হঠাৎ তুমি এলে - পর্ব ১৫ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


-কে কে কে? ছাড়ো, ছাড়ো, ছাড়ো। ছাড়ো আমাকে-------। ছাড়ো------? 

সকালবেলা প্রত্যুষাকে নিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট করে মেয়েটাকে নিয়েই বৃদ্ধ ডাক্তারের কেয়ারটেকার হামিদের বাসায় এসেছে প্রজ্ঞা। কেয়ারটেকারের ছোট্ট মেয়ে অদিতির সাথে প্রত্যুষার এক নিমিষেই বন্ধুত্বও হয়ে গেছে। প্রত্যুষা আর অদিতি দুজনেই দুই বোনের মতোই একসাথে খেলায় মেতেছে। তাই আর প্রত্যুষাকে নিয়ে কোনোরকম টেনশন করতে হয়নি প্রজ্ঞাকে। কেয়ারটেকার হামিদ আর তার স্ত্রী লতা দুজনেই অমায়িক ভালো মানুষ। একটা মিষ্টি হাসির রেখা সবসময়ই লেগে রয়েছে ঠোঁটের কোণে দুজনেরই। তাই হামিদের বাসাতেই প্রত্যুষাকে রেখে যেতে একটু হলেও ভরসা বোধ করেছে প্রজ্ঞা। তাছাড়া এই এতো বড় শহরে কার কাছে ভরসা করে মেয়েটাকে রেখে যেতে প্রজ্ঞা? সাথে যে নিয়ে যাবে সেই উপায়টাও কি আছে? যারা একজন বৃদ্ধ মানুষের শেষ সম্বলটুকু দখল করতে পারে তাদের কাছে প্রজ্ঞার ছোট্ট বাচ্চাটা কতটুকু নিরাপদ? কথাগুলো চিন্তা করেই প্রত্যুষাকে লতা আর অদিতির কাছেই রেখে এসেছে প্রজ্ঞা।

 হামিদের সাথে টুকটাক কথা বলতে বলতে ক্লাইন্টের সাথে দেখা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসেছে প্রজ্ঞা। আজকে লোকটার সাথে দেখা না হওয়া মানে এই স্মৃতিঘেরা শহরে আরো একটা দিন ওকে বেশি কাটাতে হবে। অবশ্য প্রজ্ঞার এতো শত চিন্তার ছিঁটেফোঁটাও যেন স্পর্শ করতে পারে নি হামিদকে। সেই ভদ্রলোক দুনিয়ার বকবক করছে, রেস্টুরেন্টে বসে এটা ওটা অর্ডার করছে প্রজ্ঞার আর নিজের জন্য। এতো ভোজনপ্রেমী আর সদানন্দ লোক এর আগে কখনো দেখেছে বলে মনে পড়ছে না প্রজ্ঞার। এদিকে লাঞ্চের সময়ও প্রায় পেরিয়ে যাচ্ছে। লাঞ্চ করে আবার ওই লোকটার সাথেই দেখা করতে যেতে হবে। তাই অযথা সময় নষ্ট না করে রেস্টুরেন্টের ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হওয়ার জন্য চলে গেল প্রজ্ঞা। সেখানেই বাঁধলো বিপত্তি। ফ্রেশ হয়ে চোখে মুখে পানি ছিঁটে দিতেই কারো শক্ত হাতের তালু প্রজ্ঞার নাকে মুখে চেপে বসলো। ভয়ে নাকি আতঙ্কে দু একটা আর্তচিৎকার গলা দিয়ে বের হলেও দুপুরের রমরমা রেস্টুরেন্টের উপচে পড়া ভিড়ে সেটা কারো কান পর্যন্ত পৌঁছেছে কিনা সেটাই সন্দেহ। অবশ্য সেসব ভাবার অবকাশও মেয়েটা পায়নি। সারাদিনের হাজারটা চিন্তার মধ্যেই এভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়াটা হয়তো মেয়েটার দুর্বল নার্ভগুলো ঠিক নিতে পারে নি। নিমিষেই চোখের সামনে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। 

প্রজ্ঞার যখন সেন্স ফিরে আসে ততক্ষণে সূর্যের তেজটা বেশ নরম হয়ে এসেছে। চোখ মেলে নিজেকে একটা গাড়িতে আবিষ্কার করেই ধড়ফড় করেই উঠে বসার চেষ্টা করলো। বাইরেই গাড়ির গায়ে হেলান দিয়ে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে দেখে ভয়ে বুকটা কেঁপে উঠলো প্রজ্ঞার। কে লোকটা, কেন ওকে এভাবে ধরে এনেছে সেসব ভাবায় সময় নষ্ট না করে পালানোর চিন্তাটাই প্রথমে ভাবার চেষ্টা করলো মেয়েটা। গাড়ি থেকে পালানোর পথ খুঁজতে গিয়ে এতোক্ষণে প্রজ্ঞার খেয়াল হলো জোর করে ধরে আনার কোনো লক্ষণই বোঝা যাচ্ছে না। কিডন্যাপ করলে অন্তত ওর হাত পা গুলো তো বেঁধে রাখতো। উল্টো কেউ যেন যত্ন করেই সিটবেল্টের বাঁধনে প্রজ্ঞার সেইফটিই নিশ্চিত করেছে, এর বেশি যেন তার কোনো উদ্দেশ্যই নেই। ধীর হাতে সিটবেল্টটা খুলতে খুলতে আশ্চর্য হয়ে কথাগুলোই ভাবছিল প্রজ্ঞা। অবশ্য কি ঘটেছে সেটা নিয়ে বেশ কৌতূহল জন্মালেও বাইরের দিকে সতর্ক নজর রাখতে ভুলে যায়নি মেয়েটা। আততায়ী লোকটা কি ভেবে এই নিরব জনশূন্য রাস্তায় ওকে এভাবে ছেড়ে দিয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, তার চেয়েও বড় চিন্তা হলো এখান থেকে ভালোয় ভালোয় বের হতে পারলেও হামিদের বাড়িতে যাবে কি করে? আধৌ নিজের মেয়েটাকে শেষ বারের মতো দেখতে পারবে তো?

প্রত্যুষার নিষ্পাপ মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠতেই একবার নিজেকে এই বিপদ থেকে বের করার শেষ চেষ্টাটা করলো প্রজ্ঞা। ততক্ষণে দেরি যা হওয়ার হয়েই গেছে। প্রজ্ঞা এক ধাক্কায় গাড়ির দরজাটা খুলে এক পা বাইরে রাখার আগেই পাশ থেকে আবার শক্ত হাতটা প্রজ্ঞাকে টেনে একদম নিজের সাথেই জাপটে ধরলো। হঠাৎ এভাবে টেনে ধরায় প্রজ্ঞা আঁতকে উঠলেও লোকটার কথাগুলো শুনে চমকে মুখ তুলে তার দিকে তাকালো।

-আবার পালানোর চেষ্টা করছ? ভয় নেই। তোমাকে আটকে রাখার জন্য ধরে আনি নি। আমার প্রশ্নের জবাবগুলো দিয়ে দিলেই আবার নিজের প্রিয়জনদের কাছে ফিরে যেতে পারবে। জানি কেউ ব্যাকুল হয়ে অপেক্ষা করছে তোমার। হুট করে তোমার হারিয়ে যাওয়ায় ভয়ে পুরো শহর জুড়ে ছুটোছুটি করছে। বাট কি করবো বলো? আমার প্রশ্নগুলোর জবাব না জানা পর্যন্ত ছাড়া পাবে না। তাতে দুনিয়া উল্টে গেলেও আমার কিছু করার নেই। পাঁচটা বছর পাগলের মতো অপেক্ষা করেছি এই দিনটার। আজ অন্য কারো ব্যাকুলতা দেখে নিজের পাঁচ বছরের চাপা কষ্টটা তো ভুলে যেতে পারবো না।

-ধূসর?

প্রজ্ঞা কল্পনাতেও ভাবতে পারে নি পাঁচ বছর পর এভাবে ধূসরের সামনে পড়তে হবে, এভাবে চোরের মতো পালানোর চেষ্টা করতে হবে ধূসরের কাছ থেকেই পালানোর। প্রজ্ঞার স্তব্ধ নিরব চাহনিটা দেখে ধূসরের কি হলো কে জানে সে ধাক্কা দিয়ে প্রজ্ঞাকে সরিয়ে দিয়ে হাত বাড়িয়ে প্রজ্ঞার সাইডের দরজাটা বন্ধ করে অটো লক করে দিলো। পুরো ব্যাপারটা তখনও প্রজ্ঞার কাছে কেমন স্বপ্নের মতো লাগছে। এতোগুলো দিন যে মানুষটা ওকে খুঁজতে আসে নি কেন ভেবে যে অভিমানের পাহাড় জমেছিল প্রজ্ঞার মনে, সেই মানুষটাই ওর সামনে, একদম কাছে বসে আছে সেটা বিশ্বাস হতেও যেন কষ্ট হচ্ছে মেয়েটার।

-যাক, তাহলে অন্তত চিনতে পেরেছ। আমি আরো ভাবলাম, তুমি হয়তো বলবে আপনি কে? আমাকে এভাবে এখানে ধরে নিয়ে এসেছেন কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি। নাটকটা না করার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ প্রজ্ঞা।

-ধূসর? কি বলছ এসব?

-কি বলছি? কি বলছি, কি করছি সেটা তো নিজেই গত পাঁচটা বছর ধরে বুঝতে পারছি না। গত পাঁচটা বছর, একটা দুটো নয় প্রজ্ঞা, পাঁচ পাঁচটা বছর সবার হাজার বক্তব্য শুনেছি তোমাকে নিয়ে। আমার এক্সিডেন্টের পর অন্য কারো সাথে তুমি শহর ছেড়ে চলে গেছ, অন্য কারো সাথে সংসার করছ, সুখে আছো, এমন হাজার হাজার অভিযোগের ফাঁকেও আমিও বিশ্বাস করেছিলাম আমার প্রজ্ঞা আমাকে ফেলে চলে যাওয়ার মেয়েই নয়। আর যা ই হোক, আমাকে মৃত্যুর সাথে লড়াই করতে দেখেও ডিভোর্স চেয়ে নতুন সংসার শুরু করবে এমন দুর্বল ছিল না আমার ভালোবাসা এই একটা কথা আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করে, এই বিশ্বাসটা বুকে আঁকড়ে পাঁচটা বছর অপেক্ষা করেছিলাম প্রজ্ঞা। আর আজ সেই ভরসার দারুণ প্রতিদান দিলে তুমি। আমি যে কত বড় গাধার মতো সবার বিরুদ্ধে গিয়ে তোমাকে খোঁজার চেষ্টা করেছি সেটা আজ তুমি আমাকে বুঝিয়ে দিয়েছে। কিন্তু তোমার কাছে আমার একটাই প্রশ্ন প্রজ্ঞা। কেন? কেন কেন কেন? কেন হঠাৎ তুমি আমার জীবনে এলে? কেনইবা দমকা হাওয়ার মতো এসে আমার জীবন থেকে সমস্ত সুখ, হাসি, আনন্দগুলো মুছে দিয়ে চলে গেলে? তোমাকে ভালোবাসার এটাই কি পুরস্কার?

-ধূসর? প্লিজ আমার কথাগুলো শোনো একবার? আমি সব কথা তোমাকে বলছি, তুমি প্লিজ একবার শোনো প্লিজ?

-এখানে বলা বা শোনার কিছু নেই প্রজ্ঞা। কাল রাত পর্যন্তও আমি পাগলের মতো ভাবছিলাম তোমার কোনো বিপদ হলো কিনা, তুমি কোথায় আছো, সুস্থ আছো কিনা, হাহ। এখন কথাগুলো ভেবেও হাসি পাচ্ছে আমার। যার জন্য আমি অপেক্ষার প্রহর গুনেছি এই পাঁচটা বছর সে আমার শহরেই নেই, অন্য কোথাও নিজের স্বপ্নের আশিয়ানা সাজিয়েছে। বাহ! আর আমি গর্ধব হসপিটাল থেকে ছাড়া পেয়েই বাড়ির সবার কথাকে অবিশ্বাস করেও ছুটে গিয়েছিলাম পুলিশ স্টেশনে। কেন জানো? তোমাকে ফিরে পেতে। গত পাঁচটা বছর ধরে সবাই চিৎকার করে আমাকে যে সত্যিটা দেখানোর চেষ্টা করছিল সেটা কাল উপরওয়ালা আমাকে নিজেই দেখিয়ে দিলেন। এটাকে কি বলবো বলো তো প্রজ্ঞা? আমার দুর্ভাগ্য নাকি সৌভাগ্য?

-ধূসর বিশ্বাস করো আমার আর কিছুই করার ছিল না সেদিন। আমি তোমাকে ওভাবে ফেলে যেতে চাই নি।।

-থ্যাংকস মিস প্রজ্ঞা। নিজেই অন্তত স্বীকার করেছেন যে আপনি আপনার হাজবেন্ড মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে জানার পরেও চলে গিয়েছিলেন সেদিন। ওপস সরি, এক্স হাজবেন্ড। এখন তো নিজের একটা সুন্দর সংসার হয়েছে আপনার। সেই ভদ্রলোক আশা করি আমার মতো পাগলামিভরা রাগের নাটক করে না, এনিভার্সারির দিনটা আমার মতো বিব্রত করে না। 

-ধূসর?

-এই পাঁচটা বছরে এতো বড় শহরের হসপিটাল, ক্লিনিক, মর্গ, রেলস্টেশন, বাস স্ট্যান্ডে কখন কোথায় কি ঘটছে সব বলতে গেলে মুখস্ত হয়ে গেছে আমার। ডিভোর্স লেটারটা হাতে পেয়েও এক সেকেন্ডের জন্যও যে মানুষটাকে আমি অবিশ্বাস করতে পারি নি, তাকে নতুন জীবনে দেখার পর কি ইচ্ছে হয়েছিল জানো প্রজ্ঞা? পুরো পৃথিবীটাই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নষ্ট করে দিই। 

-ধূসর? আমার কথা শোনো প্লিজ?

-কি শুনবো কি আমি? কালও তোমাকে কোথায় খুঁজবো সেটাই ভাবছিলাম। রাতের শহরের নিরবতা, মেইন রোডের শত শত গাড়ির কোলাহল সব ছাপিয়ে একটা ডাক আমাকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া একটা গাড়ির দিকে তাকাতে বাধ্য করে। তোমার ছোট্ট মেয়ে পরম আদরে নিজের বাবাকে ডাকছে। সেই দৃশ্যটা দেখার পর থেকে একটা কথাই মাথায় ঘুরছে আমার প্রজ্ঞা। পাঁচ বছর আগে সেইদিনের সেই এক্সিডেন্টে আমি মরে কেন গেলাম না?

-ধূসর?

প্রত্যেকটা মিনিট এগোনোর সাথে সাথে ধূসরের রাগটা আরো এক ধাপ করে বাড়ছে সেটা বেশ টের পাচ্ছে প্রজ্ঞা। লোকটার উপরে রাগ হওয়ার বদলে এখন কেমন ভয়ই লাগছে প্রজ্ঞার। গত রাতে ধূসর কি দেখেছে প্রজ্ঞা ঠিক বুঝতে না পারলেও প্রত্যুষা যে সত্যিই ধূূসরকে দেখেই পাপার কাছে যাওয়ার বায়না ধরেছিল সেটা এখন বেশ ভালো করেই বুঝতে পারছে। ধূসর নিজের মেয়েকে না চিনলেও প্রত্যুষা তো নিজের বাবাকে চিনে। তাহলে সত্যি সত্যিই কাল এতো রাতে ধূসরকে দেখেই 'পাপা' বলে ছটফট করছিল মেয়েটা। শুধু কয়েকটা ছবি দেখেই যে মেয়েটা ধূসরকে চিনতে পারবে সেটা কি প্রজ্ঞা ভাবতে পেরেছিল?! আর এদিকে ধূসর? লোকটার প্রত্যেকটা কথায় হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছে প্রজ্ঞার। পাঁচ বছর ধরে হাজার ছলনায় যে ভালোবাসাটা বিশ্বাস হারায় নি, আজ এক রাতের মধ্যে কি এমন হলো যে প্রজ্ঞাকে এতোটা ঘৃণা করতে শুরু করেছে ধূসর? 
.
.
.
চলবে.............................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন