হাওয়াই মিঠাই |
মীরা রাফির প্রশ্নটা নিয়ে অনেক ভাবলাে। একবার মনে হলাে প্রেম আর ভালােবাসা একই। পরে আবার রাফির বলা প্রেম আর ভালােবাসার সেই তফাৎ মনে পড়ে গেল। কিন্তু কোনটা যে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেটা বুঝে উঠতে পারলাে না। একেকবার একেকটা মনে হচ্ছিল। ছিল অনেক দ্বিধা। তবে সে এটা ঠিক করতে পেরেছিলাে যে রাফিকে কী উত্তর দেবে।
পরেরদিন বিকেলে আবার পুষ্প ভাবির মােবাইল দিয়ে রাফির সাথে কথা হয়েছিলাে। রাফি জিজ্ঞেস করলাে,
"প্রশ্নের উত্তর পেয়েছাে?"
মীরা বলল,
"কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা বুঝতে পারছি না, কিন্তু..."
"কিন্তু কী?"
"আমি ভালােবাসাও চাই, প্রেমও চাই।"
রাফি শব্দ করে হেসে ফেলল। মীরা অভিমানী কণ্ঠে বলল,
"তুমি হাসছাে কেন?"
রাফি বলল,
"বলেছিলাম না তােমার প্রশ্নের উত্তর টা আমার প্রশ্নের উত্তরের মধ্যেই আছে? উত্তরটা আমি তখন তােমাকে দিতে পারতাম কিন্তু তাতে এই উপলব্ধিটা তােমার হতাে না।"
"কোন উপলব্ধি?"
"এই যে দুটোই দরকার। আমি তাে দুটোই চাই।"
এবার মীরা হাসলাে। শব্দ করলাে না তাই রাফি সে হাসির হদিস পেলাে না।
এভাবেই প্রতিদিন বিকেলে একবার কথা হয় রাফি-মীরার। তাও খুব সামান্য। ৫-১০ মিনিটের বেশি নয়। দুজনই সারাক্ষণ অস্থির হয়ে থাকে। একদিন রাফি বলল,
"মীরা চলাে দেখা করি। এতটুকু কথা বলে শান্তি নেই। এভাবে আর পারা যাচ্ছে না। দেখা হলে আমি তােমাকে একটা মােবাইল দেব। লুকিয়ে রাখবে, রাতে শুধু এক ঘন্টা কথা বলব ব্যাস।"
"কিন্তু কিভাবে দেখা করব? তুমি তাে জানাে সব।"
"তােমার মডেল টেস্ট কবে শুরু?"
"পরশুদিন।"
"তাহলে সেদিন দেখা করি। তােমার স্কুলের সামনে যাব, তুমি আসবে। মাত্র ৫ মিনিটের জন্য হলেও হবে।"
"আমার ভয় করে রাফি।"
"প্লিজ মীরা।"
মীরা চুপ, রাফিও চুপ। কিছুক্ষণ ভেবে মীরা বলল,
"আচ্ছা তাহলে দুপুরবেলা এসাে।"
রাফি খুশি হলাে। মীরা আবার বলল,
"শােনাে ওইদিন দুটো পরীক্ষা। দুই পরীক্ষার মাঝে কিছুক্ষণ ব্রেক আছে, ১:৩০ থেকে ২:৩০ পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে এসাে, এসময় স্কুলের সামনে ভীড় থাকে না। স্কুলে গিয়ে আমি এক বান্ধবীর মােবাইল থেকে কল করবাে। তুমি এসে ওই নাম্বারে কল দিলে আমি বের হব।"
"আচ্ছা।"
"কিন্তু তুমি তাে বলােনি তুমি দেখতে কেমন, আমারটাও জানাে না। তাহলে আমরা দুজন দুজনকে চিনব কিভাবে?"
"আমি তাে সবসময় কালাে পরি। তুমি কী রঙ পরবে বলাে।"
"সবসময় কালাে পরাে কেন?"
"কোনদিন কোন রঙ পরব চিন্তায় থাকি, কেনাকাটার সময়ও দ্বিধায় পড়ে যাই রঙ নিয়ে। তাই সব এক রঙ, কালাে। কোনাে ঝামেলা নেই।"
"তার মানে তুমি ফরসা। নাহলে কালাে রঙ চুজ করতে না।"
রাফি হেসে বলল,
"এভাবে আমার মুখ দিয়ে বের করতে চাও আমি কালাে না ফরসা? বলেছি তাে আমরা দুজন পরস্পর সম্পর্কে একেবারে দেখা হয়েই নাহয় সব জানব।”
"না না এমন কিছু না। এমনি মনে হলাে। রাফি আমার না ভয় হয় মাঝে মাঝে।"
"কী বিষয়ে?"
"আমাকে দেখার পর যদি তােমার পছন্দ না হয়?"
"পছন্দ না হওয়ার চান্স নেই। ভালােবেসে ফেলেছি। শখ করেও বাসিনি, আপনা আপনি হয়ে গেছে। কিছু করার নেই।"
"তবু ভালাে লাগা না লাগার একটা ব্যাপার আছে না? যদি আমরা মানানসই না হই?"
"সবার সাথে সবাইকে মানায় মীরা। আমাদের সমাজের প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী আমার বাপের সাথেও আমার মাকে মানায় না। তবু তাে তারা একে অপরের প্রেমে পড়েছিল। এখনাে সুখে সংসার করছে। এত বেমানান জুটির সন্তান আমরা, কই তাদেরকে তাে আমাদের কাছে বেমানান লাগে না। আমাদের তাে বাবা-মাকে পৃথিবীর সেরা জুটি বলে মনে হয়।"
"ইয়ে মানে... আমার একটা সমস্যা আছে। এটা নিয়ে চিন্তায় থাকি সবসময়। তােমার যদি খারাপ লাগে?"
"সব সমস্যার সমাধান আছে। দেখা হােক তারপর সব বােঝা যাবে। এখন এ বিষয়ে জল ঘােলা করে লাভ নেই।"
"আচ্ছা।"
"এখন বলাে পরশু তুমি কী রঙ পরবে?"
"ভাবছি আমিও কালাে পরব।"
"আচ্ছা।"
"তারপরেও যদি না চিনি! কালাে রঙের কাপড় পরা অনেকেই থাকতে পারে।"
"আচ্ছা শােনাে হাতে একটা হাফ লিটারের পানির বােতল রাখবে। আমিও হাতে একটা হাফ লিটার পানির বােতল রাখবাে। তাহলে আর চিনতে অসুবিধা হবে না।"
"এটা একটা ভাল আইডিয়া।"
সব ঠিকঠাক হওয়ার পর একটা দিন আর কাটছিল না। দেখা হবে! এতদিন যে মানুষটার সাথে কথা হচ্ছিল শুধু, এবার তার সাথে দেখা হবে! কেমন দেখতে সে? এক্ষুনি এত নার্ভাস লাগছে কেন? সামনে গিয়ে কথা বলতে পারবে তাে? নাকি সব গুলিয়ে ফেলবো? উত্তেজনায় সারারাত ঘুম হলাে না মীরার।
উক্ত দিনে সবকিছু প্ল্যানমতােই হচ্ছিল। মীরা সময়মতাে রাফিকে ফোন করতেই সে জানিয়েছিল, সে এসেছে। মীরা স্কুল থেকে বের হলাে। তবে মীরা সেদিন কালাে রঙ পরেনি, নীল পরেছিল। হাতে কোনাে পানির বােতলও নেয়নি। এসব মীরা ইচ্ছা করেই করেছিল, সে রাফিকে আগে দেখতে চেয়েছিল! যদি রাফি ভুড়িওয়ালা কোন টাক লােক হতাে তাহলে সে পেছন থেকে পালাতাে। আবার এও ভাবছিল, পালিয়ে যাবে কোথায়? ভালবাসে বলে ফেলেছে যে! আবার নিজের মাথায় বাড়ি দিয়ে ভাবছিল, ধুর রাফি যেমনই হােক, শুধু একটু স্মার্ট হলেই হলাে। কথাবার্তায় যে ছেলে এত স্মার্ট সে নিশ্চই দেখতেও কিছুটা স্মার্ট হবে!
মীরা স্কুলের সামনের রাস্তা পুরােটা চক্কর দিয়ে ফেলেছিল। কিন্তু কালাে শার্ট পরিহিত পানির বােতল হাতে কাউকে দেখতে পায়নি সেদিন। এমনকি রাফির বয়সী কেউই ছিল না সে রাস্তায়। এদিকে কোনাে ফোনের দোকানও সেখানে ছিল না যে রাফিকে কল করবে! বান্ধবীর মােবাইল টা নিয়ে যাওয়া উচিৎ ছিল, কিন্তু স্কুলে মােবাইল লুকিয়ে রাখতে হয়। তাই ধরা পড়ার ভয়ে সে মােবাইল ছাড়াই বেরিয়েছিল। অল্পকিছু লােকজনের মধ্যে সবাই স্কুলেরই ছাত্রী, একটা আন্টিকে দেখা যাচ্ছিল শুধু। এছাড়া ঝালমুড়ি ওয়ালা, ফুচকাওয়ালা আর আইসক্রিম ওয়ালা ছিল। সেই যুগে এদের কাছে মােবাইল ফোন থাকা বিস্ময়কর ব্যাপার ছিল। শেষমেশ উপায় না দেখে মীরা আন্টি টার কাছে ফোন ধার চেয়েছিল। কিন্তু আন্টি দিলাে না উলটো কেমন করে যেন তাকিয়েছিল। মীরা আশেপাশে কাউকে খুঁজতে লাগলাে যার কাছে ফোন ধার চাওয়া যায়। কিন্তু এমন কেউ ছিল না। স্কুলের সামনে থেকে বেশ খানিকটা সামনে চলে গিয়েছিল সে। ঠিক তখনই দূর থেকে একজন বিদেশীকে ফোনে কথা বলতে দেখতে পেয়েছিল। ওনার কাছে ফোন ধার চাওয়া যায়, কিন্তু তিনি কি দেবে? দিক না দিক চাওয়া তাে যাক। তার ফোনে কথা বলা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলাে মীরা। শেষ হতেই মীরা কাছে গিয়ে বলেছিল,
"স্কিউজমি। ক্যান আই মেক আ কল ফ্রম ইউর মােবাইল ফর জাস্ট ওয়ান মিনিট? ইটস আর্জেন্ট।"
"শিওর, ইউ ক্যান।"
মীরা খুব নার্ভাস ছিল। কাঁপা কাঁপা হাতে নাম্বারটা টাইপ করে ডায়াল করলাে। ওপাশ থেকে একটি নারীকণ্ঠ শােনা গেল,
"দুঃখিত, আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি এই মুহূর্তে ব্যস্ত আছে। অনুগ্রহপূর্বক আবার চেষ্টা করুন। সরি, দিস নাম্বার ইজ বিজি নাও..."
মীরা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আবার ডায়াল করেছিলাে ঠিকই কিন্তু লাইন পাওয়া গেল না। তখনাে ব্যস্ত! সেই মুহুর্তে মীরার প্রচন্ড বিরক্তি লাগছিল! অত কথা রাফি তখন কার সাথে বলছিল? একটু পরে কি বলা যেত না? ওই সময় ওভাবে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকাটা প্রচন্ড রিস্কি ছিল। মীরা আরাে কয়েকবার ডায়াল করে ব্যস্ত পেয়েছিল। কান্না পেয়ে গিয়েছিল তার, এই দেখা করা নিয়ে দুদিন ধরে কতকিছু ভেবেছিল অথচ দেখাই হলাে না। অবশেষে কাঁদতে কাঁদতে স্কুলে ফিরে গিয়েছিলাে মীরা। এইজন্যই বােধহয় কথায় বলে, কোনাে কিছু নিয়ে বেশি আশা করতে নেই!
পর্ব ০৬ | পর্ব ০৮ |