হাওয়াই মিঠাই - পর্ব ০৪ - মৌরি মরিয়ম - ধারাবাহিক গল্প

পড়ুন মৌরি মরিয়ম'এর লেখা একটি অসাধারণ ধারাবাহিক গল্প হাওয়াই মিঠাই'র চতুর্থ পর্ব
হাওয়াই মিঠাই
হাওয়াই মিঠাই

মীরা সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে ফোন চেক করলাে। না কোনাে কল আসেনি মীরার। স্কুল ডে শিফটে। স্কুলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত ফোনটা হাতে নিয়েই বসে রইলাে কিন্তু কল এলাে না। মীরা স্কুলে চলে গেল। বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে আবার ফোন চেক করলাে, কোনাে খবর নেই। পড়তে বসেও ফোনটা কাছেই রাখলাে মীরা। নিজ থেকে কল করার সাহস পাচ্ছে না। রাফি বলেছে মাঝেমাঝে কল করবে, সেই মাঝেমাঝে টা যে কতদিন পর পর তা তাে ও জানেনা। হয়তাে রাফি কয়েকমাস পর পর কল করবে!
কলটা এল সন্ধ্যার পর। রিং বাজতেই মীরা আচমকা লাফিয়ে উঠলাে। ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে সেই নম্বরটা দেখেই তার হাত পা কাঁপা শুরু হয়ে গেল, অথচ এই কলটার জন্যই সে সারাদিন অপেক্ষা করেছে! মীরা দৌড়ে বারান্দায় গেল। এরপর দরজা বন্ধ করে তাড়াতাড়ি কল রিসিভ করলাে। সে নীচু গলায় হ্যালাে বলতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলাে সেই জাদুমাখা কণ্ঠস্বর,

"হ্যালাে। কেমন আছেন?"

"জি ভাল, আপনি কেমন আছেন?"

"ভাল আছি। আপনার ভয়েস শুনতে মন চাইলাে তাই কল দিলাম।"

এ কথা শুনে লজ্জায় মীরার গাল দুটো লাল টকটকে হয়ে গেলাে। ভাগ্যিস কেউ দেখেনি! মীরা কোনরকমে বলল,

"ও আচ্ছা।"

"কাল তাে সেভাবে আমাদের কোনাে পরিচয় হয়নি শুধুমাত্র নাম বিনিময় ছাড়া।"

"হ্যাঁ।"

"আজ হলে কেমন হয়?"

"কী?"

রাফি হেসে বলল,

"পরিচয়।"

"ভালই হয়।"

"আপনি থাকেন কোথায় মীরা?"

নাখালপাড়া বলতে গিয়েও ত্রিশার কথা মনে পড়ায় কথা ঘুরিয়ে বলল,

"কলাবাগান থাকি। আপনি কোথায় থাকেন?"

"আমি ব্যাংক টাউন থাকি।"

"এটা কোথায়?"

"সাভারের একটু আগে। সাভার আসেননি কখনাে?"

"হ্যাঁ গ্রামে যাওয়ার সময় তাে ওদিক দিয়েই যাই আমরা। বাস থেকে সাভার দেখেছি।"

"গ্রাম কোথায়?"

"যশাের। আপনাদের?"

"ওহ। আমাদের গ্রামের বাড়ি ধামরাই।"

"সেটা কোথায়?"

রাফি হেসে বলল,

"সাভার থেকে ফেরিঘাট যাওয়ার পথেই পড়ে।"

রাফির হাসি শুনে মীরার বেহুঁশ হবার অবস্থা হলাে। এই ছেলেটার কণ্ঠই শুধু সুন্দর না, হাসিও সুন্দর! মীরা জিজ্ঞেস করলাে,

"হাসছেন যে?"

"এমনি। আচ্ছা আপনি কাল বলছিলেন যে ক্লাস টেনে পড়েন?"

"হ্যাঁ তাে!"

"ভয়েস শুনে আরেকটু বড় মনে হয়।"

"তাই? আপনি কিসে পড়েন?"

"আমি সিক্সথ সেমিস্টারে আছি, কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং।"

"আমি যে সেমিস্টার বুঝিনা!"

"আচ্ছা বাদ দিন। আপনি তাে বুঝতে চাচ্ছেন আমি আপনার থেকে কতটা বড়? সহজে বুঝাই। আপনি ক্লাস টেনে পড়েন মানে ২০১০ সালে এসএসসি দেবেন?"

"হুম।"

"আমি এসএসসি দিয়েছি ২০০৪ সালে। তার মানে আমি আপনার ৬ বছরের বড়।"

"তাহলে তাে অনেক বড়। আমি আপনাকে এখন কি ডাকবাে? ভাইয়া ডাকবাে?"

"ভাইয়া কেন ডাকবেন? আমি কি আপনার ভাইয়া হই? কোনাে কাজিন?"

"না।"

"আপনি আমাকে নাম ধরে ডাকবেন।"

"বড়দের আবার নাম ধরে ডাকে কিভাবে?"

"আমিই তাে ডাকতে বললাম, অসুবিধা কি?"

"আচ্ছা যখনকার টা তখন দেখা যাবে। আর আপনি যখন বড় তাহলে আমাকে তুমি করে বলুন।"

"না। আমি নরমালি কাউকে তুমি করে ডাকিনা। সে ছােটই হােক কি বড়! যদি কখনাে তুমি ডাকার প্রয়ােজন হয় তবে অবশ্যই ডাকবাে।"

"আচ্ছা।"

"কি করছিলেন?"

"তেমন কিছু না, এফএম শুনছিলাম। আপনি?"

"আমি বাগানে বসে আছি। আমার দুটো বাগান। একটা ছাদে, আরেকটা বাসার সামনে। এখন ছাদের টা তে আছি। টমেটোর গাছ লাগিয়েছিলাম, তাতে টমেটো ধরেছে। দারুন লাগছে দেখতে।"

"বাগান করা আপনার শখ?"

"বলা যায়। গাছ আমার খুব পছন্দ।"

"কী কী গাছ আছে আপনার?"

"সবজি গাছ বেশি। টমেটো, বেগুন, করল্লা, লাউশাক, পুঁইশাক, সিম, মরিচ, লেবু। এসব শেষ হলে আবার অন্য সবজি করবাে, সিজন অনুযায়ী সবজি করি। তবে লেবু, মরিচ সবসময় হয়। ফলের গাছ আছে কিছু। আম, বড়ই, পেয়ারা, করমচা। এবার আবার নতুন কিছু ফলের গাছ নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করতে হবে।"

"বাহ! আপনার বাগানে ফুলগাছ নেই?"

"আছে। তবে সবজি আর ফলগাছে আমার বেশি আসক্তি।"

"ও।"

"গেটের দুইপাশে বকুল গাছ। যখন ফুল ধরে, নিচটা পুরাে সাদা হয়ে থাকে।"

"ইশ! না জানি কত সুন্দর!"

"খুব, আর আমার বারান্দার পাশে অনেকগুলাে হাসনাহেনার গাছ। ইচ্ছে করেই এদিকে লাগিয়েছিলাম যাতে ফুল ধরলেই সবসময় ঘ্রাণ পাওয়া যায়।"

"হাসনাহেনা ফুল কেমন দেখতে?"

"ওমা কখনাে দেখেননি?"

"না।"

"খুব সুন্দর হয়। সাদা রঙের ছােট ছােট ফুল, এক থােকায় অনেকগুলাে থাকে। এই ফুল ঘ্রাণের জন্য বিখ্যাত। এত সুন্দর ঘ্রাণ অন্যকোনাে ফুলে নেই বলে আমার ধারণা।"

"ওহ।"

"আপনার গাছ ভাল লাগে?"

"লাগে কিন্তু আমাদের বাসায় কোনাে গাছ নেই। কেউ লাগায় না। আমি আবার পাখি ভালবাসি। আমার দুটো পাখি আছে।"

"আচ্ছা? কি পাখি?"

"বাজরিগর। একটার নাম টুন, আরেকটার নাম টুসি, টুনটুসি।"

"বাহ সুন্দর নাম, কে রেখেছে এই নাম?"

"আমি।"

"বেশ। কী করেন সারাদিন?"

"সকালে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বসি। পড়া শেষ হলে একটু টিভি দেখি, তারপর ১১ টায় স্কুলে চলে যাই। স্কুল থেকে ফিরি বিকেল ৫ টায়। একটু টিভি দেখি, আবার পড়তে বসি। রাত ২ টা পর্যন্ত পড়ি আর এফএম শুনি। তারপর ঘুমিয়ে যাই, এইতাে। আপনি কী করেন সারদিন?"

"আমি খুব সকালে উঠি। গাছেদের যত্ন নিয়ে চলে যাই ভার্সিটিতে। ক্লাস শেষে আড্ডা দেই। প্রায় দিনই বাসায় ফিরতে ফিরতে ৮/৯ টা বেজে যায়।"

মীরা ঘড়ির দিকে তাকালাে। সাড়ে ৮ টা বাজে। তার মানে রাফি ভার্সিটি থেকে ফিরেই ওকে কল করেছে! কেন যেন খুব খুশি লাগলাে ওর। তারপর জিজ্ঞেস করলাে,

"তারপর বাসায় ফিরে কী করেন?"

"ছােটবােনের সাথে খেলি।"

"নাম কি ওর?"

"ওর নাম রূপ।"

"বাহ! সুন্দর নাম তাে! রুপ কিসে পড়ে?"

"পড়ে না। দুবছর বয়স।"

"অ্যাঁ?"

অবাক হলাে মীরা। রাফি বলল,

"হ্যাঁ রুপ একটু বেশিই ছােট, আমার প্রায় ২০ বছরের ছােট।"

মীরার মাথায় সাথে সাথে সেট হয়ে গেলাে রাফির বয়স তাহলে ২২! শুধু পড়াশােনায় না রাফি বয়সেও ৬ বছরের বড়! রাফি জিজ্ঞেস করলাে,

"আপনারা কয় ভাইবােন?"

"আমরা চার ভাইবােন। বড় এক ভাই এক বােন, তারপর আমি আর তারপর ছােটবােন। আপুর বিয়ে হয়ে গেছে। আর ভাইয়া ভার্সিটিতে পড়ে। আর ইরা ক্লাস সিক্সে পড়ে।"

"তাহলে তাে ইরা সবার অনেক আদরের!"

"না। বাসার মধ্যে আমি সবচেয়ে বেশি আদরের, আমি অনেক লক্ষী তাে তাই।"

রাফি হেসে দিলাে মীরার কথা শুনে। মীরা কিছু বুঝলাে না। জানতে চাইলাে,

"হাসছেন যে?"

"এমনি।"

"আচ্ছা, আপনারা কি দুই ভাইবােন?"

"না। আমার আর রূপের মাঝে ভাই আছে একটা, রাহি। ও কলেজে পড়ে।"

"ওহ।"

হঠাৎ মীরা শুনতে পেলাে রাফিকে কেউ ডাকছে। রাফি বলল,

"আচ্ছা মীরা আমি এখন রাখি। মা ডাকছে। আবার কল দেব আপনার কন্ঠ নিতে।"

"নিতে?"

"হ্যাঁ কারণ এখন আর আপনার কন্ঠ শুনছি না, নিচ্ছি।"

"বুঝলাম না। কণ্ঠ নেয় কিভাবে?"

"বােঝা লাগবে না, কখনাে প্রয়ােজন হলে আমি বুঝিয়ে দেব।"

রাফি ফোন রাখার পরেও ওর বলা কথাগুলাে কানে বাজতে লাগলাে মীরার। রাতে ঠিকমতাে ঘুমুতেও পারলাে না। বারবার ফোনটা হাতে নিল, কিন্তু কল করার সাহস পেলাে না। সকাল সকাল ত্রিশা এলাে বাসায়। মীরা সব বলতেই ত্রিশা ধমকে উঠলাে,

"এটা কী করছিস তুই? এত ইনফো কেন দিলি?"

মীরা মিনমিন করে বলল,

"আমি তাে তেমন কিছুই বলিনি।"

"যা বলেছিস সেটাও কম না। যদি আমি ধরা খাই ভাইয়া আমাকে মেরে ফেলবে।"

"তােকে বাঁচানাের জন্যই তাে মিথ্যে বলেছি। বলেছি যে আমি কলাবাগান থাকি।"

"কিন্তু তাের নাম? নামটা কেন বলতে গেলি? কথায় কথায় যদি রাফি ভাইয়া আমার ভাইয়াকে নামটা বলে দেয় তখন তাে ভাইয়া সব বুঝেই যাবে।"

মীরা চুপ করে রইলাে। ত্রিশা আবার ধমক দিলাে,

"আর তুই যে এত পিরিতের প্যাঁচাল পারছিস তাের কি মনে হয় রাফি ভাইয়ার মতাে ছেলে তাের মতাে বলদের সাথে প্রেম করবে? সে তাে কথা বের করার জন্য তাের সাথে ভাব জমাচ্ছে। আর তুইও গাধার মত সব বলে দিচ্ছিস। তুই বুঝতে পারছিস না, কার কাছে তার নাম্বার পেয়েছিস সেটা জানাটাই তার মূল উদ্দেশ্য।"

"প্রেম করার কথা কখন বললাম?"

"তুই তাে অলরেডি গলে গিয়েছিস। আর যাবি নাই বা কেন? তােকে তাে সারাক্ষণ ঘরে আটকে রাখে, পড়িসও গার্লস স্কুলে। জীবনেও তাে কোনাে ছেলে পাসনি। একটা পেয়ে গলে পড়েছিস!"

"ত্রিশা ব্যাপারটা এমন না।"

"ধুর মীরা। তাের মত বােকার সাথে ফ্রেন্ডশীপ করাই ভুল! তুই আর রাফি ভাইয়ার সাথে কথা বলিস না। আমি যদি ধরা খাই তাে দেখিস তােকেও বাজেভাবে ফাঁসিয়ে দেব।"

ত্রিশা গটগট করে বেড়িয়ে গেলাে। মীরা ভাবতে লাগলাে ত্রিশা কি পাগল হয়ে গেল? রাফির সাথে সে কেন প্রেম করবে? চেনে না, জানে না, কখনাে দেখেনি তার সাথে আবার প্রেম হয় নাকি? ত্রিশার ব্যাবহারে খুব কষ্ট পেলাে মীরা।
খানিকক্ষণ বাদে আরেক পােকা মীরার মাথায় খেতে শুরু করলাে। রাফি কি তবে সত্যিই আসল কথা বের করার জন্য তার সাথে কথা বলছে? কণ্ঠস্বরের ব্যাপারটা কি তাহলে রাফি মিথ্যে বলেছে?

পর্ব ০৩পর্ব ০৫

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন