ভোর রাত থেকে শুরু হয়েছে আষাঢ়িয়া তান্ডব। কাঁচের জানালাটা ভেসে যাচ্ছে বৃষ্টিকন্যার চঞ্চল নৃত্যে। হাসপাতালের করিডোরে, এক পাশে দাঁড়িয়ে বাইরেটা খেয়াল করছিল শুভ্র। চোখ-মুখ ক্লান্তিহীন। তবুও কোথায় একটা উদাসী বিষাদের ছাঁয়া। সুন্দর চোখজোড়াতে অদ্ভুত শূন্য দৃষ্টি।
' ডিসচার্জের ব্যবস্থা তো হয়ে গিয়েছে। এখনই বেরুবি? দুটো দিন হাসপাতালে থেকে গেলে হতো না?'
কাঁচের জানালায় লম্বা চওড়া এক যুবকের প্রতিবিম্ব পড়তেই সন্তপর্ণে দীর্ঘশ্বাস ফেলল শুভ্র। দুই হাত পকেটে গুঁজে রেখেই ঘাড়টা হালকা কাত করে পাশে তাকাল,
' মেয়ে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে বসে আছে। মাকে ছাড়া খাবে না। কী আশ্চর্য বিষয় বল তো সাহেল, জন্মানোর পর যে মেয়ে শুধু বাবার কোলে কোলে থেকেছে, দীর্ঘ সময় মাকে কাছে পর্যন্ত পায়নি। সেই মেয়ে মায়ের এতো ভক্ত হলো কী করে? টেকনিক্যালি বাবার প্রতি ওর আকর্ষণ বেশি হওয়ার কথা ছিল না?'
সাহেল হেসে ফেলল। বলল,
' সেদিক থেকে চিন্তা করলে মেয়ে কিন্তু বাবাকেই ফলো করছে। বাবা যার ভক্ত, বাবার মেয়েও তারই ভক্ত। বাবা থেকেই ইন্সপায়ারড বলতে পারিস।'
শুভ্র হাসল। খানিক ভাবুক হয়ে বলল,
' বাবা! বাবা হয়ে গেলাম। কী সাংঘাতিক ব্যাপার না? আজও মনে হয়, এইতো সেদিন ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। এসব ভাবলেই বাচ্চা বাচ্চা লাগে নিজেকে।'
সাহেল ঠোঁট টিপে হেসে বলল,
' আরে ধূর! সবচেয়ে ভালো এক্সামপল হলো, এইতো সেদিন ভার্সিটি গেইটে সানশাইনের হাতে চড় খেয়ে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলি। আহা! কী দৃশ্যপট! এখনও চোখে ভাসে।'
শুভ্র ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল,
' তুই শালা আর কোনো স্মৃতি মস্তিষ্কে ক্যাপচার করতে পারিস না? খুঁজে খুঁজে আমার বেইজ্জতির স্মৃতিগুলোই তোর মনে থাকে?'
' মনে থাকবে না মানে? আরে! এটা তো পুরো পৃথিবীর মনে রাখা উচিত। ভার্সিটি গ্রুপে এখনও এই বিষয়ে চর্চা হয়। বিরাট কৌতূহল নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, ভার্সিটি শাইন, মোস্ট ইগোইস্টিক শুভ্র জুনিয়রের হাতে চড় খেয়ে, সেই মেয়েরই বাচ্চার বাবা হয়ে গেল কী করে? কঠিন প্রশ্ন!'
শুভ্র চোখ গরম করে তাকাতে গিয়েও হেসে ফেলল। তারপর হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে বলল,
' সাহেল! মিসক্যারেজের ব্যাপারটা চেপে যাস প্লিজ। রোদ প্রেগন্যান্সির ব্যাপারেই জানতো না। সো, মিসক্যারেজের ব্যাপারে জানার প্রয়োজনও তার নেই। আমি চাই না ওর মন খারাপ হোক।'
সাহেল দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নাড়ল। হাসার চেষ্টা করে বলল,
' জানবে না। ওহ্ হ্যাঁ, আমি গিয়ে গাড়ি রেডি করছি। তুই সানশাইনের কাছে যা। আই হোপ, ও জেগে গিয়েছে।'
সাহেল দ্রুত পায়ে সরে যেতেই দীর্ঘশ্বাস ফেলল শুভ্র। সাহেলের যাওয়ার পথের দিকে চেয়ে থেকে আনমনে বিড়বিড় করল, 'সানশাইন!' রোদের কেবিনের দিকে ফিরে যেতে যেতে সে উপলব্ধি করল, 'সানশাইন' শব্দটা মাথায় ভোঁতা রাগ তৈরি করছে। হঠাৎ মেজাজ খারাপ হচ্ছে। আচ্ছা? সে কী এই ছোট্ট একটা নামের জন্যও ঈর্ষান্বিত হচ্ছে? শুভ্র নিজের উপরই বিরক্ত হলো। আশ্চর্য! এখন কী এসব নিয়ে রাগারাগি করার সময়? মাথার ভেতর দগদগে রাগ নিয়ে কেবিনের দরজাটা ঠেলতেই বিরক্ত চোখদুটো স্নিগ্ধ হয়ে এলো। মাথার ভোঁতা রাগটা সরে গিয়ে মন জুড়ে সুবাস ছড়াল ঐশ্বরিক এক মায়া। একদম ঝুপ করে শান্ত হয়ে গেল সে। শব্দহীন পায়ে ঘুমন্ত মানবীর পাশে দাঁড়াতেই ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটলো। বিছানার পাশের খাঁড়া টোলটির উপর বসে একদৃষ্টে চেয়ে রইল চোখ বোজা ফ্যাকাশে, তেলতেলে মুখটিতে। মুখের উপর ছড়িয়ে থাকা চুলের গোছা সরিয়ে দিয়ে মাথায় আলতো বিলি কাটতে কাটতে কপালে ঠোঁট ছুঁয়াল। প্রায় সাথে সাথেই চোখ মেলে তাকাল রোদ। দুর্বল অথচ মিষ্টি হাসি হাসল। তার সেই হাসি ছড়াল শুভ্রর ঠোঁটেও। রোদের একটা হাত নিজের হাতে তুলে নিয়ে খুব আলতো আদর করে, মৃদু কন্ঠে বলল,
' মিস ইউ।'
রোদের হাসি বিস্তৃত হলো। ঠোঁটভর্তি হাসি নিয়ে বন্ধ জানালা ইশারা করে বলল,
' এখন সকাল, বিকাল নাকি রাত? বুঝতে পারছি না।'
' সকাল।'
এমন সময় দরজা ঠেলে কেবিনে ঢুকল সাহেল। সাহেলের দিকে এক পলক চেয়ে শুভ্রর দিকে চাইল রোদ। সরল কন্ঠে বলল,
' আমার কী হয়েছিল? ডাক্তার কী বলেছে? আমার মনে আছে, মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রনা হচ্ছিল। পেটেও ব্যাথা ছিল। আমি কী মারা টারা যাচ্ছি?'
শুভ্র ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল। তারপর নিঃশব্দে সাহেলের চোখে চোখ রাখল। সাহেল শুভ্রর দিকেই চেয়ে ছিল। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে বলল,
' এই মুহূর্তে মারা যাচ্ছ না তবে প্রাণহানির সম্ভাবনাও আছে। মারা যেতে পারো। শুভ্র তোমাকে শ্রীমঙ্গলের পাহাড় থেকে ফেলে দেবে বলে পরিকল্পনা করছে।'
রোদ অবাক হয়ে বলল,
' মানে?'
শুভ্র গম্ভীর কন্ঠে বলল,
' তুমি যে ঔষধগুলো ঠিকমতো নাওনি তা ধরা পড়ে গিয়েছে। আগের সমস্যাগুলো মাথাচাড়া দিতে চাচ্ছে। তোমার ধারণা তোমাকে এমনি ছেড়ে দেওয়া হবে? সুস্থ হও আগে, ঢাকায় ফিরি তারপর বুঝাব শুভ্র কী জিনিস!'
রোদের মুখটা চুপসে গেল। ভীষণ নিষ্পাপ চোখে চেয়ে চোখ পিটপিট করে তাকাল। শুভ্র সেদিকে পাত্তা না দিয়ে নার্সকে একটা হুইলচেয়ারের ব্যবস্থা করতে বলে নিচু কন্ঠে বলল,
' এভাবে তাকিয়ে লাভ নেই। এবার আর ঘায়েল হচ্ছি না। তোমার খবর আছে।'
রোদ বলার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে মুখ কালো করে বলল,
' হুইলচেয়ার কেন? আমি হুইলচেয়ারে যাব না।'
শুভ্র উঠে দাঁড়িয়ে রোদের চুলগুলো কাটায় আটকাতে আটকাতে বলল,
' তুমি চাইলে আমি নির্দ্বিধায় পাড় করাতে পারি ভরা দামোদর। এটা তো সিম্পল একটা হসপিটাল কম্পাউন্টার। আমি খুশি মনে কোলে উঠাতে পারি, যদি তুমি লজ্জায় লাল হয়ে গলে না যাও তো। উঠবে নাকি?'
রোদ মুখ গুজ করে বলল,
' আমি হেঁটে যাব।'
' বাচ্চাদের যেখানে সেখানে হাঁটতে নেই।'
' আমি বাচ্চা?'
শুভ্র কোনোরকম অভিব্যক্তি ছাড়া বলল,
' এখানে যারা আছে তাদের তো আপাতত তাই ধারণা। সাহেলকে জিজ্ঞেস করো। ও তোমাকে বাচ্চা ভাবে কী-না?'
রোদ সাহেলের দিকে তাকাল। সাহেল হেসে বলল,
' আমাকে জিজ্ঞেস করো না। আমি আপাতত বাচ্চা-কাচ্চাদের মন্তব্য দিতে ভরসা পাচ্ছি না। আমি বরং গাড়ির কাছে যাচ্ছি। তোমরা এসো।'
শুভ্র ঠোঁট টিপে হাসল। রোদ রাগ নিয়ে তাকাতেই কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,
' আমার কী দোষ? সাহেল নিজেই তোমায় বাচ্চা বলল। আমি তো বলতে বলিনি, বলেছি?'
রোদ দুঃখী দুঃখী চোখে চেয়ে মুখ ফুলাল। এদের সমস্যাটা কী? এদের দুই বন্ধুর কী সে ছাড়া মজা করার মতো অন্য কোনো সাবজেক্ট নেই? যত্তসব!
••••••••••••
বৃষ্টি থেমেছে ঘন্টাখানেক হলো। কটেজের সামনের বাগানটির এক পাশে ঝিরির মতো গড়িয়ে পড়ছে জল। সেই জলে হাত-পা ভিজিয়ে খেলছিল শুভ্রতা। তার পাশেই কাদায় মাখামাখি হয়ে খেলনা বানানোর চেষ্টা করছিল আদ্র-রোদ্র। সাদাফ পরিচ্ছন্ন পোশাকে এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। হাতে-পায়ে কাদার ছিটেফোঁটা নেই। শুভ্রতা বড় বড় চোখে সাদাফের দিকে তাকাল। চোখ পিটপিট করে বলল,
' তুমি খেব্বে?'
সাদাফ উত্তর না দিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। শুভ্রতা এগিয়ে গিয়ে আবারও একই কথা বলতেই সাদাফ ভ্রু কুঁচকে তাকাল। ঠোঁট দুটো হালকা ফাঁক করে বলল,
' তুমি পঁচা। পানি দিয়ে খেললে আম্মু বকে জানো না?'
শুভ্রতা কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে আচমকা ঠোঁট উল্টে কেঁদে উঠল। আদ্র-রোদ্র অবাক হয়ে শুভ্রতাকে দেখল। পরমুহূর্তেই ছুটে এলো কাছে। রোদ্রর রাগ বরাবরই বেশি। সাদাফের দিকে তেড়ে গিয়ে রাগ দেখিয়ে বলল,
' এই তুমি বোনকে কাঁদালে কেন?'
সাদাফ জবাব দিল না। শুভ্রতার দিকে চেয়ে রইল চুপচাপ। শুভ্রতার কান্না বাড়ল। আদ্র কিছুক্ষণ শুভ্রতাকে কোলে তোলার ব্যর্থ চেষ্টা চালাল। সে নিজেই ছোট, শুভ্রতার ছোট্ট শরীর বাহুবন্ধন করার শক্তি তার থাকলেও ধরে রাখার শক্তি হয়ে উঠেনি এখনও। কাদামাখা হাতদুটো নিজের জামায় মুছে শুভ্রতার মাথায় হাত বুলিয়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করে বলল,
' কাঁদিস না। কাঁদলে রাক্ষস আসে, দাদু বলেছিল না?'
রোদ্র উষ্ণ কন্ঠে প্রশ্ন করল,
' কাঁদছিস কেন? সাদাফ মেরেছে?'
রোদ্রের চোখে অসহিষ্ণু। ভাবখানা এই, শুভ্রতা হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলেই সাদাফকে সে ঠেঙাবে। শুভ্রতা সেসবের দ্বারে কাছে না গিয়ে ঠোঁট উল্টাল,
' আম্মু যাব। বাবা কোতায়?'
এটুকু বলতেই দু'ফোঁটা টসটসে জলে মাখামাখি হলো কচি গাল। গোটা দুইদিন, এক রাত বাবা-মাকে দেখে না সে। কোথায় তার আম্মু আর বাবা? আদ্র শুভ্রতার কান্না থামানোর চেষ্টা করতে করতে অসহায় চোখে রোদ্রর দিকে তাকাল। রোদ্র আর সাদাফের চোখেও অসহায় দৃষ্টি। শুভ্রতার কান্না মায়ের কানে গেলে, মা নিশ্চয় বিনা বিচারে তাদের তিনজনকেই লাঠিপেটা করবে?
•••••••••••••
হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে পার্কিংয়ের কাছাকাছি এসে দাঁড়াতেই পার্কিংয়ের দিকে ইশারা করে চাপা কন্ঠে প্রশ্ন করল সাহেল,
' আরে! ওটা গ্যাংস্টার রাফিন চৌধুরী না? এই লোক এখানে কেন?'
পার্কিংয়ে কোট স্যুট পরা ভদ্র জনতার দিকে উৎসুক চোখে তাকাল রোদ। চোখ বড় বড় করে বলল,
' গ্যাংস্টার! সত্যিকারের গ্যাংস্টার? আমাদের দেশেও গ্যাংস্টার ট্যাংস্টার আছে নাকি?'
' কেন থাকবে না?'
শুভ্র হুইলচেয়ারে হাত রেখে রোদের পেছনেই দাঁড়িয়ে ছিল। সাহেলের দৃষ্টি অনুসরণ করে সামনে তাকাল। ফর্মাল স্যুট পরনে দীর্ঘকায় পুরুষটিকে দেখে ভ্রু বাঁকাল সে। পেছনে তার বডিগার্ডের বহর।
' হ্যাঁ। রাফিন চৌধুরীই।'
' তোর সাথে পরিচয় আছে?'
সাহেলের কথার মাঝেই উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করল রোদ,
' এই লোক কোন ধরনের গ্যাংস্টার? মুভির মতো? যে মেয়েকে পছন্দ হয় সেই মেয়েকেই তুলে নিয়ে যায়। আনকাউন্টেবল রেইপ কেইসেস, মার্ডার কেইসেস। যাকে ইচ্ছে হয় তাকেই মেরে ফেলে, এমন টাইপ? তবে তো সাংঘাতিক!'
শুভ্র বিরক্ত হয়ে বলল,
' শাট আপ রোদ।'
রোদ কিছু বলবে তার আগেই রাফিনকে এদিকে আসতে দেখা গেল। রাফিনকে এদিকে আসতে দেখেই চুপ হয়ে গেল রোদ। এই লোক যদি সত্যি সত্যিই গুন্ডা টুন্ডা হয় তাহলে তো বিশাল বিপদ। কিন্তু চোখ-মুখ দেখে তো ছ্যাঁচড়া,ফালতু টাইপ মনে হয় না। ইগনোর করার মতো পার্সোনালিটি অবশ্যই নয়। রাফিনের প্রতিটি অঙ্গভঙ্গিতে প্রস্ফুটিত অহংকার। হাঁটা-চলায় রাজকীয় গাম্ভীর্য। নিজের সাম্ভ্রাজ্যে ঘুরে বেড়ানো মুক্ত শাসকের মতোই দ্বিধাহীন দৃষ্টি আর আত্মবিশ্বাস। রাফিন হাসপাতালের ভেতরের দিকে যেতে যেতে হঠাৎ শুভ্রকে খেয়াল করল। ঘাড়টা হালকা কাত করে এদিকে তাকাল। চোখদুটো কালো সানগ্লাসে ঢাকা থাকায় চোখের অভিব্যক্তি বুঝা গেল না। রাফিনের স্থির, কঠোর মুখখানার দিকে এক আধবার আড়চোখে তাকাল রোদ। রাফিন রোদকে খেয়াল করল বলে মনে হলো না। শুভ্রর দিকে চেয়ে বলল,
' মিষ্টার আহমেদ?'
শুভ্র সৌজন্যতার হাসি হাসল। রাফিন এক পা এগিয়ে এসে সোজা হয়ে দাঁড়াল। শুভ্রও দুই পা এগিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে বলল,
' হ্যালো, মিষ্টার চৌধুরী।'
রাফিনের ঠোঁটে তখন কঠোর হাসি। চোখে-মুখে প্রকাশ্য অহংকার। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিজোড়াতে জ্বলজ্বল করছে অপ্রতিরোধ্য আত্মবিশ্বাস। এই পৃথিবীর কোথাও মাথা ঝুঁকাবার নয় এমন অবিশ্বাস্য গর্ব তার ঠোঁটের কোণায়। রাফিন হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
' আমার জানা মতে, এবারের তিনটি টেন্ডারই আপনাদের কোম্পানি পেয়েছে। কনগ্রাচুলেশন।'
শুভ্র হালকা হেসে বলল,
' থেংকিউ।'
রাফিন আবারও হাসল। অতিরিক্ত কৌতূহল তার স্বভাব বিরুদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও জিজ্ঞেস করল,
' এখানে কেন? আহমেদদের টাকা খরচ করার জন্য ঢাকার হসপিটালই ফার্স্ট প্রায়োরিটি হওয়া উচিত।'
' ফ্যামিলি ট্যুরে এসেছি। আমার ওয়াইফ হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় ডক্টরের এপয়েন্টমেন্ট নিতে হয়েছিল। '
রাফিন তার দাম্ভিক হাসি হেসে এক নজর রোদের দিকে তাকাল-কী-তাকাল না বুঝা গেল না। ঠোঁট গোল করে বলল,
' ওহ! ওয়াইফ! আপনিও যে হোম ম্যাটারিয়াল পার্সোন জানতাম না। নিউলি ম্যারেড?'
শুভ্র হেসে বলল,
' তেমন নয়। আমাদের একটা মেয়ে আছে।'
রাফিনের ঠোঁটে তখনও সেই দাম্ভিক হাসি। সানগ্লাসে ঢাকা চোখদুটো অভিব্যক্তিহীন।
' ওহ! দেন ইউ আর কমপ্লিটলি ওয়ার্ল্ডলি পার্সোন। অল দ্য বেস্ট।'
' থেংক্স। কিন্তু আপনি এখানে?'
রাফিন উত্তর না দিয়ে হাসল। সেখান থেকে বিদায় নিয়ে চলে যেতেই হাফ ছেড়ে বাঁচল রোদ। চাপা কন্ঠে বলল,
' এত্তো এটিটিউট! এই লোক সত্যিই গ্যাংস্টার? মানুষ মারে? যদিও প্রচন্ড এটিটিউট ক্যারি করে তবুও খুনাখুনির ব্যাপারটা বিশ্বাস হয় না। স্মোথ চেহারা। চেষ্টা করলে, সিনেমায় নায়ক টায়ক হয়ে যেতে পারত। এতো সুন্দর চেহারার ছেলেরা খুন করে কী করে?'
শুভ্র ফিরে তাকাল। রাফিন শুভ্রর সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ না করলেও ব্যক্তিগতভাবে লোকটিকে পছন্দ নয় শুভ্রর। রাফিনের 'ডোন্ট কেয়ার' বিহেভিয়ারই তার রেগে যাওয়ার প্রধান কারণ। এবারও তাই হলো। মাথায় দপদপে রাগ নিয়ে সে নিজের জায়গায় ফিরে গেল। ধমকের স্বরে বলল,
' শাট আপ রোদ।'
ধমক খেয়ে রোদ মুখ ফুলিয়ে তাকাল। সাহেল হেসে বলল,
' সুন্দর চেহারার সাথে খুন করার কী সম্পর্ক?তোমার বরের চেহারাও যথেষ্ট সুন্দর। সে যে বিনা কারণে মাঝ রাস্তায় হাড়ের ডাক্তারের হাড় ভেঙে গুড়ো করে দিতে পারে সেটাও কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবুও তা ঘটেছে। এমন অনেক কান্ডই আছে যা আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয় তবুও তোমার বর ঘটিয়েছে। তো... '
শুভ্র চোখ রাঙিয়ে তাকাল। প্রায় সাথে সাথেই সাহেল আর রোদ একসাথে বলে উঠল,
' শাট আপ সাহেল ।'
কথাটা বলে শব্দ করে হেসে উঠল দুজনেই। শুভ্র থতমত খেয়ে গেল। পরমুহূর্তেই রাগ নিয়ে বলল,
' ইয়েস! শাট আপ, বোথ অফ ইউ।'
সাহেল আর রোদ ঠোঁট টিপে হেসে চুপ করে গেল। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে তাদের সামনে আসতেই দৃশ্যপটে নতুন চরিত্রের দেখা মিলল। ছিপছিপে লম্বাটে এক তরুণী গট গট করে হেঁটে হাসপাতালের পার্কিং এ এসে দাঁড়াল। রাগে ফর্সা মুখে লালাভ ভাব। বার কয়েক এদিক ওদিক তাকিয়ে শুভ্রদের দিকে এগিয়ে এলো মেয়েটি। নম্র কন্ঠে বলল,
' এখানে গাড়ি ভাড়া পাওয়া যাবে কোথায় বলতে পারেন?'
সাহেল কিছু বলবে তার আগেই পেছন পেছন বেরিয়ে এলো ফর্সাটে এক পুরুষ। চেহারা ছবি আহামরি না হলেও চোখে মুখে অন্য রকম এক আকর্ষণ। হঠাৎ ভিড়ে চোখে পড়ার মতো চৌম্বকত্ব। লোকটি কাছে এসে বিনা ভূমিকায় বলল,
' কম অন, নার্সটা আসলেই সুন্দর ছিল। এখন সুন্দরকে সুন্দর বলা যাবে না? মেয়েটা সুন্দর হলে, হোয়াট ক্যান আই ডু?'
রাগে অগ্নিশর্মা মেয়েটি আরেক ধাপ রেগে গিয়ে বলল,
' আমি কোনো এক্সপ্লেনিশন চেয়েছি? মেয়েটি সুন্দর। ওখানে বসে বসে সুন্দর মেয়েটির সৌন্দর্যের উপর কবিতা লিখেন। মানা করেছে কে? আমি আপনাকে চিনি না। গো টু হেল।'
কথাটুকু বলেই শুভ্র আর সাহেলের দিকে তাকাল মেয়েটি। মুখ ফুলিয়ে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করল। বলল,
' এক্সকিউজ মি? আপনারা কী আমায় একটু হেল্প করতে পারবেন? আমি কী আপনাদের গাড়িতে লিফ্ট পেতে পারি? আমি ঢাকা যাব। খুব প্রয়োজন৷ আমাকে একটু বাসস্ট্যান্ডে ড্রপ করে দিবেন প্লীজ?'
শুভ্র ভ্রু বাঁকিয়ে তাকাল। রোদের চোখে কৌতুহল। লোকটি অবাক হয়ে বলল,
' মিস.ঝগড়ুটে? ব্যাপারটা কী এবার বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যাচ্ছে না? আমরা কালই এসেছি এখনই ঢাকা ফিরবে মানে কী?'
অদিতি রাগী চোখে তাকাল। চোখদুটো টলমল করছে তার। আয়ান হতভম্ব কন্ঠে বলল,
' ওহ গড! তুমি কাঁদছ! ডোন্ট ছে, তুমি সেই নার্সের প্রতি জেলাস হয়ে কান্নাকাটি জুড়ে দিয়েছ? কম অন... '
অদিতির চোখ থেকে টপ করে এক ফোঁটা জল গড়াল। তেজি কন্ঠে বলল,
' আমি কারো প্রতি জেলাস ফেলাস হচ্ছি না। আমি আজই ঢাকা ফিরব এবং এখনই ফিরব। খবরদার আমার বাবার বাড়ির আশেপাশে আসবে না। সেই নার্সকে বিয়ে করে আমেরিকা যাও। সংসার করো। হানিমুন সারো৷ আই ডোন্ট কেয়ার। আমি তোমাকে ডিভোর্স দিব ব্যস।'
আয়ানের চোখে-মুখে দুশ্চিন্তা দেখা গেল না। অর্থাৎ বউয়ের এমন রাগারাগিতে সে অভ্যস্ত। দুশ্চিন্তার বদলে ঠোঁটে দুষ্টু হাসি দিয়ে বলল,
' আহ! তুমি রেগে গেলে এত্তো কিউট করে 'তুমি, তুমি' বলো! ইচ্ছে করে আইসক্রিমের মতো গলে যাই। ইট ওয়াজ সো কিউট। আবার বলো না প্লিজ!'
অদিতি অধৈর্য হয়ে আয়ানের বাহুতে আঘাত করল। আয়ান কিছুটা সরে গিয়ে হাসি হাসি মুখে তাকাল। অদিতিকে আরও একটু রাগিয়ে দিতে সুর করে গাইল,
'Touch me like you do
Ta ta touch me like you do.
তুমি যেভাবেই টাচ করো, সুইটহার্ট। রেগে অথবা ভালোবেসে। আমার কাছে সবই টু মাচ রোমান্টিক মনে হয়। বিলিভ মি, ইট ওয়াজ জাস্ট অসাম।'
কথাটা বলে চোখ টিপল আয়ান। ঠোঁট টিপে হেসে আবারও ফিচেল গলায় গাইল,
' বল কবে হবে মিলন, দিন কাটে দিন গুণে
ভাবছি চাঁদে যাব তোকে নিয়ে হানিমুনে।
এখন এই রাতের রুটিন, লিখছি ছড়া আবারও
হিজিবিজি কাটিকুটি হারিয়েছি রাবারও....
এই সুইটহার্ট? যাবে নাকি আবারও?'
আয়ানের এই লাপাত্তা ধরনের ব্যবহারে রাগে অদিতির কান্না পাওয়ার জোগার। এই লোকটা এমন কেন? নিজের ফিলিংসের প্রতি বিন্দুমাত্র সিরিয়াসনেস কেন থাকবে না তার? অদিতি ধৈর্যহারা হয়ে চোখ বন্ধ করল। হাতের পার্সটা আয়ানের দিকে ছুঁড়ে দিয়ে বলল,
' পাগলের ডাক্তার! গো টু হেল। তুমি যদি আর দুটো মিনিট আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকো। আমি শিওর, আমি তোমাকে খুন করে ফেলব। ওই নার্সের সাথে গিয়ে হারানো রাবার খুঁজো। চাঁদ, মঙ্গল, বুধে হানিমুন করে বেড়াও, এখানে কী?'
শুভ্র-সাহেল ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আয়ান - অদিতির পুরো ড্রামাটা দেখল। কী আশ্চর্য! পাব্লিক প্লেসে দাঁড়িয়ে এডাল্ট দুজন মানুষ টিনেজারদের মতো ঝগড়া জুড়ে দিয়েছে! রোদ শুভ্রর হাতে হালকা চাপড় দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করে অনেকটা ফিসফিসিয়ে বলল,
' দেখেছেন! দিস ইজ কল্ড লাভ। বউয়ের জন্য পার্কিং-এ দাঁড়িয়ে গান গাইছে। আর আপনি? জীবনে কখনো রাগ ভাঙিয়েছেন আমার? রাগ ভাঙানোর বদলে উল্টো নিজেই রাগ করে বসে থাকেন। তিল পরিমাণ দয়া আছে আপনার? ভালো টালো তো বাসেনই না। হে খোদা, বাবা এ কেমন ছেলে দেখে বিয়ে দিয়েছে আমায়!'
কথাগুলো বলেই মুখটা দুঃখী দুঃখী করে ফেলল রোদ। সাহেল শব্দ করে হেসে উঠল। শুভ্র অবাক হয়ে বলল,
' কী আশ্চর্য! এদের দেখে তোমার মনে পড়ল, আমি তোমায় ভালোবাসি না? ভার্সিটিতে প্রেম করার সময় এসব মনে হয়নি?'
' প্রেম! প্রেম করলাম কখন? ঠিকঠাকভাবে প্রেমে পড়ার আগেই তো বিয়ে করে ফেললেন। আকস্মিক বিয়ে।'
' ওহ হ্যালো! বিয়েটা আমার জন্য হয়নি। তোমার জন্য হয়েছে। মনে করে দেখো! মেইন কালপ্রিট কিন্তু তুমি ছিলে!'
রোদ আর্তনাদ করে বলল,
' কালপ্রিট মানে! মেইন কালপ্রিট আমি? তারমানে আপনি আমায় বিয়ে করতে চাননি? আমি জোর করে বিয়ে করেছি? আমাকে বিয়ে করে এখন আপসোস হচ্ছে? আপসোস তো হবেই। ভার্সিটিতে অল্প বয়স্কা মেয়ে দেখে মন পাল্টে গিয়েছে। এখন আমাকে পছন্দ হবে কেন? অসভ্য পুরুষ মানুষ। খবরদার আমার আশেপাশে আসবেন না।'
রোদের চোখ মুহূর্তেই টলমল করে উঠল। শুভ্র ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে চেয়ে আছে। রোদের চোখ থেকে জল গড়ানোর আগেই আচমকা রোদকে হুইলচেয়ার থেকে কোলে তুলে নিল সে। সাহেলকে গাড়ির দরজাটা খুলতে ইশারা করে বলল,
' গাড়ির দরজা খুলে দিয়ে আমার সংসারটা বাঁচা দোস্ত। এখানে আর দুই মিনিট থাকলেই আমার সংসার ভেসে যাবে। আমার সহজ সরল বউটা এদের থেকে ঝগড়াঝাটি শিখে যাচ্ছে।'
সাহেল থেকে চোখ সরিয়ে রোদের দিকে তাকাল শুভ্র। রোদ অগ্নিমাখা চোখে চেয়ে আছে। যার অর্থ, নিচে নামান নয়তো খবর আছে। শুভ্র মৃদু হাসল। রোদের অভিমানী মুখটির দিকে চেয়ে টুপ করে চুমু এঁকে দিল তার কপালে। কপালের সাথে কপাল লাগিয়ে মৃদু কন্ঠে বলল,
' তোমাকে বিয়ে করতে চাইনি মানে? বিশ্বাস করো বউ, তুমি আমাকে বিয়ে করতে না চাইলে আমি তোমাকে তুলে এনে বিয়ে করে ফেলতাম। প্রয়োজনে ধ্বংস করে ফেলতাম এই পৃথিবী। পৃথিবী? এটা একটু বেশি হয়ে যাচ্ছে না? পৃথিবী নয়, ধ্বংস করে ফেলতাম যে তোমাকে বিয়ে করতে আসত তার বাড়ি, গাড়ি এবং জীবন নামক রেলগাড়ী। এটা আমার পক্ষে সম্ভব। আই ক্যান ডু ইট। এবার ঠিক আছে না?'
শুভ্র ভীষণ স্বস্তি নিয়ে রোদের দিকে তাকাল। শুভ্রর কথা বলার ভঙ্গিতে রাগ ভুলে খিলখিল করে হেসে উঠল রোদ। সাহেল অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে মৃদু হাসল। শুভ্র এবার খুব সিরিয়াস হয়ে বলল,
' আমি ভাগ্যবান যে, জীবনসঙ্গী হিসেবে তুমি আমাকেই বেছে নিয়েছ। আমাকে যদি আবারও নতুন করে প্রেমে পড়ার সুযোগ দেওয়া হয়। বিশ্বাস করো, আমি আবারও তোমার প্রেমেই পড়তে চাইব। তোমাকেই বিয়ে করতে চাইব। আমাদের প্রেন্সিসের মতো আরেকটা প্রেন্সিসের বাবা হতে চাইব। ' তুমি শুধু আমার' --- এই ভাবনাটাই কত প্রশান্তির! তোমাকে ছাড়া যে আমি আমাকেই ভাবতে পারি না, তা কী তুমি জানো না? অযথা আমায় দোষারূপ করছ রোদপাখি।'
রোদ উত্তর দিল না। ততক্ষণে গাড়ির দরজা খোলা হয়ে গিয়েছে। শুভ্র রোদকে সীটে বসিয়ে দিয়ে সীট বেল্ট লাগাল। নিজে বসতে যাবে ঠিক তখনই নতুন এক জুড়ির আগমন ঘটল। ছোটখাটো একদম অল্প বয়স্কা একটি মেয়ে। ঢোলাঢালা জামায় ভারিক্কি ধরনের পেট দেখে বুঝা যাচ্ছে, মেয়েটি অন্তঃসত্ত্বা। একহাত নিজের কোমরে রেখে অন্যহাতটা পাশে হাঁটতে থাকা লোকটির হাতে। শুভ্রর হঠাৎ মনে পড়ল, রোদের প্রেগ্ন্যাসির সময় তার বয়সও অনেকটা এমনই ছিল। কেমন মিষ্টি লাগত তখন দেখতে। কথাটা ভেবেই মৃদু হাসল শুভ্র। পাশে থাকা লোকটি অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটির অভিমানে ভরা মুখটির দিকে চেয়ে বলল,
' কী আশ্চর্য! আমি তোমাকে মানা করিনি? এই অবস্থায় এতো জার্নি ঠিক নয় বলার পরও কেন শুনলে না? তোমার জেদেই তো আসতে হলো।'
মেয়েটি জ্বলন্ত চোখে চেয়ে বলল,
' আপনি আমায় বকছেন? শুরু থেকে শেষ সব দোষই আপনার। তবুও আমায় বকছেন?'
' আমার দোষ? আমি কী করলাম? তোমার পেট ব্যথা হলে আমি কী করতে পারি রিয়া? ডাক্তার তো দেখালাম। এভ্রিথিং ইজ ফাইন।'
রিয়া নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে বলল,
' ফাইন! কীসের ফাইন! আমার পেটে এখনও কেমন ব্যথা করছে জানেন? আপনার ওয়াইফ কত সাফার করছে অথচ আপনার চোখে কোনো দুঃখ নেই। 'ইট'স নরমাল' টাইপ বিহেভিয়ার। আসল কথা আপনি আমায় ভালোই বাসেন না। ভালোবাসলে টেনশন থাকতো। ভালোবাসা নেই বলে টেনশনও নেই। ছাড়ুন।'
সাহেল শুভ্রর দিকে একটু চেপে এসে চাপা কন্ঠে বলল,
' এটা বোধহয় বউদের ইন্টারন্যাশনাল অভিযোগ তাই না? নাকি কোনো পুরুষই তাদের বউকে ভালোবাসে না?'
শুভ্র গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে ছিল। সাহেলের কথাটা কানে যেতেই মাথা নেড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। বিরক্ত কন্ঠে বলল,
' কী হচ্ছে এসব সাহেল! টোটাল সার্কাস। এদের সরতে বলে গাড়িটা বের কর তো। বিরক্ত লাগছে।'
রোদ চোখ বোজে সিটে গা এলিয়ে আছে। শুভ্র ভেতরে উঁকি দিয়েই অস্থির হয়ে উঠল। রোদের এখন বিশ্রাম প্রয়োজন। শরীরটা খারাপ লাগছে নিশ্চয়? শুভ্র গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইল। দৃষ্টি ছটফটে। সাহেল দু'পা এগিয়ে গিয়ে বলল,
' এক্সকিউজ মি? ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড, আপনারা কী একটু সরে দাঁড়াবেন? আমাদের গাড়িটা বেরুতে পারছে না।'
সাহেলের কথায় দু'পক্ষই শান্ত চোখে তাকাল। ঝগড়া কিছুটা থেমেছে। শুভ্র অধৈর্য কন্ঠে ডাকল,
' তাড়াতাড়ি সাহেল।'
' ওহ। সরি, সরি। উই ডিডেন্ট নোটিশ। বাই দ্য ওয়ে, ইউ লুক সো ফ্যামিলার টু মি। কোথায় দেখেছি বলুন তো?'
পাশে সরে দাঁড়াতে দাঁড়াতে কথাগুলো বলল আয়ান। সাহেল আয়ানকে খেয়াল করে দেখল। মনে করার চেষ্টা করে বলল,
' আপনি?'
আয়ান হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
' আয়ান চৌধুরী। সাইকিয়াট্রিস্ট অব ক্যালিফোর্নিয়া হসপিটাল। আপনি কী ক্যালিফোর্নিয়ায় ছিলেন কখনও?'
সাহেল কয়েক সেকেন্ড ভেবে হঠাৎ হেসে ফেলে বলল,
' ডক্টর চৌধুরী! আপনার সাথে বোধহয় চেরি ব্লসম ফেস্টিভ্যালে দেখা হয়েছিল। আমি পিটারের সাথে ছিলাম। লুইস হেনরী পিটার? এন্ড ইউ অয়ার দ্য ডক্টর অব হিজ গ্রেন্ডমাদার? রাইট?'
আয়ান হাসল। তাদের পরিচয় পর্বের মাঝেই শুভ্রদের গাড়ি এসে দাঁড়াল পাশে। সাহেল কটেজের নাম বলে জিজ্ঞেস করল,
' আপনারা কোন কটেজে উঠেছেন?'
আয়ান উত্তেজিত হয়ে বলল,
' হোয়াট আ কো-ইন্সিডেন্ট! আমরাও সেই কটেজেই উঠেছি। কাল দেখা হলো না কী করে বলুন তো?'
শুভ্র জানালার কাঁচ নামিয়ে হেসে বলল,
' কারণ আমরা কাল থেকে হসপিটালের করিডোরে বসে আছি। আর আপনারা কটেজের বারান্দায়।'
আয়ানও হেসে ফেলল। সাহেল শুভ্রর সাথে ওদের পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর আয়ান ফাহিমদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। রোদ শুভ্রর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমোচ্ছে। তার ঘুমিয়ে পড়ার দ্রুততা অনেকটা অবিশ্বাস্য। যেখানে সেখানে ঘুমিয়ে পড়ার ক্ষমতা নিয়ে জন্মানো এক অদ্ভুত মেয়ে। তারওপর ঘুমের ঔষধের প্রভাব! শুভ্র এক হাতে খুব সাবধানে জড়িয়ে আছে তার শরীর। ফাহিম সেদিকে খেয়াল করে বলল,
' ফার্স্ট হানিমুনে এসেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন নাকি ভাবী? অসুস্থ হওয়ারই কথা। ঢাকা থেকে সিলেট কম দূর তো নয়। অনেক ধকল। মেয়েরা ধকল সহ্য করতে পারে কম।'
ফাহিমের ফোঁড়ন বুঝতে পেরে হাসল শুভ্র,
' ফার্স্ট হানিমুন? বলতে পারেন। তবে ফ্যামিলি হানিমুন বললে বোধহয় বেশি মানায়। প্রায় পুরো পরিবার চলে এসেছি হানিমুনে। হানিমুন আর হানিমুন নেই ফ্যামিলি গেট টুগেদার হয়ে গিয়েছে।'
শুভ্র এক নজর ঘড়ির দিকে চেয়ে বলল,
' একই কটেজে যেহেতু উঠেছি চলুন ফেরা যাক। কটেজে ফিরে আড্ডা দেওয়া যাবে। বাচ্চাকে ফেলে এসেছি তো তাই আপাতত ফেরার তাড়া।'
অদিতি অবাক হয়ে বলল,
' বাচ্চা!'
' কেন থাকতে পারে না?'
শুভ্র হাসল। অদিতি থতমত খেয়ে বলল,
' না। তা নয়। তা নয় আসলে....'
অদিতির কথা কেটে আয়ান বলল,
' তবে আপনারা এগুন। আমাদের গাড়ি পেছনেই আছে। আমরা বরং আপনাদের ফলো করছি।'
সাহেল গাড়িতে উঠে যেতেই শুভ্র বলল,
' বেশ! তাহলে কটেজে দেখা হচ্ছে। আজকের ডিনারটা কিন্তু আমাদের পক্ষ থেকে।'
আয়ান হেসে মাথা নাড়ল। ফাহিম বলল,
' লাঞ্চের দায়িত্বটা তাহলে আমাদের।'
গোধূলি বিকেল। কটেজের বাইরে, ফাঁকা জায়গায় মাদুর পেতে বসেছে সবাই। সন্ধ্যায় বার্বিকিউ আর গানের আসর বসবে তার প্রস্তুতি চলছে জোরেসোরে। আদ্র-রোদ্র একের পর এক চূড়ান্ত দুষ্টুমি করে চলেছে। শুকনো কাঠের পাশে থাকা কেরোসিনের বোতলে আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, জাস্ট সেইক অব এক্সপেরিমেন্ট। এক্সপেরিমেন্ট সফল হয়েছে, বেশ ভালোভাবে বিস্ফোরিত হয়েছে কেরোসিনের বোতল। সেই সাথে অগণিত মার পড়েছে পিঠে। মার খেয়ে পাঁচ-ছয় মিনিট যে নীরবতা পালন করেনি তা কিন্তু নয়। ভদ্র ছেলের মতো মিনিট দশেক শান্ত হয়ে বসে থেকেছে তারপর আবারও হৈ-হুল্লোড় করে নতুন কোনো আবিষ্কারে মনোনিবেশ করেছে। নিজের ছেলেদের এমন সব ইউনিক চিন্তা-ভাবনায় হতভম্ব হয়ে বসে আছে অভ্র। এই দুটোকে সামলাতে গিয়ে তার পুরো পৃথিবী ঘুরছে। এতো দুষ্ট! এতোটা দুষ্ট এরা হলো কী করে? শুভ্র হাসি হাসি মুখ নিয়ে বলল,
' এতো চিন্তা করে লাভ নেই বড় মিয়া। ছোটবেলা যত পাপ করেছিলে সেগুলোই রিপিট হিস্ট্রির মতো প্রকাশ পাচ্ছে। আচ্ছা? তোমাদের রোমাঞ্চের ব্যাপারটা কীভাবে চলে?সেখানে হিস্ট্রি রিপিট হয় না?'
অভ্র দুঃখী দুঃখী চোখে চাইল। শুভ্র দাঁত বের করে হাসল,
' দিজ ইজ কল্ড রিভেঞ্জ অব নেচার। আমার রোমাঞ্চে কম বাগড়া তো দাওনি। হে বিধাতা! সঠিক বিচার। থেংকিউ।'
' তোর মতো পাপী ছোটবেলায় কেউ ছিল বলে তো মনে হয় না। ঘুমের মাঝে মাথার চুল কামিয়ে দিয়েছিলি আমার, ফাজিল! তোর হিস্ট্রি রিপিট কবে হবে? জাতি দেখুক তোর পাপ সমূহ।'
সাহেল হেসে বলল,
' ওর হিস্ট্রিও তো তোমার ছেলেদের মাঝেই রিপিট হচ্ছে অভ্র ভাই। রোদ্রর টেম্পার একদম শুভ্রর মতো। সাবধান থাকো! কবে না হিস্ট্রি রিপিট হয়ে টাক্কু হয়ে যাও।'
সাহেলের কথায় হেসে উঠল সবাই। অভ্র গম্ভীর কন্ঠে বলল,
' শালিকা! এই অভদ্র পুরুষ থেকে সরে বসো। আমাকে এভাবে অপমান করার পরও আমার একমাত্র শালিকা হয়ে তার পাশ ঘেঁষে বসে থাকবে তা তো হয় না। বয়কট অভদ্র পুরুষ। সরে আসো!'
রোদ শুভ্রর পাশে বসেছিল। তার কোলে আত্মমগ্ন হয়ে বসে আছে শুভ্রতা। চকোলেটের প্যাকেটে ছোট্ট ছোট্ট হাতদুটো ভর্তি। শুভ্রতা নিজের মতো খেলছে, মাঝে মাঝে বড়দের মুখের দিকে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তাকাচ্ছে। অভ্রর কথায় উচ্ছল হাসল রোদ। কৃত্রিম গাম্ভীর্য নিয়ে শুভ্রর দিকে চেয়ে ডান ভ্রু উঁচু করল,
' এই অভদ্র পুরুষ? সরে যান।'
শুভ্র এবার আরও কাছে ঘেঁষে বসল। ডানহাতে রোদের কোমরের উপর রেখে বলল,
' কীসের শালিকা? শালিকা টালিকা ভুলে যাও। সে এখন আমার রাজ্যে। আমার রাজত্ব। এদিকে তাকাবে না। আমার রাজ্য মানেই মৃত্যু মহাশয়।'
শুভ্রর বাক ভঙ্গি দেখে হেসে ফেলল সবাই। শুভ্রতা সবাইকে হাসতে দেখে অবাক চোখে চাইল৷ পরমুহূর্তে, কিছু না বুঝেই খিলখিল করে হেসে উঠল। সাদাফ সাহেলের পাশে বসে ছিল। মোবাইল গেইম থেকে চোখ সরিয়ে সবার দিকে এক নজর চেয়ে নিয়ে আবারও গম্ভীর মুখে মোবাইলের দিকে তাকাল। অদিতি হাস্যোজ্জল কন্ঠে বলল,
' আপনারা তো খুব মজার মানুষ।'
আয়ান ফোঁড়ন কেটে বলল,
' সবাই তো তোমার মতো ঝগড়ুটে নয়, মিস ঝগড়ুটে। এই পৃথিবীতে ভদ্র, নম্র, মিষ্টি মেয়েও আছে। এজ লাইক আমাদের রোদ ভাবী। নাবিলা ভাবী এজ ওয়েল।'
অদিতি রাগী চোখে চাইল। দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
' সেইম হেয়ার, মিষ্টার পাগলের ডাক্তার। সবাই আপনার মতো পাগল আর ফ্লার্টিং মাস্টার নয়। এই পৃথিবীতে ভদ্র, নম্র, ওয়েল বিহেভড ছেলেও আছে। এজ লাইক আমাদের অভ্র ভাইয়া।'
অভ্র আপ্লুত হয়ে বলল,
' ওহ থেংকিউ থেংকিউ। থেংক্স ফর কমপ্লিমেন্ট ইয়ং লেডি।'
অভ্রর কথার ভঙ্গিতে আবারও হাসির হুল্লোড় পড়ল। রিয়া সাদাফকে বেশ খেয়াল করে বলল,
' আপনার ছেলেটা খুব শান্ত সাহেল সাহেব। দেখে মনে হয় বয়সের তুলনায় ম্যাচিউরড। আমার মেয়ে হলে আপনার ছেলেকে পাত্র হিসেবে মনোনয়ন করব।'
সাহেল মাথা নেড়ে বলল,
' তা তো হচ্ছে না ছোট আপু। ছেলের পাত্রী ঠিক করে ফেলেছি। এতো সহজে বন্ধুর পেছন ছাড়ছি না। মেয়ে তাকে দিতেই হবে। সাদাফ? বড় হয়ে শুভ্রতাকে বিয়ে করবি বুঝেছিস? বাপে না মানলে নিয়ে পালিয়ে যাবি।'
আবারও হেসে উঠল সবাই৷ সাদাফ এবার মুখ তুলে চাইল। মায়ের দিকে প্রশ্ন ছুড়ল,
' বিয়ে কী?'
নাবিলা কয়েক সেকেন্ড ভেবে বলল,
' বিয়ে মানে ফ্রেন্ডশিপ। বিয়ে করলে সবচেয়ে ভালো ফ্রেন্ড হওয়া যায়। তোমার বাবা যেমন আমার পাশে থাকে। আমাকে হ্যাপি রাখে। আমিও চেষ্টা করি। ঠিক তেমন। একসাথে থেকে একসাথে হ্যাপি থাকাই হলো বিয়ে।'
সাদাফ মনোযোগ দিয়ে শুনল। তারপর শুভ্রতার দিকে এক নজর তাকিয়ে বলল,
' আমি বিয়ে করব না।'
সাহেল অবাক হয়ে বলল,
' কেন? বিয়ে করতে কী সমস্যা?'
' মেয়েটা এতো কাঁদে কেন? কাঁদলে হ্যাপি থাকবে কীভাবে?'
সাদাফের উত্তর কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে হাসল সবাই। নাবিলা ছেলেকে কাছে টেনে বলল,
' এভাবে বলছ কেন? সে যদি কাঁদে, তুমি অবশ্যই এমন কিছু করবে যেন সে আর না কাঁদে৷'
সাদাফ গম্ভীর মুখে মাথা নাড়ল। অর্থাৎ, বিয়ে সে করবে না। এমন সময় শিশিরের সাথে চিত্রা এসে পৌঁছাল। শিশিরের সাথে একরকম যুদ্ধ করে কালকের গাড়িতে এখানে এসে পৌঁছেছে সে। সবাই মজা করবে, পিকনিক করবে আর সে থাকবে না?অসম্ভব। রোদের পাশে নির্দিষ্ট জায়গায় বসতেই সাহেল কথা ছুঁড়ল,
' আরে সুন্দরী! তুমি তো দেখি পিছুই ছাড়ছ না? খাবারের কথা শুনেই ছুটে চলে এসেছ। আহা, বেচারা শিশির ভাই! পেটুক স্ত্রীর যন্ত্রণায় কাহিল!'
চিত্রা অগ্নিমূর্তি নিয়ে বলল,
' আপনি সবসময় আমার পেছনে কেন লাগেন সাহেল ভাই? আপনার ভাগের খাবার তো খেয়ে নিচ্ছি না।'
' যদি নাও তখন?'
চিত্রা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
' শুভ্র ভাইয়ার উচিত ছিল হাড়ের ডাক্তারকে না মেরে আপনাকে দোলায় দেওয়া। আমি উনাকে বলেছিলামও। কিন্তু উনি আমার কথা শুনলেন না। শুনলেন ভুট্টো সাহেবের কথা।'
' শিশির ভাইয়েরও উচিত ছিল তোমাকে বিয়ে না করে মানসিকভাবে সুস্থ, খাই খাই না করা টাইপ মেয়ে বিয়ে করে সংসার করা। ঠকে গিয়েছে বেচারা! আমিও উনাকে সাবধান করেছিলাম। কিন্তু উনি আমার কথা শুনলেন না। শুনলেন চিত্রা জননীর কথা।'
চিত্রা মুখ ফুলিয়ে বলল,
' মানসিকভাবে সুস্থ মানে কী? আমি মানসিকভাবে সুস্থ নই? আপনি আমায় পাগল বললেন?'
সাহেল আকাশ থেকে পড়ার ভান করে বলল,
' আমি! কখন? তুমি নিজেই না বললে? আচ্ছা যাও, আমরা মেনে নিলাম তুমি পাগল।'
এবারে সবাই হেসে ফেলল। চিত্রা কাঁদো কাঁদো কন্ঠে চেঁচাল,
' নাবিলা আপু!'
ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমেছে। আকাশের কপাল অলংকৃত করেছে বিশাল এক রূপালী চাঁদ। কী মায়াময় তার আলো! জমিয়ে রাখা শুকনো কাঠে আগুন ধরানো হলো। আগুনের রক্তিম আলো আর জ্যোৎস্না মিলেমিশে মোহময় হয়ে উঠল চারপাশ। হঠাৎ থেমে গেল সকল কোলাহল। নিশ্চুপ কল্পনার মতোই স্নিগ্ধ হয়ে গেল সকলের মুখ। ভালোবাসার মানুষগুলোর হাতে হাত পড়ল। লাজুক চাঁদটা এক টুকরো মেঘে মুখ ঢাকতেই কপালে গাঢ় এক স্পর্শ অনুভব করল রোদ। ফিসফিস কন্ঠে বসে এলো একটিই শব্দ, 'ভালোবাসি।' ঠিক একই শব্দ উচ্চারিত হলো আরও কিছু প্রেমীযুগলের ঠোঁটে। খুব গোপনে তারা অনুভব করল হৃদয় ভেজানো কোমল স্পর্শ। লাজুক চাঁদ ঘোমটা তুলল। মোহময় লঘ্নে সম্পন্ন হলো, প্রিয়দের কাল্পনিক সাক্ষাৎ!
.
.
.
সমাপ্ত......................................................................