!!৩০!!
প্রসব যন্ত্রণায় কাঁতরাচ্ছে কৃষ্ণা। অসহনীয় যন্ত্রণা ক্রমেই বাড়ছে। ঘর্মাক্ত শরীরটা অর্ধ-চেতনায় পরে আছে। সতেজ মুখখানা ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছে যন্ত্রণায়। মা হওয়া কি এতো কষ্টের! এই আটটা মাস অবশ্য যন্ত্রণা কম সহ্য হয় নি তার। দূর্বল শরীরে দু সন্তানের ভার নেওয়া যাচ্ছে কথা নয়। দেবব্রত ঠিক তার পাশে বসে আছে। কৃষ্ণার মাথাটা নিজ কোলে আগলে রেখেছে সে। মাথায় হাত বুলাচ্ছে আর ব্যাগ্র কন্ঠে বলতে লাগে,
“আর একটু সহ্য কর, এইতো পৌছে যাচ্ছি। একটু সোনা।“
ঝাপসা নয়নে দেবব্রতের দিকে তাকিয়ে থাকে কৃষ্ণা। তার মাস্টারমশাই বেশ ভয় পেয়ে আছে। এমনেই এই মাতৃকালীন সময়ে তার ভয়ের অন্ত ছিলো না। পাগলের মতো পিছু করতো কৃষ্ণার। এক এক কদম ও মেপে চলতে হতো কৃষ্ণাকে। কলেজ, পড়ানো সিকে তুলে বউকে আগলাতো সে। যতই হোক, ছোট্ট বউ তার। দেবব্রত অস্থির হয়ে বললো,
“কি করছো অর্জুন, একটু দ্রুত চালাও। কৃষ্ণার কষ্ট হচ্ছে যে।“
অর্জুন গাড়ির বেগ বাড়ালো। চিন্তিত চিত্তে অন্না বসে রয়েছে তার পাশে। কিছুক্ষণ পূর্বে সব ই ঠিক ছিলো। হুট করেই যেনো এলোমেলো হয়ে গেলো সব। কৃষ্ণার ডিউ ডেট এখনো তিন সপ্তাহ বাকি। ডাক্তার আগামী মাসের ৭ তারিখ ডেট দিয়েছেন। অথচ আজ ই তার ব্যাথা উঠেছে। কিছুক্ষণ পূর্বেও সকলের সাথে আড্ডায় মশগুল ছিলো সে। মাস তিনেক বাদে আজ এসেছে অর্জুন এবং অন্না তাদের বাড়ি। অন্নার সুখবরের দিন ঘনিয়ে এসেছে। গত সপ্তাহে জানতে পেরেছে সে মা হতে চলেছে। খুশিতে আত্নহারা হয়ে গিয়েছে অর্জুন। সেই সুখবর ভাগ করে নিতেই এখানে আসা। অথচ এর মাঝেই এই অবস্থা। আড্ডার মাঝেই ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠে কৃষ্ণা। মেয়েটা বেশ কিছু সময় ঠোঁট চেপে ব্যাথা সহ্য করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এতো যে সে ব্যাথা নয়, প্রসব যন্ত্রণা। সেটা সহ্য করা কি এতো সোজা। ব্যাথা বাড়ার সাথে সাথে দেবের পাঞ্জাবীর কোনা শক্ত করে ধরে সে। কাঁপা কন্ঠে বলে,
“মাস্টার…মশাই!”
কৃষ্ণার ব্যাথায় জর্জরিত কন্ঠ শুনেই বুকে কাঁমড় লাগে দেবব্রতের। কৃষ্ণার প্রসব যন্ত্রণা টের পেতেই তাকে কোলে তুলে নেয় সে। লাল পাড়ের সাদা শাড়িটা রক্তে ভিজে গেছে। রক্তের স্রোত দেবকে আরোও ভয়ের জালে আকড়ে ফেলে। কি হবে না তো তার কৃষ্ণার! মেয়েটাকে যে অসম্ভব ভালোবাসে সে। ভালোবাসার মাত্রাটা কোনো মাপকাঠি মাপতে পারবে না। অর্জুন ব্যাস্ত কন্ঠে বলে,
“চাবিটা আমাকে দাও। আমি গাড়ি চালাচ্ছি।“
দেব মাথা নাড়ে। অন্নার সম্ভব জেদে তাকেও সাথে আনতে হয়। অবন্তীকা দেবীর মন কু গাইছে, প্রসবের সময় এতো রক্তপাত কাউকে হতে দেখে নি সে, মেয়েটা সুস্থ হবে তো। রীতা দেবী তার কাঁধে আলতো চেপে হাত রাখেন,
“কৃষ্ণার কিছু হবে না দিদিভাই, চিন্তা করো না।“
“চিন্তা কি আর এমনি এমনি করি রে, মেয়েটা যে আমার দূর্বল। দুটো বাচ্চা বহন করা কি যাচ্ছে কথা?”
“আমাদের বউ কতো শক্ত সে তো তোমার অজানা নয়, তাহলে কিসের চিন্তা।“
“সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরলেই ভালো।“
গাড়ি চলছে, ঝুপ ঝুপ করে অঝর ধারায় বর্ষণ হচ্ছে। হবে না কেনো! দেবী আসছেন যে। দেবীর আগমনে বৃষ্টি হতেই হবে। কৃষ্ণার ধারণা দেবী তার গর্ভেই আসছেন। তার কন্যা সন্তান ই হবে। যদিও দেবের ছেলে মেয়ে কিছুতে সমস্যা নেই, তারা সুস্থ হলেই শান্তি। দেবব্রত আবেগ মাখানো স্বরে বলে,
“কৃষ্ণা, চোখ বুঝিস না। আমার সাথে কথা বল। এই তো চলে এসেছি।“
“জম…হয়তো……এসে……পড়ে……ছে……মাস্টার……মশাই”
থেমে থেমে কথাটা বলে কৃষ্ণা। তার বা চোখ থেকে পানি ঝড়ছে। দেবব্রতের বুকে কেউ যেনো ছুরিঘাত করছে এতোটা কষ্ট হচ্ছে। কৃষ্ণার এমন কথায় নিজেকে আর আটকাতে পারলো না সে। কাঁপা গলায় রাগান্বিত স্বরে বললো,
“আমার কাউকে চাই না, শুধু তুই চাই। শুধু তুই। তোর জেদ, কেনো রে বাচ্চা না হলে কি সব ধ্বংস হয়ে যেতো?”
“আজ ……ও……বকবে?”
কৃষ্ণার এমন কথায় চোখের জল ছেড়ে নেয় দেব। মুখটা আগলে অজস্র চুমু খেয়ে বলে,
“আর বকবো না। তুই একটু সহ্য কর, এইতো এসে পড়েছি।“
কিন্তু শুধু কথায় কি চিড়া ভিজে। ক্লান্ত কৃষ্ণা দুহাতে আকড়ে ধরে তার মাস্টারমশাইকে। হুট করেই মনে হলো, এই লোকটাকে বুঝি আর পাবে না সে। আর হয়তো দেখা হবে না তাদের। পরিণতির অতল গহবরে হারিয়ে যাবে কৃষ্ণা। আচ্ছা এই লোকটাকে ছেড়ে একা একা মহাজগতে কিভাবে পাড়ি দেবে সে। ভয় করবে না, করবে তো। বিয়ের ছটা বছর তো এই লোকটাকেই আঁকড়ে ছিলো সে। আর লোকটি তার ভালোবাসা, স্নেহ, আদরে আচ্ছাদনে আগলে রেখেছিলো তাকে। কৃষ্ণার চোখের সামনে সেদিনের ঘটনাটা ভেসে উঠলো। যেদিন অগ্নিকুন্ডের সামনে মাস্টারমশাই তার সিঁথিতে সিঁদুর দিয়ে রাঙিয়ে দিয়েছিলো। সেদিন তারা জানতো না ভবিষ্যতে কি লেখা। দায় ঠেকে বিয়ে করেছিলো দেব। অথচ সেই মাস্টারমশাই এর ছোট পৃথিবী রাণী হয়ে গেলো কৃষ্ণাবতী। চালচুলোহীন গ্রাম্য মেয়েটি হয়ে গেলো তার জীবনের রাজরানী, তার মনমন্দিরে পূজ্য দেবী। কৃষ্ণা অতি কষ্টে বললো,
“শোন…”
“বল”
“আমার……বালি…শের…নীচে…এক…খানা……পত্র……আছে।“
“তোর কষ্ট হচ্ছে, আমরা পড়ে কথা বলি?”
“যদি…সময়…না…পাই?”
বারবার এমন কথা শুনতে ভালো লাগছে না তার, কষ্টে বুক ঝাঝরা হয়ে যাচ্ছে। রক্তক্ষরণ হচ্ছে হৃদয়ে। বৃষ্টির বেগ বাড়ছে। বৃষ্টির সেই বৃষ্টি কেঁটে এগিয়ে চলেছে গাড়ি। আর তো কিছু মূহুর্ত। তারপর হয়তো সূখের দর্শন_______________
হাসপাতালে পৌছাতেই স্ট্রেচারে নিয়ে আসে নার্স। তারপর সেটা করে কৃষ্ণাকে প্রবেশ করানো হয় ওটি তে। ডা.নিশাত নিজেকে প্রস্তুত করছেন অপারেশনের জন্য। তাকে দেখেই এগিয়ে যায় দেব। আকুল মিনতি কর বলে,
“আমার কৃষ্ণার খুব কষ্ট হচ্ছে ডাক্তার, ওকে এই কষ্ট থেকে পরিত্রাণ দিন, দয়া করে আমার কৃষ্ণাকে বাঁচিয়ে দিন।“
“ধৈর্য ধরুন মিস্টার ভট্টাচার্য। কিছু হবে না ইনশাআল্লাহ। আমরা মানুষ, আমাদের অলৌকিক ক্ষমতা নেই। আছে উপরে যিনি বসে আছেন তার কাছে, উনি তো ধরে আছেন সবার সুতো। আল্লাহ বা ভগবান, যাই ডাকি উনি তো একজন ই। উনার কাছেই চান। ইনশাআল্লাহ উনি খালি হাতে ফিরাবেন না।“
বলেই তিনি ওটি এর দিক পা বাড়ান। দেব কি করবে বুঝতে পারছে না। তার পাঞ্জাবীটা কৃষ্ণার রক্তে ভিজে আছে। তার ছোট্ট বউ এর কাতর মুখখানা মনে পড়লেই হু হু করে উঠলো মনটা। অন্না বসলো তার পাশে। করুন চোখে তাকায় তার দিকে দেব। অন্না আশ্বস্ত করে বলে,
“কৃষ্ণার কিচ্ছু হবে না দেখো। কেবল তো ওর নতুন অধ্যায় শুরু হলো। মাতৃত্বের অধ্যায়। সেই মাতৃত্বের অধ্যায়ে ভগবান তাকে নিয়ে যাবে না। এই বাচ্চাগুলোর জন্য কম লড়াই তো করে নি সে। তোর সাথেও লড়েছে।“
“কেনো লড়তে গেলাম রে, সেদিন যদি ওকে আগলে নিতাম।“
“সেগুলো তো অতীত দাদা, অতীত অতীত ই হয়।“
অর্জুন এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। কৃষ্ণার জন্য তার কষ্ট হচ্ছে ঠিক ই। কিন্তু ভয় হচ্ছে অন্নাকে নিয়েও। সেও তো মা হতে চলেছে। তাকেও কি এতোটাই কষ্ট করতে হবে? ভেবেই বুক কাঁপছে অর্জুনের। এই বাচ্চা মেয়েটাকে যে খুব ভালোবাসে সে। ওর কিছু হলে পাগল হয়ে যাবে সে। তার হেমনলিনীতে আসক্ত যে সে। অন্না অর্জুনের দিকে তাকায়। অর্জুনের ভীতু নজরকে বুঝতে সময় লাগে না তার। কিন্তু এখন দেব কে সামলানো টা বেশ জরুরী।
ঘন্টা পেরিয়ে যাচ্ছে। এখনো কোনো খবর আসছে না ওটি থেকে। দেব বারংবার তাকাচ্ছে ওটির দিকে। নাহ কেউ আসছে না। ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে। এতো সময় কেনো লাগছে। হঠাৎ একজন নার্স বেরিয়ে আসে। দেব ছুটে যায় তার কাছে। আকুল কন্ঠে বলে,
“কি হয়েছে, কৃষ্ণা, আমার বউ ঠিক আছে?”
“ব্লাড লাগবে, এ পজেটিভ। পারলে ম্যানেজ করুন। আমরা আমাদের ব্যাংক এ খোঁজ নিয়ে আসি।“
ব্লাডের কথা শুনেই এগিয়ে আসে অর্জুন। তার ব্লাড এ পজেটিভ। সে আকুল কন্ঠে বলে,
“আমি এ পজেটিভ।“
“আসুন আমার সাথে”
নার্স অর্জুনকে নিয়ে চলে যায়। দেব ঝাপসা নয়নে ওটির দিকে তাকিয়ে থাকে। মনে মনে ঈশ্বরকে ডাকে। তার কিছু লাগবে না, কৃষ্ণা হলেই সই। শুধু কৃষ্ণাকে চাই তার।
ঘন্টা দুই বাদে, দুটো কন্যে সন্তান নিয়ে বের হয় দুজন নার্স। ফুটফুটে দুটো সন্তান। ফর্সা পুতুলের মতো তারা, চোখের পল্লব টানাটানা। এখনো চোখ খুলে নি। নার্স দুজন দেবের দিকে তাকিয়ে বলে,
“মিস্টার ভট্টাচার্য, অভিনন্দন। মেয়ে হয়েছে আপনার।“
দেব এগিয়ে যায় নার্সের দিকে। কৃষ্ণার প্রতিরুপ হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তারা। অন্না একটা বাচ্চাকে কোলে নেয়। আরেকটি বাচ্চা দেবের কোলে থাকে। দেব আকুল কন্ঠে বলে,
“আমার বউ? ও ঠিক আছে?”
নার্স দুজন মুখ চাওয়া চাওয়ি করে। তাদের মুখের রঙ পালটে যায়। এতে দেবের মনের আশংকার ঘন মেঘ বাড়ে। আকুল কন্ঠে বলে,
“বলছেন না যে?”
এর মধ্যেই ডা.নিশাত বের হন। দেব অর্জুনের হাতে নিজের কন্যাকে দিয়ে এগিয়ে যায় তার কাছে। আকুল কন্ঠে বলে,
“আমার বউ ঠিক আছে তো?”
ডা.নিশাত খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলেন
“ক্ষমা করবেন দেবব্রত, আমরা অনেক চেষ্টা করেছি।“
কথাটা শুনতেই ধপ করে বসে পড়ে দেবব্রত। পৃথিবীটা মূহুর্তেই অন্ধকার হয়ে যায় তার। কৃষ্ণা ছাড়া এই রঙিন পৃথিবী অন্ধকার। তার জীবন অন্ধকার।
____________________________________________________________________________________________________________________________
অগ্রহায়ণের প্রথম সপ্তাহ,
প্রকৃতির রুপ বদলাচ্ছে। ঝিরিঝিরি শীত আলতো পায়ে পা রাখছে পৃথিবীতে। গাছের পাতায় হলুদ বর্ণ ধারণ করেছে। পুজো কেটে গেছে মাস পেরিয়েছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে দেবব্রত। হাতে কৃষ্ণার চিঠি। চিঠিটা কম হলেও হাজার বার পড়া হয়েছে। কিন্তু এখনো যেন হাস মিটেনি। আজও পড়বে সে চিঠিটা,
মাস্টারমশাই,
হাহাকার শুনতে পাচ্ছো?? হ্যা হ্যা হাহাকার, তোমার দেয়া শূন্যতার হাহাকার৷ নিজের মাঝে চাপিয়ে রাখা কষ্টগুলো আজ আত্নচিৎকারে লিপ্ত যে। আজ শূন্যের মাঝে বিলীন আমি; আমাকে যখন খুজতে যাবে, হাড্ডিপিঞ্জরের মাঝে শুধু শুন্যতাকেই খুজে পাবে। অবশ্য এসব তোমার কাছে নিছক ন্যাকামি মাত্র। আমার কষ্টগুলো সর্বদা তোমার কাছে বাচ্চামি ছিলো। ভেবো না দোষ দিচ্ছি, না কখনোই না। কোনো অভিযোগও করছি না, তবে একটা শেষ আবদার করতে চাই রাখবে? যেদিন আমাকে ওই চিতায় তুলবে তখন একবারের জন্য সিঁদুর খানা আদরের সাথে পরিয়ে দিও। বিয়ের পর থেকে এই একটা সাদ আমার পূরণ হয় নি গো। আর একটা বেলীফুলের মালা আমার খোপাতে পরিয়ে দিও৷ হয়তো সেদিনও তোমার আমার প্রতি বিতৃষ্ণা লাগবে, তবুও মুখাগ্নি তুমিই করো কিন্তু। জানি বেশি কিছু চাইছি তবে বিশ্বাস করো, এটাই আমার শেষ চাওয়া গো মাষ্টার মশাই। আর এই কৃষ্ণা তোমাকে জ্বালাবে না, কখনই না।
ইতি,
তোমার বউ কৃষ্ণা
চিঠিটা কৃষ্ণা লিখেছিলো তার গর্ভাবস্থায়। তখন মেয়েটা অসহ্য হয়েছিলো দেবের অনীহায়। জেদ চেপে বসেছিলো যে দেব। ভেতরে বাচ্চার কন্দন শোনা যাচ্ছে। দেব চোখের পানি মোছে। ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখে কন্যা দুজন একত্রে চিৎকার করছে। ক্ষুধা লেগেছে হয়তো। দেব তাদের কাছে যায়। ব্যাকুল স্বরে বলে,
“আমার মায়েরা, কাঁদছো কেনো? ক্ষুধা লেগেছে?”
এর মাঝেই এক নারী কন্ঠ শোনা যায়। খানিকটা রেগেই বললো,
“তুমি কি গো মাস্টারমশাই? একটু সময় সামলাতে পারো না। দুখান বাচ্চা ই তো?”
দেব পেছনে ফিরে, মাত্র স্নান সেরে এসেছে কৃষ্ণা। তার শাড়ি ভিজে লেপ্টে আছে শরীরে। চুলে গামছাটা কোনো মতে জড়ানো। দু বাচ্চার মা সে, এক দন্ড শান্তি নেই তার। সেদিন শেষ রক্ষা হয়েছিলো। দেবব্রতের প্রার্থনা ফিরিয়ে দিয়েছিলো তাকে। অবস্থা খারাপ ছিলো। নিশাত আশা ছেড়ে দিয়েছিলো। রক্তক্ষরণে দূর্বল শরীর বেঁচে ওঠার সকল আশা ছেড়েছিলো। কিন্তু ঈশ্বরের মায়া, তার কাছে মানুষ কি করবে। দশদিন আইসিউ তে থাকার পর অবশেষে উন্নতি হয় তার। ফিরে আসে দেবের কাছে। কৃষ্ণা যখন আইসিউ তে তখন এই চিঠিটা পেয়েছিলো দেব। পড়েছিলো আর খুব কেঁদেছিলো। অসামান্য গ্লানি তাকে প্রতিনিয়ত খুবলে খেতো। কিন্তু ঈশ্বর তাকে দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছেন। তাই তো রোজ সন্ধ্যায় কৃষ্ণার জন্য বেলী ফুল নিয়ে আসে সে। কৃষ্ণা বাচ্চাদের দুধ খাওয়ায়। তারা ঘুমিয়ে গেলে দাঁড়ায় আয়নার সামনে গামছা খুলে চুল ঝাড়া দেয়। তখন দেব দাঁড়ায় তার সামনে। সিঁদুরের কৌটা টা নেয় হাতে। কৃষ্ণার মুখ উঁচিয়ে ধরে। রাঙ্গিয়ে দেয় তার সিঁথি। নাকেও পড়ে খানিকটা সিঁদুর। লজ্জায় লাল হয়ে উঠে কৃষ্ণা। লাজুক স্বরে বলে,
“বুড়ো বয়সে কি ভীমরতি হয়েছে?”
“উহু, প্রেম বেড়েছে।“
“তাই বুঝি?”
“হু”
বলেই পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে কৃষ্ণাকে। ঘাড়ে মুখ ডুবায়। কৃষ্ণা তাকিয়ে থাকে তার মাস্টারমশাই এর দিকে। হঠাৎ বলে,
“সেদিন ফিরে না আসলে কি করতে?”
“এক সাথে চিতায় উঠতাম”
জড়তাবিহীন কন্ঠে দৃঢ় ভাবে বলে দেব। কৃষ্ণা ঘুরে তার ঠোঁটে হাত রাখে। বলে,
“বালাই ষাট, এ বলতে আছে। আমার বয়স ও আপনি পান, এ কামনা করি। শূন্য সিঁথিতে চিতায় উঠবো না”
“উহু, কামনা করলে কর যেনো একই সাথে যম আমাদের নেয়। তোকে ছাড়া আমি যে শূন্য।“
বলেই জড়িয়ে ধরে কৃষ্ণাকে দেব। আকুল স্বরে বলে,
“একখানা গান গাবি? বহুদিন তোর গান শুনি না”
“ওরা যে ঘুমোচ্ছে। উঠে গেলে?”
কৃষ্ণার প্রশ্নে হাসে দেব। তারপর কোলে তুলে নেয় তাকে। বারান্দার আরাম কেদারায় কোলে নিয়েই বসে। কৃষ্ণা মাথা রাখে তার মাস্টারমশাই এর বুকে। তখন ধীর কন্ঠে সুর তোলে সে,
“টাপুর টুপুর বৃষ্টি নূপুর জলছবিরই গায়
তুই যে আমার একলা আকাশ
মেঠো সুরের ছায় রে মেঠো সুরের ছায়
রংবেরং এর বেলোয়ারি সাতরঙা রংমুখ
তোর মুখেতেই লুকিয়ে আছে
জীবন ভরের সুখ রে জীবন ভরের সুখ”_____________
হঠাৎ ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়। সেই বৃষ্টি আছড়ে পড়ে কৃষ্ণা এবং দেবের দিকে। কিন্তু তাদের কি হুশ আছে। তারা তো লেপ্টে আছে একে অপরের আলিঙ্গনে। ভালোবাসাগুলো হয়তো এতোটাই স্নিগ্ধ হয়_________
.
.
.
সমাপ্ত...........................