-শুভ্রা? তুই এই সময় আমার কেবিনে কি করছিস? তোকে আর কয়বার বললে বুঝবি যে এটা আমার অফিস, তোর ফুুফুর বাসা না যে যখন ইচ্ছে চলে আসবি। আর একটা মানুষকে কত বার অপমান করলে সেটা তার গন্ডারের চামড়ায় গিয়ে লাগে বলতে পারিস আমাকে?
ধূসরের এমন খোঁচা দেয়া কথাগুলো শুনেও শুভ্রা মুখের হাসিমাখা ভাবটার একটুও পরিবর্তন পর্যন্ত হলো না। নিজের হাতের ফাইলটা ধূসরের সামনে রেখে একটা চেয়ার টেনে ধূসরের মুখোমুখি হয়ে বসে পড়লো। ধূসর ভ্রু কুঁচকে একবার ফাইলটার দিকে তাকিয়ে আবার শুভ্রার দিকেই তাকালো। একটা ফুল স্লিভের সাদা ফর্মাল শার্ট আর হাঁটুর খানিকটা নিচ পর্যন্ত ফিটিংস স্কার্ট পড়েছে মেয়েটা। ঠোঁটের কটকটা লাল রঙটাই বলে দিচ্ছে ইচ্ছে করেই এমন অদ্ভুত গেটআপে নিয়ে ধূসরের সামনে হাজির হয়েছে মেয়েটা। ধূসর খানিকটা বিরক্ত হয়েই আবার নিজের কাজে মন দেয়ার চেষ্টা করলো। ইগনোর করছে বুঝতে পেরে যদি বিদায় হয় আপদটা সামনে থেকে এটাই একমাত্র চাওয়া ধূসরের এই মূহুর্তে।
-সরি স্যার। পারমিশন না নিয়েই বসে পড়লাম। আসলে এই ফ্ল্যাট শু পড়ে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে পায়ে প্রচন্ড ব্যথা হয়ে গেছে। আমার তো হাইহিল পড়ার অভ্যেস। এসব অফিস আউটফিটে আমি ঠিক অভ্যস্থ নই কিনা।
-ওহ গড! শুভ্রা ইরিটেইট করিস না আমাকে প্লিজ? তোর এসব আজাইরা প্যাঁচাল শোনার সময় আমার নেই। ডিরেক্টলি না বললেও কিছু কথা বুঝতে নিতে হয়। এই নরমাল কমনসেন্স টুকুও নেই তোর? কাজের সময় ডিস্টার্ব করিস না তো প্লিজ? বাবা বোধ হয় উনার কেবিনেই আছে, ওখানে গিয়েই গল্প কর গে যা, আমার মাথাটা খাস না এখন।
-আমি তো আঙ্কেলের সাথে দেখা করেই এসেছি। এখন আমার কাজ হচ্ছে আপনাকে এসিস্ট করা।
-আই ডোন্ট নিড এন এসিস্ট্যান্ট। আমার পি. এ. বেকুবটা কই? ওকে কতবার বলেছি কাজের সময় যাকে তাকে কেবিনে আসতে না দিতে? আজকে এই ছেলের কপালে দুঃখ আছে।
ধূসর চরম মাত্রায় বিরক্ত হয়ে ইন্টারকমের রিসিভারটা উঠিয়ে একটা নাম্বার ডায়েল করে কল করলো। অপর প্রান্ত থেকে কেউ কলটা রিসিভ করার আগেই শুভ্রা হাত বাড়িয়ে কলটা কেটে দিল। ধূসর রাগে লাল হয়ে রিসিভারটা নামিয়ে রেখে শুভ্রার দিকে তাকালো।
-হোদ্দা হেল! তুই এখনও বসে আছিস? আসলেই তোর গায়ে মানুষের চামড়া আছে বলে মনে হয় না। সত্যি সত্যিই গন্ডারের চামড়া আছে বোধহয় তোর গায়ে। কল ডিস্কানেক্ট করলি কোন সাহসে তুই?
-আরে পুরো কথা না শুনেই এতো রেগে যাও কেন সবসময়? আমার অফিস ম্যানেজমেন্টের উপর যে কোর্সটা করছিলাম, ওটার ইন্টার্নের জন্য এসেছি তোমার এখানে। একটা রিটেন এপ্লিকেশন দিয়েছিলাম, গতকাল সেটা এপ্রুভ হয়ে গেছে। আজ অফিসে আমার ফার্স্ট ডে।
-তোর ইন্টার্নি আমার অফিসে কেন করতে হবে? দুনিয়াতে আর কোনো কোম্পানি ছিল না? আর এসব ফালতু এপ্লিকেশন এপ্রুভ করলো কে?
-আমি কি জানি! আমার তো সার্টিফিকেটটা লাগবে না? তিন মাসের ইন্টার্নশিপ কমপ্লিট হলে-------।
-হোয়াট! তিন মাস মানে? তোকে তিন মাস তো দূরের কথা তিন মিনিটও চোখের সামনে দেখতে চাই না আমি। জাস্ট গেট আউট।
-আমমমমমম। বাট স্যার, আমি তো প্রজেক্ট রিপোর্ট জমা দিয়ে দিয়েছি, আপনার আন্ডারে কোর্সের ইন্টার্নশিপ করছি, তার যাবতীয় কাগজপত্র-----।
ধূসর রাগে কটকট করে তাকাতেই শুভ্রা মিষ্টি করে একটা হাসি ফুটিয়ে ধূসরের রাগটা যেন আরো দুই তিন গুণ বাড়ানোর চেষ্টা করছে। ধূসর কিছু বলবে এমন সময় কেবিনের দরজায় হালকা নকের শব্দ হলো। দরজার ওপাশে ছেলেটা একটু ভীত সন্ত্রস্ত মুখে গুটিগুটি পা ফেলে রুমে এসে দাঁড়ালো। এবারে ধূসরের সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো নিজের পি. এ ছেলেটার উপরেই।
-ঠিকঠাক মতো কাজ করার ইচ্ছে না থাকলে রিজাইন করে দিতে পারেন মিস্টার আদিব। আপনাকে এই নিয়ে কত দিন বলেছি আমার কাজের সময় পারমিশন না নিয়ে কাউকে এলাউ করবেন না আমার কেবিনে? বিনা পারমিশনে শুধু একজনই রুমে আসতে পারবে, আর সে হলো আমার ওয়াইফ, মিসেস প্রজ্ঞা ধূসর আহমাদ। কথাটা মনে থাকে না আপনার?
-সরি স্যার। আমি আসলে ম্যামকে আসতে বারণ করেছিলাম। বাট ম্যাম বললেন উনি আপনার আন্ডারে জব করবেন, আর বড় স্যারও পারমিশন দিয়েছেন গতকাল----।
-আপনার বড় স্যারের সাথে তো আমি এই বিষয়ে কথা বলে নিবো, ডোন্ট ওয়ারি। বাট ইউ টেল মি ওয়ান থিং, আপনাকে একবার বলা হয়েছে না আপনাদের ম্যাডাম ছাড়া আমার রুমে আর যেই আসুক আপনার পারমিশন নেয়া লাগবে না রুমে আসতে গেলে? বলা হয়েছিল কিনা?
-স-সরি-সরি স্যার। আসলে ম্যাম বারণ করেছিল ডিস্টার্ব করতে----।
-ম্যাম আপনার বস? নাকি আমি? ঠিকঠাক মতো।কাজ করতে না পারলে আসতে পারেন। আমি নতুন পি.এ এরেঞ্জ করে নিবো। সে আর যাই করুক আমার অর্ডার মেনে চলবে।
-স্যার স্যার স্যার? সরি স্যার। নেক্টট টাইম আর এমন ভুল হবে না। প্রমিস স্যার।
ধূসরের পি.এ আদিব ছেলেটা রীতিমতো ঘাবড়ে গিয়ে কাঁদোকাঁদো মুখে ধূসরকে কনভেন্স করার চেষ্টা করছে দেখে শুভ্রা একটু শব্দ করেই হেসে ফেললো। ধূসর রাগে লাল হয়ে শুভ্রার দিকে তাকাতেই শুভ্রা একটু বিব্রত ভঙ্গিতে কেশে ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসির রেখা ফুটিয়ে ধূসরের দিকে তাকালো।
-উঁহু। একটা ভ্যাকেন্সি খালি হয়েছে এতোদিনে। ধূসর আমি তাহলে এবার তোমার অফিসে পার্মানেন্টলি একটা জব পেয়ে যেতে পারি? কি বলো?
