হঠাৎ তুমি এলে - পর্ব ০৯ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


-ডোন্ট শাউট ধূসর। এটা বাসা নয় যে তুমি যখন ইচ্ছে চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে। আর প্রজেক্টের ফিনিশিং পয়েন্টে এসে তুমি কি করে এভাবে ব্যাকআউট করতে পারো? ডোন্ট ইউ নো এই ডিলটা আমাদের কোম্পানির জন্য কতোটা ইম্পর্ট্যান্ট? আর ক্লাইন্ট যেভাবে ডিল করতে চেয়েছে সেটাতে রাজি না হয়ে আমাদের কি কোনো উপায় আছে ধূসর?

ধূসরের ডেস্কের উপরে ছুঁড়ে ফেলা কাগজগুলোর দিকে এক নজর চোখ বুলিয়ে নিয়ে রাগী গলায় কথাগুলো বললেন ধূসরের বাবা আনিস আহমাদ। ধূসর বাবার কথাগুলো শুনে ডেস্কের উপরে সজোরে একটা ঘুষি বসিয়ে দিলো। সলিড কাঠের ডেস্কে ঘুষিটা কতটা জোরে গিয় লেগেছে সেটা ধূসরের মুখের ভঙ্গি দেখে বোঝা গেল না। তবে ব্যথায় হাতটা গুঁটিয় নিয়ে সোজা বাবার দিকে তাকালো ধূসর।

-তোমার ক্লাইন্টের সাথে তোমার কি ডিল হয়েছে আমার জানার কোনোই ইন্টারেস্ট নেই বাবা। তোমার সাথে আমার কি ডিল হয়েছিল তোমার সেটা মনে আছে নিশ্চয়ই? আমি তোমার প্রজেক্টটা সাবমিট করে দিবো, বাট এর পর ক্লাইন্টের সাথে তোমরা কিভাবে ডিল করবে সেটা তোমাদের ব্যাপার। এটাই তো ডিল ছিল আমাদের বাবা? রাইট?

-তখন ক্লাইন্টদের দেশে এসে ডিলটা নিয়ে ডিস্কাস করার কথা ছিল। বাট এখন প্ল্যানে কিছুটা চেইঞ্জ করা হয়েছে ধূসর। হোয়াই ডোন্ট ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড? এই প্রজেক্টটা ক্র্যাক করা আমাদের কোম্পানির জন্য এই মূহুর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরি। তুমি আর কতদিন এই জেদ ধরে কোম্পানির প্রত্যেকটা রেসপন্সসিবিলিটি থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখবে ধূসর? এন্ড হোয়াই ধূসর হোয়াই? এটা তোমার নিজের কোম্পানি। আজ বাদে কাল তুমিই এই কোম্পানিটার এম.ডি হবে। তাহলে নিজের কোম্পানিকে এভাবে লসের মুখে ফেলে তোমার নিজের কি লাভ হচ্ছে বলো তো ধূসর?

-সরি বাবা। এটা আমার নিজের কোম্পানি দয়া করে এই হাস্যকর স্টেটমেন্টটা দিও না। প্রজ্ঞাকে নিয়ে বাড়ি ছাড়ার সাথে সাথেই তোমার কোম্পানির সাথেও আমার এসব মালিক, বংশধর এসব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। শুধু তোমার আর মায়ের বাংলা সিনেমার মতো নাটকে প্রজ্ঞা গলে যাওয়ার কারণে আমি এখন তোমাদের অফিসের একজন স্টাফের জব করছি। 

-ধূসর?

-ডোন্ট শাউট ড্যাড। এটা তোমার বাড়ি নয়, একটা অফিস। তুমি যে অফিসের মালিক, এবং আমি যেখানে সামান্য নাইন টু ফাইভ জব করি। এখন নিজের কাজ কমপ্লিট করছি না বলে, তুমি চাইলেই আমাকে ফায়ার্ড করতে পারো। কয়েক মাসের মধ্যে কাছাকাছি লেভেলের একটা চাকরি জোগাড় করে নিতে পারবো এই ব্যাপারে আমি যথেষ্ট কনফিডেন্ট। 

-হ্যাভ ইউ গন ম্যাড ধূসর? আর দশটা দিন সময় আছে হাতে। এই মূহুর্তে তুমি যদি প্রজেক্ট থেকে ব্যাকআউট করো তাহলে আমাদের কোম্পানি রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াবে। ডিলটা না হলে--------।

আনিস আহমেদ কি বলছে সেসব চুপচাপ শুনে ধূসর কেবিন থেকে বের হওয়ার জন্য পা বাড়াতেই একটা কণ্ঠস্বর শুনে দাঁড়িয়ে গেল। কেবিনের দরজার সামনে শুভ্রাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আনিস সাহেবের দিকেই আবার ফিরে তাকালো ধূসর। ততক্ষণে শুভ্রার মুখ দিয়ে খই ফুটছে বলা চলে। এই মেয়েটা দিন দিন নিলর্জ্জের চেয়েও যেন কয়েক গুণ বেশি বাচাল হয়ে যাচ্ছে। 

-আঙ্কেল ধূসরকে কোম্পানির কথা চিন্তা করতে বলছ? নিজের বউয়ের কথা ছাড়া দুনিয়ায় আর কারো কথা ভাবার সময় আছে নাকি ধূসরের? এই যে দেখছ না বউকে রেখে যেতে হবে বলে কোম্পানির এতো ইম্পর্ট্যান্ট একটা ডিলটাকেও কমপ্লিট করবে না বলে জেদ ধরে বসে আছে? 

-আর এই মেয়েটা এখানে কেন বাবা? ওর ইন্টার্নশিপের কথা সত্যি কি তোমাদের বানানো গল্প আমার সেটা জানার আমার বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। তোমার এই কোম্পানিতে শত শত ট্রেইন্ড অফিসার আছে যাদের কাছ থেকে তোমাদের আদরের শুভ্রা অফিস ম্যানেজমেন্ট শিখতে পারবে। সো প্লিজ? আমাকে মাফ করো। 

-ধূসর এটা কেন বলছো না যে তোমার বিলাভেড ওয়াইফ তোমাকে এতোটাই অবিশ্বাস করে যে সোজা তোমার অফিসেই চলে এসেছে? তা বউকে কেবিনে বসিয়ে রেখে এসে এখন আঙ্কেলকে বলছ প্রজেক্টের কাজে দেশের বাইরে যেতে পারবে না? তা ধূসর? প্রজ্ঞা ভাবি কি তোমার বিদেশে যাওয়ার ব্যাপারটা মানছে না?

-জাস্ট শাট ইওর ব্লাডি মাউথ শুভ্রা। এন্ড গেট লস্ট। আমি কোনো প্রজেক্টে কাজ করবো, কোন কাজে দেশের বাইরে যাবো কি যাবো না সেটার কৈফিয়ত আমি তোকে দিতে যাবো কেন হ্যাঁ? আর সেকেন্ড টাইম তুই এই অফিসে আমার সামনে পড়লে আমি আর অফিসেই আসবো না, কথাটা মাথায় রাখিস। নাউ গেট লস্ট ফ্রম হেয়ার। 

ধূসর বিরক্ত হয়ে শুভ্রার একটা হাত ধরে টানতে টানতে কেবিনের বাইরে নিয়ে এসে আরেকবার ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল শুভ্রাকে। শুভ্রার ম্লান মুখে বাঁকা একটা হাসি ফুটিয়ে হাতের ইশারায় 'বিদায়' জানাতেই ধূসর ঠাস করে কেবিনের দরজাটা বন্ধ করে আবার আনিস আহমাদের দিকে ফিরলো। 

-শুভ্রাকে তো চুপ করিয়ে দিতে পারবি। কিন্তু ওর প্রশ্নটা তো রাইট। ওই মেয়েটার কারণেই তো তুই প্রজেক্টটা ইনকমপ্লিট রেখে আমাদের বিজনেসের এতো বড় ক্ষতিটা করতে চাইছিস? 

-ও রিয়েলি বাবা? তুমি, মা, শুভ্রা যত নাটকই করো না কেন প্রজ্ঞাকে একা রেখে আমি কোথায় যাচ্ছি না। আমার কাছে তোমার কোম্পানির চেয়েও আমার প্রজ্ঞার সেইফটি বেশি ইম্পর্ট্যান্ট।

-ওই মেয়ের কি হবে? বাবা মা দুজন গাড়ি এক্সিডেন্টে মারা গেছে। এই মেয়ের কিছু হয়েছে? নোপ। 

-বাবা প্লিজ? নিজেদেরকে এতোটাও নিচে নামিয়ে নিও না যে তোমাদেরকে নিজের জন্মদাতা পিতা মাতা বলতেই লজ্জা হয় আমার। আমি ছাড়া এই মূহুর্তে প্রজ্ঞাকে সাপোর্ট দেয়ার মতো, ওর বিপদে পাশে থাকার মতো কেউই নেই। থাকলেও আমার জানা নেই।

-এতো সেইফটি নিয়ে চিন্তা হলে সারাদিন একা একটা বাড়িতে রেখেছিস কেন ওই মেয়েকে? ওই মেয়ে তো বাড়িতে থাকবে না, নইলে এতো ঝামেলাই হতো না।

-কোন পরিস্থিতিতে আমি প্রজ্ঞাকে নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছি সেটা তুমিও ভালো করে জানো বাবা। এখন যদি তোমার মনে হয় বাড়ি ছাড়ার পিছনেও প্রজ্ঞাই দায়ি তাহলে আমার কিছু বলার নেই। আর তোমার গিফ্ট করা বাড়িটায় মেয়েটা তো একা নয়, যে কয়জন মানুষ আছে তাদেরকে আমি তোমাদের থেকে বেশি ভরসা করি। ওরা আর যাই করুক অন্তত আমার প্রজ্ঞাকে খুন করে ফেলবে না, এই বিষয়ে আমি নিশ্চিন্ত হয়ে কাজে আসতে পারি।

-ধূসর?

-সত্য কথাগুলো শুনতে একটু তেঁতোই হয় বাবা। আমি দেশের বাইরে কোথাও যাচ্ছি না। এটাই ফাইনাল। তার জন্য যদি আমাকে তোমার জবটা ছাড়তে হয় তবে সেটাই হোক।

-শুধু ওই মেয়েটারই তোর উপরে অধিকার আছে? আর আমরা? আমরা তোর বাবা মা। আমাদের কি তোর উপরে কোনো অধিকার নেই? কোনো স্বপ্ন নেই আমাদের তোকে নিয়ে ধূসর? বাবা মায়ের প্রতি সন্তানের যে একট কর্তব্য আছে সেটাও কি ভুলে গেছিস তুই? এই শিক্ষা দিয়ে তোকে মানুষ করেছি আমরা? তিলে তিলে মাথার ঘাম পায়ে ফেলে তোকে মানুষের মতো মানুষ করেছিলাম এই দিনটা দেখার জন্য ধূসর? আমার এতোদিনের কষ্ট, রক্ত, ঘাম এক করে দাঁড় করানো কোম্পানিটাকে এভাবে শেষ করে দিবি জানলে তোকে এতো বড় দায়িত্বটা আমি জীবনেও দিতাম না। কখনোই না।

-অবশ্যই তোমাদের আমার উপরে অধিকার আছে বাবা। তাই তো আমার স্ত্রীকে এতোটা অসম্মান করা স্বত্বেও আমি সময় বের করে মায়ের সাথে দেখা করে আসি, তোমার সাথে একই অফিসে, একই ছাদের তলায় কাজ করছি। যদি এই বাবা মা আর সন্তানের ব্যাপারটা ভুলে যেতাম না বাবা, তাহলে আমার স্ত্রীকে বিনা অপরাধে বারবার সবার সামনে, আড়ালে অপমান করা মানুষগুলোকে কখনোই নিজের চোখের সামনে আসতে দিতাম না। তোমাদেরকে আজও নিজের বাবা মা বলে সম্মান করি বলেই বিবাহবার্ষিকীর মতো একটা দিনে নিজের সোর্সদেরকে দিয়ে প্রজ্ঞাকে নানাভাবে বডি শেইমিং করার পরও তোমার অফিসে এসে প্রজেক্টের কাজ সামলাচ্ছি। এর চেয়ে বেশি আর কি চাও বাবা? 

ধূসরের কথাগুলো শুনে আনিস আহমাদের নিরবতাই ধূসরের প্রত্যেকটা কথা যে সত্য তার প্রমাণ দিচ্ছে। ধূসর এবারে সোজা কেবিনের দরজার দিকেই এগিয়ে গেল। কয়েকটা কথা বলেই বাবার কেবিনটা থেকে বেরিয়ে গেল ধূসর। আর পিছনে নিজের চেয়ারে বসে চুপচাপ ধূসরের চলে যাওয়া দেখলেন আনিস আহমাদ। মনের কোণে একটা সন্দেহই খচখচ করছে তার। ধূসর কিছু আন্দাজ করতে পারলো নাকি? নাকি সবটাই নিছক ওর অভিমান? না সন্দেহ করলে এভাবে রিএক্ট করলোই বা কেন? কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই আনিস সাহেবের কানে তখনো ধূসরের শেষ কথাগুলোই বাজছিল।

-প্রজেক্টের বাদ বাকি কাজগুলো আমি কমপ্লিট করে দিবো না সেটা তো একবারও বলি নি বাবা। আমি শুধু বলছি কাজগুলো আমি করবো, বাট ওদের শর্ত মেনে নিয়ে প্রেজেন্টেশন যদি দিতেই হয় তাহলে অন্য কাউকে পাঠাতে হবে। প্রজ্ঞার জন্য হোক বা না হোক, আমি যাচ্ছি না কোথাও। এবার এর জন্য তুমি যদি আমার নামে কেইস করতে চাও তাও করতে পারো। আই ডোন্ট মাইন্ড। বাট আমার কাজটা তোমার প্রজেক্টের আউটার সারফেসটা রেডি করে দেয়া পর্যন্তই। এর বেশি আমার কাছে কিছুই আশা করো না। আর বাকি রইলো শুভ্রার কথা? ও যদি আর একবারও আমার লাইফে দখল দিতে আসে তাহলে কাল সকালেই আমার রেজিগনেশন লেটারটা তোমার ফাইলের উপরেই পাবে। এখন তুমি সিদ্ধান্ত নিয়ে বাকিটা আমাকে জানও। কিভাবে কি করতে চাও। ওকে বায়। 
.
.
.
চলবে..........................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন