতে মেতে উঠলো ছোট দুই প্রাণ। একসময় ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে গেলো আবিরের বুকে। ডানপাশে ছেলে। বামপাশে মেয়ে। আবির দুজনের মাথায় ভালোবাসার পরশ দিয়ে বললো,
"আমার বাবা-মা। আমার কলিজা। আমার জান।"
তার ক্লান্ত শরীরেরও চোখ বুজে এলো।
চাঁদ ঔষধ আর আবিরের জন্য কেনা কাপড় নিয়ে ছুটে এলো বেডরুমে। আবিরের বুকের উপর আহির আর মৃদুলাকে দেখে চোখ যেন ভরে এলো তার। এর চেয়ে সুন্দর দৃশ্য কি পৃথিবীতে আরেকটি আছে?
চাঁদ এগিয়ে এসে মৃদুলা আর আহিরকে কোলে নিয়ে অপর পাশে রেখে আবিরকে ডাকলো,
-এই যে শুনছেন। স্যার।
আবির চোখ খুলে তাকালে। চাঁদ বললো,
-এখানে আপনার জন্য টি-শার্ট আর টাউজার আছে৷ ঐ যে বাথরুম চেঞ্জ করে আসুন।
!!৮৭!!
আবির কোনো কথা না বলে চুপচাপ চেঞ্জ করতে গেলো। জ্বরের কারণে মাথা চক্কর দিয়ে উঠছে তার। চাঁদ বেরিয়ে আবার খাবার নিয়ে আসলো। আবির তখন খাটে বসে।
-স্যার আমি এখানে ঔষধ রেখে যাচ্ছি। খাবার খেয়ে ঔষধ খেয়ে নিবেন। আপনার কিছু হলে আপনার মা হয়তো আবার আমাকেই দোষ দিবে।
চাঁদ অন্যদিকে ফিরে কথাটা বলে বের হতে নিলে টান পড়লো তার বেণীতে। চাঁদ একটুও বিরক্ত হলোনা। একটুও না। তবে পিছনে ব্যাক্তিটিকে বুঝতে দেওয়া যাবেনা। এই লোকটার জন্য অনেক কষ্ট পেয়েছে চাঁদ। চাঁদ পিছনে ফিরে চোখ রাঙালো। আবির ভয়ে বেণী ছেড়ে দিলো। কি অদ্ভুত কিছু বছর আগেও মেয়েটা তার ভয়ে কাপঁতো আর আজ সে ভয় পাচ্ছে। বউ হলে সব মেয়েরা কি এভাবেই পাল্টায়?
আবির মুখ কাচুমাচু করে বললো,
-আমাকে তুই ক্ষমা করেছিস তো চাঁদ?
-সেটা বলতে পারবোনা। তবে আপনি এবাড়িতে চাইলেই আসতে পারবেন আহির-মৃদুলার পাপা হয়ে।
-চাঁদ আমার কথাটা শুন একবার।
-আপনি খেয়ে নিন।
চাঁদ আর দাঁড়ালো না। আবির দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে খাবারের প্লেট টা হাতে নিয়ে দুই লোকমা খেলো। তবে তার গলা দিয়ে খাবার নামছে না। হঠাৎ খাবার গলায় আটকে অদ্ভুত ভাবে কাশতে লাগলো আবির। চাঁদ পানি নিয়ে দৌঁড়ে এসে আবিরের পিঠে আলতো চাপড় দিতে দিতে বললো,
-দেখে খেতে পারেন না আবির ভাই?
আবির পানি খেয়ে খপ করে চাঁদের হাতটা ধরলো। অনর্গল বলে গেলো,
-চাঁদ বিশ্বাস কর। বিদেশ থেকে হঠাৎ জানতে পারি দাদি মারা গিয়েছেন আর তুই পালিয়েছিস। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরে। আমি দেশে আসি। তখন বাবা আমাকে অনুরোধ করলেন তোর সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে দিতে। মায়ের অনুরোধ, তোর চিরকুট, দাদির মৃত্যু, পারিপার্শ্বিক অবস্থা আমি হাঁপিয়ে গিয়েছিলাম। কেন যেন বিশ্বাস টা করতে পারছিলাম না। তুই বিশ্বাস কর চাঁদ আমি ভালো ছিলাম না। আবির কি করে তার চাঁদকে ছাড়া ভালো থাকবে বল?
-আপনার তো বিয়ে হয়ে গিয়েছে। তাহলে এই পাগলামি কেন? হাত ছাড়েন।
চাঁদ হাত ছাড়াতে চাইলো। আবির ছাড়লো না।
-আমি বিয়ে করিনি চাঁদ। আমি বিয়ে করিনি। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আর কখনো দেশে ফিরবো না। তবে মা আমাকে বাবার অসুস্থতার কথা বলে দেশে নিয়ে আসেন। দেশে এসে জানতে পারি সব মিথ্যা। মা আমাকে নিতির সাথে বিয়ে দিতে চান । আমি বারণ করে দেই। পরে মা আর চাচির কথোপকথন শুনে জানতে পারি আমার চাঁদ প্রেগন্যান্ট ছিলো। এইসব তাদের স্বরযন্ত্র। এসব জানার পর আমি সব সম্পর্ক ছিন্ন করে চলে আসি। এই চাঁদ ক্ষমা করে দে। আমাদের কারোরই পরিস্থিতি অনুকূলে ছিলোনা।
-আমি এসব বিষয়ে আর কোনো কথা শুনতে চাইনা। আমি তো আপনাকে আমার সন্তানদের বাবার স্বীকৃতি দিয়েছি।
-আমার যে তোকেও চাই।
-এতো সহজে সব ভুলে যাওয়া সম্ভব না।
চাঁদ ছুটে গেলো। আবির নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো। আবিরের মনে দৃঢ় বিশ্বাস তার চাঁদ তাকে একদিন অবশ্যই মেনে নিবে।
.
.
.
চলবে............................