-আঙ্কেল আপনাকে এই অসুস্থ অবস্থায় রেখে আমি কি করে আবার ওই শহরটায় ফিরে যাবো? এতোগুলো বছর যার আমাকে খুঁজতে আসার অপেক্ষায় বসে ছিলাম তার আসার সময় হয়তো এখনও হয়নি। আধো আসবে কিনা সেটাও তো জানি না।
কথাগুলো বলতে বলতেই গলা বুজে এসেছে মেয়েটার। চার বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে গুঁটিগুঁটি পায়ে ঘরময় পায়চারি করছে। ছোটো ছোটো হাত দিয়ে রুমের বুকসেলফের যতটুকু ধরা যায় সেই কয়টা বইকেই হাতের আদরে ছুঁয়ে দিয়ে ছুটোছুটি করছে ঠিকই, তাতে রুমের আর দুজন মানুষের কোনো সমস্যা যেন না হয়ে সেদিকেও যেন বাচ্চা মেয়েটার তীক্ষ্ণ নজর রয়েছে। হ্যাঁ, ক্যালেন্ডারের পাতারা পাঁচ বছর সামনে এগিয়ে গেছে। সেদিনের হসপিটালের ঘটনাটা প্রজ্ঞার জীবনটা একদমই বদলে দিয়েছে। পাঁচটা বছরেও ধূসরের আসার অপেক্ষাটা আরো কত দীর্ঘ হবে সেটা ভেবেই গাল বেয়ে কান্নার রেখার স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে প্রজ্ঞার।
-পাঁচটা বছর কম সময় নয় প্রজ্ঞামা। সেদিন ওই রাতের অন্ধকারে তোমার আমার গাড়ির সামনে এসে পড়া, আমার ড্রাইভারের তোমাকে দেখতে পাওয়া কি সৃষ্টিকর্তার কোনো কারিশমার চেয়ে কম বলো তো? ওই অবস্থায় তোমার ট্রিটমেন্ট জরুরি ছিল তাই আমিও আর কিছু না ভেবেই তোমাকে নিজের সাথে নিয়ে এসেছি। তুমি সুস্থ হলে তোমার পরিবারের কথা বলতে পারবে এই আশায় সেদিনও অপেক্ষা করেছি, আজও অপেক্ষাই করে আছি মা। না কি হয়েছে বললে, আর না কখনো নিজের পরিবারের কথা। অবশ্য এতোগুলো বছর তুমি আর দাদুভাই আমার শূন্য জীবনটাকে হাসি আনন্দে ভরিয়ে রেখেছ, মায়ের মতো আগলে রেখেছ এতোগুলো দিন যে তোমার চলে যাওয়ার কথাটা ভাবতেও পারি নি কখনো।
-অসুস্থ শরীরে এসব কি চিন্তা করছেন বলুন তো ডাক্তার সাহেব? সেদিন রাস্তা থেকে তুলে এনে জায়গা না দিলে হয়তো আমার মেয়েটা আজ এই সুন্দর পৃথিবীর মুখটা দেখতেও পারতো না। তাই এসব ভাবা বাদ। দিন তো আঙ্কেল।
-আহা! মা রেগে গেছে দেখছি। আঙ্কেল থেকে সোজা ডাক্তার সাহেব? হা হা হা। এই মা আর দুষ্টু পরীটা আমার জীবনে আসায় অবসরের কয়েকটা বছর কিভাবে কেটে গেছে জানতেও পারি নি। তাই হয়তো শেষ সময়ে এসে।
-আঙ্কেল? আবার এসব বলা শুরু করেছেন?
-শুরুটা আমি করি নি মা। তুমিই করেছ। প্রত্যুষা দাদুভাই? অনেক খেলা হয়েছে দাদুভাই। এবার দাদুর পাশে এসে বসো তো দাদুভাই? কাল তো একা একা বেড়াতে চলে যাবে আমার দাদুভাইটা। দাদুকে ভুলে যাবে তাই না দাদামনি?
-আঙ্কেল? আপনাকে এই অবস্থায় রেখে আমি কি করে যাবো? আর ওখানে আপনার কেউ কি আমার কথা আধো শুনবে?
-মায়ের ওই একটামাত্র স্মৃতিই আমার কাছে অবশিষ্ট আছে। ইচ্ছে ছিল ওই এক টুকরো জমির সাথে আরো কিছুটা জমি কিনে সেখানে মায়ের নামেই একটা হসপিটাল বানাবো প্রজ্ঞামা। অথচ মায়ের সেই শেষ স্মৃতিটাও আজ আমার কাছ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। আমি সুস্থ থাকলে তোমাকে কখনোই জোর করতাম না মা।
-ঠিক আছে আঙ্কেল, আমি যাবো। যেই আপনার মায়ের শেষ স্মৃতিটা দখল করে থাকুক না কেন, আমি সেটা আপনাকে ফিরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করবো। আমার বিপদে আপনি বাবার মতো ছায়া হয়ে পাশে ছিলেন, এই ছোট্ট কাজটা করে যদি সেই ঋণটা একটু হলেও কমাতে পারি।
-এটাই হয়তো আমার জীবনের শেষ ইচ্ছে প্রজ্ঞামা। নিজের মায়ের জমিতে, মায়ের নামের একটা হসপিটাল তৈরি করা, সেখানে শত শত অসহায় মানুষ বিনা পয়সায় চিকিৎসার সুযোগ পাবে। তাদের দোয়াই হবে আমার মাকে দেয়া সবচেয়ে বড় উপহার। বেঁচে থাকতে অর্থ, সম্পদের পিছনে ছুটতে ছুটতে তো কিছুই দেয়া হয়ে ওঠে নি কখনো। অন্তত মৃত মায়ের প্রতি এটাই হবে আমার শেষ শ্রদ্ধাঞ্জলি। হসপিটালটা দেখে যেতে পারবো কিনা জানি না মা। শরীরটা আর সায় দেয় না তে আজকাল। তুমি একটু দেখো মা, এই বুড়ো ছেলেটার শেষ ইচ্ছেটা যেন পূরণ হয়। এক মাকে শ্রদ্ধাঞ্জলি দেয়ার দায়িত্বটা আজ অন্য এক মায়ের কাঁধেই সঁপে দিলাম।
-আঙ্কেল এবার কিন্তু আপনি বেশি বাড়াবাড়ি করছেন। চুপচাপ ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন। আর এই শেষ ইচ্ছে মানে কি হ্যাঁ? আপনার আরে কত দায়িত্ব বাকি জানেন না? আপনার দাদুভাই বড় হবে, আপনার মতো ডাক্তার হবে। এসব না দেখেই চলে যাবেন? কোথাও যাওয়া হচ্ছে না বুঝলেন আঙ্কেল?
-হা হা হা। পাগলি মেয়ে বলে কি? চোখ রাঙিয়ে কি মৃত্যু ঠেকানো যায় রে পাগলি মা আমার? আর দেরি করো না মা। কাল সকালেই জায়গাটার কেয়ারটেকারের সাথে একবার দেখা করতে হবে। আর জমির কাগজগুলো নিয়ে নিও মনে করে।
-উফ! আঙ্কেল! ওষুধটা তো আগে খেয়ে নিন। প্রত্যুষা? দাদুর পাশে চুপটি করে বসে থাকো কেমন? মাম্মাম এক্ষুণি আসছি।
ছোট্ট বাচ্চাটা মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে গুঁটিগুঁটি পায়ে এগিয়ে এসে বিছানায় শুয়ে থাকা বৃদ্ধ মানুষটার কাছে এসে বসে নিচু গলায় কিছু একটা বলতে বলতে খিল খিল হেসে উঠছে। প্রজ্ঞা আবার ফিরে আসতেই বাচ্চা মেয়েটা প্রজ্ঞার আঁচল টেনে ধরলো। প্রজ্ঞা ডাক্তার সাহেবকে ওষুধটা খাইয়ে দিয়ে প্রত্যুষার ছোট্টো চুলে বাঁধা ঝুঁটিটা নাড়িয়ে দিয়ে হাসলো।
-কি হয়েছে মামনি? কিছু বলবে আমার মাম্মামপাখিটা?
-মাম্মা মাম্মা? আমলা পাপার কাছে যাবো? পাপা কি আমাদেরকে নিতে আসবে?
প্রত্যুষার আধো আধো বুলিতে কথাগুলো শুনে অজান্তেই প্রজ্ঞার চোখজোড়া পানিতে ভরে গেল। মেয়ের চুলে আরেকবার হাত বুলিয়ে দিয়ে কোনো মতে গলা দিয়ে দুটো শব্দ বের করলো বেচারি।
-আসবে মা।
প্রত্যুষাকে কথাগুলো বলেই আর এক মিনিটও সেখানে দাঁড়ালো না। নিজের রুমে চলে এসে নিজের আর প্রত্যুষার কাপড় গোছাতে গোছাতে নিজের মনেই কথাগুলো ভাবতে লাগলো প্রজ্ঞা।
'গতকাল টিভিতে বিশাল আয়োজনে তোমার আর শুভ্রার এঙ্গেজমেন্টের এনাউন্স করলো তোমার বাবা। এর পরও ওই শহরটায় আমাকে ফিরতে হবে ধূসর। যে মানুষটা মৃত্যুর মুখ থেকে আমাদের মেয়েকে আর আমাকে বাঁচিয়ে নতুন একটা জীবন দিয়েছে সেই মানুষটার ছোট্ট একটা ইচ্ছে পূরণ করতে আবার সেই শহরটায় ফিরতে হবে আমাকে। পরিচিত সেই শহরে পরিচিত মুখগুলো সামনে চলে এলে কি করবো? শুভ্রা বা মা আমাকে দেখে ফেললে কি হবে ভেবেও ভয় করছে ধূসর। তবু ওই শহরটায় আমি যেতে চাই ধূসর। কখনো কোনো চেনা বা অচেনা রাস্তার মোড়ে তোমার সাথে দেখা হয়ে গেলে তোমার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করবো, পাঁচটা বছর কি এতোই কম সময় যে একবারও আমার বা নিজের মেয়ের খোঁজে একটা শহর পাড়ি দিয়ে আসতে পারো নি? নাকি আমাদের সম্পর্কটা এতো ঠুনকো ছিল যে কারো ষড়যন্ত্রের কাছে আমাদের ভালোবাসাটাকে হেরে যেতে হয়েছে?'
ব্যাগ গুছিয়ে রাতেই ছোট্টো প্রত্যুষাকে নিয়ে সেই শহরটার উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছে প্রজ্ঞা। পুরোটা রাস্তায় প্রত্যুষাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে একটা কথাই ভেবেছে মেয়েটা। যেন ভুল করেও ওই মানুষগুলোর সামনে পড়তে না হয়। গভীর রাতে যতটা গোপনে নিজের ছোটোবেলার স্মৃতিতে ঘেরা শহরটায় আসছে, ঠিক তেমনই গোপনে যেন আবার ফিরে যেতে পারে। বুকের ভিতরে কোথাও একটা সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা হু হু করে কেঁদে উঠছে প্রিয় মানুষটাকে এক নজর দেখার জন্য। তবু মনে প্রাণে একটা প্রার্থনাই করছে প্রজ্ঞা। যেন মানুষটার সাথে এই দুটো দিনে দেখা না হয়ে যায়। ভাগ্যই একমাত্র বলতে পারে কি লিখে রেখেছে মানুষদুটোর কপালের রেখায়।
অন্যদিকে, বেশ রাত করেই নিজের কাজ শেষ করে অফিস থেকে ফিরছিল ধূসর। ড্রাইভারকে আগেই বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছে যাতে এই সময়টুকু সে নিজের মতো করে কাটাতে পারে, নিজের অতীত স্মৃতিগুলো আঁকড়ে বাঁচতে পারে। ড্রাইভিং করতে করতেই মাঝরাস্তায় গাড়িটা ব্রেক করে গাড়ি থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে রাতের অন্ধকার দেখায় মন দিল ধূসর। প্রতিদিন বাড়ির ফেরার সময় মাঝরাতের এই অভ্যেস হয়ে গেছে ধূসরের। ব্যস্ত শহরের চলন্ত গাড়িগুলো খেয়ালও করে কখনো ধূসরকে। তবে আজ কেউ খেয়াল করেছে। বেশ কিছুটা দূর থেকেই তার ঠোঁটের কাঁপন দেখেও রাতের এতো গাড়ির হাজার রকমের হর্নের ফাঁকেও শব্দটা যেন স্পষ্ট শুনতে পেল।
-পাপা।
.
.
.
চলবে..............................................................