!!৮৮!!
চাঁদের সাথে সম্পর্ক ভালো না হলেও রত্না, আহির, মৃদুলার সাথে বেশ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে আবিরের। ছেলে মেয়ে দুইটা তো বাবা বলতে অজ্ঞান। রত্নাও এই তিনমাসে কেবল আবিরের প্রশংসাই করে গেলেন। করবেন নাই বা কেন বাজার থেকে শুরু করে বাচ্চাদের প্রতিটা জিনিস, রত্নার ঔষধ সব কিছুর খেয়াল রাখে আবির। চাঁদের আগেচোরে চাঁদেরও। এসবের পাশাপাশি চাঁদের মনোযোগ আর্কষণেরও চেষ্টা করে তবে চাঁদ ভাবলেশহীন। আবির সকালে ভার্সিটি যাবার আগে আবার বিকালে ভার্সিটি থেকে ফিরে অনেক রাত অবধি বাচ্চাদের সাথে থাকে। বাচ্চারা ঘুমালে চলে যায়। নয়তো দুইটা কান্না করে ঘর মাথায় তুলে। মেয়েটা তো রণচণ্ডী। ঘুম থেকে উঠে তাকে না পেলে মুখ ফুলিয়ে হাত পা ছড়িয়ে কান্না করবে। পরে আবিরকে সামনে পেলে প্রথমেই নাকে একটা কামড় দিয়ে বুঝাবে সে রেগে আছে আর আবির একটা চকোলেট এগিয়ে দিলে সব রাগ শেষ। ছেলে আহির বরাবরই শান্ত, ভদ্র।
এই তিনমাসে আবির চাঁদের সাথে কথা বলতে চেয়েছে, রাগ ভাঙাতে চেয়েছে তবে চাঁদ সেসব পাত্তাই দেয়নি।
এই তো সেদিনের কথা ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে প্রচুর বৃষ্টির মুখোমুখি হয়েছিল চাঁদ। আবির গাড়ি নিয়ে এগিয়ে এসেছিলো, উঠতে বলেছিলো তবে চাঁদ বৃষ্টির মাঝেই গটগট করে হেঁটে বাসায় ফিরেছে। আবিরের রাগ লেগেছিলো প্রচুর। এতো জেদ কেন মেয়েটার? সে তো ভুল স্বীকার করেছে।
আবির সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আজ অভিমানীনির অভিমান ভাঙাবেই। বাচ্চাদের নিয়ে রত্না গিয়েছেন পাশের বাসায়। সেখানে আহির-মৃদুলার সমবয়সী রাহির জন্মদিন। চাঁদ বাসায় একা। আবির এই মাত্রই এসেছে। সে এখন সোফায় বসে আছে। রত্না আগেই আবিরকে জানিয়ে দিয়েছিলেন তারা বাসায় থাকবে না। আবির যেন নিজের অভিমানীনির অভিমান ভাঙায়। আবির অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলো। একটা মানুষ এতো ভালোও হয়? রত্না কেবল বলেছিলেন,
"আমি আমার মেয়ের সুখ দেখতে চাই।"
চাঁদ বারান্দায় দাঁড়িয়ে গোলাপ গাছটার পাতা ছাঁটাই করছিলো। আবির পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো চাঁদকে। ঘটনার আকস্মিকতায় চাঁদ স্তব্ধ, হতভম্ব। অদ্ভুত এক অনুভূতি বিরাজ করছে তার মাঝে। স্তম্ভিত ফিরে চাঁদ কাঁপা কন্ঠে বলে,
-স্যার, কি.. কি করছেন এসব। ছাড়েন।
আবির চাঁদের ঘাড়ে মুখ গুঁজে বললো,
-উঁহু।
চাঁদের ঘাড়ে নরম স্পর্শে ভরিয়ে দিতে লাগলো। চাঁদের সমস্ত শরীরে বয়ে যাচ্ছে শিহরণ। কিছুক্ষণ পর চাঁদ আবার বলে,
-স্যার, এসব কি? ছাড়েন আমায়।
আবির মুখ তুলে পকেট থেকে একটা চেন বের করে তা চাঁদের গলায় পরিয়ে বললো,
-আমার পটরপটর রাণী আমার সাথে কথা না বললে যে আমার বুকটায় ব্যথা লাগে। সে কেন বুঝে না।
-সে বুঝতে চায় না।
চাঁদকে নিজের দিকে ফিরালো আবির। চোখে চোখ রেখে বললো,
-আর কখনো অবিশ্বাস করবো না। আর কখনো হাত ছাড়বোনা। আর কখনো কষ্ট দিবোনা। ক্ষমা কি করা যায় না?
-জানিনা।
আবির দুষ্টু হেসে বলে,
-জানিস না।
-না।
-ঠিক আছে।
আবিরের অধর ছুঁয়ে দেয় চাঁদের অধর। চাঁদ প্রথমে ছটফট করলেও আস্তে আস্তে অনুভব করে সে স্পর্শ। কিছুক্ষন বাদে চাঁদকে ছেড়ে দিয়ে ঠোঁট মুছতে মুছতে আবির বলে,
-এখনও জানিস না?
চাঁদ লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে বলে,
-বেশরম, বেহায়া।
-শুধু তোমারই জন্য।
!!৮৯!!
চাঁদকে কোলে তুলে নিলো আবির। চাঁদ আবিরের বুকে মাথা রাখলো।এতো শান্তি কেন এই জায়গাটায়! আবির দুষ্টু হেসে বললো,
-কে যেন আমার সাথে রাগ করেছিলো। সেই আমার বুকেই মাথা রাখলো তো।
চাঁদ আবিরের বুকে কয়েকটা কিল দিয়ে মাথা উঁচিয়ে চোখ রাঙালো। আবির ঢোক গিলে বললো,
-এভাবে তাকানোটা কবে শিখলি বলতো। ভয় লাগে তো আমার।
মাথা নিচু করে মৃদু হাসলো চাঁদ। আবিরও প্রশান্তির হাসি হাসলো। যাক অবশেষে হরিণীর অভিমান ভাঙলো। হঠাৎ কি মনে হওয়ায় আবিরের কোল থেকে নামতে চাইলো চাঁদ। আবির বিরক্তির সুর তুলে বললো,
-এতো ছটফট করছিস কেন তুই?
-আপনি একদম আমার সাথে কথা বলবেন না। গিয়ে আপনার ছাত্রী সুমাইয়াকে কোলে নিন।
-কে সুমাইয়া? আমি কেন ওকে কোলে নিবো?
-ন্যাকা, যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানেনা। খুব তো হা হা হি হি করছিলেন ওঁর সাথে।
আবির প্রথমে না বুঝলেও পরে ব্যাপারটা বোধগম্য হতেই বাঁকা হেসে বললো,
-পোড়া পোড়া গন্ধ পাচ্ছি।
-আমার বয়ে গেছে।
-হুমম। সব বুঝি। ও আমাকে তোর ঠিকানা দিয়েছিলো। তাই ওকে সেদিন ধন্যবাদ জানাচ্ছিলাম। এক মিনিট তুই দেখলি কিভাবে? তুই তো আমার দিকে তাকাতিও না।
-জানিনা।
- জানতে হবেনা। চল তোকে আজ ভালোবাসার ব্যাখা শিখাবো।
- আপনি আসলেই বেশরম।
সেদিন আবিরের ভালোবাসার ছুঁয়ায় চাঁদের রাগ, অভিমান সব ভেঙে গিয়েছিলো। ভালোবাসার মানুষটির সামনে কি এতো রেগে থাকা যায়?
________________
পেরিয়ে গেলো তিন বছর। দীর্ঘ আট বছর পর চৌধুরী বাড়িতে পা রেখেছে চাঁদ। একদিন নিস্তব্ধ এক সন্ধ্যায় এই বাড়ি থেকে পালিয়ে নিজের অনিশ্চিত জীবনের দিকে পা বাড়িয়েছিলো সে। আজ আবার রাজরানীর বেশে স্বামীর হাতে হাত রেখে সন্তানদের নিয়ে এই বাড়িতে প্রবেশ করেছে সে। মতিনের অনুরোধে আসা। মোহনা এগিয়ে আসলেন চাঁদের কাছে। ডাকলেন,
-চাঁদ।
-জ্বি।
-আমাকে ক্ষমা করে দে মা।
-এভাবে বলবেন না। আমি আপনাকে ক্ষমা করতে না পারলেও আপনার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই।
করিম, মতিনও ক্ষমা চাইলো চাঁদের কাছে।নিতি বিকালে এসেছিলো তার স্বামীকে নিয়ে।নিজের এক কলিগকে বিয়ে করেছে সে।চাঁদের সাথে অনেক কথা হলো তার। দিমা এখন মেন্টাল হসপিটালে। বিয়ের পর চারবার বাচ্চা মারা যায় তার। সেই কষ্টে আজ সে মানসিক ভারসাম্যহীন। তবে তিলোত্তমা সেই আগের মতো। কিছু কিছু মানুষ আছে যারা কখনো পরিবর্তন হয় না। তিনিও সে দলেই পড়ে। হয়তো একদিন তার পাপের শাস্তি সে পাবে। চাঁদ আনোয়ারার ঘরে ঢুকে প্রচুর কাঁদলো। চাঁদের জীবন বাঁচিয়ে আজ তিনি নেই। জীবন সত্যি অদ্ভুত। আহির-মৃদুলা তো সারাবাড়ি মাথায় তুলে রাখলো। দাদা-দাদি পেয়ে তারা ভিষণ খুশি। মৃদুলা এই নিয়ে দশবার মতিনের সাদা দাঁড়িগুলো টেনে দিয়েছে। মোহনার চোখ ভরে আসে। তিনি সেদিন চাঁদের কথা শুনলে হয়তো আজ এতো কিছু হতো না। তার ছেলেও তার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতো না।
!!৯০!!
স্নিগ্ধ আকাশে হাজারো সাদা মেঘেদের ভেলা। চারিদিকে বাতাস বইছে মৃদু। দূর থেকে উত্তাল পদ্মার ঢেউয়ের ডাক শোনা যাচ্ছে। দুইটা টিয়ে পাশের গাব গাছটায় বসে টোকর টোকর করে গাব খাচ্ছে। বিকালের এই আবহাওয়া যেকোনো প্রেমিক যুগলের মন কাড়বে।
সবুজ শাড়ি পরিহিতা চাঁদ সবুজ পাঞ্জাবি পরিহিত তার প্রেমিক পুরুষের কাঁধে মাথা রেখে ধুরী দিঘীর বাঁধানো ঘাটে বসে আছে। তার কোলে মেয়ে মৃদুলা ঘুমাচ্ছে আর আবিরের কোলে ছেলে আহিরও ঘুম। সারাদিন ঘুরে ক্লান্ত তারা। এখন বসে ধুরী দিঘীর সৌন্দর্য উপভোগ করছে। মেয়েকে সবুজ শাড়ি পরিয়েছে আর ছেলেকে পাঞ্জাবি। এতো সুন্দর লাগছে পুতুল দুইটাকে।
ধুরী দিঘীতে প্রচুর পদ্মফুল ফুটেছে। সবুজের মাঝে সাদা, হলুদ, গোলাপীর মিশ্রণে ফোটা ফুলগুলোকে অসম্ভব সুন্দর লাগছে। চাঁদ আবিরের কানে কানে ফিসফিসিয়ে বললো,
-আমি যেন আপনার কি আবির ভাই?
আবিরও ফিসফিসিয়ে বললো,
-তুই আমার পদ্মপাতা রে চাঁদ।
চাঁদ আবিরের ডান হাতটা নিয়ে তার পেটে রাখলো। আবির চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে প্রথমে চেঁচিয়ে পরে আস্তে আস্তে বললো,
-সত্যি।
চাঁদ লজ্জায় মাথায় নিচু করে হুমম বললো। আবির খুশিতে চাঁদের কপালে ভালোবাসার পরশ দিলো। পরে মেয়ে আর ছেলের কপালে।
এভাবেই মান-অভিমান, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের পালা শেষে আজ তারা সুখী। বহু প্রতিকূলতা পেরিয়ে চাঁদ আপন করে পেলো তার আবির ভাইকে। আবির পেলো তার হরিণী তার প্রেয়সীকে। পূর্ণতা পেলো তাদের ভালোবাসা।
.
.
.
সমাপ্ত...........................