পরী |
গভীর জলের মাঝে হাবুডুবু খাচ্ছে জোহরা! বিশাল জলরাশি; চারদিকে শুধু পানি আর পানি। এর শেষ কোথায় ওর জানা নেয়। ও উদভ্রান্তের মতো শুধু পানিতে সাঁতার কেটে যাচ্ছে। স্বচ্ছ নীল জলে হঠাৎ করেই বড়ো ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়। জোহরা ঘাড় ঘুরিয়ে এক পলক পিছনে তাকিয়ে দেখে, বিশাল বড়ো একটি কুচকুচে কালো সাপ খুব দ্রুত সাঁতরে ওর পানে ধেয়ে আসছে! ও সাথে সাথেই সাঁতারের গতি বাড়িয়ে দিয়ে প্রাণপনে সাঁতরাতে থাকে। কিন্তু কিছুতেই যেন সেই সাপটা থেকে বাঁচতে পারে না। সাপটা দ্রুত এসে পানির মধ্যেই জোহরার সারা শরীর পেঁচিয়ে ধরে ওর গলায় জোরে চাপ দিতে থাকে। জোহরা শ্বাস নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। ধীরে ধীরে ওর দুই চোখ বুজে আসতে থাকে। শেষ বারের মতো জোহরা ওর মুখের উপরে ঝুঁকে থাকা বিষাক্ত সাপটার দিকে তাকায়। ওটা হিংস্র চাহনিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। কে যেন অনেক দূর থেকে জোহরার নাম ধরে ডাকছে। অতি ক্ষীণ সেই ডাকে কারোর বেদনাবিধুর মনের আকুলতা ঝরে পড়ছে! জোহরা ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে ফেলে। হঠাৎ করেই ওর শরীর প্রচণ্ড ঝাঁকুনি দিয়ে ওঠে। সেই ঝাঁকুনির তালে জোহরা চোখ মেলে দেখে ও বিছানায় শুয়ে আছে। আর উমর ওর দুই বাহু চেপে ধরে অবাক চাহনিতে ওর মুখের উপরে ঝুঁকে আছে! উমরের মুখটা কেমন যেন লাগছে। তার চোখে মুখে আপন কিছু হারানোর তীব্র শোক ভেসে ওঠেছে! এইবার জোহরা তার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আশেপাশে তাকাতে থাকে। চারদিকে একটু ভালো করে তাকাতেই বুঝতে পারে ও হাসপাতালের বেডে শুয়ে আছে। কিন্তু ও তো বাড়িতে ওর রুমে ছিল, হাসপাতালে আসলো কীভাবে? জোহরা জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে উমরের দিকে তাকাতেই সে হুট করে ওকে জরিয়ে ধরে। তারপর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলে,
"এক মূহুর্তের জন্য আমার মনে হয়েছিল সত্যিই বুঝি আমি তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি। তুমি বুঝি চিরদিনের জন্য আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছ!"
উমরের কথাবার্তা কিছুই বুঝতে পারছে না জোহরা। তবে ওর ডানকানে কেমন যেন শো করে একটা শব্দ শুনতে পাচ্ছে। শব্দটার সাথে কানে তীব্র যন্ত্রণাও হচ্ছে। ও ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে বলে ওঠে,
"আমার কানে খুব ব্যথা করছে।"
জোহরার গুঙিয়ে উঠায় উমরের ধ্যান ভাঙে। সে ওকে ছেড়ে দিয়ে সাথে সাথে ছুটে গিয়ে নার্সকে ডেকে আনে। নার্স এসে জোহরার হাতের ক্যানোলাতে ইঞ্জেকশন পুশ করে দেওয়ার কিছুক্ষণ পরেই ও ঘুমিয়ে পড়ে!
