বর্ষণের সেই রাতে - পর্ব ৬৮ - সিজন ২ - অনিমা কোতয়াল - ধারাবাহিক গল্প


ব্যালকনিতে রেলিং এর ওপর দু-হাত রেখে দাঁড়িয়ে আছে স্নিগ্ধা। ঠিক তার পাশ ঘেঁষেই রিক দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের দৃষ্টি-ই আকাশের দিকে স্হির। বেশ কিছুক্ষণ পর রিক গিয়ে স্নিগ্ধাকে পেছন থেকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে বলল,

" থ্যাংকিউ।"

কিন্তু স্নিগ্ধা কিছু বলছে না। ও এখনো স্হির চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। অনেকটা সময় কেটে যাওয়ার পরেও স্নিগ্ধাকে এভাবে চুপ থাকতে দেখে রিক ভ্রু কুঁচকে বলল,

" কী হয়েছে? এভাবে চুপ করে আছো কেন?"

স্নিগ্ধা আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকেই নিজের পেটে হাত রেখে বলল,

" আমি তোমার সন্তানের মা হতে চলেছি।"

রিক স্নিগ্ধার কাঁধে মাথা রেখে বলল,

" হুম, জানিতো। এন্ড এইজন্যই তো আজ আমি এতো খুশি।"

স্নিগ্ধা আবার কিছুক্ষণ নিরব রইল। এরপর ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে রিকের দিকে ঘুরলো।
এরপর রিকের চোখে চোখ রেখে বলল,

" তোমার অতীত, অতীতের ভালোবাসা সবকিছু জেনেশুনে সবটা মেনেই আমি তোমাকে বিয়ে করেছিলাম। কখনও কিছু দাবি করিনি। তুমি নিজে থেকে যা দিয়েছো, যতখানি দিয়েছো ততটা নিয়েই খুশি ছিলাম আমি। কিন্তু আজ আমি তোমার সন্তানের মা হতে চলেছি। তুমি নিজেও জানোনা না চাইতেও আজ কতটা খুশী দিয়েছো তুমি আমাকে। আজ নিজেকে পরিপূর্ণ মনে হচ্ছে।"

রিক স্নিগ্ধার চোখের পানি মুছে দিয়ে বলল,

" কাঁদার কী আছে এতে?"

" জানিনা, আজ খুব কান্না পাচ্ছে।"

" কিন্তু তাতো হবেনা ম্যাডাম। আমার আপনার কান্না একদমই ভালো লাগেনা। তাই আমার সামনে মোটেও কাঁদা যাবেনা। সবসময় হাসি হাসি মুখে থাকতে হবে বুঝলেন?"

" এতোটা ভালো আবার কবে থেকে বেসে ফেললে?"

রিক একটু অবাক হওয়ার ভান করে বলল,

" ভালোবাসি? সেটা কখন বললাম?"

স্নিগ্ধা ভ্রু জোড়া কুঁচকে বলল,

" তারমানে বাসোনা?"

রিক মাথা দুলিয়ে বলল,

" না, একদম না।"

স্নিগ্ধা কঠিন রাগ নিয়ে তাকালো রিকের দিকে। এরপর ঝাড়া দিয়ে রিকের হাতের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেল রুমে। এদিক ওদিক না তাকিয়েই সোজা শুয়ে পড়ল স্নিগ্ধা। রিক বুঝতে পারল বউ তাঁর ভীষণ রাগ করেছে। রাগ করারই কথা। ইচ্ছে করেই তো ক্ষেপালো মেয়েটাকে। ধীরপায়ে বিছানায় গিয়ে স্নিগ্ধার পাশে শুয়ে স্নিগ্ধাকে জড়িয়ে ধরল। স্নিগ্ধা সাথে সাথেই ঝাড়া দিয়ে ছাড়িয়ে নিল নিজেকে রিকের কাছ থেকে। রিক আবার জড়িয়ে ধরল ওকে, স্নিগ্ধা আবার একই কাজ করল। কিন্তু রিকতো ছাড়ার পাত্র নয়। যতবার স্নিগ্ধা সরিয়ে দিয়েছে রিক ততবার একই কাজ করেছে। একপর্যায়ে রিকের সাথে পেরে উঠতে ব্যর্থ হয়ে স্নিগ্ধা নিজেই থেমে গেল। এই ছেলে মহা বজ্জাত, মানিয়েই ছাড়বে।