-মিস্টার আদিব? আপনি এখনো দাঁড়িয়ে আছেন এখানে? নিজের কাজে যান। আর এটাই আপনার লাস্ট ওয়ার্নিং। এর পর ভুল করার আগে নতুন জবের ব্যবস্থা করে নিতে ভুলবেন না। আর মিস শুভ্রা? আপনি এখন আসতে পারেন। আর ইন্টার্নশিপের ব্যাপারে আমি কোনো হেল্প করতে পারলাম না। সরি। আমি বাবার সাথে এই বিষয়ে কথা বলে নিবো। আপনি এখন আসতে পারেন। আর মিস্টার আদিব, ম্যাডাম চলে যাওয়ার পর দরজাটা লক করে দিবেন।
আদিব কেবিন থেকে কাঁচুমাচু মুখে বেরিয়ে যেতে পেরেই যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সেটা খেয়াল করে শুভ্রা টেবিলে হাত রেখে ঝুঁকে ধূসরের দিকে তাকালো। ধূসর একমনে নিজের কাজ করছে দেখে শুভ্রা মন খারাপ করে টেবিল পেপার গ্লোভ নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে ধূসরকে দেখতে লাগলো।
-প্লিজ গেট আউট শুভ্রা। এক কথা বারবার শুনে টায়ার্ড না হলেও আমার বলতে ভালো লাগে না।
-আচ্ছা আমি ডেইলি তোমার অফিসে আসলে কি তোমার খুব বেশি অসুবিধা হবে ধূসর? উমমমম? তোমার অসুবিধা হওয়ার কি কোনো কারণ আছে?
-অসুবিধা হওয়ার কারণটা তোর জানা নেই?
-উমমম। আমি তো কোনো প্রবলেমই দেখছি না। আমার কেন জানি না মনে হয় তুমি প্রজ্ঞার কারণেই এখন আর আমার সাথে আগের মতো যোগাযোগ করো না। অথচ ছোটোবেলায় ফুফু আর ফুফার চেয়েও তুমি আমাকে বেশি ভালোবাসতে।
-ছোটো বোন হিসেবে থাকলে আমাদের ভাই বোনের সম্পর্কটা এখনও আগের মতোই সুন্দর থাকতো। এখন আমার কেবিন থেকে বের হ। আর তোর আদরের ফুফুকে গিয়ে বলে দিস তোর আর উনার কারো চাওয়াই কখনো পূরণ হবে না। অন্তত আমি বেঁচে থাকতে তো না।।
-উফ ধূসর! তুমি এতো ওভার রিএক্ট করো কেন সবসময়? আমি কোনো প্ল্যান করে আসি নি তোমার অফিসে। জাস্ট পরিচিত জায়গা থেকে ইন্টার্নশিপটা করলে আমার জন্যই সুবিধে হবে সেজন্যই করছি। এর বেশি কিছু না। আর এমনও না যে আমাকে সারাদিন তোমার কেবিনে থেকে কাজ করতে হবে, বা বসে থাকতে হবে। আমি অন্য কোথাও বসে কাজগুলো কমপ্লিট করলেই তো হলো। তুমি চেক করে দেখবে ঠিকঠাক হচ্ছে কিনা।
-তোর পিছনে নষ্ট করার মতো সময় আমার হাতে নেই শুভ্রা। আমি নিজের প্রজেক্ট নিয়ে বিজি আছি। এর চেয়ে ভালো তোর ফুফার কাছ থেকেই ট্রেনিং নে। কাজে লাগবে। সময় নিয়ে সব বুঝিয়ে দিবে তোকে। আর সেটাও পসিবল না হলে তোর কোর্সটা ড্রপ করে দে। বাট আমার কাছে কোনো হেল্প পাবি এমনটা ভুলে আশা করিস না।
-প্রজ্ঞা তোমাকে ভিষণ সন্দেহ করে এজন্য তুমি এভাবে আমাকে ইগনোর কর তাই না ধূসর? জানি মেয়েটা ভিষণ প্রজেসিভ তোমাকে নিয়ে। বাট একটু ছাড় তো দিতেই পারে। তুমি যে ওকে ঠকাবে না এটা তো ওর বিশ্বাস করা উচিত নাকি?
-তোর কাছ থেকে কেউ জ্ঞান চেয়েছে? প্রজ্ঞা আমাকে বিশ্বাস করে কি সন্দেহ করে সেটা আমি বুঝে নিবো। তোর মাথা ঘামাতে হবে না।
-তুমি যা ই বলো ধূসর এতোটা অবিশ্বাস করাও কিন্তু ঠিক না বুঝলে? এই যেমন ধরো যে মেয়েরা হাজবেন্ডের শার্টে অন্য মেয়ের চুল, লিপস্টিকের দাগ এসব দেখে উড়াধুরা রিএক্ট করে তাদের মধ্যেই আসলে প্রবলেম আছে। খোঁজ নিলে হয়তো জানতে পারবে যে বাইরে এফেয়ারটা হাজবেন্ডের নয়, সেই সন্দেহবাতিক বউয়েরই চলছে। হা হা হা। তোমার বউকে নিয়েও সাবধান থাকা উচিত ধূসর। এই যে কাল এতোবার করে কল করলাম, বউয়ের ভয়ে রিসিভ পর্যন্ত করলে না, কল ব্যাকও করলে না।
ধূসর এতোক্ষণ পর্যন্ত দাঁতে দাঁত চেপে শুভ্রার কথাগুলো সহ্য করলেও এবারে নিজের চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে শুভ্রার একটা হাত ধরে টেনে চেয়ার থেকে উঠিয়ে সোজা দরজার বাইরে ধাক্কা দিয়ে বের করে দিল। আশপাশের কেবিন থেকে এক দু জন মুখ বের করে কি ঘটছে দেখার চেষ্টা করছে দেখে শুভ্রার মুখটা পাংশু বর্ণ হয়ে গেল নিমিষেই। ধূসর রেগে গিয়ে এভাবে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবে এটা কল্পনাও করতে পারে নি হয়তো বেচারি। ধূসর সোজা শুভ্রার ম্লান মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে কয়েকটা কথা বললো।
-এর পরও যদি তোর লজ্জা না হয় আমার কিছুই বলার নেই শুভ্রা। আর আজকের ব্যাপারটা তুই তোর ফুফা ফুফুকে জানাবি নাকি আমারই জানাতে হবে? এই কোম্পানিতে থাকতে হলে যদি ডেইলি তোর মুখটা দেখতে হয়, তাহলে আমি কালই অন্য কোথাও নিজের জবের জন্য এপ্লাই করা শুরু করবো। সেটাও তোর ফুফাকে জানিয়ে দিস। তবু অফিস আওয়ারে তোকে সহ্য করার মতো ইচ্ছে বা ক্ষমতা কোনোটাই আমার নেই।
ধূসর কথাগুলো বলা শেষ করেই ঠাস করে কেবিনের দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে চেয়ারে এসে বসলো। একটা লম্বা নিঃশ্বাস টেনে নিজের মাথাটা ঠান্ডা করার চেষ্টা করলো। ঠিক মিনিটের পাঁচেকের মাথায় আবার দরজায় নক হতেই মাথাটা আবার গরম হয়ে গেল ধূসরের। নিজেই নিজের মনে একটা কথাই বলছে ধূসর।
-এই মেয়েটা যদি আবার ফিরে এসে থাকে তাহলে আজকে ওর আর আদিব দুজনেরই কপালে ভিষণ দুঃখ আছে।
.
.
.
চলবে............................................................