-মিসেস ধূসর? দেয়ার ইজ এ প্রবলেম। মিস্টার ধূসরের কন্ডিশন ক্রিটিক্যাল। আমরা নিজেদের সাধ্যমতো চেষ্টা করেছি। বাট পেশেন্টের অবস্থার কোনো উন্নতিই হয়নি। অবস্থা আরো খারাপ হওয়ার আগে একটা শেষ চেষ্টা করতে চাইছি আমরা। এ জন্য আপনাকে বন্ডে সাইন করতে হবে। আপনি প্লিজ বন্ডে সাইন করে ক্যাশ কাউন্টারে ২৫ লক্ষ টাকা জমা করে দিন। এডভান্স পেমেন্ট করার পর আমরাও অপারেশনের ব্যবস্থা করে ফেলতে পারবো। বন্ডে সাইন করার আগে দয়া করে একবার পুরোটা পড়ে দেখবেন।
টলমলে পায়ে বহু কষ্টে রিসেপশানের টেলিফোন থেকে শাশুড়িকে যতটুকু বলতে পারলো সেটুকুই বলে হসপিটালে আসার কথাটা বলেছে প্রজ্ঞা। কোন হসপিটাল, কোথায় আছে ওরা, ধূসরের কি অবস্থা, এসব কোনো প্রশ্ন না করেই কলটা কেটে দিয়েছে ভদ্রমহিলা। কলটা কেটে যেতেই প্রজ্ঞা রিসেপশানের সামনেই বসে পড়লো। পাশের নার্স ভদ্রমহিলা সামাল দেয়ার আগেই প্রজ্ঞা কেঁদে ফেললো। কান্নার দমকে খেয়াল করেনি নার্স আর প্রজ্ঞাকে ঘিরে ছোটোখাটো একটা ভিড় জড়ো হয়েছে রিসেপশানের সামনে। নার্সের বারবার পীড়াপীড়ির পর ফ্লোর থেকে উঠে ধূসরের ওটির বাইরে এসে দাঁড়াতেই ভিতর থেকে একজন ডাক্তার বেরিয়ে এসে কথাগুলো বললো প্রজ্ঞাকে। একে তো ডাক্তারের মুখে ধূসরের এমন অবস্থার কথা, তার উপরে এতোগুলো টাকা ক্যাশ পেমেন্ট করা লাগবে! আবার বন্ডে সাইন করার কথা বলছে! কিসের বন্ড! কেন সাইন করা লাগবে?
-পঁচিশ লক্ষ টাকা! এতো টাকা এই মূহুর্তে কি করো জোগাড় করবো আমি? আনিসও তো প্রজেক্টের কাজে দেশের বাইরে গেছে আজই। এই মূহুর্তে ফ্লাইটে আছে লোকটা, তাকে জানানোর সুযোগ থাকলে হয়তো সে কোনো না কোনোভাবে টাকাটা ম্যানেজ করে দিতে পারতো। কিন্তু------।
ডাক্তারের কথাগুলো শুনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রজ্ঞার হুঁশ ফিরলো পিছন থেকে ভেসে আসা কণ্ঠস্বরটা শুনে। নিজের সমস্ত শক্তি দিয়ে ছুটে এসে শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে আবার কেঁদে ফেললো মেয়েটা। ওপারেশন থিয়েটার থেকে বেরিয়ে আসা সেই ডাক্তার ভদ্রলোক নিজের হাতের গ্লাভ দুটো খুলতে খুলতে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। যেন ধূসরের মায়ের কথাগুলো শুনে হতাশই হয়েছেন ভদ্রলোক।
-আমরা নিজেদের মতো চেষ্টা করেছি। মারাত্মক একটা এক্সিডেন্টের পরও আমরা নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি পেশেন্টকে বাঁচানোর। পেশেন্টও যথেষ্ট ফাইট করছে কামব্যাম করার। বাট এর বেশি কিছু করা আমাদের পক্ষে আর পসিবে না। দু ঘন্টার মধ্যে অপারেশনটা শুরু করা না গেলে আর কোনো মিথ্যে আশা নিয়ে বসে থেকেও কোনো লাভ হবে না। আমাদেরও কিছু ল্যাকিংস আছে ম্যাডাম। তাছাড়া উনার ব্রেইনে ব্লাড ক্লটিং শুরু হয়েছে এক্সিডেন্টের পর। সেটা সময়ের মধ্যে বের করে না আনা গেলে পেশেন্টকে বাঁচানো ইম্পসিবল। আপনারা পেশেন্টের ট্রিটমেন্ট করতে না পারলে প্লিজ পরে আমাদেরকে দোষারোপ করবেন না।
-ডক্টর ডক্টর ডক্টর? মা? ধূসর? ধূসরের কিছু হবে ন। তো মা বলুন না? ওরা এমন কেন বলছে? আমি--আমি জানি ধূসরের কিচ্ছু হয়নি। ও এভাবে আমাকে একা ফেলে যেতে পারে না। কিছুতেই পারে না।
ডাক্তার নিজের কথাগুলো শেষ করেই একটা কেবিনের দিকে চলে গেল। নার্স ভদ্রমহিলাও কিছুটা ইতস্তত করে সেখান থেকে বিদায় নিল। প্রজ্ঞা শাশুড়িকে জড়িয়ে ধরে অপারেশন থিয়েটারের কাঁচে ঢাকা জানালার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো বলার ফাঁকেই কারো সজোরে ধাক্কায় প্রজ্ঞা ছিটকে একটা ওয়েটিং চেয়ারের উপরে পড়লো। স্টিলের চেয়ারের খুঁটিতে মাথাতে বেশ ভালোই আঘাত লাগার পরও সেই ব্যথার চেয়েও বেশি বিস্মিত হয়ে নিজেকে সামলে সামনের দিকে তাকিয়েছে প্রজ্ঞা। ততক্ষণে ধূসরের মায়ের সমস্ত মুখটা রাগে লাল হয়ে গেছে। প্রজ্ঞা কিছু বলার আগেই শাশুড়ির শক্ত হাতের একটা চড় এসে পড়লো প্রজ্ঞার গালে। ঘটনাগুলো এতো কম সময়ের ব্যবধানে ঘটলো যে প্রজ্ঞা রিএক্ট করার সময়টুকুও পেল না। আধো কি রিএক্ট করবে সেটাই খুঁজে পাচ্ছে না মেয়েটা।
-এই সবকিছুর জন্য দায়ী তুই, অপয়া অলক্ষী মেয়ে। যেদিন থেকে আমার ছেলেটার জীবনে এসেছিস সেদিন থেকেই আমার ছেলেটার জীবনটাকে তছনছ করে দিয়েছিস। যে ছেলে আমার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তো, যে ছেলে নিজের বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে কখনো জোরে একটা কথা পর্যন্ত বলে নি, সেই ছেলেটাই তোর জন্য বাড়ি ছেড়েছে, নিজের বাবার চোখে চোখ রেখে বলে সে আর নিজের অফিসে আসবে না? আরে রূপ, গুণ তো দূর সামান্য স্বামীভাগ্য পর্যন্ত নেই তোর? আজ তুই অপয়াকে বিয়ে করে আমার ছেলেটা মরতে বসেছে।
-মা? কি বলছেন?
-চুপ! একদম চুপ হতভাগি মেয়ে! নিজের বাবা মাকে তো খেয়েছিস, আমার ছেলেটাও মৃত্যুশয্যায়, এবার কি আমাদেরকেও মারতে চাস? এতোগুলো দিন ছেলেটা চোখের আড়াল ছিল, তবু অন্তত বেঁচে তো ছিল! আজ? আজ কি করলি তুই রাক্ষসী? আমার ছেলেটাকেও কেড়ে নিতে চাস তুই?
-এসব কুসংস্কারের কথা বলবেন না মা প্লিজ। মানছি ভুল আমারও হয়েছে। আমার আগেই উচিত ছিল ধূসর ড্রাইভিং করছে শোনার পর কলটা কেটে দেওয়া। কিন্তু এসবে আমার ভাগ্যকে জড়াবেন না।
-তোর অপয়া ভাগ্যের জন্যই আমার ছেলেটা অকালে মরতে বসেছে। তবু তোর ভাগ্যের দোষ নয়? তোর কারণে আমার ছেলেটা আজ এই এক্সিডেন্ট করে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। অথচ ধূসরের আজ ওর বাবার সাথে বিদেশে যাওয়ার কথা ছিল। শুধু তোর কথায় ছেলেটা নিজের বাবার মুখের উপর দিয়ে বলে দিয়েছে যাবে না। কোম্পানির কোনো দায়িত্বের কখনো অবহেলা করে নি আমার ছেলেটা। এই প্রথমবার, নিজেদের কোম্পানির লস হবে জানার পরও ছেলেটা সেটাকেও ইগনোর করেছে, শুধুমাত্র তোর কথায়।
-মা? এসব এখন বন্ধ করুন প্লিজ। ধূসরের অপারেশনের জন্য পঁচিশ লাখ টাকা জোগাড় করতে হবে। এখন এতোগুলো টাকা কোথা থেকে পাবো সেটাই ভাবতে হবে আমাদেরকে। বাকিটা নাহয় ধূসর সুস্থ হয়ে ফিরে আসার দেখা যাবে।
-আমার ছেলেটাকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে এখন নাটক করতে এসেছিস? নাটক? আমার ছেলের যদি কিছু হয় প্রজ্ঞা, তাহলে তোকেও আমি ছাড়বো না বলে দিলাম। দেখে নিস।
-ঠিক আছে মা। আমি আপনাকে বলছি শুনে রাখুন, আমার ধূসরের কিচ্ছু হবে না। এটা আমার বিশ্বাস। উনাকে সুস্থ করে আপনার সামনে এনে দাঁড় করাবো আমি। সেদিন আপনি বলবেন এই অপয়া মেয়েটার কারণে আপনার ছেলেটার কোনো ক্ষতি কখনো হয়েছে কি না। ডাক্তার যত যা ই বলুক না কেন, আমার মন বলছে ধূসর সুস্থ হয়ে উঠবেই।
প্রজ্ঞার কথাগুলো শুনে ধূসরের মা বিরক্তি নিয়ে তাকালেও আর সেখানে এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না প্রজ্ঞা। নিজের সমস্ত ভয়, ব্যথা, কষ্ট ভুলে ছুটলো বাড়ির দিকে। যে করেই হোক ধূসরের অপারেশনের টাকাটা তো জোগাড় করতে হবে প্রজ্ঞাকে। হাতে মাত্র দুটো ঘন্টা সময় বাকি। দুই ঘন্টা পর প্রজ্ঞা যখন ফিরে এসেছে তখন মেয়েটার হাতে একটা ব্যাগ। পঁচিশ লাখ টাকা জোগাড় করা সম্ভব হয়নি মেয়েটার পক্ষে। বাড়িতে ক্যাশ কিছু টাকা, মায়ের রেখে যাওয়া সব গয়না, নিজের বিয়ের গয়না, পরিচিত বন্ধু বান্ধব সবার কাছে কাকুতি মিনতি করে শেষ পর্যন্ত পনেরো লাখ টাকার মতোই জোগাড় করতে পেরেছে প্রজ্ঞা। তবু শেষ আশা নিয়ে রিসেপশনে টাকাগুলো জমা দিতে এসেছে মেয়েটা। বাকি টাকা সকাল হলেই ব্যবস্থা করে ফেলা সম্ভব। রাতটা বেশ গভীর হয়েছে, আর সব ব্যাংকগুলোও বন্ধ। এতো রাতে এর বেশি টাকা জোগাড় করা কি করে সম্ভব?
টাকার ব্যাগ হাতে বেশ অনেকক্ষণ ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে শেষে নিজের নিজের সিরিয়াল আসার পরও টাকা দিতে না পারায় মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো প্রজ্ঞার। রিসেপশান থেকে সোজা জানিয়ে দিল, এই পেশেন্টের পেমেন্ট হয়ে গেছে। এর বেশি তারা কিছু জানে না। প্রজ্ঞা পড়িমড়ি করে হাতের ব্যাগটা আঁকড়ে ধরে রিসেপশান থেকে ছুটে ওটির সামনে এসে শাশুড়িকে দেখে ছুটে এলো। প্রজ্ঞার শাশুড়ি প্রজ্ঞার দিক থেকে চোখ সরিয়ে দেয়ালে ঝুলানো।ঘড়িটার দিকে এক নজর তাকিয়ে ভদ্রমহিলার ঠোঁটের কোণে একটা তাচ্ছিল্যভরা ম্লান হাসি ফুটে উঠলো। একটু পরেই শাশুড়ির বলা কথাগুলো সোজা প্রজ্ঞার একেবারে কলিজায় গিয়ে লাগলো। প্রজ্ঞার হাতের ব্যাগটা ততক্ষণে ফ্লোরে পড়ে গেছে। মেয়েটাও ততক্ষণে ছলছলে চোখে শাশুড়ি আর তাস পাশে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে পাথরের মতো ভাবলেশহীন হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। আর এই স্তব্ধতার মধ্যেও মেয়েটার কানের কাছে ঘুরে বেড়াচ্ছে শাশুড়ির বলা কথাগুলো।
-আমি জানতাম তোমার অপেক্ষায় বসে থাকলে আমার ছেলেটাকে হারাতে হবেই আজকে। তোমার উপরে ভরসা করে নিজের ছেলের জীবন নিয়ে বাজি ধরি নি, এটা ভেবেই শুকরিয়া করছি ওপরওয়ালার কাছে। যাকে পাগলের মতো ভালোবেসেছে তার কারণেই মরতে বসেছিল ছেলেটা, আর যাকে এতোদিন তুচ্ছ করেছে, অপমান করেছে, সেই সেই সময়ে জীবন বাঁচাতে ছুটে এসেছে। একেই বলে ভাগ্য! ভাগ্যের পরিহাস।
.
.
.
চলবে.............................................................