হঠাৎ তুমি এলে - পর্ব ০৮ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


-একটা মানুষের এতোটুকু লজ্জা কি করে না থাকতে পারে? একটু আগে ঘাড় ধাক্কা দেয়ার পরও আমার রুমে আসার সাহস হয় কি করে এই মেয়েটার? এক্ষুণি যদি বের না হয়ে যাস শুভ---------।

ধূসর নিজের সামনে রাখা ফাইলটা চেক করতে করতে কথাগুলো বলে সামনে দরজার দিকে চোখ পড়তেই বিষম খেয়ে বেচারা কাশি উঠে গেল। হালকা হাতে ধূসরের কেবিনের দরজাটা খুলে গুটিগুটি পায়ে সামনের দিকে যে মানুষটা এগিয়ে আসছে সে শুভ্রাও নয়, আদিবও নয়। সামনে দাঁড়ানো মানুষটা যে আর কেউ নয়, প্রজ্ঞা, ধূসরের প্রজ্ঞা, সেটা যেন বিশ্বাসই হচ্ছে না ধূসরের। ধূসর এমনভাবে কাশছে যে প্রজ্ঞা এবারে ছুটে এসেই হাতের একটা লাঞ্চ বক্স রেখে টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাসটা ধূসরের মুখের সামনে ধরতেই ধূসরও এক চুমুকে পুরো গ্লাসটা খালি করে দিলো। ধূসর গ্লাসটা টেবিলের উপরে নামিয়ে রাখতেই দেখলো প্রজ্ঞা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে দেখে ধূসর প্রজ্ঞাকে টেনে নিয়ে নিজের সামনে দাঁড় করিয়ে গালে আলতো করে হাত ছুঁইয়ে দিল। প্রজ্ঞা ভ্রু নাচিয়ে ধূসরের দিকে তাকালো।

-ম্যাডামের ব্যাপার কি? একটু আগেই না ম্যাডামকে বাড়িতে ড্রপ করে দিয়ে আসলাম, ম্যাডাম দেখি এই কয় ঘন্টায় এতো মিস করেছে যে সোজা অফিসেই চলে এসেছে? এই অসম্ভব ব্যাপারটা সম্ভব হলো কি করে বলো তো প্রজ্ঞা? যাকে বলতে বলতে অফিসে আনানো যায় না, সেই প্রজ্ঞা ম্যাডাম আজ সোজা আমার কেবিনে? এই অসাধ্যটা সাধন করলো কে জানতে পারি ম্যাডাম?

ধূসরের খোঁচা দেয়া কথাটা শুনে প্রজ্ঞা হাতে থাকা ধূসরের মোবাইলটা ধূসরের হাতে ধরিয়ে দিল। ধূসর একটু অবাক হয়ে নিজের মোবাইলের দিকে তাকিয়ে আবার প্রজ্ঞার দিকে তাকালো।

-আপনার এই মোবাইলের কারণেই আমাকে এই ভর দুপুরে আপনার এই পচা অফিসে ছুটে আসতে হলো। আর আসার পর তো দেখছি অন্য কাহিনী চলছে এখানে। কে বা কেন এসেছে শোনার আগেই এত্তোগুলো বকা দিয়ে ভাগিয়ে দিচ্ছ। আর কোন মেয়ে এসে তোমাকে এতো বিরক্ত করছে যে জনাব এতো খেপে গেছেন?

-আর বলো না। আসলেই আশেপাশে এতো বিরক্তিকর মানুষ ঘুরঘুর করে যে মেজাজটাই খারাপ হয়ে যায় আমার।

-এই বিরক্তিকর মানুষটা কে? শুভ্রা আপু?

-শুভ্রা! 

-উনার উপরেই তো রেগে গিয়ে আমাকেও খেয়াল করো নি। উল্টো ধমকে বের করে দিচ্ছিলে? আর এদিকে মোবাইলটা কাল রাতে বাড়িতে রেখেই বেরিয়ে গেছেন ভদ্রলোক। আমি বাসায় গিয়ে দেখি ভদ্রলোকের মোবাইলে এক রাতের মধ্যে চল্লিশ বারের মতো কল এসেছে। আরো বিশ ত্রিশটার মতো মেসেজ জমা পড়েছে মেসেজবক্সে। 

-এতো কল আর মেসেজ! 

-জি। তাই ভাবলাম জনাবকে মোবাইলটা দিয়েই আসি।

-শুধু মোবাইল দিতে এসেছেন ম্যাডাম? নাকি চেক করতে এসেছেন যে আপনার হাজবেন্ড অফিসে আছে কি না। 

-শুধু মোবাইল দিতে তো আসি নি। আপনার জন্য বাসা থেকে লাঞ্চ নিয়ে এসেছি। সেটাই দিতে আসলাম।

 -সোজাসুজি বললেই হয় হাজবেন্ডকে মিস করছিলে, তাই দেখা করতে চলে এসেছ। এতে লাঞ্চের বায়না, মোবাইলের বায়না দেয়ার কি খুব দরকার আছে ম্যাডাম?

-তার মানে আপনার মোবাইল আর লাঞ্চ কোনোটাই লাগবে না তাই তো? ওকে। আমি চললাম। মোবাইলও পাবেন না, লাঞ্চ বাসায় এসেই খেয়ে নিবেন। আমি চললাম মিস্টার।

-আরে আরে আরে! প্রজ্ঞা? শোনো শোনো?

প্রজ্ঞা ধূসরের সামনে থেকে সরে এসে দরজার দিকে পা বাড়াতেই ধূসর প্রজ্ঞার কোমড় জড়িয়ে ধরে টেনে নিয়ে নিজের টেবিলের উপরে বসিয়ে দিল। প্রজ্ঞা ধুপধাপ কিল বসালো ধূসরের বুকে। বেশ কিছুক্ষণ দুজনের খুনোশুটি ভরা হাতাহাতির পর ধূসর প্রজ্ঞার হাত দুটো চেপে ধরে নিজের বুকের সাথে আটকে নিয়ে প্রজ্ঞার গালে আলতো করে নিজের খোঁচা দাঁড়ির ঘষা দিতেই প্রজ্ঞা কেঁপে উঠে চোখ বুজে নিল। ধূসরও সুযোগ পেয়ে প্রজ্ঞার নাকে নাক ঘষে দিয়ে ছোট্ট একটা আদরের পরশ বুলিয়ে দিল প্রজ্ঞার ঠোঁটের কোণে।

-পালাচ্ছ কোথায় হ্যাঁ? মোবাইলটা ততটা ইম্পর্ট্যান্ট না হলেও আমার বউটা এতো কষ্ট করে খাবার নিয়ে এসেছে সেটা তো ভিষণ ইম্পর্ট্যান্ট আমার জন্য। তা না ম্যাডাম? আমার আর কিছু টুকটাক কাজ বাকি আছে, কাজগুলো কমপ্লিট করে দুজনে একসাথে লাঞ্চ করে বাড়ি ফিরবো ওকে?

-টুকটাক কাজ বাকি? সকালে এতো তাড়াহুড়ো করছিলে যে বাড়িতে গিয়ে ব্রেকফাস্ট করার সময়ও ছিল না। এমনকি আমাকে বাড়ির গেইটে ড্রপ করে দিয়েই অফিসে চলে এসেছ। আর এখন বলছ কিনা টুকটাক কাজ বাকি?

-কাজ তো অনেক বাকি গো সোনা। বাট আজকে মেজাজটা এতো খারাপ হয়ে গেছে যে কাজে মন বসবে না। তাছাড়া ম্যাডাম এতোদিন পরে অফিসে এলেন তাকে একটু সময় দেয়া উচিত না বলো?

-জি না জনাব। আমি বাড়িতে গিয়ে লাঞ্চ করে নিতে পারবো। আপনি আপাতত কাজ করুন। আমি বাসায় চললাম।

-মামার বাড়ির আবদার আর কি! একা একা কোন সাহসে অফিসে এসেছ সেটা নিয়ে কিছু বলতেও পারছি না। তুমি হুট করে আসায় দারুণ একটা সারপ্রাইজ পেয়েছি আর আমার মুডটাও ফুরফুরে হয়ে গেছে বলে। বাট তাই বলে ভেবো না যে এখন আবার তোমাকে একাই ছেড়ে দিবো আমি। নো। নেভার। 

-কেন জনাব? একা একা কোথায় যেতে অসুবিধা কি? আমি কি ছোটো বাচ্চা যে হারিয়ে যাবো? নাকি ভরসা নেই আমার উপরে?

-তোমার উপরে ভরসা আমার আজীবন থাকবে প্রজ্ঞা। কিন্তু আশেপাশে যত নোংরা মানুষগুলো থাকে তাদের কারো প্রতি আমার ভরসা নেই। 

-তো কি করা যায় বলুন তো জনাব? কাউকে বিশ্বাস করতে না পারলে তো সমস্যা। আজীবন কি বউকে লুকিয়ে রাখবেন নাকি সবার নজর থেকে?

-উঁহু। আমার বুকের মধ্যে আগলে রাখবো আমার পরীটাকে। সবসময়, আজীবন, আমৃত্যু।

-হয়েছে জনাব। বুঝেছি। এখন তাড়াতাড়ি নিজের কাজ শেষ করুন। দুষ্টুমিগুলো বাড়ির জন্য তোলা থাক? এটা যে অফিস ভুলে গেছেন?

-ওহো! তাই তো। আমার পি. এ ভদ্রলোকটির আবার ভরসা নেই। যেকোনো সময় হুট করে চলে আসতে পারে। আর ছেলেটা হুট করে চলে আসলে তোমাকে আমার এতোটা কাছে দেখে------।

-এই এই এই? নিজের কাজ করো তো। আর আমি কিন্তু লাঞ্চ করবো না বলে দিচ্ছি। এখানে শুধু তোমার জন্য এনেছি। আমি বাসায় গিয়ে খেয়ে নিবো।

-ওকে। লাঞ্চের কথা পরে চিন্তা করা যাবে। আপাতত প্রি-লাঞ্চ কোর্সটা শেষ করি। সকালে নাস্তা করে বের হয়েছি আর কিছুই খাওয়া হয়নি। এখন লক্ষী বউয়ের মতো আমাকে খাইয়ে দিতে থাকো। আর আমিও নিজের কাজে কনসেন্ট্রেট করি।

-হুম? আমি খাইয়ে দিবো তোমাকে?

-না না। তুমি কেন খাইয়ে দিতে যাবে? পিয়নের বউ এসে আমাকে খাইয়ে দিয়ে যাবে। 

-অসভ্য ছেলে একটা। যা মুখে আসে তাই বলতে শুরু করে। 

-তো আর কি করবো? কোথায় লক্ষী মেয়ের মতো হাত ধুয়ে এসে আমাকে নিজের হাতে করে খাইয়ে দিবে, তা না করে উল্টো প্রশ্ন করছ 'আমি খাইয়ে দিব?'! আজব!

-হাত দিয়ে খাওয়াতে হবে কেন? চামচ নিয়ে এসেছি।

-এই যে ম্যাডাম। নো চিটিং। যেভাবে বলছি সেভাবে খাইয়ে দিতে পারলে খাওয়াও, নইলে বাদ দাও। বুকসেলফে অনেক বই আছে। একটা নিয়ে পড়তে থাকো। ততক্ষণে আমি আমাড কাজটা শেষ করি।

-উফ! এই লোকটাকে নিয়ে সত্যি পারা যায় না। 

প্রজ্ঞা টেবিলের উপর থেকে নেমে ধূসরের কেবিনের ওয়াশরুম থেকে হাত ধুয়ে এসে একটা চেয়ার টেনে ধূসরের পাশে বসে লাঞ্চ বক্সটা খুলে ধূসরকে খাইয়ে দিতে শুরু করলো। প্রজ্ঞার খাইয়ে দেয়ার ফাঁকে ধূসর আরাম করেই নিজের ফাইলগুলো চেক করছে। প্রজ্ঞার খাইয়ে দেয়া শেষ হতেই ধূসরের মুখটা মুছিয়ে দিয়ে ওয়াশরুম থেকে হাত ধুতে চলে গেল। ফিরে এসে ধূসরকে ল্যাপটপের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকতে দেখে প্রজ্ঞা কিছুটা অবাকই হলো। লোকটার চোখে মুখে রাগ ফুটে আছে নাকি বিরক্তি সেটাই ঠিকমতো বোধগম্য হচ্ছে না প্রজ্ঞার। এই দুই মিনিট সময়ের মধ্যে কি হলো প্রজ্ঞা সেটা ভাবার সময়ও পেল। এর মধ্যেই ধূসর নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে কেবিনের বাইরের দিকে পা বাড়িয়েছে।

-আরে কি হয়েছে ধূসর? কোথায় যাচ্ছ এভাবে?

-তুমি একটু আমার কেবিনেই ওয়েট করো প্রজ্ঞা। আমার বাবার সাথে দেখা করেই বেরিয়ে পড়বো।

-তোমার কাজ শেষ? এতো তাড়াতাড়ি?

-কাজ শেষ করার প্রয়েজন পড়বে না আর। তুমি এখানেই ওয়েট করো। জাস্ট দুই-তিন মিনিট।

প্রজ্ঞা মাথা নেড়ে সায় জানাতেই ধূসর নিজের কেবিন থেকে বেরিয়ে সোজা চলে গেল আদিবের কেবিনে। ছেলেটা হুট করে ধূসরকে দেখে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও ধূসরের সবক'টা প্রশ্নেরই ঠিকঠাকমতো জবাব দিতে পেরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। ধূসর নিজের চোয়াল শক্ত করে আদিবের কথাগুলো শুনছিল। আদিবকে কয়েকটা কাগজ প্রিন্ট করতে দিয়ে নিজেই আদিবের ল্যাপটপে অফিসের সার্ভার থেকে কয়েকটা মেইল চেক করলো। আদিব প্রিন্ট করা কাগজগুলো ধূসরকে এনে দিতেই ধূসর এবারে সোজা নিজের বাবার কেবিনের দিকেই পা বাড়ালো। দাঁতে দাঁত চেপে নিজের রাগটা হজম করার চেষ্টা করে কেবিনের দরজাটা এক টানে খুলে ফেলে কেবিন ঢুকে পড়লো ধূসর। হাতের প্রিন্ট করা কাগজগুলো ডেস্কের উপরে প্রায় ছুঁড়ে ফেলে সোজা সামনে বসা মানুষটার দিকে তাকালো ধূসর।

-তোমার প্রজেক্টটা আমি করতে রাজি হয়েছি জাস্ট একটা কন্ডিশনে বাবা। তোমার ক্লাইন্টরা দেশে এসে ডিলটা সাইন করবে। বাট এই লাস্ট মূহুর্তে এসব কি ধরনের নাটক শুরু করেছ তোমরা? তোমার ড্রিম প্রজেক্টের ডিল এপ্রুভ করাতে আমাকে দেশের বাইরে যেতে কেন? আমাকে জিজ্ঞেস না করেই এমন এপ্রুভাল দাও কি করে তুমি? আ'ম ডান উইথ দা প্রজেক্ট। তোমাদের প্রজেক্ট তোমরাই সামলাও। আমি কোথাও যাচ্ছি না, ওকে?
.
.
.
চলবে................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন