দরজা খুলে জাহ্নবী দেখল অর্ণব ও জাভেদ আলী এসেছেন। আজ অর্ণবকে স্বতঃস্ফূর্ত মনে হচ্ছে না। যেন জোর করে তাকে ধরে নিয়ে এসেছেন বাবা। অর্ণবের হাতে একটা ছোটখাটো বস্তা।
জাহ্নবী জাভেদ আলীকে জড়িয়ে ধরে বলল, 'কেমন আছো আব্বু?'
'ভাল আছি মা। অর্ণব ভেতরে এসো।'
অর্ণবের পায়ে কালো রঙের কেডস। জুতা খুলতে গিয়ে বেচারা কাৎ হয়ে পড়ে যাবার জোগাড়। জাহ্নবী দ্রুত সেখান থেকে চলে গেল। অর্ণব দরজায় এক হাত রেখে জুতা খুলে ভেতরে এসে বসল। আজ ক্লিন সেভ করে এসেছে সে। চাকরি জীবন শুরু করার আগে মানুষের মাঝে হয়তো আলাদা একটা মাধুর্য চলে আসে।
'কী অবস্থা অর্ণব ভাইয়া? শুনলাম চাকরি পেয়ে গেছেন?'
অর্ণব প্রশ্ন শুনে মাথা ঘুরিয়ে দেখল সামার দাঁড়িয়ে। হাসিমুখে অর্ণব উত্তর দিলো, 'হ্যাঁ। কেমন আছেন সামার?'
'ভাল আছি। কেমন আছেন সামার বাক্যটা কেন জানি ভালো শোনাচ্ছে না। হয় জিজ্ঞেস করুন কেমন আছেন আপু? আর নয়তো, কেমন আছো সামার?'
অর্ণব লাজুক হাসি দিয়ে বলল, 'আপু ডাকবো আপনাকে? এটাও ঠিক মানানসই হচ্ছে না। আর তুমি ডাকতে তো অনুমতির প্রয়োজন আছে।'
'অনুমতি দেয়া হল। শুনলাম আপনি নাকি একটা ইয়া বড় বস্তা নিয়ে এসেছেন?'
অর্ণব লজ্জা পেলো। মাথা চুলকে বলল, 'না মানে আম্মু জোর করে দিয়ে দিলো।'
'কী দিয়ে দিলো শুনি!'
'কাথা, প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। আম্মু আমাকে অনেক ভালবাসে।'
'সেটা সবার আম্মুই বাসে। মিষ্টি এনেছেন আমার জন্য?'
' না তো।'
'আপনার এত বড় বস্তা, এত বড় ব্যাগ, অথচ আমার জন্য সামান্য মিষ্টি আনার জায়গা হল না?'
অর্ণব এবার ভীষণ লজ্জা পেয়েছে। মাথা নিচু করে মুচকি হাসি সমেত উত্তর দিলো, 'আপনাদের সবার জন্যই মিষ্টি এনেছিলাম সেদিন। আপনি ছিলেন না বাসায়।'
'আপনি তো জানেনই আমি ছিলাম না। তাহলে আজকে আবার মিষ্টি নিয়ে আসবেন না?'
'না, মানে.. আমি আসলে ভুলে গিয়েছিলাম।'
সামার মুখ টিপে হাসল। অর্ণবকে বিব্রত অবস্থায় দেখতে মজা পাচ্ছে সে। হাসতে হাসতে বলল, ' হয়েছে, আর লজ্জা পেতে হবে না। আমি মজা করছিলাম।'
'থ্যাংকস।'
'তাই বলে ভাব্বেন না ট্রিট টা আমি ছেড়ে দেবো।'
'ভাব্বো না।'
সামার অর্ণবের মুখোমুখি সোফায় বসে রইল। জাহ্নবী নিয়ে এলো চা ও নাস্তা। সামার বলল, 'জানেন, আমার আপুরও চাকরি হয়েছে?'
'হ্যাঁ, আংকেলের কাছে শুনেছি। অভিনন্দন আপু।'
জাহ্নবী মুখ তুলে একবার অর্ণবকে দেখল। মুচকি হাসি ফুটে উঠল জাহ্নবীর মুখে। আজকে 'আপু' ডাক শুনে মোটেও খারাপ লাগেনি তার। নাস্তা রেখে জাহ্নবী নিজের ঘরে চলে গেলে সামার বলল, ' খেয়ে নিন। আমি যাই।'
'আপনিও বসুন না।'
'আমি এখন খাবো না। আব্বুর সঙ্গে দেখা করে আসি।'
'মিস সামার..'
সামার চলে যেতে গিয়েও মুখ ফিরে তাকালো। কৌতুহল ফুটে উঠল সামারের চেহারায়।
অর্ণব বলল, 'আপনি আমাকে কিছু একটা বলতে চেয়েছিলেন। বলেছিলেন আমার চাকরি হলে কথাটা বলবেন। এখন কী বলবেন সেটা?'
'না, বলবো না।'
'কেন?'
'আগে নাস্তা খেয়ে নিন। খাওয়া শেষ হলে বলবো।'
অর্ণব মুচকি হাসল। সামারকে অনেক উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। পরনে গোলাপ ফুল রঙা টি শার্টে ওকে ভীষণ মিষ্টি দেখাচ্ছে। গুণগুণ সুরে গান গাইতে গাইতে বাবার ঘরের দিকে চলে গেল সামার।
অর্ণব নাস্তা শেষ করে বসে রইল। আজকে এখানে আসার কোনো ইচ্ছাই ছিল না তার। জাভেদ আলী রীতিমতো জোর করে নিয়ে এসেছে তাকে। বলেছে, একসঙ্গে দুপুরের খাবার খাবো। তারপর আমি নিজে তোমাকে তোমার নতুন বাসায় রেখে আসবো।'
অর্ণব অধীর আগ্রহ নিয়ে বসে আছে সামারের কথাটি শোনার জন্য। কিছুদিন আগেও সে সামারের কথাটা শোনার জন্য আগ্রহ নিয়ে এসেছিল। সামার ছিল না বাড়িতে। আজকে সেটা শুনতে পাবে, ভেবেই আনন্দ হচ্ছে। এই বাড়ির মানুষগুলো সকলেই ধীরেধীরে কেমন আপন হয়ে উঠছে তার!
দুপুরের আগ পর্যন্ত আর সামারের সঙ্গে দেখা হলো না অর্ণবের। সে কিছুক্ষণের জন্য জাহ্নবীর ঘরে বিশ্রাম নিতে এসে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম ভাংলে টের পেলো বেলা এগারো'টা বাজে। এরপর আর সামারের সঙ্গে দেখা হয় নি।
জাহ্নবী ভায়োলেটকে বলল, 'আব্বুকে কখন বলবো নতুন বাসার ব্যাপারটা?'
'কয়েকটা দিন যাক, তারপর।'
'এ মাস তাহলে বাদ দিয়ে দিই? কি বলিস?'
'হ্যাঁ।'
ভীষণ খুশি খুশি দেখাল জাহ্নবীকে। সে আসলে নিজেও এত তারাতাড়ি এ বাড়ি ছেড়ে যেতে চাইছে না। ভায়োলেটের সঙ্গে গল্প করা, সামারের সাথে কাটানো মুহুর্তগুলো, মায়ের সঙ্গে কাজ করা, বাবাকে চা বানিয়ে দেয়া, সবকিছুকেই মিস করবে সে।
দুপুরের খাবার খেয়ে জাভেদ আলীকে সঙ্গে নিয়ে রওনা দিলো অর্ণব। যাওয়ার আগ পর্যন্ত সে উদগ্রীব হয়ে সামারকে খুঁজছিল। সামার কী বলতে চায়, সেটা শোনার জন্য অস্থির হয়ে রইল সে। অথচ সামার ফিরল না। বাধ্য হয়েই জাভেদ আলীকে নিয়ে অর্ণব বেরিয়ে পড়ল। জাভেদ আলী নিজ দায়িত্বে অর্ণবের জন্য কিছু জিনিস কিনলেন। যেমন, একটা লাল রঙের মগ, সাবান, তোশক ও বালিশ, আরও টুকটাক কিছু জিনিস। অর্ণবের রুমে গিয়ে বিছানাপত্র গোছগাছ করা পর্যন্ত তিনি বসে রইলেন। রাতুলের সঙ্গে পরিচিত হলেন তিনি। রাতুলকে বললেন, 'আমার ছেলের দিকে খেয়াল রাখবেন বাবা। একসঙ্গেই থাকবেন আপনারা।'
অর্ণব অবাক হল। জাভেদ আলী তাকে নিজের ছেলে বলে পরিচয় দিলেন! বিস্ময়ে অভিভূত হল অর্ণব। মানুষটার মনটা আসলেই অনেক ভালো। গত কয়েকটা দিন একসঙ্গে কাটানোর পর ওনার জন্য মনে এক ধরনের টান জন্মেছে। জাভেদ আলী নিজেও নিশ্চয়ই অর্ণবের শূন্যতা অনুভব করবেন।
অর্ণব ওনাকে বাসার সামনে থেকে রিকশায় তুলে দিয়ে বলল, 'সাবধানে যাবেন।'
'শোনো বাবা, তোমার যখনই খারাপ লাগবে আমাকে ফোন দিও।'
'আচ্ছা আংকেল। আপনি আমার জন্য দোয়া করবেন।'
'তা তো করিই রে বাবা। নিজের যত্ন নিও ঠিকমতো। খাওয়াদাওয়া করবে সময়মত। আর অফিস শেষে যদি কখনো একা একা লাগে, আমাকে কল দিও। আমরা বাইরে বসে এক কাপ চা খাবো, একটু হাঁটবো। এই বুড়ো মানুষের সঙ্গ নিশ্চয়ই ভালো লাগবে না তোমার, তাই না? ভাবছ, এরপর আর দেখা না হলেই ভালো হবে।'
অর্ণব লজ্জায় মাথা নুইয়ে ফেলল। জাভেদ আলীর হাত শক্ত করে ধরে বলল, 'আপনি এরকম কেন ভাবছেন? আমি আপনাকে অনেক মিস করবো আংকেল। আমি যখনই সময় পাবো তখনই আপনার সঙ্গে দেখা করতে যাবো। আপনার মতো একটা মানুষই হয় না।'
জাভেদ আলী বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। ওনাকে বিমর্ষ দেখাচ্ছে। অর্ণবকে তিনি এই কয়েকদিনে নিজের ছেলের মতোই আপন করে নিয়ে ফেলেছেন।
আগামীকাল জাহ্নবীর অফিসের প্রথম দিন। সামার জোরপূর্বক তাকে নিয়ে মার্কেটে গেল। নতুন চাকরি, নতুন জীবন। নতুন নতুন সবকিছু নিতে হবে টাইপের একটা ব্যাপার বারবার জাহ্নবীকে বোঝাচ্ছে সে। জুতা, হ্যান্ডব্যাগ ও একটা ছাতা কিনলো জাহ্নবী। সামারকে কিনে দিলো একটা লিপস্টিক। ভায়োলেটের পছন্দের ব্যাপারে জাহ্নবী'র ধারণা কম। তাই একটা বই কিনলো ওর জন্য।
অফিসের বিভিন্ন জল্পনা কল্পনায় সারা রাত ছটফট করেই কাটল জাহ্নবীর। চোখে ঘুম নেমে এলেও ক্ষণিক পরেই তা ভেঙে যেতে লাগল। বারবার এপাশ ওপাশ করে অবশেষে উঠে পড়ল জাহ্নবী। মোবাইল হাতে নিলো। ভায়োলেট একটা চমৎকার ফোন কাভার উপহার দিয়েছে। ফোনটাকে আকর্ষণীয় লাগছে এখন।
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়ল জাহ্নবী। ছাদে খানিক্ষণ হাঁটাহাঁটি করল। এতটা অস্থির কখনোই লাগেনি তার। মনে হচ্ছে ঠিক যেন এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিন আজকে। পারভীন নিজেও আজ ভোরে উঠেছেন। পরোটা, সবজি ও মাংস রান্না করলেন। দুধ চা বানিয়ে নিজে এক কাপ খেয়ে শুয়ে রইলেন স্বামীর পাশে। জাহ্নবীর চাকরির খবরে তিনি খুশি না হলেও আজকে অদ্ভুতভাবে ওনার আনন্দ হচ্ছে।
নাস্তা খেয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জাহ্নবী অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। প্রথমদিন আজ, তাই রাইড থেকেই গাড়ি নিলো সে। মনের ভেতর এক ধরনের অজানা আশংকা। ভয়, উত্তেজনা, আনন্দ, সবমিলিয়ে জগাখিচুরি অবস্থা জাহ্নবীর। এই অস্থিরতা ক্রমশই বাড়তে লাগল।
অফিসে প্রথম পা রেখে জাহ্নবী খুব সতর্কভাবে হাঁটা শুরু করল। প্রথমে ওর মনে হলো, সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। আজকে সে নতুন, সবার কাছে বিস্ময়ের নাম। সবাই তার জামাকাপড় নিয়ে হাসাহাসি করবে, ওর মুখে মেকআপ নেই দেখে ফিসফিস করে কথা বলবে। অথচ এসব কিছুই হল না। জাহ্নবী মুখ তুলে চারপাশে তাকিয়ে দেখল, কেউই তার দিকে তাকাচ্ছে না। বরং প্রত্যেকেই নিজের মতো ডেস্কে বসে কাজ করছে। সকালের শুরুতে ধীরেধীরে অনেকেই আসছে অফিসে। কেউবা গুছিয়ে নিচ্ছে ডেস্ক, পুরনো কাজ। কারোরই যেন কারও দিকে তাকানোর সময় নেই। বিষয়টা স্বস্তি দিলো জাহ্নবীকে।
নিজের ডেস্কে এসে জাহ্নবী সবকিছু একবার ভালো করে দেখে নিলো। অফিসের সবকিছুই পুরনো, কিন্তু তার কাছে নতুন। এটাই সবচেয়ে আনন্দের বিষয়। জাহ্নবী চেয়ারে বসল, সামনে থাকা ফাইল হাতে নিয়ে তাতে চোখ বুলালো। সবকিছুই তার কাছে সম্পূর্ণ নতুন। কম্পিউটার অন করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হল সে। পাসওয়ার্ড ছাড়া অন করা যাচ্ছে না।
পেছন থেকে কারও গলার আওয়াজ শোনা গেল, 'হ্যালো ম্যাম?'
জাহ্নবী পেছন ফিরে হাসিমুখে বলার চেষ্টা করল, 'হ্যালো।' কিন্তু গলা দিয়ে আওয়াজ বের হল না। নার্ভাস লাগছে তার।
সামনে যিনি দাঁড়িয়ে আছেন, তার পরনে কালো স্যুট, টাই, ভেতরে উঁকি দিচ্ছে হালকা গোলাপি শার্ট। লোকটাকে অসম্ভব স্মার্ট দেখাচ্ছে। চোখে পাতলা চশমা ওনাকে আরও জিনিয়াস ধরনের লুক এনে দিয়েছে। জাহ্নবী মনেমনে হতাশ হল। নিজেকে নিয়ে বিব্রত লাগছে। মনে হচ্ছে, তাকে দেখতে একদমই এই অফিসের মানানসই লাগছে না। কিন্তু সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার কথায় ধারণা পাল্টালো তার।
লোকটা বলল, ' Welcome to your new office. Our company was waiting for someone extraordinary like you. Hopefully, your journey with us will be very long.
জাহ্নবী সহাস্যে উত্তর দিলো, ' থ্যাংক ইউ স্যার।'
লোকটা নিজের পরিচয় দিলো, 'আমি নাদির, হেড অব বিজনেস ম্যানেজমেন্ট। আগামী এক সপ্তাহ আপনি আমাদের স্পেশাল ট্রেইনিংয়ের আওতায় থাকবেন। আপনার সব কাজ আমি দেখবো এবং আপনাকে সবকিছু বুঝিয়ে দেবো। আপনার আইডি কার্ড ও কম্পিউটারের পাসওয়ার্ড কিছুক্ষণের মধ্যেই পেয়ে যাবেন। আপনাকে সুন্দর একটি ইমেইল পাঠিয়েছি। সেখানে মিটিংয়ের সময়সীমা দেয়া আছে। মিটিংয়ে দেখা হবে।'
জাহ্নবী ধন্যবাদ জানাতেই নাদির নামের প্রচণ্ড প্রফেশনাল লোকটা চলে যেতে যেতেও আরেকবার পেছন ফিরে জাহ্নবীর সামনে এসে দাঁড়ালেন। বললেন, 'আপনি কি অফিসের প্রথমদিনে একটা ফুলের তোড়া আশা করছেন?'
জাহ্নবী ভড়কে গেল। কী উত্তর দেবে বুঝতে পারল না। নাদির বলল, ' সরি। কেউই আপনাকে ফুল দেয়ার অপেক্ষায় নেই।'
' স্যার আপনি আমাকে স্বাগত জানিয়েছেন তাতেই আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করছি।'
'সৌভাগ্যবতী।'
লাজুক হাসি দিয়ে জাহ্নবী বলল, 'জি স্যার। সৌভাগ্যবতী।'
নাদির সুন্দর একটি হাসি উপহার দিয়ে চলে গেল। বিস্মিত হল জাহ্নবী। এতটা প্রফেশনাল ব্যক্তিত্বের কাউকে কখনো দেখেনি সে। বড় বড় কোম্পানির ব্যাপারগুলোও হয়তো আলাদা!
চেয়ারে বসে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল জাহ্নবী। এখন তার নার্ভাসনেস কমেছে। সবকিছু ভালো লাগতে শুরু করেছে ধীরেধীরে। অফিসের প্রথমদিনের সূচনাটা দারুণভাবে শুরু হওয়ায় মনটা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে গেল।
.
.
.
চলবে........................................................................