-ওটি রেডি করা হয়ে গেছে ম্যাডাম। এবার হসপিটালের বন্ডে সাইন করে দিলে আমরা অপারেশন শুরু করতে পারবো।
শুভ্রা আর শাশুড়িকে দেখে প্রজ্ঞার স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার মাঝেই আগের নার্স ভদ্রমহিলাটি হাতে একটা ফাইল নিয়ে ফিরে এসেছে দেখে প্রজ্ঞা হাত বাড়িয়ে ফাইলটা নেয়ার চেষ্টা করলো। ফাইলটা প্রজ্ঞা নেয়ার আগেই শুভ্রা নার্সের হাত থেকে রীতিমতো ছোঁ মেরে ফাইলটা নিজের হাতে নিয়ে ফেলে একটা বাঁকা হাসি দিয়ে প্রজ্ঞার দিকে তাকালো। প্রজ্ঞা রাগী চোখে শুভ্রার দিকে তাকিয়ে ফাইলটা নেয়ার জন্য বহুকষ্টে দু কদম এগিয়ে আসতেই শুভ্রা বাম হাত দিয়ে প্রজ্ঞাকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ফাইলটা উল্টেপাল্টে দেখায় মন দিল। প্রজ্ঞা রাগে কিছু বলতে যাবে তার আগেই শুভ্রা আবার মুখ তুলে তাকালো।
-অপারেশনের টাকা নিয়ে এতো রাতে ছুটে এলাম আমি, আর বন্ডে সাইন করবে তুমি? এটা কোন ধরনের ন্যায়বিচার বলো তো প্রজ্ঞা?
-শুভ্রা ফাইলটা আমাকে দাও বলছি। আমি ধূসরের ওয়াইফ, বন্ডে সাইন করার তুমি কে?
-সত্যিই তো। আমি কে! এই বন্ডের মানে জানো তুমি? এর মানে হলো অপারেশনের সময় পেশেন্ট।যদি কেলাপ্স করে তাহলে তার দায়ভার হসপিটাল কর্তৃপক্ষ বা ডাক্তার কেউই নিবে না। তো দায়টা সেক্ষেত্রে কার হবে? এক্সিডেন্টের ট্রিটমেন্ট করতে ডাক্তারদের অবহেলায় কত পেশেন্ট এভাবে মারা যায় জানো তুমি? আজ ধূসরের কিছু হয়ে গেলে তার দায় তুমি নিতে পারবে? ফুফু আর আঙ্কেলকে তাদের সন্তানকে ফিরিয়ে দিতে পারবে বলো?
-শুভ্রা ফর গড সেইক, বন্ডে সাইন না করা পর্যন্ত ওরা অপারেশন শুরু করবে না। প্লিজ আমাকে ফাইলটা দাও, প্লিজ। হাত জোড় করছি তোমার কাছে।
-উমমমমম। তোমার জন্য আমার আসলেই দয়া হচ্ছে মেয়ে। কি বলো তো? অপারেশনের পর ধূসর তো বেঁচে যাবে, তারপর তুমি আর ধূসর সুখে দিন কাটাবে, আর আমি? আমি কি পাবো? এতো রাতে নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, এতোগুলো টাকা নিয়ে হসপিটালে ছুটে এসেছি, একবারও নিজের লাভের কথা ভাবলাম না। বলো তো প্রজ্ঞা? আমি কি পাবো এর বিনিময়ে?
-শুভ্রা প্লিজ। যাকে ভালোবাসো সে বেঁচে আছে, সুখে আছে এটাই কি তোমার সবচেয়ে বড় পাওয়া নয়? আর কি চাও তুমি?
-তোমার ভাগের সুখটা আমার চাই প্রজ্ঞা।
-মানে!
শুভ্রা কথা শুনে প্রজ্ঞা নিজের সমস্ত কষ্ট, ব্যথা, যন্ত্রণা নিমিষেই ভুলে গিয়ে বোকার মতো তাকিয়ে একবার শাশুড়ির মুখের দিকে তাকাচ্ছে, আর একবার শুভ্রার দিকে। মেয়েটার মাথায় কি চলছে সেটা বুঝতেই পারছে না প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞার এমন হতভম্ব ভাবটা দেখে শুভ্রা আবার হাসলো।
-এই পেপারটায় সাইন করতে চাও তো তুমি? যাতে ডাক্তাররা অপারেশনটা শুরু করতে পারে। যাতে ধূসর আবার আমাদের সবার মাঝে সুস্থ হয়ে ফিরে আসে? ওকে। আমি ফাইলটা তোমাকে দিয়ে দিবো। এক্ষুণি দিয়ে দিব। বাট---একটা শর্তে।
-শ-শর-শর্ত! কি শর্ত! অলরেডি ইটস টু লেইট শুভ্রা। এই সময়ও তোমার শর্ত দিতে ইচ্ছে করছে? কি চাও কি বলো তুমি? কাল সকালের ব্যাংক খোলার সাথে সাথেই আমার বাবার রেখে যাওয়া সব তোমার হাতে তুলে দিব, প্লিজ। প্লিজ শুভ্রা!
-হা হা হা। নাইস জোক মিসেস ধূসর আহমাদ। উপস সরি। হসপিটাল এতো হাসহাসি করার জায়গা না, তবুও তোমার কথায় না হেসে পারছি না। তুমি শুভ্রাকে টাকার লোভ দেখাচ্ছ? এতোই যদি টাকার গরম থাকে তাহলে নিজেই ধূসরের ট্রিটমেন্টের টাকাটা দিয়ে দাও। আমার কাছে হাত পাতার তো দরকার নেই।
-এতো রাতে ব্যাংক বন্ধ না থাকলে তোমার একটা পয়সাও দেয়া লাগতো না শুভ্রা। আর কাল সকালেই তোমার সব টাকা তুমি পেয়ে যাবে। যা দিয়েছ, তার চেয়ে বেশিই পাবে।
-বাট আমার তো টাকা নাই প্রজ্ঞা। আমার ধূসরকে চাই।
-হোয়াট!
-আরে এতো অবাক হচ্ছো কেন? একটু আগে তুমিই না বললে, যাকে ভালোবাসে সে বেঁচে আছে, সুখে আছে এটাই সব থেকে বড় পাওয়া। তো তোমার নিজের এই ইন্সপিরেশন নিজে প্রমাণ করে দেখাও। তোমার কাছে জাস্ট দুটো অপশন আছে, এক, সকাল পর্যন্ত ধূসরের লাশের পাশে বসে কেঁদে কেঁদে নিজেদের প্রেমের দিনগুলো স্মরণ করা, অর দুই, এই বন্ডে সাইন করো, আমার কোনো প্রবলেম নেই তাতে। বন্ডে সাইন করার পর এই হসপিটালে আর এক সেকেন্ডের জন্যও থাকতে পারবে না। আর না ধূসরের জীবনে কখনো ফিরে আসার চেষ্টা করবে।
-কখনোই না। কিছুতেই না। ধূসর সেন্সে আসার পর আমাকে দেখতে না পেলে------।
-কিছুই হবে না মেয়ে। আমি আর ফুফু ঠিক সামলে নিবো ধূসরকে। তুমি আসার আগে যেমন করে আগলে রেখেছিলাম, তার চেয়েও বেশি কেয়ার দিয়ে আগলে রাখবো এবার আমার ধূসরকে। শুধু তুমি ওর জীবন থেকে দূরে গিয়ে আমাদেরকে মুক্তি দাও।
-প্লিজ শুভ্রা! আমি পারবো না।
-নিজেকে কখনো দেখেছ আয়নায়? ধূসরের পাশে তোমার মতো একটা মেয়েকে ভাবতেই গা ঘিনঘিন করে আমার। কি জাদু করে রেখেছ ওকে আমি জানি না। জানতে চাইও না। আমি শুধু আমার ধূসরকে ফিরে পেতে চাই। আর তার জন্য তোমাকে ওর জীবন থেকে চিরদিনের জন্য চলে যেতে হবে। তুমি নিজে গেলেই সেটা সবার পক্ষে ভালো।
-আমি কোথায় যাবো ধূসরকে ছেড়ে? বিশ্বাস করো আমার জীবনে ও ছাড়া আর কেউ নেই।
-তাহলে মরে যাও। তবু ধূসর আর আমার মাঝে আসার কথা ভুলে যাও তুমি। তুমি বুঝতে পারো না ধূসরের জন্য তুমি যে একদম ব্যাড একটা চয়েজ? আহহহ। দেখো মেয়ে, লাস্ট বারের মতো বলছি, তুমি কি চাও ধূসরের অপারেশনটা হোক? যদি চাও, তাহলে এখান থেকে এতো দূরে চলে যাও যেখান থেকে ধূসরের জীবনে আর ফিরে আসতে পারবে না। আর যদি না চাও, তাহলে ফুফি, আমি গেলাম। তোমাদের সো কলড পুত্রবধূর তোমার ছেলের জীবনের কোনো দামই নেই বলতে হবে।
-না না না প্লিজ শুভ্রা যেও না। আমি ধূসরের অপারেশনটা শেষ হলে তারপর----।
-কিছুতেই না। অপারেশন হয়ে গেলে তুমি যদি না যেতে চাও তখন? আমার বাপু তোমার মতো মেয়ের উপরে ভরসা নেই। যে বিয়ের আগেই জানতো ধূসরের সাথে আমার বিয়ের কথা পাকা ছিল, তবু সব জানার পরও যে মেয়ে ধূসরের গলায় ঝুলে পড়তে পারে, সে যে পরে নিজের কথা রাখবে তার গ্যারান্টি কোথায়?
-ঠিক আছে। আমি যাবো, চলে যাবো। কিন্তু ধূসরকে আমার থেকে দূরে রাখার কোনো প্ল্যানই তোমার বা মা আপনার, কারোই কাজে আসবে না। কথাটা মিলিয়ে নিবেন।
-সেটা তোমাকে ভাবতে হবে না প্রজ্ঞা। ওহ! শেষ দায়িত্বটুকু পালন করে যাও। বন্ডে সাইনটা তো করে দিয়ে যাও? হাজার হোক, এখন পর্যন্ত ধূসরের লিগ্যাল ওয়াইফ তুমি।
-এই অধিকারটা আজীবন শুধু আমারই থাকবে শুভ্রা। আর মা, একদিন ঠিক আপনি বুঝবেন আপনার সন্তানের জন্য কাকে চিনতে ভুল করেছেন।
-প্রজ্ঞা? ডায়লগের সময় নেই বুঝলে? জাস্ট সাইন ইট এন্ড লিভ।
শুভ্রার নাছোড়বান্দা ছলনার কাছে শেষমেষ পরাজয় স্বীকার করতেই হলো প্রজ্ঞাকে। বন্ডের পেপারে কাঁপা হাতে সাইনটা করে দেয়ার প্রায় সাথে সাথেই শুভ্রা এক টানে কাগজটা নিজের হাতে নিয়ে নিল। প্রজ্ঞার গাল বেয়ে এতোক্ষণ ধরে যে কান্নার বন্যা বেয়ে যাচ্ছে সেটা শুভ্রা আর ধূসরের মা কারো চোখেই যেন পড়লো না। প্রজ্ঞা এখনও স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে দেখে শুভ্রা প্রজ্ঞার একটা হাত টানতে টানতে হসপিটালের রিসেপশানের দিকে নিয়ে গিয়ে বাইরের দিকে প্রায় ছুড়ে ফেলে দিল।
-তোমার কাজ শেষ, সো জাস্ট গেট লস্ট। ধূসর আর আমার জীবন থেকে এতোটা দূরে চলে যাও যেন আমার সামনে কখনো পড়তে না হয় তোমাকে। যদি ভুলেও কোনোদিন সামনে পড়ো তাহলে জানতে পারবে শুভ্রা নিজের জেদ পূরণ করতে ঠিক কতোটা নিচে নামতে পারে।
প্রজ্ঞাকে হসপিটাল থেকে বের করে দিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো শুভ্রা। ধূসরের মায়ের সাথে কিছু একটা নিয়ে হাসাহাসি করতে করতে ধূসরের কেবিনের দিকে এগিয়ে আসতে গিয়েই এতোক্ষণে প্রজ্ঞার ফেলে যাওয়া ব্যাগটা চোখে পড়লো। শুভ্রা ভ্রু কুঁচকে ব্যাগের ভিতরে থাকা ক্যাশগুলো হালকা হাতে নেড়ে চেড়ে দেখে ফুফুর দিকে তাকিয়ে বাঁকা হাসল।
-দেখলে তো ফুফি? কত ইজি ছিল কাজটা? ধূসর একটু ইনজর্ড হয়েছে, বাদ বাকি কত সহজে এই আগাছাটাকে ধূসরের জীবন থেকে উপড়ে ফেললাম? উফ! বেচারির জন্য কষ্টই হচ্ছে এবারে আমার। বেচারি জানতেও পারলো না এই একটা অধিকার নিয়ে করা সাইন কিভাবে ধূসরের জীবন থেকে ওর অস্তিত্বটাকেই মুছে দিবে।
অন্যদিকে, হসপিটাল থেকে বের হয়ে কোনদিকে চলেছে প্রজ্ঞা নিজেও জানে না। সন্ধ্যে বেলায় পড়নের কালো শাড়িটা এখন বেশ এবড়োথেবড়ো হয়ে গুঁটিয়ে গেছে। যার জন্য এতো যত্নে শাড়িটা পরা তার আর কখনো দেখা হবে কিনা এসব ভাবতে ভাবতেই সমানের দিক থেকে একটা তীক্ষ্ণ আলো এগিয়ে আসছে খেয়াল হলো প্রজ্ঞার। তীক্ষ্ম আলোটা একসময় এতোটা আলোকিত আকার নিল যে চোখে সামনে অন্ধকার হয়ে গেল প্রজ্ঞার। আর সেখানেই সেই তীক্ষ্ম আলোর গতিপথেই লুটিয়ে পড়লো মেয়েটা।
অন্যদিকে, হসপিটালে ডাক্তারদের নিবিড় পর্যবেক্ষণ, আন্তরিক চিকিৎসার মাঝেই হঠাৎ ধূসরের অস্বাভাবিক হার্টরেটের বৃদ্ধি দেখে সেটা সামাল দেয়ার জন্য ছুটোছুটি শুরু হয়েছে ধূসরের কেবিনে। ব্যস্ত ছুটোছুটির মাঝেও কেবিনের সব ক'জন ডাক্তার, নার্স ধূসরের কণ্ঠে অস্পষ্ট একটা নাম ঠিকই শুনতে পারলো। আর নামটা আর কারো নয়। অচেতন অবস্থাতেও একটাই নাম সমস্ত স্বত্তায় মিশে আছে ছেলেটার।
'প্রজ্ঞা।'
.
.
.
চলবে............................................................