ভোরের দিকে জোহরার ঘুম ভাঙলে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে উমর ওর বেডের পাশে চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। তার মাথাটা কাঁধের একপাশে হেলে পড়েছে। দুশ্চিন্তায় তার চেহেরার সৌন্দর্য কিছুটা ম্লান হয়ে গেছে। জোহরা পরম আবেশে তার একটা হাত চেপে ধরে। ওর হাতের ঠান্ডা স্পর্শে উমরের ঘুম ভেঙে যায়। সে ঘুম থেকে উঠে জোহরাকে সজাগ দেখে আতংকিত গলায় প্রশ্ন করে,
"কী হয়েছে, কানে কী ব্যথা করছে?"
জোহরা উমরের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তার হাতটা ওর গালে চেপে ধরে নিশব্দে কাঁদতে থাকে। উমর আহত গলায় জিজ্ঞেস করে,
"কাঁদছ কেন জোহরা? তোমার শরীর কি খুব বেশি খারাপ লাগছে? তুমি একটু অপেক্ষা কোরো আমি এক্ষুনি ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে আসছি।"
এই বলে সে বসা থেকে উঠতে চাইলেই জোহরা খপ করে তার পাঞ্জাবীর এককোণা ধরে আস্তে করে বলে,
"আপনি আমার পাশে শুয়ে আমার মাথাটা একটু আপনার বুকে নিন না।"
উমর ওর হাত থেকে পাঞ্জাবীর কোণাটা ছাড়িয়ে নিয়ে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। এত ধীরে বলায় সে হয়তো ওর কথা শুনতে পায়নি ভেবে জোহরা মন খারাপ করে ফেলে। কিন্তু উমর ওকে অবাক করে দিয়ে দরজাটা বন্ধ করে এসে বেডে ওর পাশে শুয়ে জোহরার মাথাটা আলতো করে তার বুকে চেপে ধরে। জোহরা দীর্ঘক্ষণ তার বুকে মুখ গুজে রেখে চুপ করে থাকে। হুট করেই ওর বাড়ির কথা আর বাকি সবার কথা মনে পড়লে উমরের মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,
"বাবা, রামীসা আর ইয়াসিন কেমন আছে? আমি যে এখানে হাসপাতালে পড়ে আছি, তাহলে ওদেরকে রান্না করে খাওয়াচ্ছে কে? রামীসা তো এখনো রান্নাটা ভালো করে শেখেনি।"
উমর চোখ বন্ধ করে জোহরার মাথায় হাত বোলাচ্ছে। সেভাবেই বলে,
"বড়ো আপা আছে বাসায়। তুমি চিন্তা কোরো না।"
"তাহলে আপনি বাসায় যাননি কেন? গতকাল রাতেও যখন আমি ঘুম থেকে উঠেছিলাম আপনি এখানেই ছিলেন। এখনো এখানেই আছেন। রাতে বাসায় যাননি যে?"
উমর জোহরার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বলে,
"কাল রাতে না, পুরো একদিন আগে সেই রাতে তোমার জ্ঞান ফিরে ছিল। তাও দুই দিন পরে!"
তার কথা শুনে জোহরা হতবাক হয়ে যায়।
"কী বলছেন? আমি দুই দিন অজ্ঞান ছিলাম! কি হয়েছিল আমার?"
"সেটা তুমি ভালো বলতে পারবে সেদিন তোমার কী হয়েছিল? দুপুরে রামীসা হঠাৎ তোমার চিৎকার শুনে আমাদের রুমে ছুটে গিয়ে দেখে তুমি অজ্ঞান হয়ে ফ্লোরে পড়ে আছ; আর তোমার নাক দিয়ে রক্ত পড়ছিল! তারপর ও আমাকে আর আব্বাকে ফোন করলে আমরা দুইজনেই দ্রুত বাসায় চলে যাই। আমরা তখন বাজারেই ছিলাম। বাসায় গিয়ে দেখি তোমার দুই গাল ফোলা আর লালচে হয়ে ছিল। মনে হচ্ছিল কেউ প্রচণ্ড জোরে তোমার গালে চড় মেরেছে। নাক দিয়ে অনেক রক্ত পড়ছিল। তখনি আর দেরি না করে আমরা তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসি। তারপর থেকেই তুমি অজ্ঞান ছিলে।"
সব শুনে জোহরার মন খারাপ হয়ে যায়। ও মলিন সুরে জানতে চায়,
"আচ্ছা সেদিন কি রামীসাকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল?"
"না। তুমি অসুস্থ আর আমরা সবাই তখন তোমাকে হাসপাতালে নিয়ে আসায় ব্যস্ত ছিলাম। ঐ অবস্থায় বাড়িতে মেহমানদের আপ্যায়ন করা সম্ভব ছিল না। তাই আব্বা তাদের ফোন দিয়ে সেদিন আসতে নিষেধ করে দিয়েছিলেন।"
জোহরা আফসুস করে বলে,
"ইশ! আমার জন্য সেদিন রামীসাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসতে পারেনি। আচ্ছা, তারা কি পরে আর কিছু জানিয়েছিল, আবার কবে আসবে রামীসাকে দেখতে?"
"ঐসব নিয়ে আর কোনো কথা হয়নি তাদের সাথে। আর তুমি রামীসার বিয়ে নিয়ে অস্থির হয়ে পড়লে কেন? আসলে তোমাকে এই ব্যাপারে আগে থেকে কিছু জানানোই উচিত হয়নি। এরপর থেকে রামীসার বিয়ের ব্যাপারে কোনো আলোচনা হলে তোমাকে আগে থেকে কিছুই বলবো না আমি।"
উমরের এমন হুট করে বিরক্ত হয়ে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারে না জোহরা। ওর কেন যেন মনে হচ্ছে, সে ওর কাছে কিছু একটা লুকাতে চাইছে!
জোহরাকে হাসপাতাল থেকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছে আরও সপ্তাহ খানেক আগেই। এসেই ও আবার নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আসলে নারী জাতটাই এমন, তাদের নিজেদের উপর দিয়ে যত ঝড় ঝাপটায় বয়ে যাক না কেন, তারা নিজেদের দুঃখ কষ্টের চেয়ে নিজের সংসার আর আপন মানুষগুলোর যত্ন নেওয়াটাকেই বেশি প্রাধান্য দেয়। হাসপাতালে থাকাকালীন জোহরা বুঝতে পারে ওর এক কানের শ্রবণ ক্ষমতা কমে গেছে। এক কানে কম শুনতে পায় ও। আর ওর এক চাপার দুটি দাঁতও পড়ে গেছে! চাপার দাঁত ছাড়া খাবার খেতে খুব কষ্ট হলেও জোহরা কাউকে নিজের কষ্ট বুঝতে না দিয়ে হাসিমুখে সব কষ্ট মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। রামীসাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসার ব্যাপারে জোহরা উমরকে আর কিছু জিজ্ঞেস করার সাহস করতে পারেনি। উমর এখন সারাক্ষণ শুধু জোহরার আশে পাশে থাকার চেষ্টা করে। আর এইজন্য সে ব্যবসার দিকে ভালো করে মনোযোগ দিতে পারছে না। সে বাড়িতে থাকায় মনির সাহেবকেই বাধ্য হয়ে ব্যবসার হাল ধরতে হয়েছে।
জোহরা হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফেরার আগেই উমর ওদের পুরনো রুম ছেড়ে দিয়ে অন্য রুমে সবকিছু গুছিয়ে নিয়েছিল। তাই ও বাড়িতে আসার পর থেকে আর ওদের আগের রুমটাই যাওয়া হয়নি। ঐ রুমের দরজায় সব সময় তালা লাগানো থাকে। আর ওরা এখন যেই রুমটাতে থাকে সেটার দরজার সামনে সাদা কাগজে আয়াতুল কুরসি লিখে টাঙিয়ে রাখা হয়েছে। এসব দেখে জোহরার মন খচখচ করে। ওর কেবলি ইচ্ছে করে ঐ রুমে যেতে। কিন্তু আবার ভয় ও করে। আর তাছাড়া উমর ওকে সেই রুমে যেতে বারণ করেছে। তার নিষেধ সত্ত্বেও ঐ রুমে যাওয়া অনুচিত হবে। তাই ও এতদিন যাবত নিজের আগ্রহটাকে দমিয়ে রেখেছে। কিন্ত জোহরা জানে সেই মেয়ের সাথে ওর কথা বলা দরকার। ওকে জানতে হবে সে কে? আর কেনই বা ওকে সেদিন এমন ভয়ংকর ভাবে ভয় দেখিয়ে অমন নির্দয় ভাবে মেরেছিল; যার দরুন ওর দুটো দাঁত পড়ে গেছে এবং এক কানের শ্রবণ শক্তিও হ্রাস পেয়েছে! আর ওর কাছে কি চায় সেই মেয়ে? হ্যা, সেই দিন জোহরার সাথে ঘটে যাওয়া পুরো ঘটনায় ওর মনে আছে। কিন্তু সবকিছু পরিস্কার মনে থাকার পরও পরিবারের কাউকেই এই বিষয়ে কিছু বলেনি ও। এমন কি উমর যখন বার কয়েক জানতে চেয়েছিল সেদিন ঠিক কি ঘটেছিল ওর সাথে, ও উমরকেও কিছুই জানায়নি। তখন ওর শুধু মনে হয়েছিল এই ব্যাপারে সবটা না জেনে আপাতত কাউকে কিছু জানানো ঠিক হবে না। তবে সেই মেয়েটা যে কোনো সাধারণ মেয়ে নয় সেটা জোহরা বেশ ভালো ভাবেই বুঝতে পেরেছে। কিন্তু তার উদ্দেশ্য কি সবটাই ওর জানতে হবে। জোহরা আগে থেকেই মনে মনে সব ঠিক করে রেখেছিল। তাই আজ সকালে উমরকে জোর করে কাজে পাঠিয়ে দিয়েছে। মনির সাহেব ও বাসায় নেই। ইয়াসিন স্কুলে। কিন্তু রামীসা বাড়িতেই আছে। উমর যাওয়ার আগে বারবার করে ওকে জোহরার পাশে থাকতে আর ওকে একা না ছাড়তে নিষেধ করে গেছে। বিছানায় শুয়ে এতক্ষণ একমনে কথাগুলো চিন্তা করছিল জোহরা। ওর পাশেই রামীসা শুয়ে আছে। দুপুরের খাওয়ার পর বিছানায় শুতেই আরামে ঘুমিয়ে পড়েছে মেয়েটা। জোহরা এতক্ষণ এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিল। তাই রামীসা গভীর ঘুমে কি না সেটা ভালো করে দেখে নিয়ে নিশব্দে বিছানা থেকে নেমে পা টিপে টিপে রুম থেকে বেড়িয়ে যায়। এই রুম থেকে ওদের পুরনো রুমে যেতে হলে ড্রইংরুম পেরিয়ে যেতে হয়। যাওয়ার সময় ড্রইংরুমের বড় দেয়াল ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখে দুপুর ৩টা বাজে। দ্রুত কয়েক কদমে হেঁটে জোহরা পুরনো রুমের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর ওড়নার এক কোণার ছোট্ট গিট খুলে তালার চাবিটা বের করে কাঁপা কাঁপা হাতে তালাটা খুলে ফেলে। অনেক কষ্টে উমরের কাছ থেকে চাবিটা সরিয়েছে ও। অতঃপর দরজা খুলে ধীরে ধীরে ভীরু মনে রুমের ভেতরে প্রবেশ করে। জোহরা ভেতরে ঢুকতেই রুমের দরজা আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে যায়! হঠাৎ করেই জোহরা আবার সেই মিষ্টি গন্ধটা পেতে শুরু করে। তারপর আচমকায় পিছন থেকে একটি মেয়েলি কণ্ঠ ওর কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলে,
"তুমি এসেছ জোহরা? আমি তো এতদিন ধরে তোমার অপেক্ষাতেই ছিলাম!"
← পর্ব ০২ | পর্ব ০৪ → |