_________

দেখতে দেখতে প্রায় দুটো মাস কেটে গেছে। নিয়মমতো জাবিন ছুটিতে বাড়ি এসেছে। এবার বেশ লম্বা ছুটিতেই এসেছে। অভ্র এতোদিন জাবিনের আসার অপেক্ষাতেই ছিল। এই দুই মাস ভেতরে ভেতরে ভীষণ ছটফট করেছিল ও। প্রথমত ও নিজেও জাবিনকে ভালোবাসে আর দ্বিতীয়ত সেদিন আদ্রিয়ান ঠিক যেভাবে ওকে হুমকি দিয়েছিল ভাবলেই গা শিউরে ওঠে। কিন্তু জাবিন যে এতো সহজে সবকিছু ভুলে সবটা মেনে নেবেনা সেটা অভ্র খুব ভালো করেই জানতো। ছাদে পাশাপাশি এখন দাঁড়িয়ে আছে অভ্র আর জাবিন। জাবিন প্রচন্ড জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। রাগে সমস্ত শরীর জ্বলে যাচ্ছে ওর। কিছুক্ষণ আগেই অভ্র জাবিনকে সব সত্যি খুলে বলে দিয়েছে। সবটা শুনে জাবিনের সত্যি ভীষণ রাগ হচ্ছে। একটা বছর ধরে ও গুমরে গুমরে কষ্ট পাচ্ছে, এতো চোখের জল ফেলেছে সবটাই এই বোকা ছেলেটার জন্যে। নিজে নিজেই সব কল্পনা জল্পনা করে বুঝে নিয়েছে। কে বলেছিল একে এতো বুঝতে? নিজে নিজে এতো বেশি পাকামো করতে? শুধু শুধুই এতোদিন এতো কষ্ট পেয়েছে। না, এই ছেলেকে এভাবে মোটেই ছেড়ে দেওয়া যাবেনা। ওকে যেমন কষ্ট দিয়েছে এখন অভ্রকেও ওর পেছনে কিছুদিন ঘুরতে হবে। তবেই তো হবে ইটের বদলে পাটকেল। অভ্র জাবিনের চোখ-মুখ দেখেই বুঝে গেছে যে এই মেয়ে আজ ভয়ংকর রেগে গেছে। ওর কপালে কী আছে কে জানে? একটা শুকনো ঢোক গিলে বলল,

" জাবিন তুমি__''

অভ্র কথাটা শেষ করার আগেই জাবিন রাগী কন্ঠে বলল,

" আপনি, আপনি করে বলার কথা ছিল না?"

অভ্র আবার অসহায় দৃষ্টিতে তাকাল জাবিনের দিকে। ওর বোঝা হয়ে গেছে এই মেয়ে এখন ওর জালেই ওকে ফাঁসিয়ে ছাড়বে। কেন যে তখন ওসব করেছিল কে জানে! মুখে এক মুচকি হাসি ফুটিয়ে অভ্র বলল,

" আচ্ছা আমার কথা__"

জাবিন এবারেও অভ্রকে কোনকিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বলল,

" কিছু শোনার নেই। আর শুনুন আপনার প্রতি আমার যেই ফিলিংস ছিল সেটা তখন ছিল। বুঝতেই পারছেন আবেগে পড়ে গেছিলাম আরকি। বাট কয়েকদিন দূরে থাকার পরেই সেটা কেটে গেছে। স্পেশালি কলেজে আমার ক্রাশবয় আসার পর থেকে। এন্ড আমার মনে হয় ইদানিং সেও আমায় পছন্দ করে। আমার জন্যে ওরকম ছেলেই পার্ফেক্ট।"

অভ্র অবাক হয়ে বলল,

" ক্রাশবয় মানে?''

জাবিন একটু দাম্ভিক স্বরে বলল,

" সেসব জেনে আপনার কোন লাভ নেই। মাইন্ড ইউর ওউন বিজনেস।"

কথাটা বলে আর দাঁড়ালোনা অভ্রর দিকে তাকিয়ে মুচকি এক হাসি দিয়ে চলে গেল। অভ্র বোকার মত তাকিয়ে রইল জাবিনের দিকে। 'ক্রাশ বয়' মানে কী? ওকে বোকা বানাচ্ছেনা তো? ভাই-বোন দুটোই চরম শেয়ানা। কখন কী করে বসে কেউ জানেনা। 

_________

আজ আদ্রিয়ানের ফিরতে তেমন রাত হয়নি। আটটার মধ্যে চলে এসেছে। মাথাটা নাকি হালকা ধরেছে আজ। এসে ফ্রেশ হয়েই অনিমার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে পড়েছে। সাথে সেই পরিচিতি বায়না, মাথাটা টিপে দাও। অনিমাও বাধ্য মেয়ের মতো তাই করছে। অনিমা আদ্রিয়ানের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

" স্নিগ্ধার ছ-মাস চলছে। আর মাত্র তিনটে মাস এরপর বাড়িতে ছোট্ট বাবু আসবে। গুলুমুলু একটা বাচ্চা। ভাবলেই খুশিতে নাচতে ইচ্ছে করছে।"

আদ্রিয়ান অনিমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,

" গত আড়াইমাস যাবত দিন-রাত আমার কানের কাছে বাবু আসছে। বাবু কতো কিউট হয়। এরপর দেয়ালে বাচ্চাদের এসব ছবি এনে টানিয়ে রেখে। বাচ্চাদের সবরকম ভালো দিক এসব বলে, করে কোন লাভ হবেনা, জানপাখি। আমারও বাচ্চা ভীষণ পছন্দ। তোমার চেয়ে আমার বাচ্চার শখ কম নেই। কিন্তু ফাইনাল এক্সামের আগে এসব বলে কোন লাভ নেই। আমি গলছি না।"

অনিমা মুখ ফুলিয়ে তাকিয়ে রইল আদ্রিয়ানের দিকে। এই আড়াইমাসে কম চেষ্টা করেনি আদ্রিয়ানকে মানানোর। সরাসরি বললে ধমক দেবে তাই কত টালবাহানাই না করেছে। কিন্তু ফলাফল শুন্য। এই ছেলে নিজের সিদ্ধান্তে অটল। আদ্রিয়ান বলল,

" বিকেলে ফ্রুট জুস খেয়েছিলে তো?"

অনিমা হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ল। আদ্রিয়ান আবার বলল,

" সত্য বলছো তো? আমি কিন্তু জিজ্ঞেস করব। নতুন এসেছে বাড়িতে কী জেনো নাম? হ্যাঁ, রুণাকে।"

" দিয়ে গেছিল ও, খেয়েছি।"

নিচু কন্ঠে বলল অনিমা। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর অনিমা মুখ গোমড়া করে বলল,

" আশেপাশের আন্টিরা মাঝেমাঝেই ইনডিরেক্টলি কথা শোনায়। স্নিগ্ধা বিয়ের ছ-মাসের মাথাতেই মা হতে চলেছে আমি কেন এখনো হতে পারিনি। কেনো এখনো বাচ্চা নিয়ে ভাবছি না। মামনীর কাছে এসেও বলে এসব। যদিও মামনী পাল্টা উত্তর দিয়ে দেয়। কিন্তু__"

আদ্রিয়ান এবার বুঝলো অনিমার কেন মন খারাপ হয়েছে। আদ্রিয়ান এবার উঠে বসে বলল,

" দেখ, তুমি খুব ভালো করেই জানো যে আমি লোকের কথায় কান দেইনা। আর দেবই বা কেন? কারোটা খাই নাকি পরি? আর তাছাড়াও একজন দম্পতি বিয়ের কতবছর পর বাচ্চা নেবে, ক'টা বাচ্চা নেবে এটা সম্পূর্ণ সেই দম্পতির নিজস্ব ইচ্ছে। তাদের নিজস্ব সুযোগ সুবিধা, ইচ্ছে, সামর্থ্য অনুযায়ী তাঁরা সিদ্ধান্ত নেবে। এটা নিয়ে বাইরের কেউ যদি নাক গলায় বা অনধিকারচর্চা করতে চায় তাহলে তাঁরা একপ্রকার শেমলেসদের তালিকাতে পড়ে। আর তাদের মত শেমলেসদের নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় আমাদের আছে না-কি?"

অনিমা চুপ করে রইল। ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে আদ্রিয়ানের কথায় ও সন্তুষ্ট হয়নি। মুখ গোমড়া করেই উল্টো ঘুরে শুয়ে পড়ল অনিমা। আদ্রিয়ান একটু এগিয়ে ওর কাঁধে হাত রাখতেই অনিমা ঝাঁঝালো কন্ঠে বলল,

" ছাড়ুন আমাকে। আপনি আপনার নিজের ইচ্ছে নিয়েই থাকুন। আমার ইচ্ছেরতো কোন দামই নেই আপনার কাছে। আমার কাছেও আসবেন না আপনি। একদম না।"

আদ্রিয়ান অবাক হয়ে গেল। সচরাচর ও ভালোভাবে বোঝালে অনিমা সবসময় বুঝে যায়। মেনেও নেয়। আজই প্রথম আদ্রিয়ান বোঝানোর পরেও অনিমা উল্টো আরও বেশি রেগে গেল। অনিমার এরকম ব্যবহারের সাথে আদ্রিয়ান পরিচিত না। সমস্যা টা কোথায়?
.
.
.
চলবে.............................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন