মোমবাতি নিভানোর পর কেবল তপ্ত নিশ্বাসের শব্দ শোনা যাচ্ছিলো। সেই তপ্ত নিশ্বাসের প্রতিটা ঝাপটা মেহনূরের গালের উপর আছড়ে পরছিলো। মেহনূর বিমূঢ় অবস্থায় বসে থাকলেও মাহতিমের হাতের মুঠোয় ছোট্ট নরম হাতটা শক্ত করে আবদ্ধ ছিলো। মাহতিম কি করতে চাইছে এখনো সেটা অস্পষ্ট, তাই মেহনূর পরিস্থিতির উপর নির্ভর হয়ে চুপচাপ সব সহ্য করছিলোম এমনি সময় হঠাৎ করে মাহতিম নিরবতা চ্ছিন্ন করে একটুখানি কাশলো। কোমল আর্দ্র নরম কন্ঠে অসহায় সুরে বললো,
- আমি যে অসভ্য সেটা আরেকটু প্রমাণ করলাম মেহনূর। তবে সেদিন রাতে এমনই করে তুমি আমার হাতটা ধরতে চেয়েছিলে। সেটা ঘুমের ঘোরেই হোক বা অন্য কোনো কারনে, তুমি কিন্তু আমার হাতে চুমু খেয়েছিলে। আমি যেহেতু অসভ্য, তাই সেটার শোধবোধ নিশ্চয়ই করতে পারতাম। কিন্তু করিনি।
মাহতিম কথাটুকু শেষ করে মেহনূরের প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য থামলো। সেই ঘুটঘুটে অন্ধকারে মেহনূর ঝরঝর করে কেদেঁ উঠলো, কিন্তু শব্দ হলোনা একটুও। মেহনূরের কান্নার শব্দ যখন হেচকির সুর তুললো, তখন ওই মূহুর্তে আকড়ে ধরা হাতটা মাহতিম ধীরগতিতে উপরে উঠালো। অন্ধকারে মুখও দেখা যাচ্ছিলোনা মাহতিমের, সেই অবস্থায় হঠাৎ করে হাতের উল্টোপিঠে নরম ওষ্ঠের উষ্ণছোঁয়া অনুভব করলো মেহনূর। অস্ফুট শব্দ করে তুমুল আকারে কেঁপে উঠলো সে। কিন্তু মাহতিম সেটা দমন করে মৃদ্যুকন্ঠে বলে উঠলো,
- হিসাব সমান-সমান হলো। সবসময় একটা জিনিস মনে রাখবে, নিজেকে এতোটাও বেকুব বানিয়েও না, যেটা তোমার জন্য ক্ষতির কারন হবে। আজ শুধু একারনেই এসেছি, মলমটা দিয়েছো কিনা সেটা দেখতে। কিন্তু আফসোস, ভংচং করে সেটা আর লাগাওনি। যাইহোক পরবর্তীতে ইনফেকশন হলে শহরে আসার অনুরোধ রইলো। আর পারলে অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলো ভুলার চেষ্টা করো। আজকের পর থেকে না তুমি আমায় চিনো, না আমি তোমায় চিনি। পূর্বে যেভাবে ছিলে, সেভাবেই যেনো সব চলতে থাকে। আমি মাত্র কিছুদিনের জন্যই আছি, তাই কষ্ট করে আমার সামনে থেকে নিজেকে একটু দূরে রাখার চেষ্টা করো।
কথা শেষ করতেই হাত ছেড়ে দিলো মাহতিম। সেটা এমনভাবে ছেড়ে দিলো, সেটা যেনো ছুঁড়ে মারার মতো ঘটনা হলো। বিছানা থেকে নেমেই টেবিলের উপর মোমবাতি রেখে দিলো। পাশ থেকে দিয়াশলাই নিয়ে মোমবাতি জ্বালিয়ে চুপচাপ ডোন্ট কেয়ার ভঙ্গিতে চলে গেলো। একবারও পিছু ফিরে তাকালোনা মেহনূরের দিকে। ফিরেও দেখলোনা মেহনূর কতটা আশ্চর্য হয়ে হকচকিয়ে গিয়েছে। হতভম্ব মেহনূর তার হাতটা ঘুরিয়ে উল্টোপিঠের দিকে তাকালো, নাক টেনে বাম হাতের তালুতে চোখ মুছে সেই ওষ্ঠ স্পর্শ করা জায়গাটা দেখতে লাগলো। আজ এবং এই প্রথম বোধহয় পুরুষের স্পর্শ পেলো মেহনূর,হাতের উল্টোদিকটা অনিমেষ নয়নে দেখতে থাকলে আচমকা পুরো রুম আলোকিত হয়ে কারেন্ট চলে এলো। ভেজা চোখে রুমের চারপাশ দেখতেই মনে হলো, এই অন্ধকার, এই কারেন্ট, এই নিস্তব্ধতা যেনো মাহতিমের ইচ্ছায়, স্বেচ্ছায়, ইশারায় হয়েছিলো। এতে যেনো কাকতলীয় ঘটনা ছিলোনা।
.
সকালের নির্মল পরিবেশটা সূর্যের তীব্রতায় দুপুরের দাপটে পরিণত হলো। বাড়িতে আজ বড় করে খাওয়া-দাওয়ার ধুম লেগে গেলো। শুরু হলো রান্নার জন্য মহিলাদের দৌড়াদৌড়ি, পানি আনার জন্য মেয়েদের ছুটাছুটি, সবজি কুটার জন্য সকলের হাতাহাতি একসঙ্গে শুরু হলো সকাল থেকে।সুজলা, শেফালী, মাহমুদা রান্নাঘরে গিয়ে সব কাজ দেখতে লাগলো, মারজা এসে যুক্ত হলো ধনিয়াপাতা বাছার কাজে। কিন্তু সবচেয়ে কঠিন কাজের একটা এসে পরলো শেফালীর কাধে। কচুর লতি কাটার মতো ভয়াবহ চুলকানির কাজটা শেফালীর করতে হবে। উপায় ঠাহর করতে না পেরে ডালাভর্তি কচু এনে আঙিনায় এসে বসলো তখন। এদিকে শানাজ, সাবা, সুরাইয়া, মেহনূর উঠানের দিকে বড়ই পারার কাজে ছিলো, হঠাৎ সেদিকে চোখ পরতেই শেফালী এক হাঁক দিয়ে সবগুলাকে আঙিনায় এনে হাজির করলো। শানাজ কচুর ডালা দেখেই বুঝে যায় মেজো মা এখানে খাটাতে ডেকেছে। শেফালী সবগুলার দিকে তিরিক্ষি দৃষ্টি ছুড়ঁলে শেষমেশ প্রতিশোধের মেজাজটা মেহনূরের উপর ফলিয়ে বললো,
- এ্যাই ঢঙি, এইদিকে আয়। এই পিড়িতে বসতে পারবিনা তুই? নাকি কোমর নিয়া টাফালিং করবি?
মেহনূরের ঘা-টা সকাল থেকেই শুকিয়ে আসছে, কিন্তু বেশি চাপের কাজ করলে জায়গাটা ফের কাঁচা হয়ে যাবে। মেহনূরের ওমন নিরবতার দেখে ধমকে উঠলো শেফালী। একসঙ্গে চারবোনই প্রচণ্ডরূপে ভয়ে চমকে উঠলো। মুখ কালো করে চোখ নিচু করে সবাই কাঁচুমাচু করছিলো। কিন্তু শেফালী সেটা ভঙ্গ করে হাত ধরে টেনে মেহনূরকে পিড়িতে বসিয়ে দিলো। রান্নাঘরের দিকে একপলক দৃষ্টি দিয়ে মাথার ঘোমটা আরেকটু মাথায় টেনে এবার বাকি তিনজনের দিকে ক্ষীপ্ত দৃষ্টিতে তাকালো। কপাল কুঁচকে এমন গালি দিলো কেউ আর দাড়ালো সেখানে। মেহনূর জানে, সে যদি এই মূহুর্তে একটা টু শব্দ উচ্চারণ করে তাহলে ঠাস করে চড় মারতেও এই মহিলা দেরি করবেনা। বাড়িতে সৌভিক, নীতিরা গ্রাম দেখতে মাইক্রো নিয়ে বেরিয়েছে। কাছাকাছি সুন্দর জায়গাগুলো দেখতে কিছুসময়ের জন্য বাইরে গেছে। মাহতিমও জিপ নিয়ে কিছু সময়ের জন্য ভিজিটিং স্পট দেখতে গিয়েছে। এদিকে ঘন্টার-পর-ঘন্টা কচু কেটে হাত কালো হয়ে যায় ওর, মারাত্মক চুলকাতে শুরু করে হাতের তালু। একদিকে হাত চুলকাতে থাকে, অন্যদিকে কাত থাকে কচু। দূর থেকে শানাজ, সাবা সব দেখলেও মেজো মার ভয়ে একপাও এগুতে পারছেনা, অপরদিকে সুরাইয়া শেফালীর সাথে চৌকিতে বসে এ্যালোভেরার জেল বের করছে। ফেসপ্যাকের জন্য চন্দন গুড়া, মুলতানি মাটি মিক্স করে সেখানে এ্যালোভেরার জেল নিংড়ে রাখছে। হঠাৎ আরো উপাদান মিশানোর জন্য শেফালী দ্রুত মেয়েকে নিয়ে ঘরের মধ্যে চলে গেলো। ঠিক ওইমূহুর্তেই জিপের শব্দ তুলে মাহতিম এসে ভিড়লো। কানে ফোন এঁটে পকেটে হাত গুঁজিয়ে ব্যস্ত ভঙ্গিতে বাড়িতে ঢুকলো মাহতিম। মেহনূর যে আঙিনার মাঝখানে বসে কচু কাটার যন্ত্রণায় হাঁশফাস করছিলো সেটা একপলকের জন্যও দৃষ্টিগোচর হলোনা মাহতিমের। দ্রুতপায়ে আঙিনা পেরিয়ে সোজা সিড়ি ধরে উপরে উঠলো, ওই অবস্থাতেই রুমের দরজা খুলে সেটা ভিড়িয়ে দিলো। মেহনূর আড়চোখে মাহতিমের কীর্তিকলাপ পর্যবেক্ষণ করলেও এই মূহুর্তে বীভৎস জ্বালায় নাস্তানাবুদ হয়ে গেলো। কাজ শেষে পুরো হাত কালো কুচকুচে হয়ে তীব্র চুলকানিতে বিষিয়ে উঠলো। এদিকে কলপাড়ে যেয়ে নিরব চিত্তে হাত ধুচ্ছে মেহনূর। সাবা কল চেপে দিলে শানাজ মগ কাত করে ওর হাতে পানি ঢালছে। শানাজ রাগে গজগজ করতেই ক্ষীপ্র সুরে বলে উঠে,
- মেজো মা এই কাজটা ইচ্ছে করে করলো। সে ঠিকই জানতো তোর অবস্থা এখন খারাপ, আর তুই কচু কাটার জন্য উপযোগী না। এই বদমাইশ মহিলা আমাদের শান্তি দিলো না মেহনূর, একটুও শান্তি দিলো না। কাকা যে কেমন বজ্জাত মহিলাকে বিয়ে করেছে সেটা যদি এক ইঞ্চি কাউকে দেখাতে পারতাম? পোড়া কপাল! কেউ জানেও না এই শয়তান মহিলা আমাদের তিনজনকে খাটিয়ে মারছে। অথচ দ্যাখ, নিজের মেয়েকে রূপচর্চা করাচ্ছে। ফালতু মহিলার জায়গায় এখন সুরাইয়ার উপর জিদ উঠে! কষিয়ে যদি মারে পারতাম? হারামিটা কেমন পল্টি মেরে মায়ের সাথে ঢ্যাং ঢ্যাং করে চলে গেলো। এমন বোন কিভাবে জুটলো রে মেহনূর? আমাদের সাথে থাকার পরও এতোটা নির্লজ্জ, বেহায়া, স্বার্থপর হয়েছে সেটা মুখে বলতেও লজ্জা করে। দেখি তুই উঠ, আর হাত ডলিস না।
শানাজ মগটা সাবার হাতে দিয়ে কলপাড়ের টুল থেকে মেহনূরকে দাড় করিয়ে দিলো। দুবোন একসাথে যখন ভেতরে ঢুকে রুমের দিকে গেলো, তখন শানাজ রান্নাঘর থেকে ফিরে এসে অবাক হয়ে দাড়িয়ে পরলো। চৌকির কাছে ফেসপ্যাকের কাছে মাহতিমকে কি যেনো করতে দেখলো। শানাজ কৌতুহল হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে বললো,
- ভাইয়া? আপনি ওটা কি করছেন?
মাহতিম স্বাভাবিক ভঙ্গিতে ফেসপ্যাকের বাটিটা নাকের কাছ থেকে সরিয়ে নিলো। দৃষ্টি তুলে শানাজের দিকে তাকিয়ে ফেসপ্যাকের বাটি দেখিয়ে বললো,
- এগুলো কি জিনিস সেটাই বুঝার চেষ্টা করছি। আচ্ছা এগুলো কি কোনো মশলা? রান্নার কাজে দিবে?
ফেসপ্যাক নিয়ে এমন উটকো প্রশ্ন শুনে মৃদ্যুভঙ্গিতে হেসে দেয় শানাজ। এগিয়ে এসে মাহতিমের উদ্দেশ্য বলে উঠে,
- ভাইয়া এগুলো রূপচর্চার জিনিস। আপনি চাইলে আপনিও দিতে পারেন। তবে আপনার না দিলেই ভালো হবে। আপনিতো এমনেতেই হ্যান্ডসাম।
মাহতিমও সৌজন্যের সঙ্গে হেসে দিয়ে ফেসপ্যাকের বাটিটা চৌকির উপর রেখে দিলো। শানাজও রান্নাঘর থেকে লেবুর টুকরো নিয়ে রুমের দিকে চলে গেলো। কিন্তু বিপত্তি শুরু হলো বিশ মিনিট পর। এক তুমুল চিৎকার দিয়ে বাড়িঘরের নিরবতা ক্ষুণ্ণ হয়ে গেলো। হাউমাউ করে চিৎকার করতেই দাপাদাপির শব্দ শোনা গেলো নিচ থেকে! কেউ গলা ফাটিয়ে ' মা, ও মাগো, বাঁচাও ' বলে আহাজারি করছে। শানাজ,সাবা, মেহনূর তৎক্ষণাৎ রুম থেকে বেরিয়ে সিড়ি ধরে নিচে নামে। কোমরের ব্যথার জন্য আবারও জায়গাটা চিনচিন করে উঠলে মেহনূর সেটা দাঁতে কামড়ে নিচে এসে হাজির হয়। এসেই দেখে শেফালী পাগলের মতো কপাল চাপড়ে ' হায় হায় ' করছে। অন্যদিকে সুরাইয়া মুখে ফেসপ্যাক লাগিয়ে কান্নারত অবস্থায় দুগাল চুলকিয়ে যাচ্ছে। সুজলা এসেই ভেজা আচঁল দিয়ে ওর ফেসপ্যাক তুলে চুপ করার জন্য সান্ত্বনা দিচ্ছে। মাহমুদা চটজলদি কলপাড় থেকে ঠান্ডা পানি এনে মুখ ধুয়াতে থাকে। মারজা দ্রুত শেফালীকে ঠান্ডা হতে বলে। শানাজ এতোটা আশ্চর্য হয়ে যায় সে আর কিছুই বলতে পারলোনা। সাবাও মুখে দুহাত দিয়ে বিস্ফোরণ চাহনিতে তাকিয়ে আছে। মেহনূর কৌতুহল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেও পুরো ঘটনা নিয়ে মন খচখচ করতে থাকলো। কি মনে করে যেনো, অপজিট দোতলায় তাকালো, ওমনেই দেখতে পেলো বারান্দার রেলিংয়ে দুহাত ফেলে মাহতিম শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। দুজনের দৃষ্টিতে চোখাচোখি হতেই মাহতিম অদ্ভুত ভঙ্গিতে বাঁকা হেসে দিলো।
.
.
.
চলবে...........................