কালের আর্বতনে দুঃসহ জীবনের গতিবেগ আশ্চর্য ধারায় পরিবর্তন হলো। পশ্চিম আকাশে ডুবে যাওয়া তপ্তহীন সুর্যটা পুনরায় পূর্বাকাশে তেজী রূপে দেখা দিলো। নবজাগরণের দামামা শব্দ বজ্র-কন্ঠের মতো উচ্চারিত হতে লাগলো চারধার জুড়ে। ক্ষণেক্ষণে যন্ত্রণা সহ্য করতে থাকা পূর্বের জীবনে হঠাৎ এক টুকরো আশার আলো জ্বলে উঠলো মহা সংগ্রাম শেষে। দেহের সব শক্তিটুকু খরচ করে শক্ত মনোবলের আদর্শপূর্ণে সে যখন জেল থেকে অব্যহতি পাওয়ার এক গুন্ঞ্জন শুনলো তখন মনেপ্রাণে আরো কঠোর হয়ে উঠলো সে। এবার আর হার নয়! মিথ্যার বেড়াজাল ছিড়ে অবশ্যই হবে সত্যের জয়! দূর্নীতিবাজ মিথ্যাবাদীকে পরাস্ত করার দায়িত্ব এবার ঐশ্বরিক শক্তির উপর ন্যস্ত। দুনিয়ার মানুষ যখন বিবেকের আদালতে পরাজিত, ঐশ্বরিক জগতের সেই সৃষ্টিকর্তাই তখন বিচার করতে সর্মথ্য। প্রকৃতির অভিশংসন এবার দহনের মতো জ্বালিয়ে দিবে মিথ্যার কিংকরকে! সাগ্রত সেদিন কফি ফেলে আধা খাওয়া নাস্তা ছেড়ে সত্য সন্ধানের উদ্দেশ্যে দৌড় লাগিয়েছিলো ঠিকই, কিন্তু মৃত্যুর খুব কাছাকাছি নাকি পূর্বের যাত্রা হচ্ছিলো জেলে। এরপরের ঘটনা আজও ধোয়াশা, আজও অজানা, আজও সকলের নিকট গোপন। তীব্র উত্তেজনায় আবারও ফেটে পরে পুরো ঢাকা শহর। সংবাদ মাধ্যমে আবারও মুখ্য হয়ে উঠে ওয়াসিফ পূর্বের খবর। বড় বড় নেতারা নিন্দাবাক্য বাদ দিয়ে টিভির সামনে তাদের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় বসলো। কনকনে শীতের মৌসুমে পূর্বের অব্যহতির খবর যেন উত্তাপের মতো মুখরিত হচ্ছিলো। যারা এতোদিন চুপ ছিলো এবং পূর্বের উপর জুলুমের তামাশা দেখেছিলো, তারা হুট করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠলো সত্যকে জানার জন্য। শুরু হলো মানববন্ধন, সড়ক অবরোধ এবং হৈহৈ মাতামাতিতে লম্বা র্যালির আন্দোলন। গুটিয়ে থাকা জনগণ এক সুপ্ত কড়াঘাতে দাবিয়ে রাখা সত্য উদঘাটনের জন্য প্রচণ্ড উন্মুখ হয়ে উঠলো। আদালতে তখন পূর্বের কেস নিয়ে দফায় দফায় শুনানি হচ্ছিলো ঠিকই, কিন্তু শেষমেশ কাঙ্ক্ষিত দিন হিসেবে বিচার শুনানোর দিনটিও চলে এলো দ্রুত। পূর্বকে তিন সপ্তাহ ধরে অত্যাচার করেনা, খাবার নিয়ে নিরাসক্ত দেখায় না, কোনোরূপ অন্যায়াচরণ করেনা জেলখানা। কেনো করেনা সেই বিষয়টা এখনো ধোয়ার আড়ালে আবৃত। কি করেছিলো পূর্ব, যার জন্য জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার শুনানি অকস্মাৎ এসে পরলো? বিচারের দিন যখন পূর্বকে আদালতে পেশ করা হলো তখন সাগ্রত প্রচণ্ড মাত্রায় অবাক হয়েছিলো। পূর্বের অবস্থা এতোটাই রোগা, জীর্ণ ও অসুস্থ হয়ে পরেছে যে, আগের রূপের সাথে এই রূপটা কোনোভাবেই মিলানো যাচ্ছিলো না তখন। কিন্তু চোখের দৃষ্টি এবং মনের তাগদ যেনো আগের মতোই বলিয়ান, অটল, অবিকল ছিলো ওর। সাগ্রত তার দীর্ঘ সাধনায় প্রচুর চেষ্টায় পূর্বকে বের করে আনার নানাপন্থা অবলম্বন করেছিলো ঠিকই, কিন্তু শেষ মূহুর্তে এমন কি ঘটেছিলো জেলের ভেতরে যার জন্য আজ পূর্ব অব্যহতি পাওয়ার ঘোষণা পাচ্ছে সেটা সম্পূর্ণ অজানা ওর। পূর্ব যেনো বিরাট এক সত্য বুকের ভেতরে পুষে রেখেছে। সাগ্রত অনেক জিজ্ঞাসা করেও পূর্বের কাছ থেকে সেই সত্য জানতে সর্মথ্য হয়নি। পূর্ব চুপ ছিলো কিন্তু নিজের গম্ভীর ব্যক্তিত্বের মাঝে কিছু একটা অগোচরে লুকিয়ে বেড়াচ্ছিলো। পূর্বের ভাগ্যের চাকা হুট করে অনুকূল্য হয়ে উঠবে ভাবা যায়নি। এ খবর শুনে ওয়াসিফ ভিলায় গর্ভবতী পূর্ণতা একপলক পূর্বকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠলেও নিজের দায়বদ্ধতার দিকে দৃষ্টি রেখে সেও সেই ইচ্ছেটাকে দমিয়ে রাখলো। পূর্ব জেল থেকে শেষ যেই চিঠিটা সাগ্রতের হাত দিয়ে পাঠিয়েছিলো তাতে সে স্পষ্ট করে বলেছিলো যেকোনো অবস্থায় বাড়ি থেকে এক পা যেনো না বেরুয়। যত দূর্ভোগ, যত দূর্যোগ, যত দূশ্চিন্তাই হোক না কেনো বাড়ির সীমানা পেরিয়ে বাইরে যাওয়ার প্রতি পূর্ব তার রক্তমাখা লেখনীতে জোরালো হুঙ্কার দিয়েছিলো। টিভির পর্দায় যখন পূর্বকে নিয়ে নানা সমালোচনা হতো তখন অদ্ভুত ভাবে কেউ-না-কেউ সেই জবাবের পাল্টা একটা যোগ্য উত্তর দিয়ে মুখ বন্ধ করে দিতো। পূর্বকে ঘিরে যতো মিথ্যা মামলার ফ্যাসাদ পাকানো হয়েছিলো তার মধ্যে একটা প্রমাণসাধ্য হয় যে, পূর্বের অধীনে কর্মরত ব্যক্তি হিসেবে ব্যক্তিগত গাড়ির যেই ড্রাইভার ছিলো, অর্থাৎ মোমিনই ওই কোকেনের প্যাকেটগুলো গাড়ির গদিতে লুকিয়েছিলো। এটা প্রমাণ করতে সাগ্রত নিজের হাতেই সবটা হ্যান্ডেল করে প্রমাণ এনেছে। মোমিন এখন পলাতক হলেও মোমিন ওয়াসিফ ভিলার যে কক্ষে থাকতো সেই রুম তল্লাশি করে দেয়ালঘড়ির পেছনে কোকেনের প্যাকেট পাওয়া গিয়েছে। সেই সাথে জুসের বোতলে ফেনসিডিল এবং টিস্যুর বক্সে রিভলবার পেয়েছে পুলিশ।। নাটকীয় ঘটনায় সবকিছু আগে থেকেই সাজানো-গোছানো পরিকল্পনা লাগছিলো সাগ্রতের। পূর্বকে গ্রেফতার করার পর অন্তত দুইবার পুরো বাড়ি তামা তামা করে তল্লাশ করেছে পুলিশ। বাদ যায়নি তখন মোমিনের কক্ষও। কিন্তু সেই সময় মোমিনের কক্ষ থেকে সামান্য সুতাও উদ্ধার করতে পারেনি পুলিশ। তাহলে আজ কিভাবে পুলিশ ওয়াসিফ ভিলায় আসতে-না-আসতেই মোমিনের কক্ষে ঢুকে ওগুলো একমনে পেয়ে গেলো? গভীর ষড়যন্ত্রের গন্ধ যখন চারপাশ আচ্ছন্ন করে রেখেছিলো তখন সেটা কেবল সাগ্রত টের পেয়েছিলো। ওয়াসিফ পূর্বের আকস্মিক নিরবতা, কিছু জিজ্ঞেস করলে চুপ করে থাকা, মোমিনের দোষী সাব্যস্ত ঘটনা, আদালতে হঠাৎ পূর্বের নির্দোষ প্রমাণ হওয়া, জেল থেকে মুক্তির ঘোষণা আসা এ সবই যেনো বানোয়াট খেলার একটা অংশ ঠেকছিলো। রাজনীতি নামক ধূর্ত খেলায় পূর্বও শেষ মূহুর্তে কোনো জঘন্য অংশে জড়িয়ে পরলো কিনা এ নিয়েও নানা শঙ্কায় পরলো সাগ্রত। কিন্তু পূর্ব ইনিয়ে-বিনিয়ে সাগ্রতকে এটা বুঝিয়ে দিলো জেলের ভেতর যা হয়েছে তা সকলের ভালোর জন্য হয়েছে এবং সেই ভালোর রেশেই পূর্ব বহু কষ্ট শেষে জেল থেকে মুক্তি পাচ্ছে। সে কোনো অন্যায় কাজ কষ্মিনকালে করেনি..না সে আজ কোনো অন্যান্য কাজ করেছে। সাগ্রতের জন্য এমন কথা বিশ্বাস করা কঠিন হলেও রাজনীতির জগতে সবই সম্ভব এটাও সে কাটায়-কাটায় মানতো। কিন্তু ' জেলের ভেতর যা হয়েছে ' দ্বারা পূর্ব কোন্ ঘটনাকে ইঙ্গিত দিলো সেটা বুঝতে পারেনি সাগ্রত। আদালতে আসামী হিসেবে পূর্বের পক্ষ থেকে যে উকিল দাড়িয়েছিলো তাকেও যেনো অদ্ভুত কারনে অন্যমনষ্ক দেখাচ্ছিলো। পূর্বের মুখ থেকে শোনা তিনজন ব্যক্তির মধ্যে যার নামটা পূর্ব জোর দিয়ে বলেছিলো সেই ইমতিয়াজ উদ্দিন যেনো প্রফুল্ল চেহারায় আদালতে বিচারের শুনানি শুনছিলো। সাগ্রত একবার পূর্বের গম্ভীর চেহারা দেখে ঘটনা বুঝার চেষ্টা করে, আরেকবার চেষ্টা চালায় ইমতিয়াজের উৎফুল্ল মেজাজের চেহারা দেখে। কিন্তু ফলাফল প্রতিবারের মতোই শূন্য হয়ে যায়।
সাগ্রত জেলের ভেতর যেই দারোগাকে টাকা খাইয়ে অভ্যন্তরীণ ঘটনা শুনতো সেই দারোগাও অন্তিম মূহুর্তে কোনো জবাব চুকাতে পারলো না। শুধু এটুকুই ছিলো দারোগার শেষ কথা যে, একদিন ইমতিয়াজ উদ্দিন পূর্বকে দেখতে জেলে এসেছিলো এবং সেদিন ইমতিয়াজ উদ্দিন কি কথা বলে সেটা জানা যায়নি তবে পূর্ব প্রচুর আকুতির সুরে মিনতি করছিলো কোনো কিছু নিয়ে। একপর্যায়ে নাকি হাতজোর করেছে ইমতিয়াজের সামনে এবং ইমতিয়াজ উদ্দিন পৈশাচিক হাসিতে হো হো করে হাসছিলো এ দৃশ্য দেখে। এরপর থেকেই পূর্ব চুপ হয়ে যায়। নিজ থেকেই খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেয় এবং পানির ছিটেফোঁটাও সে গলা দিয়ে নামানো কমিয়ে ফেলে। ইমতিয়াজ উদ্দিনের সেই সাক্ষাৎটাই ছিলো শেষ সাক্ষাৎ, এরপর থেকে সে আর জেলে আসেনি পূর্বকে দেখতে। এখানেও বিশাল রহস্য মনে গুঁজে দিয়ে গেছে। কিন্তু দারোগা আর কোনো গোপন তথ্য দিতে পারেনি সাগ্রতকে।
.
উত্তপ্ত মরুভূমিতে একফোঁটা পানি পেলে মন যেমন উচ্ছ্বাসিত হয়ে উঠে, তেমনি ওয়াসিফ-ভিলায় পূর্বের আগমন শুনে রুক্ষ, ভারাক্রান্ত শীর্ণ পরিবেশ পালটে গিয়ে অনাবিল খুশিতে উল্লাসিত হয়ে যায়। আয়েশা এ খবর যখন জানতে পারেন নিজের কান্না আটকাতে পারেনি তখন। খুশিতে কেদেঁ দিতেই ফ্লোরে বসে পড়েন তিনি। খোদার দরবারে প্রতিদিন মাথা ঠেকিয়ে আর্জি যা যা জানিয়েছিল তন্মধ্যে বড় ইচ্ছাটি কবুল হয়ে গেছে আজ। মাতৃমনের সকল ব্যথা ওই একটি খবরে উপশম হয়ে উঠেছে তৎক্ষণাৎ। পূর্ণতাকে সুসংবাদ জানাতে গিয়ে রুমের দরজায় কড়া নাড়লে পূর্ণতা অশ্রুধারা মুছে শ্বাশুড়ির কাছে আসে। আয়েশা অশ্রু নয়নে অপলকে তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ গাল ভিজিয়ে ওকে জানিয়ে দেয় পূর্বের ছাড়া পাওয়ার কথা। কোনো এক কারিস্মায় উনার ছেলেকে অতি শীঘ্রই ওয়াসিফ ভিলায় ফিরিয়ে দিচ্ছে মহান শক্তিশালী খোদা। কথাটুকু শেষ করতেই আয়েশা তৎক্ষণাৎ শব্দ করে কেদেঁ উঠে দুহাতে পূর্ণতাকে জড়িয়ে ধরে। হাউমাউ করে তীব্র কান্নায় ভেঙ্গে পরলে পূর্ণতার ঢোলা পোশাকের ম্যাক্সি নামধারী বস্তুটার কাধে টপটপ করে আয়েশার অশ্রুপাত হতে থাকে। পূর্ণতা স্থির হয়ে দাড়িয়েছিলো শুধু। আয়েশাকে পাল্টা করে দুহাতে জড়িয়ে ধরার মানসিকতায় সে ছিলো না। সবকিছু ভেঙ্গেচুড়ে বিধ্বস্ত কান্নায় বুক নিংড়ে আসছিলো পূর্ণতার। অবশেষে বহু প্রতীক্ষার সেই সুবর্ণ সংবাদটি এসে পরেছে কর্ণকুহরে। চোখ বন্ধ করে ঠোঁট কামড়ে আকস্মিক কান্নার জন্য ধীরে-ধীরে কাঁপছিলো সে। আচমকা গলদেশ পেরিয়ে ফোপানো সুর নিস্তব্ধ রুমের ভেতর প্রকাশ হতেই ধীরেসুস্থে আয়েশাকে জড়িয়ে ধরার হাতদুটো সজোরে জাপটে ধরে। আয়েশার কাধে মুখ লুকিয়ে পূর্ণতা কাঁদতে থাকে। ক্ষণিকের মধ্যে দুজনের মধ্যে আনন্দ-অশ্রুর ধারাবর্ষণ ঘটলে আয়েশা নিজেকে অনেকক্ষন পর সামলে নেয়। নিজের ভেজা চোখ শুকনো হাতের তেলোয় মুছে নিজের সফেদ শাড়ির আচঁল টেনে পূর্ণতার সিক্ত গাল মুছে দেয়। পূর্ণতা তখনো চোখ বন্ধ করে হুহু করে কাঁদছিলো। একটা হাত পেটের উপর রেখে অন্যহাতটা শ্বশুরির হাতের মুঠোয় ছিলো। মুঠোয় ধরে রাখা হাতটা আয়েশা নিজের ঠোঁটের কাছে টেনে স্নেহভরা চুমু খেলো। পূর্ণতার চোখদুটো ভালো করে মুছে দিতেই আয়েশা নরম কন্ঠে বললো,
- এবার আসলে আর যেতে দিবো না মা। আর দূরে যেতে দিবো না। নিজের গহনা বেচেও যদি বেকার ছেলেকে ঘরে পালা লাগে আমি তাও করবো। কিন্তু ওই রাজনীতিতে আমি যেতে দিবো না। ওই নরকের কাছে যাওয়ার মানে নেই। এই যুগে সুস্থ রাজনীতি হয়না। টাকার জোরে কিছু অসাধু মানুষ সবাইকে দূর্নীতি করতে বাধ্য করে। মাগো, আর কেঁদো না। তুমি আবার কাশতে কাশতে বমি করে দিবে।
আয়েশার শান্তসুর শুনে পূর্ণতা বেশ সময় পরে ঠান্ডা হয়। বাথরুমে গিয়ে বেসিনের সামনে যেয়ে চোখেমুখে পানি ছিটা মারে। গলার পাতলা ওড়না দিয়ে মুখ মুছতেই দখিন দিকের জানালায় নজর পরে। সন্ধ্যা শেষে রাতের আকাশে শুভ্র-বৃত্তের চকচকে চাঁদ উঠেছে। সেই চাঁদের জোৎস্না আলোতে ঝিমিয়ে থাকা পরিবেশ স্নিগ্ধ লাগছে। পায়ে-পায়ে হেঁটে জানালার কাছে যেতেই শীতের হিমেল হাওয়া এসে গা কাঁপিয়ে দেয়। দুহাতের তালু দিয়ে দুইবাহুতে অনবরত উষ্ণ ভাব আনয়ন করতেই পূর্বের কথা আবার মনে পরে। মাঝ থেকে কতগুলো মাস পেরিয়ে গেলো, ভাবা যায়না। যার চেহারা একবার না দেখলে অস্থির হয়ে উঠতো, সেই রাশভারী মুখটা কতদিন দেখতে পায়না। সেই মানুষটার বুকটার মধ্যে কতদিন মাথা রাখার সুযোগ মেলেনা, হাত বারিয়ে স্পর্শ করার সৌভাগ্য হয়না এখন আর, রুমের মধ্যে সেই মানুষটার পরিচিত গন্ধও যেনো বহুদিন ধরে নাকে আসেনা। এখনো চোখ বন্ধ করলে জেলে সেই দৃশ্যপট স্মরণে ভেসে বেড়ায়। মনের অগোচরে তার পুরোনো দিনগুলো এসে যায়। পূর্বের হাসি-কান্না-খুশির মূহুর্তগুলো মন আবারও খুব করে পেতে চায়। এবার এই মানুষটা আসলে আর তাকে কোত্থাও যেতে দেয়া হবেনা। তার জীবনের সকল যন্ত্রণা মুছে দিয়ে কিছু সুখকর স্মৃতি দিবে পূর্ণতা। আর তাকে দূরে যেতে দিবেনা। জানালার ডানপাশে শরীর হেলান দিয়ে পেটের উপর হাত রাখে পূর্ণতা। রাতের ওই বৃত্তাকার চাঁদের দিকে দৃষ্টি রেখে মনেমনে বলতে থাকে কিছু কথা। মনের গোচরে তুমি আছো, চোখের গোচরে আজ নেই। চোখ বন্ধ করলে তোমাকে দেখতে পাই আমি, চোখ খুললে তুমি পাশে নেই।
.
আয়মান তার ব্যস্তজীবনে বিভোর হয়ে পরলে সাবিহার প্রতি দায়িত্ব পালনে যথেষ্ট অনিয়ম শুরু করে। বিদেশ যাত্রার জন্য সবকিছু ঠিকঠাক করে সে দেশ ত্যাগ করতে মরিয়া ছিলো। এদেশে যতদিন সে থাকবে ততদিন কারনে-অকারনে শ্রেয়ার স্মৃতিগুলো একটু হলেও মনের মধ্যে আনাগোনা হবে। আয়মান সেই নূন্যতম স্মৃতিও এখন পুষতে ইচ্ছুক নয়। অনেকটা স্বার্থপরের মতোই সে নিজেকে নিয়ে চিন্তিত হতে চায়। শ্রেয়ার জন্য মনের মধ্যে বদ্ধ অবস্থায় যে ভালোবাসাটা এতোদিন যত্ন করে রেখেছিলো তা যেনো অকস্মাৎ অযত্ন করে ভুলার জন্য শক্ত হলো। এর জন্য সাবিহার সাথেও মুখ গোমড়া করে কথা বলে আয়মান। নিজের প্রয়োজনীয় কথাবার্তা এবং টুকিটাকি কাজও সে খুব সাবধানে কারোর সাহায্য ছাড়া করতে পছন্দ করে। সবাই যেখানে ভেবেছিলো সাবিহার সান্নিধ্য পেয়ে আয়মান হয়তো বদলে যাবে, সেটা অবশ্য আর ফলস্বরূপ হলো না। চোখের সামনে বোন সমতুল্য পূর্ণতার যখন এতো দূর্দশা হচ্ছিলো তখন নিজেকে সবচেয়ে বড় দূর্ভাগা হিসেবে আখ্যায়িত করে আয়মান প্রচণ্ড কষ্ট পেয়েছিলো। নিজেকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে পূর্ণতার সামনে যাওয়াই কমিয়ে দিয়েছিলো সে। পূর্ণতা নিজের গর্ভাবস্থা এবং পূর্বের আজ্ঞা পালনের জন্য বাড়ির বাইরে যেতে পারতো না। আয়মানের সমস্যা নিয়ে সমাধান করার উপায়ও খুজেঁ পেতো না। কল করলে আয়মান কখনো রিসিভ করে কথা বলতো, কখনো সাইলেন্ট বা এয়ারপ্লেন মুড অন করে রেখে দিতো। মানসিক অসুস্থতায় আয়মান দিনদিন ভেতর থেকে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছিলো। এতোগুলো মানুষ থাকার পরও মন খুলে কথা বলার কেউ তেমন ছিলো না। অফিস শেষে খাবার খেয়ে সবসময়ের মতো সাবিহাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমের চেষ্টা করতো, কিন্তু ঘুম আর হাতছানি দিয়ে চোখের পাতায় আসতো না। এখনো সাবিহার সাথে চাহিদা পূরণের সম্পর্ক হয়ে উঠেনি ওর। সাবিহাও জোর করেনি আয়মানের ইচ্ছের উপর।
বারটা ছিলো শুক্রবার। সময় দুইটা পেরিয়ে দুপুর তখন। আগামীকাল পূর্ব রেহাই পেয়ে বাড়ি ফিরবে এবং সাগ্রত তার কর্ম শেষ করে সবাইকে বিদায় জানিয়ে ঘরমুখো হয়েছে। বিদায় বেলায় সবচেয়ে বেশি কেদেঁছে পূর্ণতা। পূর্বের খবরাখবর আনা, খোঁজখবর রাখা এবং শেষমেশ নির্দোষ প্রমাণের জন্য সাগ্রত যে অবদানটা রেখেছে এই অবদানের জন্য পূর্ণতা ওর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। যখন একটার-পর-একটা বিপদ এসে জাঁকিয়ে ধরে তখন অদ্ভুত ভাবেই সাগ্রত এসে সেই বিপদের হাল ধরে। এই দুনিয়ায় স্বার্থপর মানুষের অভাব নেই, কিন্তু নিঃস্বার্থ মানুষের জন্য বোধহয় পৃথিবী আজও টিকে আছে। সাগ্রত যখন কান্না করা পূর্ণতার মাথায় হাত রেখেছিলো, চোখ ঝাপসা এসেছিলো ওর। এতিম হয়ে দুনিয়ায় জীবিত থাকা যতটা দুঃখের ছিলো, আজ কর্মজীবনের জন্য পূর্ণতার মতো বোন পেয়ে সে নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবছিলো। পূর্ণতার দিকে তাকালে মনের মধ্যে যে মোচড় অনুভব হতো তা একটু হলেও শান্তিতে পরিপূর্ণ হলো। স্নেহভরা দৃষ্টিতে সাগ্রত পূর্ণতার হাতদুটো নিজের মুঠোয় চেপে শান্ত কন্ঠে বললো,
- আমার এই দুনিয়ায় কেউ নেই পূর্ণতা। আমার স্ত্রী, আমার সন্তান ছাড়া এই পৃথিবীর বুকে আমার কোনো আত্মীয় নেই। আমার প্রচুর খারাপ লাগে। প্রচুর কষ্ট হয়। আমার ছোট্ট মেয়েটা যখন নানী,দাদী,ফুপি,খালা খুজেঁ তখন কাউকে কাছে পায়না। আমি কখনো বলতেও পারিনি আমার বা স্নেহার আপন বলতে কেউ নেই। কিন্তু আজ বলতে চাই, যদি জীবনে কোনো পূন্য করে থাকি তাহলে তোমাকেই আমার বোন হিসেবে পেয়েছি। আমি আর কাউকেই চাইনা। সাওদা এবার জানুক তার একটা ফুপি আছে। একটা আদর্শবান ফুপা আছে। কিছুদিন পর একটা ফুপাতো ভাই বা বোন দুনিয়ায় আসছে। আমি তোমার পরিচয়ই সাওদাকে দিবো। তোমার এই ওয়াসিফ ভিলায় আমার জীবনের টুকরোটাকে খেলতে আনবো। কিন্তু তোমাকে আমি হারাতে পারবো না। আমার কর্মজীবনে প্রচুর ব্যস্ত থাকি। আমার স্ত্রী একা একা তার পুরোটা জীবন আমার জন্য আমার সেবায় লাগিয়েছে, কোনো আনন্দ সমাগমে যাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি। শুধুমাত্র পূর্বের জন্য আমি আজ বোন পেয়েছি। ওই মানুষটা আজ জেল থেকে মুক্তি পেয়ে আমার সমস্ত ভার নামিয়ে দিয়েছে। আমি শান্তিতে নিজের বাসায় ফিরতে পারবো, শান্তির ঘুম দিবো, আমার মেয়েটাকে সুখবর দিবো। আমার কিছু চাওয়ার নেই পূর্ণতা। আমি কোনো টাকা নিতে চাইনা। প্লিজ আমাকে টাকার চেক দিও না। এটা তুমি রাখো। একটা এতিমের জন্য আত্মীয় পাওয়ার সুখ টাকার কাছে বেশি হতে পারেনা।। আজ আমি সৌভাগ্যবান।
কথাটুকু শেষ করতেই জ্যাকেটের হাতায় চোখ ঢেকে তাড়াতাড়ি পকেট থেকে রুমাল বের করলো সাগ্রত। পূর্ণতার দিকে পিঠ দিয়ে দ্রুত সে চোখ শুকনো করে মুছে ফেললো। গ্রাউন্ড ফ্লোরে উপস্থিত আয়েশাও অশ্রু বিজরিত চাহনিতে সাগ্রতের কথাগুলো শুনেছিলো। তিনি পরমাহ্লাদে সাগ্রতের কাছে গিয়ে কাধে হাত রেখে বললেন,
- বাবা, যদি পূর্ণতাকে বোন ভাবো তাহলে আমাকেও আপন ভাবতে পারো। এই দুনিয়ায় আর কদিন বাঁচি বলো? জীবনে এটুকু সুখও যদি কাছে টেনে না আনি, তাহলে এ জীবনে কি করলাম? তুমি বউমা আর সাওদাকে নিয়ে চলে এসো। যতদিন ইচ্ছা এ বাড়িকে আপন ভেবে একটু জীবন দিয়ে দাও। কেউ তো থাকেনা এখানে। দুই বুড়ো-বুড়ি আর পূর্ণতাই শুধু এ বাড়ির মালিক।
সাগ্রত এ কথার প্রেক্ষিতে খুশি হয়ে সায় দেয় সে নিশ্চয়ই সাওদা ও স্নেহাকে নিয়ে ওয়াসিফ ভিলায় আসবে। পরবর্তী কোনো কেস নিয়ে অন্য জেলায় দৌড়াতে হলে স্নেহা ও মেয়েকে এ বাড়িতে সবার মাঝে রেখে যাবে। সাগ্রত সবাইকে হাসিমুখে বিদায় জানিয়ে দরজার কাছে চলে আসলে হঠাৎ পা থমকে কিছু মনে পরার ভঙ্গিতে পিছু ফিরে তাকায়। পূর্ণতার দিকে একচিলতে হাসি ফুটিয়ে সাগ্রত বলে উঠে,
- একটা ফোন করলেই এই তাশরীফ সাগ্রত বোনের জন্য হাজির! আজকের মতো আসি। আবার দেখা হবে।
.
পরেরদিন সকাল দশটা। আজ পূর্বের ফেরার কথা। পুরোটা রাত ছটফট করে নির্ঘুমে কাটিয়ে ভোরের দিকে উঠে গেছে পূর্ণতা। মনের ভেতর অদ্ভুত অস্থিরতা কাজ করছে। সেই সাথে তীব্র উত্তেজনায় রুমের ভেতর পায়চারি করে হাঁটছে। আয়েশা চাকর ডেকে হরেক রকমের রান্নার পসরা বসিয়েছে। পুরো ওয়াসিফ ভিলার কোণায়-কোণায় ধূলো ময়লা পরিষ্কার করে চকচকে করার প্রক্রিয়া চলছে। পূর্ণতা নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেনা। ইচ্ছে করছে এক্ষুনি পূর্বের কাছে ছুটে যেতে। তার বলশালী দুই বাহুর মাঝে আবদ্ধ হওয়ার জন্য মন আকুলিবিকুল করছে। সেই সাদা পান্ঞ্জাবী, সেই পরিচিত মুখ, সেই হৃদ-কাঁপানো কন্ঠসুরের জন্য মনের উঠোনে ব্যকুল অবস্থা চলছে। মাস্কের আড়ালে থাকা সেই ঘায়েল করা দুই চোখ আজ কিরূপ লাগবে? কঠোর চাহনির অটল দৃষ্টির চোখদুটো বুকের ভেতর ধড়ফড়-ধড়ফড় দামামা বাজিয়ে তোলে। তার স্পর্শ সমস্ত শরীর কাঁপিয়ে শিহরণ জাগায়। তার গায়ের পরিচিত সুভাষ হৃদ-গহ্বরের সুগভীর জায়গায় গিয়ে কড়াঘাত করে। পূর্ণতা আনমনে যখন পূর্বকে নিয়ে চিন্তাচেতনায় মগ্ন, তখন ফোনের রিংটোন বাজিয়ে একটা মেসেজ বার্তা আসলো। পূর্ণতা শব্দটা শুনে চিন্তার জগত থেকে সৎবিৎ ফিরে পেলে বিছানা থেকে ফোন তুলে স্ক্রিনে চোখ রাখে। মেসেজের লাইনগুলো স্বাভাবিক হয়ে পড়তে থাকলে হঠাৎ ওর হাত অনবরত কাঁপতে শুরু করে। স্থিরদৃষ্টিতে ফোনের উপর তাকিয়ে থাকতেই হাত থেকে ফোন খসে পরে। বিকট আওয়াজ করে ফ্লোরের সাথে বারি খেয়ে ব্যাকপার্ট খুলে যায় ফোনের।
.
.
.
চলবে.......................................