মেঘফুল - পর্ব ২৩ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিলো জাহ্নবী। নিজের জীবনের অদ্ভুত পরিবর্তন ওকে অবাক করছে। যে মানুষটা নিজের ঘর থেকে বের হয়ে পরিবারের সঙ্গে অনায়াসে মিশতে সংকোচ করত, সেই মানুষটাই এখন পরিবারের সবার মধ্যমণি! পারভীনের প্রত্যেকটা ফোনকল ওকে আনন্দ দেয়। গতকাল থেকে বেশ কয়েকবার ফোন করেছেন তিনি। শেষ ফোনকলে জাহ্নবীকে বাসায় যেতে বলেছেন। জাহ্নবী অবশ্যই যাবে। আজকে শরীরটা বড্ড ক্লান্ত। কাজের চাপ ছিল অনেক। আগামীকাল সে যাবে ওই বাড়িতে। পারভীনকে জড়িয়ে ধরে মায়ের চিরচেনা ঘ্রাণ অনুভব করবে। 

ঘর অন্ধকার করে জানালা খুলে রাখলে বাইরে থেকে আলোকচ্ছটা ঘরে এসে পুরো ঘরের সৌন্দর্য বদলে দেয়। দেয়ালে আলোছায়ার অদ্ভুত খেলা দেখে জাহ্নবী অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। সেদিন 'পান্নাবাহার'কে দেখার পর সারা রাত অস্থির লেগেছে তার। আগে কখনো এমন হয়নি। আর হবেই বা কী করে! জাহ্নবী জীবনের বেশিরভাগ সময় এসব প্রেমানুভূতিকে অপছন্দ করে এসেছে। কারও প্রেমের প্রস্তাবকে মুখের ওপর 'না' বলে দিয়েছে। আঠাশ বছরের পূর্বে কখনো পুরুষ মানুষের প্রতি কোনোরকম আকর্ষণ অনুভব করেনি সে। ধীরেধীরে বয়স যতই বাড়তে লাগল, একাকীত্ব গ্রাস করল তাকে। একটা সময়ে এসে মনে হল, জীবনে নিজের একটা মানুষ বড্ড প্রয়োজন। যে তাকে বুঝবে, ভালোবাসবে। মানুষটা হবে একান্তই তার। এই ভাবনা ধীরেধীরে জাহ্নবীকে প্রেমের প্রতি দুর্বল করে তুলেছে। গত কয়েকটা মাস সে প্রেমে পড়ার জন্য ব্যকুল হয়ে আছে। এই ছেলেটাও হয়তো সেরকমই একটা অনুভূতি বৈ আর কিছুই না। কিন্তু জাহ্নবী 'পান্নাবাহার'কে যতবারই ভোলার চেষ্টা করেছে, প্রত্যেকবারই তার মনে হচ্ছে, 'এ অনুভূতি সবার চাইতে আলাদা।'

জাহ্নবী বেলকনিতে এসে দাঁড়াল। গত দুদিন সে একটিবারও ওই চায়ের দোকানের দিকে তাকায় নি। সে বুঝতে চেষ্টা করছে, এটা প্রেম নাকি শুধুই আবেগ। আজ বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সে নিজেকে বলল, 'আমি ওই দোকানের দিকে তাকাবো না।' 

রাস্তা প্রায় ফাঁকা। দু একটা রিকশা মাঝেমাঝে হর্ন বাজিয়ে চলে যাচ্ছে। জাহ্নবী ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ঢাকা শহরটাকে দেখছে। রাস্তাঘাট, ফুটপাত, বড় বড় বিল্ডিং। দূরে দেখা যাচ্ছে একটা দোকান। ওপরে একটা সাইনবোর্ডে জ্বলজ্বল করছে, 'when tea meet toast'. 
জাহ্নবী একটা নিশ্বাস ফেলে দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। তার গাছগুলো বড় হচ্ছে। জাহ্নবী গাছে হাত বুলিয়ে বলল, 'তোরা কী অনুভব করিস? তোদেরও কি অদ্ভুত অদ্ভুত ব্যথা হয়? আবেগ আছে তোদের?'
জাহ্নবীর মনে হলো গাছ ওর সঙ্গে কথা বলছে। একটা বেবিটিয়ার্সের চারা বেলকনির গ্রিলে ঝুলিয়ে রেখেছে সে। দ্রুত বাড়ছে সেটা। বড্ড আদর করতে ইচ্ছে করে গাছটাকে। জাহ্নবী বলল, 'তুই সবসময় এত হাসিখুশি থাকিস কেন রে?'
ওর মনে হলো, গাছ উত্তর দিচ্ছে, 'কারণ আমার কোনো দুঃখ নাই।'
জাহ্নবী হো হো করে হেসে উঠে আপন মনে বলল, 'আমারও কোনো দুঃখ নাই। আমার একটাই দুঃখ ছিল, বিয়ে হচ্ছে না। এটা আবার কোনো দুঃখ হল? বিয়ে না হলে কী আমার ফাঁসি হবে? হবে না। তাহলে আমিও তোর মত হাসিখুশি মানুষ। হা হা হা।'

জাহ্নবী জোরে জোরে হাসছে। ঘরের দরজা বন্ধ। তার হাসির শব্দ এই ঘরের বাইরে যাবে না। জাহ্নবী আবছা অন্ধকার ঘরে এসে ফ্যান চালিয়ে দিলো। শিরশির করে বাতাস লাগছে গায়। তার খুব উড়তে মন চাইছে। সুখের বাতাসে গা ভাসিয়ে। 
জাহ্নবী হেডফোন কানে গুঁজে গান ছেড়ে দিলো। গান শুনতে শুনতে মনে হল বাতাসে ভাসছে সে। সুখের বাতাসে ভেসে যাচ্ছে। 
'তোমাকে জানিনা প্রিয়, জানো না তুমি আমায়...'
গানটা ভীষণ প্রিয় হয়ে উঠেছে জাহ্নবীর। গত তিনদিনে সাতাশ বার গানটা শুনেছে সে। গানটা প্রায় মুখস্থই হয়ে গেছে তার। আজকে সে গুণগুণ করে গানও গাইল। 

খাবার টেবিলে পিনপতন নীরবতা। মাঝেমাঝে গ্লাস ও জগের টুংটাং আওয়াজ আর খাবার চিবানোর চাপুতচুপুত শব্দ। বলার মতো কথা কেউই খুঁজে পাচ্ছে না হয়ত।
পারভীন নীরবতা ভাঙলেন। ভায়োলেটকে শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলেন, 'সেদিনের ওই ছেলেটা কে সেটা জানার ইচ্ছা নাই আমার। ওর সঙ্গে আর যোগাযোগ করবি না।'
'আচ্ছা মা। ও আমার ক্লাসমেট। এর বাইরে কিছুই না।'
'আমরাও সেটাই মনে করি। এরকম ছেলেদের আমাদের পছন্দ না।'

সামার দুষ্টুমি করে বলল, 'চুল দাড়ি কেটে আসলে পছন্দ হবে?'
পারভীন কটমট করে তাকালেন সামারের দিকে। দুষ্টুমি হাসি সামারের চেহারায়। সে ঠোঁট টিপে হাসছে। 
বলল, 'না মানে অর্ণব ভাইয়াকে প্রথম প্রথম তোমার ভালো লাগেনি। এখন তো ভালো খাবার রান্না হলেই অর্ণবকে ডাকো, অর্ণবকে ফোন দাও। তাই বলছিলাম। চুল দাড়ি কেটে এলেই হবে?'
সামার হেসে উঠল কথাটা বলেই। জাভেদ আলী ইশারায় সামারকে চুপ করতে বললেন। পারভীন খুব অল্পতেই রেগে যান। কিন্তু আজকে তিনি রাগলেন না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, 'জাহ্নবী কাল আসবে। তোমরা সবাই মিলে মেয়েটাকে ভালো করে বুঝাও। যেন বিয়েতে অমত না করে।'
ভায়োলেট নিঃশব্দে খাবার খেয়ে উঠে পড়ল। এসব বিষয় নিয়ে বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই তার। প্রত্যেকের জীবনটা তার নিজের, নিজের মতোই গোছাতে দেয়া উচিৎ। 

অফিস শেষ করেই জাহ্নবী আজ বাসায় এলো। পারভীন জাহ্নবীকে জড়িয়ে ধরলেন। দীর্ঘসময় পর এতটা আন্তরিকতা নিয়ে জাহ্নবীকে খাওয়ালেন তিনি। আদর স্নেহে ভরিয়ে দিলেন বড় মেয়েকে। তারপর নরম গলায় বললেন, 'মা জাহ্নবী, মোস্তফা কামাল ছেলেটা ভালো।'
জাহ্নবী মুহুর্তেই বুঝে ফেলল নিশ্চয়ই আবারও বিয়ের সম্বন্ধটা এগিয়েছে। সে জানতে চাইলো, 'ভায়োলেটের সঙ্গে ওনার বিয়ে দিচ্ছো?'
'না। উনি তোকেই বিয়ে করতে চাচ্ছে।'

জাহ্নবী চমকে উঠলো। কয়েকদিন আগেও কথাটা শুনে নিশ্চয়ই খুশি হওয়ার মতো অবস্থায় ছিল সে। কিন্তু আজকে সে খুশি হতে পারল না। ভালো লাগছে না লোকটাকে। মনে হচ্ছে আর যাই হোক, ওনাকে সে বিয়ে করতে পারবে না।
জাহ্নবী মায়ের মুখের ওপর কিছু বলতে পারল না। নিঃশব্দে বসে রইল। পারভীন আশাবাদী হলেন। জাহ্নবী শেষ পর্যন্ত বিয়েটা করবেই, এটা নিশ্চিত তিনি। ওনার আনন্দ হচ্ছে এখন। 

জাহ্নবী দ্বিধাগ্রস্ত অবস্থায় বাসায় ফিরল। মনের শান্তি নষ্ট হয়েছে তার। কঠিন সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে সে। মা বলেছেন দ্রুত মোস্তফা কামালকে সিদ্ধান্ত জানাতে হবে। ওনারা স্বপরিবারে জাহ্নবীকে দেখতে আসবেন। কী করবে জাহ্নবী?

জাহ্নবী এক মগ কফি নিয়ে এসে বারান্দায় বসল। অদূরে 'when tea meet toast' দোকানটির দিকে তাকিয়ে মনেমনে ভাবল, 'ওই পান্নাবাহার একটা মরিচীকা। তাকে একদিন দেখেছি মাত্র। আর কখনো দেখা হবে না। দেখা হলেও দেখা যাবে সে বিবাহিত। পঁয়ত্রিশ ছত্রিশ বছর বয়সে কেউ অবিবাহিত থাকে না। লোকটার কথা ভাবা বন্ধ করা উচিৎ আমার।' 

কফির মগে চুমুক দিলো জাহ্নবী। পান্নাবাহারকে নিছক কল্পনা ভেবে ভুলে যেতে পারবে হয়তো। কিন্তু মোস্তফা কামালকে এইমুহুর্তে তার বিয়ে করতে একদমই ইচ্ছে করছে না। তবুও কী বিয়ে করতে হবে তাকে? এদেশের বেশিরভাগ মেয়েই তো ইচ্ছের বাইরে গিয়েই বিয়ে করে। সবাই তো সুখে সংসার করছে৷ সেও নিশ্চয় পারবে। জোরপূর্বক মনকে একজনের দিকে টেনে এনে বেঁধে রাখাটাই তো মেয়েদের জীবন!

মোস্তফা কামালের পরিবার যেদিন জাহ্নবীকে দেখতে এলো, সেদিন বাড়ি জুরে আনন্দের বন্যা। অর্ণব এসেছে, বড় মামা, মামী এসেছেন। দাদু এসেছেন গ্রাম থেকে। কুমিল্লা থেকে এসেছেন দোলন চাচা। সবাইকে দেখে মনে হচ্ছে আজকেই বিয়ে পড়িয়ে দিয়ে হাফ ছেড়ে বাঁচতে চান তারা। জাহ্নবী শাড়ি পরেছে আজ। ভায়োলেট নিজ হাতে তাকে সাজিয়ে দিয়েছে। 

মোস্তফা কামালের দুলাভাই বললেন, 'মেয়ে আমাদের পছন্দ হয়েছে। আমাদের কোনো দাবী দাওয়া নাই। বিয়ে আপনারা কোন ক্লাবে করবেন নাকি ঘরোয়া ভাবে করবেন সেটা নিয়েও আমাদের চিন্তা নাই। তবে বিয়ের পর মেয়েকে কুমিল্লায় গিয়ে থাকতে হবে। শাশুড়ীর দেখাশোনা করতে হবে। উনি একলা মানুষ। ওনাকে দেখাশোনার জন্যই বিয়েটা দেয়া।'

জাহ্নবী মাথা নিচু করে রাখল। সে জানে তার আত্মীয় স্বজন সকলেই এতে রাজী হয়ে যাবে। চাকরি ছেড়ে দিয়ে সংসার করাটাই সবার মতামত হবে। তার একমাত্র আশার কারণ ভায়োলেট। কেবল ভায়োলেটই এই পরিস্থিতিতে তাকে আশার আলো দেখাবে। কিন্তু ভায়োলেট বাসায় নেই!

মোস্তফা কামাল তাকিয়ে আছেন জাহ্নবীর দিকে। সামান্য ভ্রু কুঁচকানো ওনার। খুব সম্ভবত মেয়ের বয়স নিয়ে চিন্তিত তিনি। তবুও মনকে বুঝাতে চাইছেন, বয়স বেশী হওয়াটা কোনো ব্যাপার না। দুলাভাই গ্রামে বেশ কয়েকটা মেয়ে দেখেছে। সবাই অল্পবয়সী, সুন্দরী তরুণী। তারা মোস্তফাকে পছন্দ করেছে বলে বিয়ে করবে না, বিয়ে করবে মোস্তফার টাকার কারণে। এ কারণে সেসব মেয়েগুলোকে মোস্তফার বিয়ে করার ইচ্ছে নেই। তাদেরকে গ্রামে রেখে গেলে যদি পরকীয়া করে? এই দুশ্চিন্তা নিতেই পারবে না সে। জাহ্নবীকে দেখে তার অন্যরকম একটা মেয়ে মনে হয়েছে। এ ধরনের মেয়েরা স্ত্রী হিসেবে অত্যন্ত লক্ষী হয়। আদর্শ স্ত্রী হয়। এখন তার একমাত্র দুঃখ জাহ্নবীর বয়স বেশী। 

বিয়ের কথাবার্তা একরকম পাকা হয়েই যাচ্ছে। জাহ্নবী অবস্থা বেগতিক দেখে ভায়োলেটকে ফোন দিলো। ফোনে দুবার রিং হলেও কল রিসিভ হল না। চিন্তা হচ্ছে জাহ্নবীর। তাকে কী অবশেষে চাকরিটা ছাড়তেই হবে! কুমিল্লায় গিয়ে বাধ্য স্ত্রী হয়ে সংসার করতে হবে? কিন্তু জাহ্নবী এখন তার বর্তমান জীবন নিয়েই সুখী। তার এখন মোটেও বাধ্যগত স্ত্রী হতে ইচ্ছে করছে না। আরও কিছুদিন এভাবে একা থাকতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু উপায় নেই। সেদিন জাহ্নবী নিজ মুখেই বাবা মাকে বলেছে পাত্র দেখতে। এখন নিজেই 'না' বলার দুঃসাহস করলে বাবা মা কষ্ট পাবেন। 
.
.
.
চলবে........................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp