বাতাসে জানালার পর্দা সামান্য উড়ছে। রাতে জানালা কিংবা দরজা কিছুই লক করা হয়নি। জানালা দিয়ে এক ফালি স্নিগ্ধ রোদ ওদের বিছানায় এসে পড়েছে। বাইরে পাখির কিচিরমিচির শব্দ জানান দিচ্ছে বেশি সকাল হয়নি। উষ্ণ নিশ্বাস আর কপালে ঠোঁটের স্পর্শে রুশার ঘুম ভাঙলো। তবুও রুশা চোখ মেলল না। ঘুমের ভান করে শুয়ে আছে। কিছুক্ষণ পরে আধো আধো চোখ মেলে আদ্রিশকে ওয়াশরুমে যেতে দেখল। রুশা আবারও চোখ বন্ধ করল। ঘুমে চোখ মেলতে পারছে না। ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দে আবারও রুশার ঘুম ভেঙে গেল। ওর ঘুম বরাবরই হালকা। বিরক্তি নিয়ে চোখ খুলল রুশা। আদ্রিশ আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে রেডি হচ্ছে। এত সকালে আদ্রিশ কোথায় যাচ্ছে তা অজানা নয় রুশার।
রুশা মনে মনে বলছে,
"ও শুনবে না আমার কথা। একবার যখন মাথায় ভূত চেপেছে জারিফের খেলা শেষ করবেই। যদিও জারিফের চ্যাপ্টার শেষ হওয়া জরুরি। এই লোক বেঁচে থাকলে আমাদের শান্তি দেবে না। আমাদের জীবনে বারবার হানা দিবে। আদ্রিশ আর আমি দু'জনেই ভয়ে থাকব। প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য কখনো আদ্রিশ আবার কখনো আমার উপর হামলা করবে। আদ্রিশ আমাকে নিয়ে চিন্তিত থাকবে, একা ছাড়বে না।"
রুশা আবারও চোখ বন্ধ করল। দেখার অপেক্ষা আদ্রিশ ওকে ডাকে কি-না অথবা বলে যায় কি-না।
রুশার কাছে এসে আদ্রিশ দাঁড়ালো কিন্তু ওকে ডাকল না। মুখের উপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে গালে হাত দিয়ে স্লাইড করে চাদরটা ভালো করে জড়িয়ে দিল। তারপর উঠে চলে গেল। দরজা বন্ধ করার শব্দে রুশা আদ্রিশের চলে যাওয়ার নিশ্চিত হলো। চোখ খুলে রুশা মুখ ভার করে রাখল। তারপর আবারও বালিশে মুখ গুজে ঘুমিয়ে পড়ল।
জারিফ ছোট একটা খাঁচার মধ্যে বসে আছে। দাঁড়ানো যায় না। মাথা ঠেকে যায়। এদিক সেদিক নড়া যায় না। অনেক কষ্ট সহ্য করতে হচ্ছে ওকে। ঠিকঠাক খাবার পায়নি আর না পেয়েছে পানি। মাঝেমধ্যে দয়া হলে একটু পানি আর খাবার দেয়। ঘুমাতেও পারে না ঠিকমতো। সারা শরীর ব্যথা। জারিফ শুধু ভাবছে একবার যদি এখান থেকে বের হতে পারে কিন্তু সে আশাও নেই। আদ্রিশের গার্ডগুলো সব সময় সতর্ক থাকে। আদ্রিশ হঠাৎ করে ভেতরে ঢুকে। এই বাজপাখিকে দেখে জারিফের কলিজা শুকিয়ে যাচ্ছে। আদ্রিশ ওর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ঘাড় কাত করে আবার সোজা করে।
"কিরে ইঁদুরের বাচ্চা? কেমন লাগছে? তোকে দেখে ইঁদুরই মনে হচ্ছে। ইঁদুরের খাঁচায় বন্দী ছোট্ট একটা ইঁদুর। হাহাহা।"
জারিফ রাগে গজগজ করছে। কিছু বলতে পারছে না নিজের অবস্থার জন্য। আদ্রিশ গিয়ে ওর সিংহাসনে পা ঝুলিয়ে বসে। দৃষ্টি জারিফের দিকে। দু'জন লোক ওকে ধরে আদ্রিশের সামনে আনে। আদ্রিশ উঠে ওর সামনে গিয়ে দাঁডায়। ওকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে বলল,
"তোকে ঠিক কোন কোন কাজের জন্য শাস্তি দেব? রুশাকে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য? না তোর লোক ওকে ছুয়েছে তার জন্য? না তুই ওকে নিয়ে বাজে পরিকল্পনা করেছিলি তার জন্য? না আমাকে মারতে চেয়েছিলি তার জন্য?"
জারিফ শুধু রাগে ফোঁসফোঁস করছে কিছু বলছে না। আদ্রিশ একটা চাকু এনে ওর দুই চোখে দুই বার আঘাত করল। জারিফ চিৎকার করছে আর ছটফট করছে। রক্ত পড়ছে চোখ দিয়ে। দুই হাত দিয়ে চোখ ধরে রেখেছে।
আদ্রিশ পৈশাচিক হেসে বলল,
"রুশাকে নিয়ে বাজে পরিকল্পনা করার জন্য ছোট্ট উপহার।"
তারপর বড় একটা তলোয়ার দিয়ে একে একে ওর দুই হাত কেটে বলল,
"এটা ওকে ছোয়ার জন্য।"
জারিফের আর্তনাদ, চিৎকার, আহাজারি আদ্রিশকে বেশ মজা দিচ্ছে। আদ্রিশ হাসছে তৃপ্তির হাসি। ওর কলিজাটা ঠান্ডা হয়েছে। খুব শান্তি লাগছে। আদ্রিশ আরাম করে বসে জারিফের ছটফটানি দেখছে। কিছুক্ষণ পরে উঠে গিয়ে ওকে লাথি মারল। জারিফ নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে।গোঙ্গানি দিচ্ছে শুধু। আদ্রিশ রিভলবার বের করে পুরো ছয়টা বুলেটে ওর শরীর ঝাঝড়া করে দিল। তারপর বলল,
"এটা আমার সাথে দুশমনি করার জন্য। আমাকে আঘাত করার জন্য। রুশাকে কাঁদানোর জন্য।"
আদ্রিশ ওর লাশটায় আরেকটা লাথি মেরে রিভলবার সেজানের হাতে দিয়ে বেড়িয়ে গেল।
.
রুশা ফ্রেশ হয়ে ঘর গোছাচ্ছে। বিছানার চাদর চেঞ্জ করে ওর পছন্দমতো একটা চাদর বের করে বিছিয়ে নেয়। রুশা গুণগুণ করছে। আদ্রিশ ওকে পেছনে থেকে জড়িয়ে ধরল। আকস্মিক ভাবে জড়িয়ে ধরায় রুশা লাফিয়ে চেঁচিয়ে উঠে। আদ্রিশকে দেখে স্থির হয় কিন্তু ভয় পাওয়ার কারণে শ্বাস উঠানামা করছে। আদ্রিশ ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকাল।
"তোমার হাত এত ঠান্ডা কেন? ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।"
আদ্রিশ ওর কথায় পাত্তা না দিয়ে রুশাকে কাছে টেনে নিল। রুশার নাকে নাক ঘঁষছে। ঘন ঘন শ্বাস ওর মুখের উপর আঁছড়ে পড়েছে। রুশা আদ্রিশের শার্ট শক্ত করে ধরল। ওর চোখ বন্ধ। আদ্রিশ টুপ করে ওর ঠোঁটে কিস করে বলল,
"ব্রেকফাস্ট করেছো?"
রুশা চোখ খুলে বলল,
"না, মাত্র ফ্রেশ হয়ে ঘরটা গোছালাম।"
আদ্রিশ খেয়াল করল রুশার চুল ভেজা। চুলে আঙুল পেঁচিয়ে বলল,
"তোমাকে আজ অন্যরকম লাগছে।"
"কেমন লাগছে?"
আদ্রিশ মাতাল করা কন্ঠে বলল,
"সো হট।"
রুশা লজ্জা পেয়ে বলল,
"ধ্যাত! খেতে আসো।"
রুশা নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে খেতে চলে গেল। রুশা খাওয়ার জন্য খাবার মুখে তুলে নিতে গেলে আদ্রিশ হা করে। রুশা নিজের মুখে খাবার পুড়ে বলল,
"তুমি এখন সুস্থ, নিজের হাতে খাও।"
"খাইয়ে দিলে কি হয়?"
"কি শুরু করলে? সবাই দেখছে।"
আদ্রিশ আবারও হা করল। রুশা সার্ভেন্টদের ইশারা করল চলে যেতে। ওরা চলে গেলে রুশা লাজুক ভঙ্গিতে আদ্রিশকে খাইয়ে দিচ্ছে। রুশা আদ্রিশকে তৃপ্ত দেখে নিজেও তৃপ্ত। বারবার ভাবছে ওর কপালে এত সুখ সইবে তো? এই সুখের সংসারে কোন ঝড় আসবে না তো? এসব ভাবতেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে।
.
রুশা দীর্ঘ সময় ইউটিউব দেখে পায়েস রান্না করা শিখেছে। সার্ভেন্টরা সব জোগাড় করে দিয়েছে। রুশা এখন মনোযোগ দিয়ে পায়েস রান্না করছে। আদ্রিশ দুপুর বেলা অফিস থেকে ফিরে সরাসরি রুশার জন্য রান্নাঘরে ঢুকেছে। রুশাকে আগ্রহ নিয়ে রান্না করতে দেখে বাঁধা দিল না। রুশা রান্নাঘরে আছে শুনে প্রথমে রেগে গিয়েছিল। কিন্তু এই হাসি মাখা মিষ্টি মুখটা দেখলে সাত খুন মাফ করে দেয় আদ্রিশ। বড্ড ভালোবাসে যে তাই।
"কি রান্না করো?"
রুশা হাসি মুখে উত্তর দিল,
"পায়েস।"
"বাহ! পায়েস রান্না করতে পারো?"
রুশার মুখ কালো হয়ে গেল। মলিন মুখে বলল,
"আমি রান্নাবান্না কিছু পারি না। তবে চেষ্টা করছি। কেমন হবে জানি না। যেমনই হোক, তোমার জন্য এত এফোর্ট দিচ্ছি খেয়ে বলবে ভালো হয়েছে। না হলেও বলবে।"
"তুমি ভালোবেসে বিষ দিলেও খেয়ে নেব।"
"বাজে কথা বলো না তো। গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নেও। আমি আসছি।"
আদ্রিশ চলে যেতে নিলে রুশা পেছনে থেকে প্রশ্ন করল,
"জারিফ নামের মাফিয়ার কি খবর?"
রুশা উত্তর জানার জন্য উতলা হয়ে গেছে। অনেক আগ্রহ নিয়ে চেয়ে আছে। আদ্রিশ মুখ ভার করে বলল,
"শালা, পালিয়ে গেছে। তাইতো সকাল সকাল তোমাকে কিছু না বলে বের হয়ে গিয়েছিলাম।"
রুশার মুখে যেন এক গুচ্ছ কালো মেঘ নেমে এলো।
"পালিয়ে গেছে! কি করে? ও তো আবার আমাদের ক্ষতি করতে চাইবে। ও আপনার হাত থেকে কি করে পালাল?"
আদ্রিশ রুশার চোখে মুখে ভয় দেখে মনে মনে বেশ খুশি হলো।
"তুমি চিন্তা করো না। ওকে খুব শীঘ্রই ধরে ফেলব। তুমি শুধু একটু সাবধানে থাকবে। তোমার জন্য পর্যাপ্ত সিকিউরিটির ব্যবস্থা করছি। ভয় পেও না।"
আদ্রিশ দরজার দিকে ঘুরে বাকা হাসল। রুশা থম মেরে দাঁড়িয়ে আছে। জারিফের চ্যাপ্টার ক্লোজ হওয়া জরুরি ছিল কিন্তু তা হলো না। পালিয়ে গেল। কি করে পালাল? আদ্রিশ এই জন্য সকাল সকাল বেড়িয়ে গেছে। জারিফ কি আবার বিদেশে চলে গেল? তাহলে ধরবে কি করে?
.
.
.
চলবে...............................