হঠাৎ তুমি এলে - পর্ব ০৬ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


দুষ্টু মিষ্টি খুনশুটি করতে করতে বেশ অনেকটা সময় কেটে গেছে। শাওয়ার শেষ করে স্কার্ট আর ফতুয়াটা পড়ে চুল মুছতে মুছতে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় চোখ পড়লো প্রজ্ঞার। ধূসর শার্টের স্লিভ গুঁটিয়ে নিতে নিতেই থমকে আয়নায় প্রজ্ঞার দিকেই তাকিয়ে আছে। প্রজ্ঞা ভ্রু নাচিয়ে 'কি হয়েছে' ইশারায় জানতে চাইতেই ধূসর এগিয়ে এসে প্রজ্ঞাকে পিছন থেকেই জড়িয়ে ধরে কাঁধে নাক ডুবিয়ে লম্বা করে শ্বাস নিলো। হুট করে এভাবে জড়িয়ে ধরে কাঁধে নাক মুখ ডুবিয়ে দেয়ায় ধূসরের উষ্ণ নিঃশ্বাসগুলো আছড়ে পড়ছে প্রজ্ঞার ঘাড়ে আর কাঁধে। আর তাতে কেমন গা শিরশির করা অনুভূতি হচ্ছে প্রজ্ঞার। প্রজ্ঞা আপাতত অনুভূতিটাকে পাত্তা না দিয়ে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় ধূসরের মুখটা দেখার চেষ্টা করলো।

-এভাবে হা করে আমাকে দেখতে হবে না ম্যাডাম। আপনার এই মু্গ্ধ দৃষ্টিতে নিজেকে হারিয়ে ফেলার জেদ চাপলে কিন্তু তখন পালাতে চাইলেও পারবেন না। 

-মাঝেমাঝে তোমার কথা শুনলে আমি বুঝে উঠতে পারি না, লজ্জা পাবো নাকি হাসবো। তোমার মতো স্মার্ট, হ্যান্ডসাম একজন ভদ্রলোক পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় যে কোনো মেয়েই একবার হলেও আড়চোখে তাকাবে। আর সেই হিসেবে আমার মতো একটা মেয়ের হাজবেন্ড তুমি। তোমাকে মুগ্ধ হয়ে দেখবো না তো কি করবো?

-তোমার মতো মেয়ের হাজবেন্ড মানে? আমার বউটাকে নিয়ে টন্ট মেরে কথা বলতে বারণ করেছি না একবার? কেনো কথাই শুনবে না বলে ঠিক করে রেখেছ তাই না প্রজ্ঞা?

-এতো রাগ করো কেন কথায় কথায়? তুমি মানে আর না মানো নিজেকে সুন্দরী বলার মতো গায়ের রঙ আমার নয়। কালো না বললেও অন্তত এই গায়ের রঙের তামাটে ভাবটাকে আর যাই হোক সুন্দর বলা যায় না। শুভ্রাদের মতো অত আগুন সুন্দরীও নই যে তুমি এতো হুট হাট আমাকে দেখে হা করে তাকিয়ে থাকবে।

-শুভ্রারা আগুন সুন্দরী হলেই বা আমার কি? আর তোমারই বা কি? খালি ফর্সা গালে আরো সাদা গোলাপি লাল হলুদ রঙ মাখলেই কি তাকে সুন্দর বলে? এই যে আমার প্রজ্ঞা রাণী, শাওয়ার নেয়ার পর এতো স্নিগ্ধ লাগছে তাকে, একদম তাজা কুয়াশার চাদরে মোড়া ধানের শিষের মতো। অথবা ভোরের প্রথম শিউলি বৃষ্টিতে ভিজলে যেমনটা দেখায়, তার চেয়েও বেশি দারুণ দেখাচ্ছে তোমাকে।

-হয়েছে হয়েছে। আর বলতে হবে না। কেমন সুন্দর দেখায় সেটা তো কাল তোমার গেস্টরাই বলে দিল। আপনার মতো একজন লম্বা, সুদর্শন পুরুষ এমন বউ নিয়ে এক বছর কি করে সংসার করেছে সেটাই গতকাল পার্টির হট টপিক ছিল।

-তো আমি কি করতে পারি? আর একটা ভুল কথা বললে। আমার গেস্ট নয়, তোমার গেস্ট। আরো স্পেসিফিক করে বলতে গেলে তোমার শ্বশুর শাশুড়ির গেস্ট। ওদের কাছে নজরে যারা সুন্দরী তাদের সাথে বড় জোর দু একটা রাত কাটানো যায়, এক বছর ধরে সংসার করবে! হাস্যকর মনে হবে ভাবতেও।

-ছি! তুমিও আজকাল ওদের মতো বাজে কথা বলা শুরু করেছ ধূসর। সুন্দরী মেয়েরা কি সংসার করে না? এই যে এতো এতো যে বিশ্বসুন্দরী হয়, বিউটি কনটেস্টের বিজয়ী মেয়েগুলো, ওরা কি সংসার করে না? যত্তসব আজেবাজে কথা। সরো তো। মেজাজটাই খারাপ করে দিল লোকটা আমার।

-তুমি আমার কথাটা ধরতে পারো নি। আমি বলেছি তোমাস গেস্টদের দৃষ্টিতে যারা সুন্দরী তাদের কথা। যারা তোমাকে গায়ের রঙ নিয়ে কথা শুনিয়েছে তাদের ঘরের বউগুলো কিন্তু কোনো বিশ্বসুন্দরীর চেয়ে কম নয়। রূপে, গুণে, ঘরকন্যায় অনেকে অল ইন ওয়ান প্যাকেজ বলতে পারো। তবু খবর নিয়ে দেখবে সেই ভদ্রলোক অফিসের কাজের নাম করে বান্ধবীর সাথে হোটেলে গিয়ে উঠছে। কি বা কেন সেসব আশা করি তোমাকে এখন ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হবে না।

-সবাই তো এক না।

ধূসরের কথাগুলো শুনে প্রজ্ঞা মিনমিন করে কথাগুলো বলে নিজেই নিজের মনকে শান্তনা দেয়ার চেষ্টা করলো। ধূসর ব্যাপারটা বুঝতে পেরে প্রজ্ঞাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে প্রজ্ঞার মুখটা দু হাতের আঁজলায় তুলে ধরলো।

-সবাই যেমন এক না তেমনি সবার চয়েজও এক না। আমার চোখে পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা সুন্দর মানুষটা হলে তুমি। তোমার স্নিগ্ধ, আনকোরা মুখটা তাই আমাকে অনেক বেশি টানে বুঝলে মেয়ে? আর তুমি সুন্দর নও, হাইটে একটু শর্ট, এসব না মাথা থেকে বের করে দাও বুঝলে? যারা চায় না তুমি আমার পাশে থাকো, তারা এমন বহু খুঁত বের করবে, এটাই স্বাভাবিক। বাট তুমি আমার সাথে থাকতে চাও কি না সেটা হলো জরুরি।

-আমার দুনিয়াটাই তো তুমি। আমি তোমার সাথে থাকতে চাই কি না এটা কেমন কথা? তবে মাঝেমাঝে তোমাকে দেখলে এতো অবাক হই জানো? মনে হয় আসলেই তো তোমার পাশে শুভ্রার মতোই কাউকে মানায়। অন্তত আমার চেয়ে আরে কয়েক ইঞ্চি লম্বা, আরেকটু ছিমছাম গড়নের, সুন্দরী। এমন কেউ তোমার পাশে দাঁড়ালে একদম পার্ফেক্ট মানাতো। 

প্রজ্ঞার কথাটা শেষ হতেই ধূসর প্রজ্ঞাকে একটু সরিয়ে দিয়ে ভালো করে এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখা শুরু করলো। ধূসরের এমন কাজে বেচারি এবারে একটু লজ্জাই পেয়ে গেল। 

-কি দেখছে এভাবে?

-দেখছি না, হিসেব করছি। যেদিক থেকেই দেখি না কেন তোমাকে একটা কিউট পুতুলের মতো লাগে বুঝলে? যে পুতুলটাকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে আগলে রাখতে হয় সবসময়। আর হাইটের কথা বলছ? এই যে তোমাকে জড়িয়ে ধরলে একদম বুকের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে লুকিয়ে পড়ো, সেটাই তো একদম পার্ফেক্ট মনে হয় আমার। আর তোমাকে কে বলেছে শুভ্রা তোমার চেয়ে বেশি লম্বা? কয় ইঞ্চি উঁচু হিল পরে থাকে খেয়াল করেছ কখনো? কখনো দেখা হলে ওকে বলো হিলগুলো খুলে ফ্লোরে তোমার পাশাপাশি দাঁড়াতে তারপর বুঝবে ওসব হাইটের খেলা না, এসব হলো তিন-চার ইঞ্চি উঁচু হিলের জাদু।

-তোমার সব কথাই রেডি থাকে আগে থেকে তাই না? হিলের কথা যে বললে, তার মানে তুমি ওই শুভ্রাকে খুব ভালোভাবেই অবজার্ভ করেছ। নইলে তো এতো কিছু বলতে পারতে না।

-এই প্রজ্ঞা? তোমার চুলগুলো তো আগের চেয়ে বেশ লম্বা হয়েছে! কি তেল ইউজ করছ বলো তো?

-কিহ? তেল, চুল, এসব কোথা থেকে এলো?

-বারবার শুভ্রাই বা আমাদের মাঝে কোথা থেকে আসছে? ওর সাথে নিজেকে কম্পেয়ার করে নিজের লেভেলটাকে এতো নিচে নামিও না বুঝলে? ওকে আমি নিজের বোনের চোখেই দেখে এসেছি আজীবন। তুমি আমার লাইফে না আসলেও অন্তত ওকে বিয়ে করতাম না। এটা তোমার শ্বশুর শাশুড়ি যত তাড়াতাড়ি বুঝবে ততই ভালো।

-কিন্তু মা তো মামাকে কথা দিয়েছিল -----।

-তো আমি কি করবো? মায়ের কথা রাখতে কি এখন শুভ্রাকে বিয়ে করতে হবে নাকি? 

-এভাবে বলছ কেন? আমি কি সেটা বললাম নাকি?

-মাঝে মাঝে তুমি এমন এমন সব কথা বলো যে আমার মাথাটাই গরম হয়ে যায়। তোমাকে প্রথম যেদিন দেখেছি, গোল একটা লঙ ড্রেস পরা, একদম কিউট পুতুলের মতো লাগছিল। সেদিন থেকেই প্রার্থনা করেছি এই পরীর মতো দেখতে ছোট্টো পুতুলটা আমার হোক। বাকিরা কে কি বললো সেটা আমার শোনার সময় নেই। আমি শুধু একটা কথাই জানি এই পুতুলটাকে আমার সারাজীবনের জন্য পাশে চাই, আর এই অনুভূতিটা আমার মৃত্যুর আগ মূহুর্ত পর্যন্ত থাকবে। সো এসব আজাইরা কথাবার্তা না ভেবে রেডি হয়ে নাও। রেস্টুরেন্টে একসাথে নাস্তা করে তোমাকে বাড়িতে ড্রপ করে দিয়ে অফিসে যাবো আমি।

-রেডিই তো। চলো? দেরি হয়ে যাচ্ছে তো তোমার?

-রেডি? এভাবে যাবে রেস্টুরেন্টে?

-কেন ভালো লাগছে না? চেইঞ্জ করতে হবে?

-ভালো লাগছে কিনা বুঝতে পারছো না? তোমাকে এভাবে দেখে অফিসে যেতে ইচ্ছে করছে না। বাট আফসোস, একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং আছে।

-তাহলে?

-আমার ফতুয়া আপনার পড়নে ম্যাডাম। শেষে সবাই যখন হা করে তাকিয়ে থাকবে, লজ্জা পেলে তো আপনিই পাবেন। তাই আর কি ভাবলাম হয়তো চেইঞ্জ করে নিবেন।

-উঁহু না। বয়ফ্রেন্ডের ড্রেস তো পড়ি নি, নিজের হাজবেন্ডের ফতুয়া পরেছি। হুহ। আর যার ইচ্ছে দেখুক। আমার কি। 

-ওকে। তোমার প্রবলেম না হলে তো আমারও কোনো প্রবলেম নেই। চলো? ওয়েট, এক মিনিট।

ধূসর কাবার্ড থেকে একটা ওড়না বের করে প্রজ্ঞার গলায় পেঁচিয়ে দিয়ে দু পাশে ঝুলিয়ে দিয়ে প্রজ্ঞাকে আরেকবার দেখে নিলো।

-ওকে, এবার পার্ফেক্ট। চলো?

একটা ফ্যামেলি রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট সেরে প্রজ্ঞাকে বাড়িতে ড্রপ করে দিয়ে সোজা অফিসে চলে গেল ধূসর। দুদিনের অনেক কাজ জমা পড়ে আছে। আজকের মধ্যে কাজগুলো শেষ করার জন্যই একমনে কাজে মন দিল ছেলেটা। ধূসর এতো মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিল যে কখন ওর রুমের দরজা খুলে কেউ একজন এসে দাঁড়িয়েছে, সেটা টেরই পায়নি। দরজায় দাঁড়ানো মানুষটা অনেকক্ষণ ধূসরের দিকে তাকিয়ে থেকে শেষে হতাশ হয়েই দরজায় নক করলো। আর ব্যস্ত ধূসর হঠাৎ কারো কণ্ঠস্বর শুনে চমকে তাকাতেই দরজায় দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। আর কানে তখনো বাজছে কয়েকটা শব্দ।

-মে আই কাম ইন স্যার?
.
.
.
চলবে............................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন