রিকের কথা শুনে উপস্থিত সকলেই হতভম্ব হয়ে গেলো একপ্রকার। অনিমা আপেলের একটা টুকরো মুখে নিয়েছিল। রিকের কথা শুনে আপেলটা মুখে নিয়েই চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। মানিক আবরার, মিসেস রিমা আর লিমা, অভ্র সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। স্নিগ্ধা চমকে তাকাল রিকের দিকে। রিকের বলা কথাটা ওর মোটেও বোধগম্য হচ্ছেনা। কী বলল রিক এটা? ওকে বিয়ে করতে চায়? এটা স্বপ্ন নয়তো? কিন্তু আদ্রিয়ানের চোখেমুখে অবাক হওয়ার কোন লক্ষণই প্রকাশ পেলোনা। বরং ও হেসে উঠে গিয়ে রিকের পিঠে একটা চাপড় মেরে বলল,
" এইতো! এতোদিনে একটা ঠিকঠাক ডিসিশান নিয়েছিস। আমার বিয়ের প্রায় একবছর পেরিয়ে গেলো আর এই গবেটটার এখনো বিয়ে-সাধির নামই নেই। বাবা, এবার চটজলদি বিয়ের এরেঞ্জমেন্ট করে ফেলোতো।"
মানিক আবরার এবার দ্রুত নিজেকে স্বাভাবিক করে বললেন,
" হ্যাঁ কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি?"
রিক এবার একটু অভিযোগের কন্ঠে বলল,
" তো কতদিন আর সিঙ্গেল লাইফ পার করব। বিয়েতো করতেই হতো একদিন। তাছাড়া চোখের সামনে একভাই যখন হ্যাপি ম্যারিড লাইফ কাটাচ্ছে, ক'দিন পর বাচ্চার বাপও হয়ে যাবে। আর আমি এখনও বিয়েটাই করতে পারিনি। এটা কী ঠিক?"
স্নিগ্ধা এখনো একটা ঘোরের মাঝে আছে। রিক ওকে বলেছিল, বিয়ে যদি কোনদিন করে ওকেই করবে। কিন্তু সেই দিনটা যে এতোটা তাড়াতাড়ি চলে আসবে সেটা স্নিগ্ধা কল্পনাও করতে পারেনি। ও শুধু অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রিকের ব্যবহার দেখছে।
রিকের এমন সিদ্ধান্ত শুনে সবাই প্রথমে অবাক হলেও একটু পরেই সবাই ভীষণ খুশি হয়েছে। মানিক আবরার এক সপ্তাহ পরেই ওদের বিয়ের ডেট ফিক্সট করেছে। সবাইকে সাথেসাথেই ফোন করে জানানো হয়েছে সবটা। সকলেই অবাক হওয়ার সাথে সাথে খুশিও হয়েছে। বিশেষ করে অনিমা। রিককে দেখলে সবসময়ই ওর মধ্যে একটা অনুতাপবোধ কাজ করত। যদিও এতে ওর কোন দোষ ছিলোনা তবুও। কিন্তু এখন আর সেটা থাকবেনা। ও জানে স্নিগ্ধা রিককে ভালো রাখবে।
________
রাত দশটা বাজে। ছাদের রেলিং ধরে পাশাপাশি বসে আছে রিক আর স্নিগ্ধা। দুজনেই অনেক্ষণ যাবত চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। মনে অনেক কথাই জমে আছে কিন্তু সেটা প্রকাশ করে উঠতে পারছেনা। গত ছয়মাসে রিক নিজের অজান্তেই স্নিগ্ধার প্রতি প্রচন্ড দুর্বল হয়ে পরেছে। স্নিগ্ধা ওর অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। কিন্তু এটা ভালোবাসা কি-না সে সম্পর্কে ও নিশ্চিত নয়। আর সেইজন্যই বিয়ের কথা ভাবেনি। কিন্তু মাসখানেক যাবত স্নিগ্ধাকে নিয়ে অনেক বেশি ইনসিকিউরিটি ফিল করতো ও। কোন ছেলের সাথে নরমালি কথা বললেও ওর রাগ হতো। আর আজ বিকেলে সেই রাগের বশেই স্নিগ্ধার সাথে তর্ক হয়। আর সেই তর্কের মধ্যেই একপর্যায়ে স্নিগ্ধা বলে ওঠে,
" কোন অধিকারে এসব বলছো তুমি? তুমি আমার স্বামীও নও আর না আমার বয়ফ্রেন্ড। তাহলে? আমার ব্যাক্তিগত জীবন নিয়ে এতো কথা বলার অধিকার কী তোমার আছে?"
রিক তখন বলেছিল,
" আমি কিন্তু তোকে কথা দিয়েছি স্নিগ্ধা।"
স্নিগ্ধাও ভীষণ কঠোর স্বরে জবাব দিয়েছিল,
" তো? মাথা কিনে নিয়েছো আমার? তোমার ঐ একটা কথার ভিত্তিতে কী আমার জীবন চলবে? না-কি আমি সারাজীবন বসে থাকব? এরকম ভাবাটাও বোকামি নয় কী?"
রিক তৎক্ষণাৎ নিজের মনকেও একই প্রশ্ন করল। একটা মেয়ে নিঃস্বার্থভাবে ওর জন্যে আর কত করবে? তাছাড়াও একবার নিজের ভুলের জন্যে নিজের নীলপরীকে হারিয়ে ফেলেছে ও। এখন যদি স্নিগ্ধাকেও হারিয়ে ফেলে তাহলে ও বাঁচতে পারবেনা। একদম পারবেনা। তারপরই স্নিগ্ধার হাত ধরে একপ্রকার টেনে বাড়িতে নিয়ে এসে সবার সামনে নিজেদের বিয়ের ঘোষণা করে দেয়।এসব কথা একবার ভেবে নিয়ে নিরবতা ভেঙ্গে স্নিগ্ধা নিজেই বলল,
" আমি কিন্তু তোমাকে ফোর্স করিনি রিক দা। আমি জাস্ট এমনিই বলেছিলাম কথাটা তোমাকে।"
রিক একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,
" কথাটা এমনি বললেও সত্যি বলেছিলি। এভাবে তো দিন চলেনা। আর নিজেকে সুযোগ না দিলে, মুভ অন না করলে। যত সময়ই নেই না কেন লাভ হবেনা। তাই এবার আমি চাই আমাদের বিয়েটা হয়ে যাক। আমি সবকিছু নতুনভাবে শুরু করতে চাই।"
স্নিগ্ধা একদৃষ্টিতে রিকের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল,
" সত্যি বলছো?"
রিক ঘুরে স্নিগ্ধার হাতদুটো নিজের দু হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল,
" একদম! আমি চাই তোকে ভালোবাসতে। ভীষণভাবে ভালোবাসতে। আমি বড্ড অগোছালো স্নিগ্ধু। তোকেই দায়িত্ব নিয়ে আমায় গুছিয়ে দিতে হবে। কথা দিচ্ছি তোকে সর্বোচ্চ সুখ দেওয়ার চেষ্টা করব। তবে একটাই অনুরোধ_"
স্নিগ্ধা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালো রিকের দিকে। রিক একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,
" নীলপরীকে ভুলে যেতে বলিসনা প্লিজ। সেটা আমি পারবনা। কথায় আছে ভালোবাসতাম বলে কোন শব্দ হয়না। কিন্তু ভালোবাসার রূপ বদলায়। ঠিক যেমন শক্তি বা পাওয়ার কখনও শেষ হয়না কেবল রূপ পরিবর্তন করে ঠিক তেমনই সময় এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী ভালোবাসা তাঁর রূপ বদলে নেয়। আগে আমি ওকে ভালোবাসতাম নিজের করে পাওয়ার জন্যে, নিজের প্রেয়সী হিসেবে। আর এখন আমি ওকে আমি ভালোবাসি শুধুমাত্র ওকে ভালো রাখার জন্যে, ওর সবচেয়ে ভালো বন্ধু হিসেবে। তবে ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি। মেনে নিতে পারবি এই সত্যিটা?"
স্নিগ্ধা মুচকি হেসে রিকের চোখে চোখ রেখে বলল,
" ভালোবাসি বলে দাবীতো অনেকেই করে। কিন্তু প্রকৃত অর্থে ভালোবাসতে পারে ক-জন? আর যেই পুরুষ এভাবে কাউকে ভালোবাসতে পারে তাঁকে নিজের স্বামী হিসেবে পাওয়া সৌভাগ্যের। আমি শুধু আপনার প্রেয়সীর স্হানটুকু চাই, অর্ধাঙ্গিনী হতে চাই। আমি চাই আপনার ওপর শুধু আমার অধিকার থাকবে। আর কিচ্ছুনা।"
রিক হালকা হেসে স্নিগ্ধার কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,
" আজ থেকে আমি সম্পূর্ণ আপনার ম্যাডাম। যা ইচ্ছা হুকুম করুন।"
স্নিগ্ধা হেসে ফেলল রিকের কথায়। রিকও হেসে দিল। এ হাসিতে অনেক না পাওয়াকে পেয়ে যাওয়ার খুশি আছে, তৃপ্তি আছে, ভালোবাসা আছে।
_________
আজ স্নিগ্ধা আর রিকের হলুদ সন্ধ্যা ছিলো। দু-জন এক বাড়িতেই থাকে তাই এক জায়গাতেই দুটো স্টেজ সাজিয়ে দুজনের হলুদের প্রোগ্রাম করা হয়েছে। বিয়ে বাড়ির নানারকম ব্যস্ততা আর অনেক হৈ হুল্লোড়ের মাঝেই কেটেছে দিনটা। জাবিন চট্টগ্রাম থেকে আজকেই এসেছে। এক সপ্তাহের জন্যে থাকবে এখানে এরপর আবার চলে যাবে। তবে যেই জাবিন সারাক্ষণ অভ্রর পেছন পেছন ঘুরঘুর করতো, বিরক্ত করতো সেই জাবিন আসা থেকে এখনো অবধি অভ্রর দিকে ঠিকভাবে তাকায় অবধি নি। আর এই পরিবর্তন অভ্র স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে। সেটা দেখে এক শূন্যতা গ্রাস করে চলেছে ওর মনকে। কিন্তু সবটাতো ওই করেছে। ও ঠিক যেটা চেয়েছে সেটাইতো হয়েছে। তাই এরকম কষ্ট পাওয়া এখন একদমই ভিত্তিহীন। বেশ ক্লান্ত শরীর নিয়ে অনিমা বিছানায় এসে গা এলিয়ে দিল। বিয়ে বাড়িতে প্রচুর কাজ থাকে। তারওপর এতো হৈচৈ। অরুমিতা, তীব্র, স্নেহাকে কিছুক্ষণ আগেই বিদায় দিলো। এখন প্রচন্ড ক্লান্ত লাগছে ওর। ঘুম পাচ্ছে ভীষণ। এরমধ্যে চোখও লেগে এলো ওর। বেশ কিছুক্ষণ পর আদ্রিয়ান ঢুকলো রুমে। রুমে এসে অনিমাকে এভাবে এলোমেলোভাবে শুয়ে থাকতে দেখে বেশ বিরক্ত হলো ও। এই মেয়েটাকে দিনরাত ননস্টপ বকাবকি করলেও এ শোধরানোর নয়। অনিয়ম করবেই করবে। এটা করা একপ্রকার বাধ্যতামূলক হয়ে উঠেছে ওর কাছে। কীভাবে পোশাক চেঞ্জ না করে, ফ্রেশ না হয়ে ঘুমিয়ে আছে। রাতে ঠিকভাবে খায়ও নি কিছু এতো কাজের চক্করে। ও নিজেও ভীষণ ব্যস্ত ছিল তাই খোঁজ নিতে পারেনি। ছোট্ট একটা শ্বাস ফেলে দরজাটা লক করে টি-টেবিলে দুধের গ্লাসটা রেখে অনিমার কাছে গিয়ে দেখল অনিমা একদম গুটিয়ে শুয়ে আছে। শাড়ি এলোমেলো হয়ে আছে, কুচি প্রায় খুলে গেছে, চুলগুলো সব ছড়িয়ে আছে এপাশ ওপাশে, মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট। ভেবেছিল ঘুম থেকে তুলে মেয়েটাকে আচ্ছামতো বকুনি দেবে। কিন্তু অনিমাকে এভাবে ঘুমোতে দেখে আদ্রিয়ানের সব রাগ এমনিই চলে গেল। মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে ডাকতে যাবে তখনই খেয়াল করল যে মাথাটা গরম। পরে গলায় হাত দিয়ে বুঝলো যে অনিমার জ্বর এসছে। আদ্রিয়ান অনিমার মাথায় হাত বুলিয়ে আলতো স্বরে কয়েকবার ডাকার পর চোখ খুলল অনিমা। কিন্তু এখনো ওর চোখে প্রচুর ঘুম। আদ্রিয়ান হাত ধরে আস্তে করে বসিয়ে দিয়ে বলল,
" বারবার বলেছি ভেজা শরীর নিয়ে বেশিক্ষণ থাকবেনা। জ্বর বাঁধিয়ে ছাড়ল মেয়েটা। এখন খুশি?"
অনিমা পিটপিটে চোখে তাকালো আদ্রিয়ানের দিকে বোঝাই যাচ্ছে যে প্রচন্ড দুর্বল আর অর্ধঘুমে আছে। আদ্রিয়ান দুধের গ্লাসটা হাতে নিয়ে অনিমার মুখের কাছে নিতেই অনিমা নাক ছিটকে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। আদ্রিয়ান ধমক দিয়ে বলল,
" নাক ছিটকালেই থাপ্পড় মারব। চুপচাপ শেষ করো।"
একপ্রকার জোর করেই পুরো দুধটা অনিমাকে খাইয়ে দিল আদ্রিয়ান। এরপর একটু পানি খাইয়ে ঔষধও খাইয়ে দিল। অনিমা আবারও ঘুমে ঢলে পরল আদ্রিয়ানের বুকে। আদ্রিয়ান অনিমার পড়নের শাড়িটা খুলে নিলো গা থেকে। এরপর ওয়াসরুম থেকে পানি এনে ভেজা কাপড় দিয়ে মুখ গলা হাত ভালোভাবে মুছে দিল। এরপর চুলগুলো ভালোভাবে বেঁধে দিয়ে বিছানায় ঠিক করে শুইয়ে দিল।কিন্তু অনিমার শরীরের জ্বর বেড়েই চলেছে তাই বেশ অনেক রাত অবধি জেগে থেকে জলপট্টি দিয়েছে আদ্রিয়ান। জ্বরটা অনেকটা কমতেই নিজেকে সহ একটা চাদরে অনিমাকে জড়িয়ে নিয়ে জাপটে ধরল নিজের সাথে। এরপর শেষ রাতের দিকে নিজেও ঘুমিয়ে পড়ল।
.
.
.
চলবে.........................................