মন বাড়িয়ে ছুঁই - পর্ব ১৩ - ফাবিয়াহ্ মমো - ধারাবাহিক গল্প


অচেতন মেহনূরের মুখ থেকে এমন ভয়াবহ শব্দ শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো মাহতিম!নিজের কানদুটো পযর্ন্ত ঝিঁঝি করে বাজছে। কি শুনলো সে? মেহনূরের গায়ে তরুণ হাত দিয়েছে? আচ্ছা নামটা কি সে ঠিক শুনেছে নাকি ভুলভাল শুনলো? এমন একটা পরিস্থিতি হলো মাহতিম তখন স্বাভাবিক চিন্তা-চেতনাও যেনো গুলিয়ে ফেললো। বারবার কল্পনায় ভাবতে লাগলো তরুণ ওকে বাজেভাবে স্পর্শ করছে, মেহনূর তাতে ছটফট করছে, ছাড় পাওয়ার জন্য ছুটাছুটি করছে, তরুণ আরো হিংস্র হয়ে ছোঁয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে, এদিকে মেহনূর চেচাঁমেচিও শুরু করে দিয়েছে ---! এরপর আর ভাবতে পারলো না মাহতিম! তড়াক করে ওর পাশ থেকে উঠে দাড়াঁলো। শরীরের ভেতর রক্তের স্রোত টগবগ-টগবগ করে ফুটছে এখন। এখুনি যেনো আগ্নেয়গিরির লাভা উদগিরণ হবে। মেহনূরের রুম থেকে রাগান্বিত মেজাজে বেরিয়ে গেলো সে। সিড়ি ধরে হনহন করে নামতেই ঘুমঘুম চোখে কলপাড়ের জন্য বাইরে যাচ্ছিলো নীতি। মাহতিমের ওমন ক্রুদ্ধভঙ্গির মেজাজ দেখে চোখ কচলানো থমকে গেলো। চকিত দৃষ্টি ছুঁড়ে মাহতিমের দিকে ছুটে গেলো ও। মাহতিম তখন নীতির পাশ কাটিয়ে দ্রুতবেগে সিড়ি ধরে নিজের রুমের জন্য যেতে লাগলো। পেছন থেকে ওর হাব-ভাব দেখে শঙ্কিত মুখে ছুট লাগালো নীতি। পিছন-পিছন দৌড়ে যেতেই প্রশ্ন করতে লাগলো ওকে,

  - মাহতিম ভাই! ভাই, দাড়াও! ভাইয়া কি হয়েছে? ভাইয়া আস্তে চলো!এভাবে দৌড়াচ্ছে কেনো? জবাব দাও!

নীতির প্রশ্নমালা চলতে থাকলো ঠিকই,রাগে ভষ্ম হওয়া মাহতিম সেটার একটা উত্তর দিলো না। রুমে ঢুকে কাঠের আলমারি খুলে এমন একটা বস্তু বের করলো সেটা দেখে নীতি একদম বিস্ফোরণ চাহনিতে চিল্লিয়ে উঠলো, 

  - খবরদার ভাইয়া, এটা বের করো না! আমরা এখন শহরে নেই, এটা গ্রাম! এখানে এসব জিনিস বের করো না ভাইয়া। কি হয়েছে, আমাকে বল। আমি সব হ্যান্ডেল করছি ভাইয়া, ফর গড সেক তুমি ঠান্ডা হও। ভাইয়া ঠান্ডা হও। আমি আছিতো, নীতি সব ঠিক করবে। তুমি আমাকে খুলে বলো। 

নীতির অস্থির চাউর দেখে মাহতিম কঠোর দৃষ্টিতে একপলক তাকালো। একেবারে ওর চোখে-চোখ রেখে রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, 

  - তোকে যদি কেউ মলেস্ট করার চেষ্টা করে ওই সময় আমার কি করা উচিত? এই মূহুর্তে কোনো পাল্টা প্রশ্ন করবিনা! একদম কাট-কাট আন্সার দিবি। ইন্সটেন্ট উত্তর দে এখন!

মাহতিমের কথা শুনে মুখের বুলি হারিয়ে ফেললো নীতি। মাহতিম তখনও রাগী দৃষ্টিতে তাকিয়েই আছে। নীতি কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ধীর কন্ঠে প্রত্যেকটা শব্দ থেমে-থেমে বললো, 

  - তুমিতো তাকে মে-রেই ফেলবে। 

কাঙ্ক্ষিত এবং যোগ্য জবাব পেয়ে তৎক্ষণাৎ নিজের কঠোর দৃষ্টি নীতির উপর থেকে সরিয়ে ফেললো মাহতিম। হাতে থাকা চকচকে সিলভার রঙের ভারী বস্তুটা দ্রুতগতিতে টিশার্ট উঠিয়ে পেটের বাঁ-পাশে প্যান্টের সাথে গুঁজে রাখলো। আবার দৃষ্টি তুলে নীতির স্তম্ভিত মুখের পানে কাঠিন্য সুরে বললো, 

  - তুই সামনে দেখে মুখটা খারাপ করলাম না, কিন্তু তরুণের বাচ্চাকে আমি ছাড়বো না! ওই শালার ইতরামি যদি না ছুটিয়েছি দেখিস! ওর কারেন্ট এক্কেবারে নিভিয়ে দেবো। ওর আসল জায়গায় যদি মেইন কাজ না সারছি, আমি ওর -- 

মুখ থেকে বাজে কথা ছিটকে আসার পূর্বেই তড়িঘড়ি করে থামিয়ে দিলো নীতি। মাহতিমের একদম সামনে দাড়িয়ে ভীত অবস্থায় নিজেকে শান্ত করে জোর খাটিয়ে বললো, 

  - আমরা কিন্তু শহরে না ভাইয়া। তোমার এই ব্যাপারটা মাথায় রাখতে হবে, তুমি কিন্তু এই মূহুর্তে কোনোপ্রকার সিনক্রিয়েট করতে পারবেনা। আমরা এখন জমিদার বাড়িতে আছি। এই বাড়ির নাম-ধাম যদি একটু এদিক-ওদিক হয়, তাহলে কেমন ভয়াবহ অবস্থা হবে একবার ভেবে দেখো। তুমি আপাতত ঠান্ডা হও, জাস্ট রিল্যাক্স! আমি জানি তুমি এইসব নষ্টালজিক ব্যাপারগুলো নিতে পারো না। কিন্তু ভাইয়া কে মলেষ্ট হয়েছে? কার জন্য তুমি তরুণের উপর তেড়ে যাচ্ছিলে? তরুণ কি করেছে? 

 একটু আগের ঘটনাগুলো আবার মনে পরলো মাহতিমের। ওমনেই রাগের চোটে টেবিলের পায়ে জোরে একটা লাত্থি মারলো! সেই লাত্থির কারণে কাঁচের গ্লাসটা খাড়া থেকে কাত হয়ে নিচে গড়াতে যাচ্ছিলো। নীতি তাড়াতাড়ি টেবিলের কাছে সেই গ্লাসটা ধরে সোজা করে রাখলো। রাগে নিশ্বাসের গতি বেড়ে গেছে মাহতিমের। কয়েক পা পিছিয়ে ধড়াম করে বিছানায় বসে পরলো সে। মুখটা দুহাতের তালুতে ঢেকে রাগ সংবরণের চেষ্টায় আছে। তরুণকে যদি এই মূহুর্তে সামনে পায় ওর শরীরের চামড়া উঠিয়ে তেজ মিটিয়ে দিবে! গলায় দড়ি বেঁধে চামড়া খসিয়ে জিপের পেছনে ছুটাবে! ওর জন্য যখন উত্তপ্ত মস্তিষ্কে উপর্যুক্ত শাস্তির চিন্তা করছিলো, তখনই চিন্তার জালে ছেদন করে নীতি বলে উঠলো, 

  - ভাইয়া তরুণ কার সাথে বাজে কাজ করেছে? কাকে মলেস্ট করে ---

প্রশ্নটা সম্পূর্ণ করতে পারলো না নীতি, পথিমধ্যে মাহতিমের তেজালো কন্ঠ এসে থামিয়ে দিলো ওকে। সেই তেজালো কন্ঠেই চিবিয়ে-চিবিয়ে বললো,

  - মলেস্ট করেনি! শালা শয়তানটা সুযোগে কোপ মেরেছে। মেহনূরকে মেবি একা পেয়েছে, ওমনেই শয়তানের জিহবা টসটস করে উঠেছে। কুত্তার মতো পেটাতে পারতাম! মারতে পারতাম হারামজাদাকে! উফ, এই মূহুর্তে কি উচিত? তাড়াতাড়ি বল কি করা উচিত? 

প্রচণ্ড উত্তেজনায় টগবগ করে উঠলো মাহতিম। রাগের চূড়ান্ত অবস্থা ওর চোখে-মুখে পরিদৃষ্ট। এই মূহুর্তে সত্যিই নিজেকে সামলাতে পারছেনা ও! কোনোভাবে তরুণকে একবার হাতের মুঠোয় এনে কেঁচে ফেলবে একদম! নীতি পরিস্থিতি ওমন গরম দেখে দ্রুত মাহতিমের উদ্দেশ্যে অস্থির ভঙ্গিতে বললো, 

  - ভাইয়া? ভাইয়া দেখো, আগে নিজেকে কন্ট্রোল করো। বেশি উত্তেজিত হয়ো না, এইসময় বাড়িতে কেউ না থাকলেও ওই বজ্জাত শেফালী কিন্তু ঠিকই ঘাপটি মেরে আছে। যদি উঁচুনিচু কিছু ঘটিয়ে ফেলো সম্পূর্ণ দায়ভার মেহনূরের উপর এসে পরবে। এসব ঘটনায় কিন্তু মেয়েরা বেশি ভিক্টিম হয়। তাই সাবধান করে দিচ্ছি ভাইয়া, নিজেকে ঠান্ডা করো। 

মাহতিম ওর কথার মাঝে দাড়ি বসিয়ে আদেশসূচকে বললো, 

  - তুই ওর রুমে যা এক্ষুনি, ওর অবস্থা কেমন সেটা দ্যাখ। আমি যা করার নিজের মতো করেই করবো। শয়তান তো জানেনা এই মাহতিম কি জিনিস। ওর মতো দশটা কুত্তাকে পায়ের নিচে মাড়াতে আমার টাইম লাগবেনা!

নীতি টান-টান পরিস্থিতির ভেতর শুষ্ক গলায় ঢোক গিললো। গলাটা স্বল্প ভিজিয়ে সম্মতির সুরে মাথা দুলিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। মেহনূরের রুমের দিকে আসতেই সৌভিকের কানে কথাটা দিয়ে গেলো। সৌভিক প্রথমে রাগে ক্ষেপে উঠলে পরক্ষণে মাহতিমের চিন্তায় সবকিছু গুলিয়ে ফেলে। তাড়াতাড়ি তৌফ ও সিয়ামের কানে কথাটা পেড়ে ফেলে। ওরা দুজনও বাকরুদ্ধ অবস্থায় দুমিনিট হা করে তাকিয়ে থাকে। এরপর মাহতিমের রুমের দিকে একসঙ্গে তিনজন ছুট লাগায়। নীতি মেহনূরের রুমে ঢুকার আগে বুদ্ধি করে প্রীতি ও ফারিনকে সবকিছু বলে দেয়। এদিকে শানাজ দরজা চাপিয়ে ঘুমাচ্ছে দেখে ওকে আর ডাকে না। সুরাইয়া এখন কোথায় আছে সেটা কেউ জানেনা। নীতি, প্রীতি, ফারিন একসাথে তিনজন মেহনূরের রুমে আসলো। বিছানায় চোখ বন্ধ করা অবস্থায় মেহনূর চেতনাশূন্য হয়ে আছে। তিনজন সেই দৃশ্য দেখে নিজেদের মুখের পানে কিছুক্ষণ চাওয়া-চাওয়ি করে। চোখের ইশারায় কিছু সায় বুঝিয়ে বিছানার কাছে চলে আসে। নীতি ওর মাথাটা নিজের কোলে নিয়ে বসে। প্রীতি রুমে গিয়ে নিজেদের লাগেজ থেকে গ্লুকোজের বয়াম খুলে একটা ফ্লাক্সভর্তি গ্লুকোজের পানি নিয়ে আসে। ফারিন একটা গামছা নিয়ে সেটা ভিজিয়ে এনে মেহনূরের হাত ও পায়ের তালু মুছে দেয়। প্রীতি চামচে করে গ্লুকোজের পানি ধরলে নীতি ওর ঠোঁট ভেদ করে সেটা খাইয়ে দেয়। প্রীতি ফ্লাক্সের ছোট কাপ থেকে চামচ দিয়ে গ্লুকোজ নিতেই ক্ষুদ্ধ স্বরে বলে, 

  - এই বাড়ির মানুষগুলো খুবই আজব আপু। মা এদিকে মেয়ের খেয়াল রাখেনা, দাদা বাড়ির গোপন খবর জানেনা, শেফালীর আকাম কারোর চোখে দেখেনা। আবার আজকে দেখো, তরুণের মতো খবিশও সাহস পেয়ে গদগদে হয়ে ওর গায়ে হাত দিয়েছে। আচ্ছা সব ঘটনা মেহনূরের সাথেই কেনো ঘটে আপু? কি এইটার রিজন? 

নীতি ব্যস্ত ভঙ্গিতে একনজর প্রীতির দিকে তাকালো। খাওয়ানোর জন্য মেহনূরের ঠোঁটে চামচ কাত করতেই শান্ত স্বরে বললো, 

  - মেয়েটার দিকে ঠিকমতো তাকিয়ে দ্যাখ, তাহলেই আসল ঘটনা বুঝবি। 

নীতির এমন কথায় আগা-মাথা কিছুই বুঝলো না প্রীতি। তবুও বড়বোনের কথায় মান্য করে মেহনূরের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকালো। মেহনূরের দিকে নিবিড় চাহনিতে তাকিয়ে থাকলে পাশ থেকে ফারিন বলে উঠে, 

  - মেয়েটা যে একটু বেশিই সুন্দর এটা তুমি দেখো না? একটা মেয়ে যে ওর সৌন্দর্য্য দেখে হিংসা করতে পারে এটুকু বুঝো না? ওর বোনগুলোর মধ্যে সুরাইয়া এক নাম্বার ফাজিল। ওই মেয়েকে দেখলে জুতিয়ে মারতে ইচ্ছে করে। 
  
ফারিনের কথা শেষ হতেই প্রীতি তীক্ষ্মদৃষ্টি ফেলে ভাবুক চিন্তিত ভঙ্গিতে বলে,

  - আচ্ছা ফ্রক পরিয়ে দিলে কি সত্যিই ওকে বাচ্চা লাগবে? মাহতিম ভাই কি তখন কন্ট্রোল অপশনে থাকতে পারবে? আমার কিন্তু মেয়েটার ফেস মারাত্মক লাগে। 

প্রীতি কথাটুকুর ইতি টানবে ওই মূহুর্তেই চট করে ফারিন বলে উঠে, 

  - সবাই যে এই সময়টায় ঘুমায় এটারই সুযোগ নিয়েছে। তরুণ তো দেখি ডেন্ঞ্জারাস টাইপের চালাক! ওর চালাকি কি কেউ ধরতে পারলো না? 

নীতি এবার মুখ খুলে স্বাভাবিক কন্ঠে বললো, 

  - মুখে যদি নকল চেহারা পরে থাকে তাহলে ভালো মানুষরা অবশ্যই ঢপ খাবে। শেফালী মামী ছাড়া সবাই কিন্তু ভালো মনের মানুষ। সবাই যথেষ্ট সহজ-সরল। অন্য দশটা গ্রামের মহিলার মতো উনাদের মনে অতো ঘুরপ্যাঁচ নেই। কিন্তু যা কাহিনী ঘটানোর এই জমিদার বাড়িতে শুধু শেফালী মামীই করে। আর নিজের মেয়েটাকেও খারাপভাবে এক্সপার্ট বানিয়েছে। দেখলি না? কিভাবে মাহতিম ভাইয়ের কাছে চিঠি গুঁজে দিয়েছে। এগুলাকে থাপড়ানো উচিত। হান্নান নানা যদিও সহজ মনের মানুষ কিন্তু আমার মনেহয় তিনি অবশ্যই সবকিছু টের পাচ্ছেন, অথচ মুখে কিছু স্বীকার করছেনা। বাড়ির মধ্যে যদি কলহ সৃষ্টি হয় সেটা কিন্তু বাইরের গ্রামবাসীরা ভালো নজরে দেখবেনা। 

নীতির যুক্তিপূর্ণ কথা শুনে দুজন চুপ করে থাকলো। কিছুক্ষণের মধ্যে মেহনূর চোখ খুলে সম্বি ফিরে পেলে স্বাভাবিক অবস্থায় একটু-একটু করে চেতন ফিরে এলো ওর। তবুও দুদফা বমি করলো আবারও। শানাজ ততক্ষণে ঘুম থেকে উঠে গেলে প্রথম কয়েক মিনিট মূর্খের মতো তাকিয়ে রইলো শানাজ। তারপর ধীরে-ধীরে যখন সম্পূর্ণ ঘটনা জানতে পারলো সে মূহুর্তে আর স্বাভাবিক রূপে থাকলোনা ও। গর্জে উঠেই হোক বা গালির চোটে, তরুণের গুষ্ঠি তখন শানাজ একদম চোটপোট করে দিচ্ছে। সাবা এই ঘটনা জানার পর ভয়ে কেমন গুটিয়ে গেলো। কিন্তু সুরাইয়া তখনও লাপাত্তার নজিরে রইলো। শেফালী ঘুম থেকে মাগরিবের আযানের সময় উঠলেন। আঙিনায় এসে যখন সুনশান নিরবতা দেখলেন, সেই সঙ্গে যখন বাড়ির ভেতর ওমন সন্ধ্যার অন্ধকারে বাতিহীন অবস্থা ছিলো, তখন শুধূ মেহনূরের রুমেই আলো জ্বালানো হয়েছিলো। আবার সেখান থেকেই অনেকগুলো স্বরের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিলো। শেফালী মাথায় ঘোমটা টেনে মোটা শরীরটা নিয়ে সিড়ি ধরে মেহনূরের রুমের দিকে এগুতে লাগলো। ক্রমেই যখন পা এগিয়ে রুমের এসে দাড়ালো, তখন সাদা পর্দা সরাতেই রুমভর্তি সকলকে যেনো একত্রে দেখতে পেলো। শেফালীকে আচমকা দরজার সমুখে দেখে পিনপতন নিরবতায় চুপ গেলো সবাই। মেহনূরকে বিছানার মাথার সাইডে পিঠ লাগিয়ে বসতে দেখা যাচ্ছিলো। চুলগুলোও কেউ সুন্দর করে ফ্রেন্ঞ্চ বেণী করে দিয়েছে ওর। মাথার সবগুলো চুল পেছনে টেনে মোটা একটা বেণী ঝুলছে। কপালের কাছে মাথার শুরু-প্রান্তে ছোট-ছোট চুলগুলো ছেয়ে আছে। মলিন-উদাস-বিষণ্ণতায় ঢেকে থাকা উজ্জ্বল-লাবণ্য-সুন্দর মুখটা একটু যেনো তর্জমা করে দিয়েছে কেউ। সবই শেফালী খুটিয়ে খুটিয়ে দরজার দ্বারপ্রান্তে দাড়িয়ে পরোখ করছিলো। শেফালীকে ওমনভাবে তাকাতে দেখে সাবির সৌভিকের দিকে সুক্ষ্ম ইশারা করলো। সেই ইশারার ইঙ্গিত ধরে সৌভিক তৎক্ষণাৎ হাসি দিয়ে বললো, 

  - মেজো মামীর আগমন কি করে হলো? আসেন মামী। আসেন দু'কাপ চা খেয়ে গল্প করি। 

শেফালী ওর কথা শুনে সৌজন্যতার খাতিরে হাসি দিলো। তাও হাসিটা কুশ্রী লাগলো। মনে-মনে নাক ছিটকালো সৌভিকরা, কিন্তু মুখের ভাবে সেটা একটুও প্রকাশ করো না। শেফালীর দিকে নমনীয় কন্ঠে শান্ত ভঙ্গিতে বললো শানাজ, 

  - মেজো মা, আপনার কি কিছু দরকার? 

শেফালী এবার নিরবতার সুতো কেটে বললেন,

  - ঘরে যে বাত্তি জ্বালাইতে হয় এইটা কি মনে থাকেনা? ঘরদোর তো আন্ধার হই গেছে। এট্টু পর আব্বা আসি দেখলে গজগজ করবে। 

সিয়াম একচুলও শেফালীকে সহ্য করতে পারছেনা। ঝাড়ু এনে যদি ঝাটের মতো বিদায় করা যেতো তাহলে সিয়াম দেদারসে সেটাই করতো। কিন্তু ভদ্রতার খাটিরে সেটা করতে পারছেনা। সৌভিক মনে-মনে ভয় পাচ্ছে যদি হুট করে মাহতিম এ ঘরে ঢুকে, না-জানি এই মহিলা বিবিসির দশটার খবর রটাতে থাকে। মাহতিম এখন না আসলেই চলে। এদিকে মেহনূর চুপচাপ নতমুখে বসে থাকলে পাশ থেকে ওর হাতটা শানাজ মুঠোয় চেপে ধরে। একটুখানি দৃষ্টি তুলে আড়চোখে শানাজের দিকে তাকাতেই দেখলো শানাজ শেফালীর দিকে তাকিয়ে আছে। শেফালী সকলের দৃষ্টিতে যখন অস্বস্তিতে ফাসঁলো, তখন বাধ্য হয়ে নামাজের উছিলায় নিচে চলে গেলো। সবাই হাঁফ ছেড়ে বাচঁলেও মেহনূর মনের ক্যানভাসে যেই বিভীষিকা ঘটনার চিত্র এঁকে ফেলেছিলো, সেটা মুছে বড় দুঃসাধ্য ওর জন্য। কিন্তু ফারিনের কথায় চিন্তাচেতনা থেকে সৎবিৎ ফিরে পেতেই ফারিনের মুখ থেকে শুনলো, তরুণ নাকি এখনো বাড়িতে আসেনি। ও যদি বাড়িতে ফিরে তাহলে কোনদিক থেকে যে হিংস্র হামলা ঝাঁপিয়ে পরবে সেটা ওরা জানেনা। মাহতিম নাকি নিজের রুমের ভেতর কাউকে ঢুকতে দিচ্ছেনা। দরজা যদিও আটকানো না, কিন্তু ওর বিধিনিষেধ অমান্য করা কারোর পক্ষেই সম্ভব না। সবই চুপচাপ শুনছিলো মেহনূর, সবাই চা-নাস্তার খাবারগুলোতে মুখিয়ে থাকলে মেহনূর একটা কিছুও মুখে তুললো না। শানাজ অনেকক্ষণ পর নিজের চাপা উদ্বেগ প্রকাশ করে ফেললো। তীব্র উৎকন্ঠায় জর্জরিত হয়ে বললো, এই ঘটনার কথা বড়দের মধ্যে কাউকে জানাতে না। শানাজের মা অর্থাৎ সুজলা জানলে আর কখনোই ওদের স্কুল-কলেজ যেতে দিবেনা। পথেঘাটে মানুষ ছি ছি করবে এসব ঘটনা সুজলৃর নিশ্চয়ই পছন্দ বেনা। হান্নান শেখও বাড়ির বাইরে পা ফেলতে দিবেনা। মেহনূরের মা যদিও সাদাসিধে মহিলা, কিন্তু এসব ঘটনা শুনলে তিনিও ঠান্ডা মেজাজে থাকবেননা। সবাই একমনে শানাজের কথা শুনলো কিন্তু পথে-পথে নীতি, সৌভিক, ফারিন, সামিক দফায়-দফায় বাধা দিয়ে প্রতিবাদী হওয়ার জন্য রুখতে বললো। কিন্তু শানাজ সেসব কথা মানতে নারাজ। এটা মূলত শহর নয়, এটা একটা গ্রাম। এ গ্রামে একবার দূর্নাম রটে যায়, আর সেটা যদি বাড়ির ভেতর থেকেই ঘটে তাহলে মান-সম্মান সব ধূলিসাৎ হতে একসেকেন্ড লাগবেনা। জমজমাট আলোচনা দীর্ঘসময় নিয়ে শেষ করলো শানাজ। প্রতিটি পয়েন্ট সুন্দর এবং যুক্তি দিয়েই বুঝালো। সঙ্গে এটাও বুঝালো মাহতিমকে থামতে। ও যেনো তরুণের গমনে কোনো গণ্ডগোল না করে। তরুণকে বিদায় করার জন্য চোরা পথ অবলম্বন করা লাগবে। ওর মতো ধুরন্ধর ব্যক্তকে সোজা করার জন্য ধূর্ত পরিকল্পনা প্রয়োজন। এদিকে মাহতিম তরুণকে পেটানোর জন্য, মারার জন্য যেভাবে গর্জে উঠেছে সেটা এই মূহুর্তেই থামানো অত্যাবশ্যক। কেউ কোনো পথই বের করতে পারলো না, কারোর কোনো বুদ্ধিও এখানে থামানোর কাজে আসলোনা। ঘন্টা আধা পেরিয়ে গেলে সবাই নিরুপায় হয়ে নিরুদ্যম ভঙ্গিতে বসে থাকলো। কিন্তু বুদ্ধির আসল এবং মোক্ষম সূত্রটা কেবল তৌফের মাথায় আসলো। তৌফ সবাইকে মারাত্মক ভাবে চমকে দিয়ে বললো, 

  - শুনো এ্যাটেনশন, আমি যা বলি, যেভাবে বলি, সবই প্লিজ মনযোগ দিয়ে শুনবে। আমার মাথায় একটা সলিড-প্রুফ টিকলি এসেছে। এটা যদি খাটাতে পারি, আমার কলিজা-গুরদা সব বলছে, মাহতিম আনসারী মাস্টবি-ডেফিনটলি-সিরিয়াসলি কুপোকাত হবে! 

তৌফের এমন প্যাঁচমুখো কথা শোনে সিয়াম ওর পিঠে জোরে একটা কিল বসালো। ব্যথার জন্য তৌফ ফরফর করে সবার সামনে অশ্রাব্য গালি দিলো। শেষে লজ্জায় নিজেকে আড়াল করতে যেয়ে মূল কথায় ফিরলো। 

  - আমাদের কাছে চাবি আছে, জাস্ট তালার কাছে গিয়ে চাবিটা একটু মোচড় মারা লাগবে। ব্যস, এতেই আমাদের অসাধ্য সাধন হয়ে যাবে শিওর। 

তৌফ কথাটা এমন ভঙ্গিতে বললো সবাই ওর ভ্রুঁ নাচানো দৃষ্টি ধরে আসল ব্যক্তির দিকে তাকালো। একমূহুর্ত ওভাবেই নিরবতা কাটলো, কিন্তু পরক্ষণেই সমস্বরে ' সলিড আইডিয়া ' বলে জোরে হুল্লোড় তুললে, মেহনূর তখন তীব্র শব্দের জন্য বাধ্য হয়ে দুকানে হাত চাপা দিয়ে চোখ কুচঁকে ফেললো। কয়েক ন্যানো সেকেন্ডের মধ্যে মেহনূর চোখ খুলে দেখলো সবাই ওর দিকে হাসি-হাসি দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মেহনূর বোকা-বোকা চাহনিতে ডানে-বামে সবার দিকে দৃষ্টি দিয়ে কান থেকে স্লো-মোশনে হাত নামিয়ে ফেলছে। উজবুকের মতো তাকিয়ে থাকতেই হঠাৎ মৃদ্যু স্বরে থেমে-থেমে বলে, 

  - আ-মার দি-দিকে তাকিয়ে আ-ছো কেনো?

মেহনূর আটকতে যাওয়া কথা শুনে সবাই নিজেদের মধ্যে চাওয়া-চাওয়ি করলো। পরক্ষণে তৌফ ঢোক গিলে বললো, 

  - তুমি যদি ভাইয়ের কাছে একবার যেয়ে থামতে বলো, তাহলে ভাই কোনো হাঙ্গামা করবেনা। তুমিতো বুঝতেই পারছো আমি কি বলতে চাইছি?

মেহনূর আবারও কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো, 

  - আপপনাদের কথা না শুনে ওই লোক আমার কথা শুনবে?

মেহনূরের বোকার মতো কথা শুনে সবাই মিটিমিটি হাসলো। কিন্তু এখনই কিছু ভেঙ্গে না বলে নিজ থেকে বুঝার জন্য সুযোগ রেখে দিলো। তৌফ সবার তরফ থেকে উত্তর প্রস্তুত করে বললো, 

  - মানে, ঘটনা হয়েছে কি, তুমিতো এখানে ভিক্টিম। এ্যাটলিস্ট তুমি যদি ভিক্টিম হয়ে আনসারী মশাইকে থুক্কু মাহতিম ভাইকে এখনই কিছু করতে না বলো, তাহলে তোমাদের জন্যই ভালো হবে। নাহলে ভাইসাব যে কাহিনী করতে পারে, সেই কাহিনী যদি এই গ্রামের মধ্যে ঘটে যায়, তাহলে পরদিন যুগান্তর পত্রিকায় এটা হেড শিরোনাম দেখতে পারবা। মাহতিম ভাইজান তো ভালো মানুষ না, এটা তো আমরা নেংটাকাল থেকেই জানি। এজন্য তোমাকে সাবধান করতেছি জলদি ভাইকে থামাও। বাড়ির সবার ফিরতে কিন্তু বেশি টাইম নেই। আমরা এদিকে শেফালী মামীকে টেক্কা মারতেছি। যাও, যাও উঠো। আর বসে থেকো না। তোমার শরীরে এখন আমাদের চেয়েও বেশি পাওয়ার। এই নীতি ছাগলের বাচ্চায় তোমাকে এক লিটার গ্লুকোজ খাইয়ে দিছে। এখন উঠো, শাড়ি ধরো, আর ভাইয়ের রুম দৌড় লাগাও। 

মেহনূর আবারও সবার দিকে উজবুকের মতো তাকালো। এখন ওই তরুণের জন্য মাহতিমের রুমে যাওয়া লাগবে? তাও কিনা একা-একা যেতে হবে? কি বলবে মাহতিমকে? কিভাবে গুছিয়ে বলবে এসব কথা? যতবার মাহতিমের সামনে স্বাভাবিক চেতনা নিয়ে হাজির হয়েছে, ততবারই চেতনার নাম-নিশানা পাল্টে দিয়ে অস্থির অবস্থায় কাঠ-কাঠ হয়ে গিয়েছে মেহনূর। এবার এই ভয়াবহ অস্থিরতার জন্য দেহ থেকে প্রাণ বের হয়ে যায় কিনা, কে জানে?
.
.
.
চলবে............................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন