জাহ্নবী আইসক্রিমের দোকানে বসে লজ্জায় কুঁকড়ে যাচ্ছে। তাকে বসিয়ে রেখে দাঁড়িয়ে রয়েছে অর্ণব। তিনজন কপোত কপোতী ভীষণ রোমাঞ্চকর পরিবেশ তৈরি করেছে আইসক্রিমের দোকানে। এত রঙ্গ করেও যে আইসক্রিম খাওয়া যায়, এ ধারণা ছিল না জাহ্নবীর। দ্রুত আইসক্রিম শেষ করে পালিয়ে বাঁচল সে।
রাস্তার পাশে হাঁটতে এসে অর্ণব বলল, 'আপনি তাহলে বাসায় চলে যান। আমিও চলে যাই।'
'মানে!'
'চট্টগ্রাম ব্যাক করবো।'
' এটা ভালো দেখায় না। আপনি চলুন আমাদের বাসায়। খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিয়ে তারপর যাবেন।'
কাঠফাটা রোদ তার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। জাহ্নবী'র এখন মনটা চাঙা। এই চাঙা মনকে সে ভাঙা করতে চায় না বলেই তার এখন বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না। আবার অর্ণবের সঙ্গে থাকতেও ইচ্ছে করছে না। লজ্জায়, সংকোচে দুরত্ব বজায় রেখে হাঁটছে সে।
অর্ণবের দ্রুত বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে। একজন মেয়ে মানুষকে সঙ্গে নিয়ে রোদে রোদে ঘুরতে কোনো আনন্দ নেই। জাহ্নবীকে দেখে মনে হচ্ছে সে অনেক আনন্দিত। অর্ণব কিছু বলতে যাবে এমন সময় জাহ্নবী বলল, 'আমি..'
'বলুন?'
'না, আপনি বলুন।'
'আপনি আগে শুরু করেছেন। আগে আপনি বলুন।'
'আমি একটা বই কিনতে চাই। যদি আপনার কোনো অসুবিধা না থাকে, আমি একটা বই কিনতে যাবো।'
অর্ণব দ্বিধাদ্বন্দে পড়ে গেল। জাহ্নবী বই কিনতে যাবে কথাটার দুটো অর্থ পারে। অর্থ এক, জাহ্নবী অর্ণবকে চলে যেতে বলছে। যেন সে একা একা নিজের কাজে যেতে পারে। অর্থ দুই, জাহ্নবী অর্ণবকেও অনুরোধ করছে তার সঙ্গে বই কিনতে যেতে। অর্ণব কী বলবে সেটা বুঝে উঠতে পারল না। প্রশ্ন করে বসল, 'আপনি কোথায় বই কিনতে যাবেন?'
'এখানে একটা লাইব্রেরি আছে।'
'তাহলে চলুন।'
জাহ্নবী চমকালো। কারণ সে মনেমনে অর্থ এক টাকেই চেয়েছিল। অর্থাৎ, সে চেয়েছিল অর্ণব বাসায় চলে যাক। সে একা একা লাইব্রেরিতে গিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকবে। একটা বইয়ের দু চারটা পৃষ্ঠা উলটে পালটে দেখবে। তারপর পছন্দমত একটা বই কিনে ধীরেসুস্থে বাসায় ফিরবে। কিন্তু অর্ণব সঙ্গে গেলে সংকোচেই মরে যাবে সে।
তবুও অর্ণবকে সঙ্গে নিয়েই যেতে হল। লাইব্রেরির প্রবেশ দ্বারে পা রেখেই বুক ধক করে উঠল জাহ্নবীর। অর্জন নামের সেই লোকটার কথা মনে পড়ে গেছে। সে এই লাইব্রেরিতে নেই তো!
ধরফর করছিল জাহ্নবীর বুক। স্ত্রস্তপদে লাইব্রেরিতে পায়চারি করতে লাগল সে। লাইব্রেরির নাম 'বেঙ্গল বই'। মনোরম নির্জন এক পরিবেশ। বসার মতো অসাধারণ সব জায়গায় বসে বই পড়ছে অনেকে। পরিবেশ দেখেই বই পড়ার সাধ জাগে। অর্ণব একদিকে বই খুঁজতে লাগল। জাহ্নবী চলে গেল অন্যদিকে।
হুট করে কাউকে দেখে ফেললেই সে মনেমনে ভাবে, এটাই অর্জন নয় তো? আজকে পড়ার মুডটা হারিয়ে গেছে। অযথা একটা টেবিলে বসে কয়েক পাতা বই ওল্টালো জাহ্নবী। অর্ণব নিজেও ওর মুখোমুখি বসে বইয়ে মনযোগ দিলো। এতক্ষণে ধীরেধীরে অস্বস্তিভাব কাটতে শুরু করল জাহ্নবীর।
অর্ণব অনেক্ষণ বই থেকে মাথা তুলল না। ছেলেটা অনেক ভাল। ভাল বলতে বর্তমান ছেলেদের তুলনায় বেশ ভাল। জাহ্নবী মুগ্ধ চোখে কয়েক পলক তাকিয়ে রইল অর্ণবের দিকে। হঠাৎ মুখ তুলল অর্ণব। এই চোখাচোখি সত্যিই অপ্রত্যাশিত ছিল দুজনের জন্য। কেউই বিব্রতকর পরিস্থিতি এড়াতে পারল না।
অর্ণব দুই কাপ কফির অর্ডার দিতে গেল। শান্ত ভঙ্গীতে বসে রইল জাহ্নবী। অর্ণবের হাঁটার ধরণ অনেক সাবলীল। কোনো জটিলতা নেই এতে। দুলতে দুলতে গিয়ে আবার ফিরে এলো মুহুর্তেই। জাহ্নবী মাথা নিচু করে বই পড়তে লাগল।
কফি খেতে খেতে ভার্সিটি জীবনের গল্প জুড়ে দিলো অর্ণব। গল্পে কথায় জড়তা কাটিয়ে অনেকটাই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে এলো ওরা। কফি শেষ করে একটা বই কিনে বাসার উদ্দেশ্য রওনা দিলো। অর্ণব জোরপূর্বক একটা বই কিনে দিয়েছে জাহ্নবীকে। জাহ্নবী কিছুতেই নেবে না। অর্ণব অনুরোধের সুরে বলল, 'প্লিজ নিন। আপনাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। তার দুঃখপ্রকাশ হিসেবে সামান্য উপহার।'
জাহ্নবী খুশিমনে গ্রহণ করল। কারণ অর্ণব একবারও 'আপু' বলে ডাকে নি। আপু ডাকটা অর্ণবের মুখে শুনতে কুৎসিত লাগে ওর।
তারা বাড়ি ফিরে দেখল পারভীন খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছেন। দরজা খুলে দিলেন তিনি নিজেই। আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন, 'বাসা পেয়েছো বাবা?'
অর্ণব বলল, 'জি আন্টি। এগুলো রাখুন।'
তিন কেজি আম কিনে এনেছে অর্ণব। খুশি হয়ে গেলেন পারভীন। ভালো ছেলে না হলে এভাবে বাইরে থেকে কেউ আম কিনে আনে? আজকালকার ছেলেপেলেদের এসব দিকে কোনো নজর থাকে নাকি? তিনি আম নিয়ে রান্নাঘরে চলে গেলেন। অর্ণবকে জোর করতে লাগলেন দ্রুত খাবার খাওয়ার জন্য।
খাবার টেবিলে অর্ণব ও জাভেদ আলীকে মনের সমস্ত আয়েশ মিটিয়ে খাবার খাওয়ালেন পারভীন। জাহ্নবী গোসল করতে গিয়েছে। ফিরে এসে দেখল মায়ের আনন্দের সীমা নেই। খাওয়াদাওয়ার পর আম কেটে পিরিচে সাজিয়ে কাটাচামচ সহ খেতে দিয়েছেন অর্ণবকে। এমন জামাই আদর দেখে জাহ্নবীর চক্ষু চড়কগাছ!
পারভীন আদুরে গলায় জাহ্নবীকে বললেন, 'মা, তুইও বস। আগে আম খা, তারপর ভাত খা। দ্যাখ অর্ণব কত ভালো আম কিনে এনেছে। ছেলেটাকে দেখেই মনে হয় সংসারে মনোযোগী। মায়ের কাজে সাহায্য করো তাইনা?'
অর্ণব লজ্জা পেয়ে উত্তর দিলো, 'তা করার চেষ্টা করি আন্টি। আপনিও আম খান না।'
'খাবো। তোমরা খেয়ে নাও। খেয়ে বিশ্রাম করো। তারপর ধীরেসুস্থে বের হইয়ো।'
আম খাওয়া শেষ করে অর্ণব চলে গেল জাহ্নবীর ঘরে। জাহ্নবী খাবার টেবিলে এলো। পারভীনের আর খোঁজ নেই। তিনি রান্নাঘরে গেছেন। অর্ণবকে খাওয়ানোর আরও কিছু বাকি আছে হয়তো।
জাভেদ আলী জাহ্নবীকে বললেন, 'তোর মায়ের মধ্যে একটা কিশোরী মেয়েকে দেখতে পাচ্ছি। বহুদিন পর ও অনেক উচ্ছল।'
বাবার মুখে এমন কথা শুনে জাহ্নবী আর কোনো কথা বলার সাহস করল না। পারভীন পিরিচে করে দই নিয়ে অর্ণবের দরজায় কড়া নেড়ে বললেন, 'বাবা, একটু দরজা খুলতে হয় যে..'
জাহ্নবী মুখ টিপে হাসল। তার ধারণাই সঠিক। পারভীন স্বস্তির সঙ্গে খাবার টেবিলে এসে বসলেন।
জাভেদ আলী বললেন, ' নিজে খাওয়ার চাইতে অন্যকে খাইয়ে বেশী সুখ পাওয়া যায়। তোর মাকে দ্যাখ।'
পারভীন বললেন, 'আসলেই। অনেকদিন পর মন ভরে কাউকে কিছু খাইয়েছি। নিজে রান্নাবান্না করে। শান্তি শান্তি লাগতেছে।'
'শান্তি লাগতেছে সেটা তো ভালো কথা। যাও তুমি বিশ্রাম নাও এখন।'
এমন সময় অর্ণব এসে বলল, 'আন্টি, আংকেল। আমার একটা অনুরোধ আছে। রাখতেই হবে আপনাদের। প্লিজ?'
জাভেদ আলী ও পারভীন কৌতুহলী চোখে অর্ণবের দিকে তাকালেন। পারভীনের চোখে মুখে খুশির দীপ্তি।
অর্ণব বলল, 'আমি এইমাত্র আমার মায়ের সঙ্গে কথা বলেছি। মা বলেছেন যেন আপনাদেরকে সঙ্গে নিয়ে যাই। ঢাকায় চলে এলে তো আগামী কয়েক মাস আমার আর বাড়ি যাওয়া হবে না। আপনারা এখন আমার সঙ্গেই চলেন। ঘুরে আসবেন। মা নিজে আপনাদের দাওয়াত দিয়েছেন।'
পারভীন ভীষণ অবাক হলেন। তিনি ভাবলেন, অর্ণবও কী মনেমনে জাহ্নবীকে পছন্দ করে বসে আছে! নয়তো তার বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার জন্য এত উতলা হয়ে আছে কেন? মাকেও রাজি করিয়ে ফেলেছে। অতিরিক্ত এই ভাবনা আরও আনন্দিত করল পারভীনকে।
তিনি স্বামীকে বললেন, 'এই, তুমি যাও। দুটো দিন থেকে আসো। ছেলেটা এত করে বলছে।'
জাভেদ আলী একবার স্ত্রী'র মুখের দিকে তাকাচ্ছেন, আর একবার অর্ণবের দিকে। অর্ণব ওনার হাত ধরে বলল, 'প্লিজ আংকেল চলেন না। আন্টিও চলেন।'
তিনি খুশি হলেন। উত্তর দিলেন না বটে, কিন্তু মনেমনে কোথাও একটা ঘুরে আসার প্রত্যাশা তারও ছিল। অনেকদিন বাসায় থেকে থেকে নিজেকে কারাগারের বন্দি মনে হয় তার।
অর্ণব পারভীনকেও তার সঙ্গে যাওয়ার জন্য জেদ করল। পারভীন রাজি হলেন না। আনন্দিত মনে শুধুমাত্র স্বামীর ব্যাগটাই গোছাতে লাগলেন তিনি।
জাহ্নবী এসে বলল, 'মা, তুমিও যাও।'
'ধুর কী বলিস। তোর আব্বু যাবে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার। আমি ক্যামনে যাই।'
'যাও ঘুরে আসো। তুমি ওনার ছেলেকে খাতির আপ্যায়ন করেছ, তাই ছেলের মা খুশি হয়ে তোমাকেও দাওয়াত করেছেন।'
কথাটা সুন্দর শোনালেও পারভীন খুশি হতে পারলেন না। কারণ অতিরিক্ত ভাবনায় তিনি ভেবে বসে আছেন, অর্ণব জাহ্নবীকে পছন্দ করেছে। কিন্তু জাহ্নবীর কথা শুনে ওনার অতিরিক্ত ভাবনায় ছেদ পড়ল। তাই মুখ কালো হয়ে গেল ওনার। তিনি ব্যাগ গোছানো বন্ধ করে বসে রইলেন।
জাহ্নবী বলল, 'কি গো? কী হল তোমার? যেতে ইচ্ছে করলে যাও।'
'নাহ। তোর বাপ যাক।'
অন্ধকার মুখ নিয়েই তিনি ব্যাগ গোছালেন। তৈরি হলেন জাভেদ আলী। জাহ্নবী পারভীনকে কখনোই বুঝতে পারে না। মুহুর্তেই মুড বদল হয় ওনার। স্বামীকে বিদায় দেয়ার আগে দরজা বন্ধ করে কী কী শিখিয়ে দিলেন, বোঝা গেল না।
বিদায়ের ক্ষণে অর্ণব আরেকবার সেই বিখ্যাত ভুল-টি করে বসল। জাহ্নবীকে বলল, 'ভাল থাকবেন আপু। আমার জন্য দোয়া করবেন।'
কথাটা পারভীনের সামনেই উচ্চারণ করেছে সে। পারভীনের প্রচণ্ড মন খারাপ হয়ে গেল। বড়সড় ধাক্কা খেয়ে গেলেন তিনি। এত সাধ করে তিনি জাহ্নবীর সঙ্গে বিয়ে দেবেন ভেবে অর্ণবকে এত খাতির করলেন, অথচ অর্ণবের কথা শুনে মনে হল সে জাহ্নবীকে বড় বোন ব্যতীত কিছুই ভাবে নি। আপু ডাকটা নাহয় স্বাভাবিক। কিন্তু দোয়া করবেন! এই কথাটা গুরুজন ছাড়া কি কেউ কাউকে বলে? মাথা ঘুরে গেল ওনার। এদিকে জাভেদ আলীও ততক্ষণে বেরিয়ে পড়েছেন অর্ণবের সঙ্গে। তিনি দ্বিধায় পড়ে গেলেন। ঘরে পায়চারি করতে করতে নিজেকে স্বান্তনা দিলেন, 'আজকাল বয়সে বড় মেয়ের সঙ্গে অনেক ছেলের বিয়ে হয়। জাহ্নবীর বাবা গিয়েছে যখন, নিশ্চয়ই একটা কিছু করেই আসবেন।'
স্বস্তির সঙ্গে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করলেন তিনি।
জাহ্নবী নিজের ঘরে চলে এলো। এই ঘরে এখনো অর্ণবের ঘ্রাণ রয়ে গেছে। সহ্য হচ্ছে না ওর। বিছানার চাদর ও বালিশের কভার বালতিতে ভিজিয়ে রাখল সে। অর্ণব আবারও আপু ডেকেছে! রাগে মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে জাহ্নবীর। ভায়োলেট এখনো বাইরে থেকে ফিরছে না কেন? একমাত্র সে-ই জাহ্নবীর মন ভাল করে দিতে পারে।
টেবিলের ওপর অর্ণবের উপহার দেয়া বইটা দেখে ইচ্ছে করল ওটাও বালতিতে ডিটারজেন্ট পাউডারের সঙ্গে ভিজিয়ে রাখতে। ওই ছেলের কিচ্ছু দরকার নেই তার, কিচ্ছু না।
.
.
.
চলবে........................................................................