বর্ষণের সেই রাতে - পর্ব ৬৩ - সিজন ২ - অনিমা কোতয়াল - ধারাবাহিক গল্প


অনিমা রুমে দাঁড়িয়ে পায়চারী করছে আর বারবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। আদ্রিয়ান এখোনো আসছেনা কেন? রিকেরই বা কী হয়েছে? হঠাৎ এতোদিন পর আবার ড্রিংক করল কেন? এসবই ভেবে চলেছে। রিকের অনুভূতি অনিমার জানা থাকলেও সেই অনুভূতির গভীরতা অনিমার জানা নেই। রিক সেভাবে কোনদিন প্রকাশই করেনি ওর সামনে। আদ্রিয়ান অনেকটা অন্যমনস্ক হয়ে ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে নিজের রুমে এসে ঢুকলো। চোখে রয়েছে একরাশ বিষন্নতা। অনিমা হালকা চমকে উঠল। একটু দ্রুত পদে আদ্রিয়ানের সামনে গিয়ে বলল,

" আপনি এসে গেছেন?"

আদ্রিয়ান রিকের বলা কথাগুলো গভীরভাবে ভাবছিল। অনিমার ডাকে ও ভাবনা থেকে বেড়িয়ে এলো। কোনরকম ইতস্তত করে বলল,

" হুম?"

" রিক__"

এইটুকু বলে অনিমা থেমে গেল। ঠিক কী জিজ্ঞেস করবে বুঝে উঠতে পারছেনা। তাই ইতস্তত বোধ করছে শুধু। আদ্রিয়ান পাশ কাটিয়ে বিছানায় গিয়ে বসল। এরপর অনিমার দিকে না তাকিয়েই বলল,

" ও ঠিক আছে এখন‍, ঘুমাচ্ছে।"

অনিমা আদ্রিয়ানের পাশে বসে কিছুটা অবাক কন্ঠে প্রশ্ন করল,

" ও হঠাৎ করে এভাবে ড্রিংক কেন করল?"

আদ্রিয়ান বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,

" ও এখনো তোমাকে ভুলতে পারেনি অনি। আজও পাগলের মত ভালোবাসে ও তোমাকে। আমাদের একসাথে দেখলে ওর খুব কষ্ট হয়। এতোদিন কষ্টটাকে বুকে চেপে রেখে দিয়েছিল। কিন্তু আজকে আর পারেনি। ওও তো একটা মানুষ, সহ্যের একটা সীমা আছেতো।"

অনিমা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আদ্রিয়ানের দিকে। এরকমটা ও মোটেই আশা করেনি। ও ভেবেছিল রিক সব মেনে নিয়েছে। হ্যাঁ হয়তো খানিকটা কষ্ট হচ্ছে কিন্তু ধীরে ধীরে সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু সেটা এতোটা? এতোগুলো মাস কেটে যাওয়ার পরেও? আদ্রিয়ান কম্পিত কন্ঠে বলল,

" মাঝেমাঝে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হয় জানো? আমার ভাই এতোটা কষ্টে আছে শুধুমাত্র আমার জন্যে। এভাবে ভেতরে থেকে গুমরে গুমরে মরছে। এসব কিছুর জন্যে শুধুমাত্র আমিই দায়ী। কী করব বল? তোমাকে ছাড়ার ক্ষমতা তো আমার ছিলোনা। আর না এখন আছে। এক্ষেত্রে আমি বড্ড বেশি স্বার্থপর। যদি আমি তোমাকে ভালো না বাসতাম। বা আগেই সবটা জেনে যেতাম। তাহলে হয়তো__"

অনিমা এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে শুনছিল আদ্রিয়ানের কথাগুলো। চোখ ছলছল করে উঠছিল ওর। নিজেকে সামলে অনিমা শক্ত কন্ঠে বলল,

" তাহলে? বাসতেন না আমায় ভালো? তুলে দিতেন নিজের ভাইয়ের হাতে?"

কিছুক্ষণের জন্যে হলেও আদ্রিয়ান চিন্তা করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলল। দুহাতে মুখ চেপে ধরে একটা শ্বাস ফেলে বলল,

" আমি জানিনা।"

আদ্রিয়ানের উত্তরটা শুনে অনিমা প্রচন্ড রেগে গেল। ওকে কী মনে করে আদ্রিয়ান? ও এতোই সস্তা? মন চাইলেই কারো হাতে তুলে দিতো? ওর ইচ্ছে অনিচ্ছের কোন দাম নেই? অনিমা চোখ মুছে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,

" ও, তারমানে আপনার এখন আফসোস হচ্ছে আমায় ভালোবেসেছেন বলে? বিয়ে করেছেন বলে? খুব পস্তাচ্ছেন বুঝি?"

আদ্রিয়ান মুখ থেকে হাত সরিয়ে অনিমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে অনিমাকে ছুঁতে নিয়ে বলল,

" অনিমা তুমি ভুল__"

অনিমা কথাটা শেষ করার আগেই দূরে সরে গিয়ে বলল,

" ছোঁবেন না আপনি আমায়। আমার বোঝা হয়ে গেছে। আফসোস হচ্ছেতো আমায় ভালোবেসে নিজের বউ করেছেন বলে? ঠিক আছে। চলে যাবো আমি। কালকেই চলে যাবো আব্বুর কাছে। তখন আর আপনার আফসোস থাকবেনা।"

বলে অনিমা উঠে ওয়াসরুমে চলে গেলো।আদ্রিয়ানের ভেতরটা হঠাৎ করে কেমন কেঁপে উঠল। অনিমাকে ছাড়া তো ও ওর জীবন কল্পনাও করতে পারে না। রিকের কষ্ট দেখে মানসিক চাপে পরে কী সব বলছিল ও? যেকোন মেয়ের জন্যেই এটা অপমানের। আর এটাতো অনিমা। মেয়েটাকে অযথাই কষ্ট দিয়ে ফেলল। নিজের ওপরই রেগে গিয়ে বেডে ভীষণ জোরে একটা ঘুষি মারল।

প্রায় দশমিনিট পর অনিমা ওয়াসরুম থেকে বের হল। অনিমার বের হওয়ার আওয়াজ পেয়ে আদ্রিয়ান চোখ তুলে তাকালো অনিমার দিকে। তবে অনিমা তাকালো না আদ্রিয়ানের দিকে। কিন্তু দেখেই বোঝা যাচ্ছে ওয়াসরুমে গিয়ে কান্নাকাটি করেছে। চোখ হালকা লালচে হয়ে আছে। শ্যামবর্ণ হওয়া সত্ত্বেও নাক আর গালে লালচে আভা ফুটে উঠেছে। আদ্রিয়ানের ভেতরে অপরাধবোধ কাজ করছে। কী দিয়ে অনিমার সাথে কথা বলা শুরু করবে সেটাই বুঝে উঠতে পারছেনা। অনিমা একটা বালিশ নিয়ে সোজা সোফায় গিয়ে গুটিশুটি মেরে শুয়ে পড়ল। আদ্রিয়ান কিছুক্ষণ বোকার মতো তাকিয়ে অনিমার কার্যকলাপ দেখছিল। ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই ওর ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল। ছোট ছোট চোখে অনিমার দিকে তাকিয়ে থেকে এগিয়ে গেলো সোফার কাছে। এরপর বলল,

" এখানে এসে শুলে কেনো?"

অনিমা কোনরকম উত্তরই দিলোনা। আদ্রিয়ান হাঁটু ভেঙ্গে ফ্লোরে বসে অনিমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, 

" আ'ম সরি, জানপাখি। আসলে তখন কী হয়েছিল নিজেই জানিনা। বলে ফেলেছি।"

কিন্তু অনিমা তবুও কিছু বলল না। আদ্রিয়ান এবার কানে হাত দিয়ে বলল,

" এই দেখ, কান ধরেছি।"

অনিমা এমন ভাব করছে যেন কিছু শুনতেই পায়নি ও। আদ্রিয়ান বুঝতে পারল যে অনিমা এভাবে উত্তর দেবেনা। যা করার ওকে ওর মতো করেই করতে হবে। তাই অনিমাকে সোজা কোলে তুলে নিলো আদ্রিয়ান। অনিমা প্রথমে হকচকিয়ে গেলেও পরে বিরক্তিকর দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আদ্রিয়ানের দিকে। আদ্রিয়ান সেদিকে পাত্তা না দিয়ে অনিমাকে নিয়ে বেডে শুইয়ে দিল। অনিমা উঠে পরতে নিলেই দুহাত দিয়ে ওকে বিছানার সাথে চেপে ধরে নিজেও শুয়ে পরল। এরপর অনিমাকে নিজের সাথে শক্ত করে চেপে ধরে বলল,

" বিশ্বাস করো, আমি ওভাবে বলতে চাইনি। জানিনা তখন কী হয়ে গেছিল। প্লিজ ফরগেট দিস। আ'ম সরি।"

অনিমা ইতিমধ্যে আদ্রিয়ানের কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্যে ছটফট করে চলেছে। কিন্তু আদ্রিয়ানের শক্তির সাথে কিছুতেই পেরে উঠছে না। আদ্রিয়ান এতো করে বোঝাতে চাইছে যে ওর ভুল হয়ে গেছে। ও এভাবে বলতে চায়নি। কিন্তু অনিমা কোন কথাই কানে নিচ্ছেনা। ও ওর মতো করে ছটফট করে চলেছে ছাড়া পাওয়ার জন্যে। একপর্যায়ে আদ্রিয়ান ধমক দিয়ে বলল,

" এই মেয়ে! বলছিতো ভুল হয়ে গেছে। এমন করছো কেন? সরি বলছিতো। কান ধরেছি। এবার কী পায়ে পড়ব? এরকম আর কখনও বলব না, বলেছিতো! তখন কী হয়েছিল নিজেই জানিনা।"

অনিমা এবার অভিমানী কন্ঠে বলল,

" ঘোরের মাঝে মানুষ মনের কথাই বলে। আপনিও বলে দিয়েছেন। চিন্তা করবেন না আপনার গিল্টনেস বাড়াবোনা আমি। তবে এটা ভাববেন না যে আমি আপনার ভাইয়ের সাথে কোন সম্পর্কে জড়াবো। সেটা সম্ভব নয়। আমি পারবোনা অন্যকাউ__"

অনিমা আর কিছু বলতে পারলনা। কারণ আদ্রিয়ান পরম যত্নে নিজের দখলে নিয়ে নিয়েছে ওর ঠোঁটজোড়া। অনিমা সাথেসাথেই একদম স্হির শান্ত হয়ে গেল। আদ্রিয়ান জানতো এটাই হবে। অনিমাকে শান্ত করার এখন এটাই একমাত্র উপায় ছিল। কিছুক্ষণ পর অনিমাকে ছেড়ে দিয়ে ওর কপালে কপাল ঠেকিয়ে জোরে জোরে কয়েকটা শ্বাস নিয়ে বলল,

" আজ বলেছো বলেছো। ভবিষ্যতে আর কোনদিন এই ধরণের কথা বলবেনা। তোমার কী মনে হয় তুমি চাইলেই আমি অন্যকারো হতে দেব তোমাকে? প্রয়োজনে তোমাকে খুন করে এরপর নিজেকেও শেষ করে দেব। কিন্তু তোমাকে অন্যকারো হতে দেখতে পারব না আমি। কোনদিন না।"

অনিমা এবার আদ্রিয়ানের বুকে মুখ গুজে ফুপিয়ে কেঁদে দিল। আদ্রিয়ানের ভেতরটা কেঁপে উঠল অনিমার কান্নায়। ও অস্হির কন্ঠে বলল,

" জানপাখি প্লিজ কেঁদোনা। সরি বলেছিতো আমি। প্লিজ!"

অনিমা ফুপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল,

" প্লিজ আমায় ছেড়ে দেবেন না কখনও। আমি পারব না আপনাকে ছাড়া থাকতে। আমি জানিনা কে আমাকে ভালোবাসে। আমি জানতেও চাইনা। আমি শুধু জানি আমি ভালোবাসি আপনাকে। নিজের চেয়েও বেশি ভালোবাসি। আপনিই আমার প্রথম আর শেষ ভালোবাসা। রিকের সাথে একই বাড়িতে একটা বছর থেকেও, এতোটা সময় একসাথে কাটিয়েও ওকে বন্ধু ছাড়া অন্যকিছু ভাবতে পারিনি আমি। কিন্তু ক্ষনিকের আলাপেই ভালোবেসে ফেলেছিলাম আপনাকে। আপনাকে ভুলে যেতে পারবনা আমি। আপনি প্লিজ কোনদিন আমায় ছেড়ে দেবেন না। যাই হয়ে যাক না কেন। পরিস্থিতি যতই বদলাক না কেন। প্রয়োজনে আপনি আমায় জোর করে আটকে রাখবেন, নিজের অধিকারে আটকে রাখবেন। নিজের বুকে আগলে রাখবেন কিন্তু আমায় ছেড়ে দেওয়ার কথা ভাববেনও না। আর না আমায় ছাড়তে দেবেন। কথা দিন?"

অনিমার কথাগুলো এতক্ষণ বেশ মনোযোগ দিয়ে শুনছিল আদ্রিয়ান। চোখের কোণ হালকা ভিজে এসছিলো ওর। কিন্তু দ্রুতই নিজেকে সামলে নিয়ে অনিমাকে শক্ত করে নিজের সাথে জড়িয়ে নিয়ে বলল,

" কথা দিলাম। যত যাই হয়ে যাক না কেন। যদি সমস্ত পৃথিবীর সাথেও লড়তে হয়, লড়ব। কিন্তু তোমাকে ছাড়ার কথা ভাববোও না। তোমাকে সারাজীবন এভাবেই বুকে আগলে রাখব।"

আদ্রিয়ানের কথা শুনে অনিমার মন শান্ত হল। ওতো শুধু এটুকুই চায়। আদ্রিয়ান ওকে এভাবেই বুকে আগলে রাখুক। শেষ নিশ্বাসও যেন ও আদ্রিয়ানের বুকেই ত্যাগ করতে পারে। আদ্রিয়ান অনিমাকে নিজের বুক থেকে সরিয়ে চোখদুটো ভালোভাবে মুছে দিলো। এরপর কপালে ঠোঁটের স্পর্শ দিয়ে নিজের খুব কাছে টেনে নিলো।

_________

বিকেল চারটে বাজে। স্নিগ্ধা মেডিকেল থেকে বেরিয়ে অপেক্ষা করছে গাড়ির জন্যে। তখনই রিকের ডাক শুনে ঘুরে তাকাল। তাকিয়ে দেখে রিক গাড়ি নিয়ে ওয়েট করছে। স্নিগ্ধা তাকাতেই রিক হাতের ইশারায় ডাকল ওকে। স্নিগ্ধা গাল ফুলিয়ে হনহনে পায়ে গেলো গাড়ির কাছে। এরপর রিকের দিকে না তাকিয়েই গাড়িতে উঠে বসল। রিকও অপেক্ষা না করে ড্রাইভিং সিটে গিয়ে বসল। স্নিগ্ধা কপাল কুঁচকে বাহিরে তাকিয়ে আছে। রিক একটু গলা ঝাড়ল, কিন্তু এতে কোন লাভ হলোনা। স্নিগ্ধা কথা বলল না। রিক গোমড়া মুখ করে বলল,

" আচ্ছা সরি বলেছিতো কতবার। সেদিন ভুল করে ড্রিংক করে ফেলেছিলাম। বলেছিতো আর করব না। এতো রাগ করছিস কেন?"

স্নিগ্ধা বিরক্তি নিয়ে বলল,

" তুমি জানো তুমি আদ্রিয়ান ভাইয়ের সামনে কী কী বলছিলে? ধারণা আছে তোমার? লোকটার মনে এসব কথার কী এফেক্ট পরেছে জানো?"

রিক একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্টেয়ারিং এর দিকে। ও জানে সেদিন ভুল করে ফেলেছে। এরকম করা ওর উচিত হয়নি। ওর আরও সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। শুধু শুধুই আদ্রিয়ানকে মানসিক চাপে ফেলেছে। ও একটা ছোট্ট শ্বাস ফেলে বলল,

" যা হয়েছে তাতো আর বদলাতে পারব না। তবে কথা দিচ্ছি যে আর কখনও এরকম ভুল করব না। ড্রিংকস এর ধারেকাছেও যাবোনা। আই প্রমিস!"

স্নিগ্ধা আড়চোখে তাকাল রিকের দিকে। তারপর গম্ভীর কন্ঠে বলল,

" সত্যি তো?"

রিক স্নিগ্ধার মাথায় একটা চাটা মেরে বলল,

" একদম সত্যি!"

স্নিগ্ধা মাথায় হাত বুলিয়ে ঠোঁট ফুলিয়ে বলল,

" ভালো হচ্ছেনা কিন্তু!"

রিক হাসতে হাসতে গাড়ি স্টার্ট দিল। তবে রিক না মানতে চাইলেও এটা সত্যি যে রিক বদলাচ্ছে। স্নিগ্ধা অজান্তেই রিকের মনের অনেকটা জায়গা দখল করে নিয়েছে। কারণ এখন একমাত্র স্নিগ্ধাই আছে যার কাছে রিক নিজের সমস্ত দোষ, অপারগতা স্বীকার করে। সব বলে। রিকের অজান্তেই স্নিগ্ধা রিকের খুব স্পেশাল একজন হয়ে উঠেছে। এসব ভাবতে ভাবতে স্নিগ্ধা মুচকি হাসল তবে সেটা রিকের আড়ালে।
.
.
.
চলবে.........................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন