হঠাৎ তুমি এলে - পর্ব ১০ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


-আরে ধূসর! কি করছ কি তুমি? এতো স্পিডে ড্রাইডিং করছো কেন? আস্তে চালাও গাড়ি! ধূসর! সামনে থেকে গাড়ি আসছে! আআআআআআআ। ধূসর? প্লিজ স্টপ দা কার। 

আনিস আহমাদের কেবিন থেকে বেরিয়ে ধূসর সোজা নিজের কেবিনে এসেই প্রজ্ঞাকে সোফা থেকে একটা হাত ধরে টেনে নিয়ে এসে গাড়িতে বসিয়ে দিয়ে গাড়ি স্টার্ট করলো। ধূসর কিছু না বলেই গাড়ি ফুল স্পিডে চালানো শুরু করায় প্রজ্ঞা নিজের সিটবেল্টটা বেঁধে নিয়ে ধূসরের দিকে তাকালো। ধূসর চোয়াল শক্ত করে কিছু একটা ভাবতে ভাবতে গাড়ি চালাচ্ছে দেখে প্রজ্ঞা ধূসরের বাম হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে কথাগুলো বললো। ধূসরদের গাড়ির অপজিট থেকে আরেকটা গাড়ি আসছে দেখে প্রজ্ঞা এতোটা ভয় পেয়ে গেছে যে কখন ধূসরের হাতটা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে নিয়েছে। একটু পরেই ওদের গাড়িটা হুট করে ব্রেক করায় প্রজ্ঞা ভয়ে আরো শক্ত করে চোখ বুজে মনে মনে যত দোয়া দূরুদ আছে সব পড়তে শুরু করেছে। বেশ কয়েক মিনিট কেটে যাওয়ার পরেও কিছুই ঘটে নি দেখে প্রজ্ঞা ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাতেই দেখলো ধূসর ম্লান মুখে প্রজ্ঞার দিকে তাকিয়ে আছে। প্রজ্ঞা বড় বড় চোখ করে ধূসরের দিকে তাকাতেই ধূসর হাত বাড়িয়ে প্রজ্ঞাকে বুকে টেনে নিয়ে কপালে আলতো করে চুমু এঁকে দিলো।

-পাগলি মেয়েটা এতো ভয় পেয়েছ কেন বলো তো? আমি থাকতে তোমার শরীরের একটা চুলও কেউ স্পর্শ করতে পারবে না বুঝলেন ম্যাডাম? এভাবে শক্ত করে হাতটা চেপে ধরেছে যে হাতটাই ভেঙ্গে গেল আমার। উফ! প্রজ্ঞা আমার হাত!

-কি হয়েছে তোমার হাতে? আমি মোটেও এতো শক্ত করে ধরি নি ধূসর। দেখাও দেখাও? কি হয়েছে হাতে দেখি? 

ধূসরের বুকের কাছ থেকে সরে এসে প্রজ্ঞা ব্যস্ত হাতেই ধূসরের বাম হাতটা ধরে হাতটা অনেকটা ফুলে গেছে ধূসরের দিকে তাকালো। ধূসর একটু হাসার চেষ্টা করে প্রজ্ঞার মাথাটা টেনে নিয়ে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে আবার স্টিয়ারিংয়ে হাত দেয়ার চেষ্টা করতেই প্রজ্ঞা ধূসরের বাম হাতে ঠাস করে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল। ধূসর ব্যথা পেয়ে হাতটা সরিয়ে নিয়ে একটু অবাক বিস্ময়েই তাকাতেই প্রজ্ঞা নিজের জ্বিভ কামড়ে ধূসরের হাতটা আবার টেনে নিল।

-সরি সরি সরি সরি। বেশি ব্যথা পেয়েছ? হাতটা কেমন ফুলে গেছ দেখেছ? এভাবে লাগলো কি করে হাতে?

-আরে তেমন কিছু না। একটু টেবিলের সাথে লেগে ব্যথা পেয়েছি। কিচ্ছু হয় নি তো বাবা। আর ব্যথাও পাই নি ম্যাডাম। 

-এটাকে একটুখানি ব্যথা বলে? হাতটা ফুলে গেছে বুঝতে পারছ না? এক্ষুণি ডাক্তারের কাছে যাবে তুমি। আর টেবিলের সাথে লেগে কি করে ব্যথা পায় একটা মানুষ আমি বুঝলাম না। আর গিয়েছিলে তো বাবার কেবিনে তাহলে---------।

-উফ! এই মেয়েটা এখন পুলিশের মতো জেরা শুরু করে দিবে। বলছি ম্যাডাম একটু থামুন। কোনো।ডাক্তারের কাছে যাওয়া লাগবে না। হালকা ব্যথা পেয়েছিলাম, তার উপরে আপনি যেভাবে ভয় পেয়ে হাতটা চেপে ধরেছেন, মনে হয় হাতটা ভেঙ্গেই গেছে। বাট সেই কথাটা তো ডাক্তারকে বলা যাবে না বলো? ডাক্তার কি ভাববে বলো তো? আজীবন শুনেছি জামাই বউকে পিটায়, আমার বেলায় দেখি উল্টা কেইস। বউ পিটিয়ে হাত পা ভেঙ্গে দিবে কোনদিন কে জানে।

-ধূসর? ফাইজলামি হচ্ছে? আর একটাও আজাইরা কথা বললে তোমার কিন্তু খবর আছে। আমি হাত ধরেছি বলে এমন হয়েছে বোঝাতে চাইছ তুমি? আমি দেখতে পাচ্ছি না চোখে কিছুতে জোরে লেগে ব্যথা পেয়েছ যে হাতে?

-আরে বাবা, বেশি ব্যথা পাই নি।

-তুমি ডাক্তারের কাছে যাবে আমার সাথে ধূসর? জাস্ট ইয়েস অর নো?

-এই মেয়েটাকে নিয়ে এই এক মুশকিল। একবার জেদ ধরলে তাকে বোঝানোর সাধ্য কারো আছে? ওকে তোমার সব কথাই মানবো, যার কাছে নিয়ে যেতে চাও, যাবো। বাট আমার একটা শর্ত আছে। সেটা যদি মানো তাহলে এখন এই মূহুর্তে যেদিকে যেতে বলবে সেদিকেই যাবো। আজ যদি বলো হসপিটালে থেকে যাবো আমরা, তাতেও রাজি আমি।

-ধূসর? আবার তোমার ইয়ার্কি শুরু হয়ে গেল না? তোমাকে বলছি না ডাক্তারের কাছে যাবো আমরা এখন? কথা না বলে হসপিটালের দিকে ড্রাইভিং করবে তুমি? নাকি আমিই গাড়ি থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরবো?

-আরে বাবা। তুমি নিজেই তো দেরি করছ এবারে? বলছি না দুজনে মিলে একটা ডিল করি এসো? তুমি রাজি হয়ে গেলেই আমাদের গাড়ি সোজা ছুটবে হসপিটালের দিকে। আর রাজি না হলে আমরা যাবো---উমমমম? রেস্টুরেন্টে? কি বলো?

-কি করতে হবে জনাব এখন আমাকে? আগে বলুন শুনি। তারপর ভাববো ডিল ওকে নাকি বাতিল।

-ওকে। শুনুন ম্যাডাম। আমি না বললে যে আপনি জানতে পারবেন না তেমনটা নয়। আর আমিও চাই না তোমার আমার মধ্যে আড়াল থাকুক। আর এটাও চাই না যে তুমি আবার অন্য কারো কথার জালে আটকে আমাদের সম্পর্কটায় তিক্ততা আনো। বুঝতে পারছ কি বললাম?

-কি বলছ আগামাথা নেই। আমি আবার কার কথায় তোমার সাথে ঝামেলা করবো হ্যাঁ?

-ঝামেলা করার কথা বলছি না। বাবার রিসেন্ট প্রজেক্টটার কথা তো জানোই। যেটা কমপ্লিট করার জন্য আমাকে বাবা বাড়ি ছাড়া সহ্য করতে পারলেও কোম্পানি ছাড়া করতে সাহস পায়নি।

-আবার? ধূসর তোমার সমস্যাটা কি? বাবা মায়ের সম্পর্কে কেউ এভাবে কথা বলে? আজব! আর মানছি আমিই তোমাকে জোর করেছি বাবার কোম্পানিটা না ছাড়তে, তাই বলে সবসময় এই এক কথা কেন টেনে আনো?

-আবার নতুন করে আপনি যেন আরেকটা এক্সামপল দাঁড় করাতে না পারেন তারজন্যই বারবার মনে করিয়ে দিই।

-আর একবারও এই ফালতু জোক করলে দেখবে তোমার কি আর আমি। যা বলবে বলো। আমি আর জীবনেও তোমাকে কিছু করতে বলবো না। দেখে নিও।

-তোমার নিজের মনের যত ইচ্ছে আমার সাথে শেয়ার করো, রাগ হলে চিৎকার করো, বকো, ঝগড়াঝাটি, যা ইচ্ছা করো, বাট ওই দুটো মানুষের কথার ফাঁদে পড়ে তাদের বুলি আওড়িও না কখনো। ওকে?

-তার মানে আবার কি একটা হয়েছে? আমার তোমাকে কনভেন্স করা লাগবে এমন কিছু করেছ নাকি আবার?

-প্রজ্ঞা? মজা নাও না তুমি? আমি কিন্তু সিরিয়াস। তোমার শ্বশুর শাশুড়ি দেখবে আজ কালের মধ্যে কল করে বলবে, আমার প্রজেক্টের কাজে বিদেশে যাওয়ার দরকার, নইলে ডিলটা আমাদের কোম্পানি পাবে না, অনেক লস হয়ে যাবে, ইত্যাদি ইত্যাদি। আরো কত কিছু বলবে তার হিসেব নেই। 

-মানে কি? তুমি দেশের বাইরে যাবে? কবে? আগে বলো নি তো কিছু।

-আমি কোথাও যাচ্ছি না সোনাময়নাপাখি। আমার প্রজেক্টটা কমপ্লিট করে বাবাকে বুঝিয়ে দেয়ার কথা ছিল, আমি সেটুকুই করবো। এর বেশি কিছু না। ওকে? তোমার শ্রদ্ধেয় শ্বশুর শাশুড়ি এই ব্যাপারে যা ই বলুক না কেন আমি না কোথাও যাবো, আর না তাদের এই প্রজেক্টের বাকি আর কোনো দায়িত্ব নিব। ওকে? আর ম্যাডাম আপনি। আপনি দয়া করে আমাকে এই বিষয়ে কোনো রকম জ্ঞান, বুদ্ধি, পরামর্শ কিছুই দিতে আসবেন না। ওকে? ডিল ডান?

-আমমমমমম। কিন্তু ধূসর?

-এই ব্যাপারে আর কোনো ডিস্কাশন হবে না ম্যাডাম। আপনি জাস্ট হ্যাঁ বা না তে আনসার দিন। দুনিয়ার যে যাই বলুক এই বিষয়ে আর কোনো কথা হবে না আমাদের। অন্তত যাওয়ার ব্যাপারে কনভেন্স করার জন্য তো মরে গেলেও নয়। ডিল ওকে? অর নট?

ধূসর সরাসরি প্রজ্ঞার চোখে চোখ করে প্রশ্নগুলো করছিল। প্রজ্ঞা থতমত খেয়ে কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না। ধূসর বিদেশে যাক এটা তো প্রজ্ঞা ভাবতেও পারে না, কিন্তু ধূসর না গেলে কাজটাই যদি নাহয়? প্রজ্ঞা আরো কিছু ভাবার আগেই ধূসর প্রজ্ঞার চোখের সামনে আঙুল দিয়ে তুড়ি বাজাতেই প্রজ্ঞা চমকে তাকালো ধূসরের দিকে।

-ম্যাডাম মাঝরাস্তায় এতোক্ষণ গাড়িতে বসে থাকলে একটু পরেই আশেপাশে ভিড় জমে যাবে। বুঝলেন? একদল আসবে গাড়িতে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে গেল কিনা এটা দেখতে, আরেক দল আসবে ভিতরে কোনো রোমান্টিক সিন চলছে কিনা সেটা দেখে মজা নিতে, বা ফায়দা নিতে। 

-উফ! ধূসর চুপ করো তো। 

-তা আপনার ওভার থিংকিং শেষ হলে দয়া করে বলবেন কি ম্যাডাম আমরা এখন কোনদিকে যাচ্ছি? হসপিটাল নাকি রেস্টুরেন্ট?

-হসপিটাল।

-তার মানে কি আমি ধরে নিব আমাদের ডিলটা ফাইনাল? 

-আমার মুড চেইঞ্জ হওয়ার আগে আপনি কি গাড়ি স্টার্ট দিবেন প্লিজ ধূসর? নাকি আমি এখানেই নেমে যাবো?

-ওকে ওকে। বাট পরে যদি কোনো গন্ডগোল পাকানোর চেষ্টা করো মেয়ে তাহলে তোমার খবর আছে। 

-ওকে দেখা যাবে। এখন চলো?

হসপিটাল থেকে ধূসর আর প্রজ্ঞা এসেছে রেস্টুরেন্টে। সেখানে লাঞ্চ সেরে সারাদিনই দুজনে একসাথে ঘুরোঘুরি, শপিং আর খাওয়া দাওয়া করে শেষে বেশ রাত করেই বাসায় ফিরছে। সারাদিনের ছুটোছুটির শেষে প্রজ্ঞা টায়ার্ড হয়ে সিটে একেবারে গা এলিয়ে দিয়েছে দেখে ধূসর হাসলো। বাইরের একটার পর একটা জায়গায় শাঁ শাঁ করে ওদের গাড়ির উল্টোদিকে ছুটে যাচ্ছে, বাতাসের তোড়ে প্রজ্ঞার চুলগুলো লাগামহীন উড়োউড়ি করেও আজ বিরক্ত করতে পারছে না প্রজ্ঞাকে। রাতের শহরের সৌন্দর্যের সাথে আরো গভীর একটা আকর্ষণে সারাদিনের সমস্ত ক্লান্তি ভুলে আবেশেই চোখ বুজে আসছে মেয়েটার। তেমন কিছুুই না, সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো হাতের আদরে হুটহাট প্রজ্ঞাকে ছুঁয়ে দেয়ার মাঝেই গাড়ি চালাতে চালাতেই খালি গলায় গান ধরেছে মানুষটা। তারই সুরের লহরিই যেন প্রতিধ্বনিত হয়ে কানে এসে বাজছে প্রজ্ঞার। 

"তোমার ইচ্ছে গুলো ইচ্ছে হলে
আমায় দিতে পারো,
আমার ভালো লাগা, ভালোবাসা
তোমায় দেবো আরো।

তুমি হাতটা শুধু ধরো,
আমি হবো না আর কারো,
তোমার স্বপ্ন গুলো আমার চোখে
হচ্ছে জড়সড়,

তোমার ইচ্ছে গুলো ইচ্ছে হলে
আমায় দিতে পারো
আমার ভালো লাগা, ভালোবাসা
তোমায় দেবো আরো।

তোমার আবেগ মাখা খামখেয়ালী
হাঁটছে আমার পিছু,
আমার আসা যাওয়ার পথের বাঁকে
পাইনি অন্য কিছু।

তুমি হাতটা শুধু ধরো,
আমি হবো না আর কারো
তোমার স্বপ্ন গুলো আমার চোখে
হচ্ছে জড়সড়।

তোমার ইচ্ছে গুলো ইচ্ছে হলে
আমায় দিতে পারো
আমার ভালো লাগা, ভালোবাসা
তোমায় দেবো আরো

আমার হৃদয় যেন বানভাসি হয়
তোমার স্রোতের টাণে
আমি তোমার কাছে যাবোই যাবো
একলা থাকার দিনে

তুমি হাতটা শুধু ধরো,
আমি হবো না আর কারো
তোমার স্বপ্ন গুলো আমার চোখে
হচ্ছে জড়সড়

তোমার ইচ্ছে গুলো, ইচ্ছে গুলো
তোমার ইচ্ছে গুলো ইচ্ছে হলে
আমায় দিতে পারো
আমার ভালো লাগা, ভালোবাসা
তোমায় দেবো আরো....।"
.
.
.
চলবে.............................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন