হাওয়াই মিঠাই |
প্রেমটা আরেকটু মাখাে মাখাে হয়েছিলাে রাফির দেয়া মােবাইলে ফোনের বদৌলতে। তখন নিয়মিত রাতে কথা হতাে। যদিও আগের মতাে সারারাত নয়। রাফি খুব কঠিন এবার! ১ ঘন্টার বেশি কিছুতেই কথা বলবে না। এসএসসি পরীক্ষার আগ পর্যন্ত এভাবেই চলবে বলে জানিয়ে দিয়েছে। এর মধ্যেই আরেকদিন দেখা হলাে। এবার কিন্তু মীরা মােটামুটি স্বাভাবিক ছিল। প্রথমবারের মত নার্ভাস নয়। অনেক কথা বলল এবার। কিন্তু তবুও রাফির চোখের দিকে তাকাতে পারলাে না। রাফি এটা নিয়ে একটু আফসােস করলেও পরে বলল মীরার ওই চোখে চোখ রাখার জন্য সে অপেক্ষা করবে।
এর কিছুদিন পরের ঘটনা,
সাধারণত রাতে কথা হলেও সেদিন সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ মীরার ইচ্ছে হলাে একটু কথা বলতে। তাই ফোনটা বের করলাে। বের করে দেখে রাফির ফোন এসেছিল কয়েকটা। মীরা কলব্যাক করতেই রাফি বলল,
"কী করছাে মীরা?"
"পড়তে বসেছি।"
"আচ্ছা পড়াে তাহলে। পরে কথা বলবাে।"
"ওমা তাহলে এতবার ফোন করলে যে! একটু কথা বলি? তারপর আবার পড়তে বসবাে। তাছাড়া আর একটা পরীক্ষাই তাে আছে।"
"প্রিপারেশন শেষ?"
"জাস্ট রিভিশন দিচ্ছিলাম।"
"ও।"
"তােমার কী হয়েছে? মন খারাপ তােমার?"
"হ্যাঁ, অনেক বেশি মন খারাপ।"
"কেন?"
"রাতে বলব। আমি বাসায় যাই, কিছু ভাল লাগছে না আমার।"
"না এখনই বলাে। কী হয়েছে রাফি?"
"বাসায় গিয়ে বলব। বিরক্ত লাগছে সবকিছু।"
মীরা বেশ চিন্তায় পড়ে গেল রাফিকে নিয়ে। কী এমন হলাে তার? কিন্তু জানা হলাে না। সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত দুশ্চিন্তা নিয়ে বসে থাকতে হলাে। কারণ বাসায় গিয়ে রাফি রূপকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাে। একেবারে রাতেই কথা হলাে তাদের। ইরা ঘুমিয়ে পড়ার পরে মীরা ফোন নিয়ে বাথরুমে ঢুকে রাফিকে ফোন করল। রাফির প্রথম কথাটাই ছিল,
"আমি ভেঙে গেলাম মীরা, আবারাে।"
"মানে? কিভাবে? কেন? কী হয়েছে?"
"আমার মনটা ভাঙা মীরা। ছােটবেলায় প্রথমবারের মত যাকে ওটা দিয়েছিলাম সে খুব যত্ন করে অনেকগুলাে টুকরাে করে দিয়েছিল। তার কিছু তুমি জানাে, কিছু জানাে না। তারপর ৪ বছর কেটে গেছে, এই মন আর কাউকে দিতে পারিনি আমি। অনেক সুযােগ ছিল আমার, একেকটা টুকরাে একেকজনকে দিতে পারতাম। দেইনি কেন জানাে? ভয়ে! আর কোনাে ধাক্কা খেতে চাইনি বলে।"
মীরার মাথায় কিছুই ঢুকছে না। সে বুঝতে পারছে না রাফি কেন এসব কথা বলছে! রাফি এবার বলল,
"কিন্তু দেরীতে হলেও ভুলটা আমি করেই ফেললাম! ভাঙা টুকরােগুলাে আমি তােমাকে দিয়ে দিলাম। তােমাকে পেয়ে আমি কিছুটা বিস্মিত ছিলাম মীরা! একটা মেয়ে এতটা সহজ সরল হতে পারে তা আমার জানা ছিল না। ভালবেসে ফেললাম, অনেকটা অন্ধের মতাে। আমি শতভাগ নিশ্চিত ছিলাম আমার এই মীরা শুদ্ধ, শতভাগ শুদ্ধ! একমাত্র এই শুদ্ধ মানুষটাই তার শুদ্ধতা দিয়ে আমার মনের টুকরােগুলােকে জোড়া লাগাতে পারবে। বাট আই ওয়াজ রং।"
মীরা এবার ভয়ে কাঠ হয়ে গেল। কী বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। সে নিজের অজান্তেই বলল,
"তুমি এসব কেন বলছাে?"
রাফি আগের মতই শীতল গলায় বলল,
"এখনাে বুঝতে পারছাে না কেন বলছি? নাকি নিজেকে সেফ জোনে রাখার জন্য না বােঝার ভান করছাে? ১ টা মিথ্যে বললে সেটাকে ঢাকার জন্য আরাে ১০০ টা মিথ্যে বলতে হয়। তুমি সেটাই করছ এখন।"
"রাফি তুমি আমাকে ভুল বুঝছাে।"
"প্লিজ মীরা, নিজের দোষটা ঢাকতে তুমি এখন আর কোনাে মিথ্যে বলাে না। আমি নিশ্চিত না হয়ে তােমাকে ব্লেইম দিচ্ছি না। তুমি আমার মীরা নও, তুমি তপনের বােন ত্রিশার বান্ধবী। তপনের ফোন থেকে আমাদের সব বন্ধুদের নাম্বার কালেক্ট করে ফোন দিয়েছাে তুমি! শুভকে বানিয়েছাে স্বামী, বাচ্চার বাবা। আর আমাকে বানিয়েছাে প্রেমিক। অথচ আমাকে বলেছাে তােমাদের কাজের মেয়ে তার বাড়িতে ফোন করতে গিয়ে একটা ডিজিট ভুল করে আমাকে ফোন করেছে! এত সুন্দর গুছিয়ে মিথ্যে বলতে পারাে তুমি যে, আমি ধরতেই পারলাম না! ছি... মীরা!"
"রাফি..."
"নাে, শেইম অন মি একচুয়েলি।"
মীরা কিভাবে রাফিকে পুরাে ব্যাপারটা বােঝাবে জানে না। বােকার মত কাঁদছে শুধু। একটাই ভয় মনে কাঁটা দিচ্ছে এবার কি রাফি তাকে ছেড়ে চলে যাবে? নাহ এটা সে হতে দেবে না। রাফিকে সব বুঝিয়ে বলতে হবে। কাঁদতে কাঁদতেই বলল,
"রাফি আমার কথা শােনাে...*
"আমি তােমার কোনাে কথা শুনবাে না মীরা। অনেক কথা শুনে ফেলেছি তােমার! না জানি কত মিথ্যে ছিল সেসব কথায়! অথচ প্রথমেই আমি তােমাকে বলেছিলাম আমাকে মিথ্যে বলবে না। আমি নিজেও মিথ্যে বলি না, মিথ্যে বলা সহ্যও করতে পারি না। তারপরেও তুমি আমার সাথে মিথ্যে বলেছাে! আমার এখন নিজের উপর ঘৃণা হচ্ছে একটা মিথ্যেবাদী সরল সেজে থাকা অতিচালাক মেয়ের পেছনে এতটা সময় নষ্ট করেছি বলে!"
মীরার কান্না আরাে বেড়েছে,
"রাফি প্লিজ..."
"এই মুহুর্ত থেকে না আমি তােমার কেউ, না তুমি আমার কেউ! অল ওভার।"
এ কথা বলে রাফি লাইন কেটে দিলাে। মীরা আবার কলব্যাক করলাে। ওপাশে বেজে উঠলাে পৃথিবীর সবচেয়ে দূর্বিসহ ভাঙা রেকর্ড,
"দুঃখিত! আপনার ডায়ালকৃত নম্বরটি এখন বন্ধ আছে। কিছুক্ষণ পর আবার চেষ্টা করুন।"
সারারাত চেষ্টা করেছিলাে মীরা। পাগলের মতাে কাঁদছিলাে! রাত পেরিয়ে দিন এলাে, সারাদিন চেষ্টা করলাে। আবার রাত এলাে, সারারাত চেষ্টা করলাে। আবার সারাদিন, আবার সারারাত। কিন্তু এই একই ভাঙা রেকর্ড শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেলাে মীরার।
পর্ব ০৮ | পর্ব ১০ |