হঠাৎ তুমি এলে - পর্ব ১৭ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


-ওহ শিট! প্রজ্ঞা! 

বেশ কিছুদূর গাড়ি চালিয়ে আসার পর রাগটা কিছুটা কমে এলে হঠাৎ প্রজ্ঞার কথাটা খেয়াল হলো ধূসরের। এই শুনশান জায়গাটা থেকে মেয়েটা একা ফিরবে কি করে সেটা মাথায় আসতেই গাড়িটা ঘুরিয়ে প্রজ্ঞাকে যেখানে গাড়ি থেকে নামিয়ে দিয়েছিল সেদিকেই গাড়ি চালিয়ে নিল ধূসর। প্রজ্ঞাকে যেখানে নামিয়ে দিয়েছিল সেই জায়গাটা থেকে বেশ কিছুটা দূরেই চলে এসেছিল ধূসর। রাগের বশে কাজটা যে একেবারেই ঠিক করে নি সেটা ভেবেই নিজেকে মনে মনে হাজারটা গালি দিল ধূসর। প্রজ্ঞা ঠিক আছে কিনা সেটা ভেবেই রাগে নিজের মাথাটা ফাটাতে ইচ্ছে করছে এই মূহুর্তে ধূসরের। কেন যে রাগটাকে কন্ট্রোল করতে পারে নি প্রজ্ঞাকে দেখে সেটা ভেবে আশপাশের জায়গাটা দেখতে লাগলো ধূসর। প্রজ্ঞাকে খুঁজে পাওয়ার আগেই হঠাৎ মোবাইলের রিংটোনের শব্দে ধূসর চমকে উঠে হাত বাড়িয়ে নিজের মোবাইলটা হাতে নিয়ে কলটা রিসিভ করলো। 

-হ্যাঁ শুভ্রা বল-------।

-ধূসর? ধূসর কোথায় তুমি? কালরাত থেকে না বাড়ি ফিরেছ না সকালে অফিসে গিয়েছ? কোথায় তুমি বলো প্লিজ? আমি এদিকে টেনশন করে মরছি আর তুমি কি সুন্দর 'হ্যাঁ শুভ্রা বল' বলছ! বাড়িতে যে কেউ তোমার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকে কথাটা কি একবারও মনে পড়ে না তোমার? একদিনও মনে পড়ে না?

-আজাইরা প্যাঁচাল করবি না একদম শুভ্রা। আমার জন্য পথ চেয়ে বসে থাকতে তোকে কেউ মাথার দিব্যি দিয়েছে? না তো। তাহলে এসব ন্যাকামি করিস কেন আমার সামনে? ডিজগাস্টিং। আমার অফিস, আমার বাসা, আমি যাবো নাকি রাস্তায় থাকবো তার কৈফিয়ত কি তোকে দিতে হবে আমার?

-এভাবে বলছ কেন ধূসর? এই পাঁচটা বছরেও এক বারের জন্যও আমার পাশে বসে দুইটা মিনিট ধীরে সুস্থ কথা বলেছ তুমি? এমন একটা দিনের কথা বলতে পারবে যেদিন তুমি আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে জিজ্ঞেস করেছো আমি ভালো আছি কিনা?

-এসব ন্যাকামি করার সময় আমার নেই শুভ্রা। কথাটা যত তাড়াতাড়ি বুঝবি সেটাই তোর আর তোর প্রাণের প্রিয় আঙ্কেল আন্টির জন্য ভালো। 

-প্রজ্ঞা যখন ছিল তখন এই ন্যাকামিগুলোর জন্য তোমার আশেপাশে আসার জো ছিল না ধূসর। 

-সবাই প্রজ্ঞা নয়।

-ঠিকই বলেছ ধূসর। সবাই প্রজ্ঞা নয়। আর প্রজ্ঞা নয় বলেই সেদিন হসপিটালে যখন মৃত্যুর সাথে লড়াই করছিলে সেদিন প্রজ্ঞার মতো তোমাকে ফেলে চলে যেতে পারি নি।

-তুই কিছু বলবি শুভ্রা? নাকি আমার মাথাটা খেতেই কল দিয়েছিস প্রতিদিনের মতো? আমি বুঝি না এতো অপমানের পরও তোর শিক্ষা হয়না কেন। আমি অফিসে যাই নি এটা তোকে কে বললো? তোর আঙ্কেল তো দেশে নেই, অফিসেও স্পাই লাগিয়েছিস নাকি?

-ধূসর? উফ! তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করা যায় না, এমন আজেবাজে টপিক নিয়ে এসো কথার মাঝে তুমি। ভালো করে যে দুটো মিনিট কথা বলবো তার উপায় নেই।

-আমার সাথে কথা বলতে কে বলে তোকে হ্যাঁ? রাখ ফোন। যত্তসব। আমি আমার কাজ করছি, ইচ্ছে হলে অফিসে যাবো, ইচ্ছে না হলে যাবো না। বুঝতে পেরেছিস?

-বাড়িতে আসবে কখন? ফুফু বাড়িতে একা আছে। একবারও কি ইচ্ছে হয়না নিজের মায়ের পাশে বসে দু মিনিট মন খুলে কথা বলতে? এতো রাতে ফিরো, আবার সকালেই বেরিয়ে যাও-----।

-তোর জ্ঞান দেয়া হয়ে গেলে আমি রাখছি। তোর ফুফু আর আঙ্কেলকে কোম্পানি দেয়ার জন্য তুই তো রেডিই বসে আছিস, আমার তো দরকার নেই। 

-ধূসর? কখন বাসায় ফিরবে সেটা তো বলো? 

-রাখ তো ফোন। ব্যস্ত আছি বললাম যে বুঝতে পারছিস না? রাখ তো রাখ। বিরক্ত করিস না আমাকে।

শুভ্রা আর কিছু বলার আগেই ধূসর নিজেই কলটা কেটে দিয়ে আরো মিনিট খানেক সামনের দিকে গাড়ি ছোটাতেই দেখতে পেল প্রজ্ঞা উল্টোদিক থেকে দ্রুত গতিতে আসা একটা গাড়ির দিকেই তাকিয়ে আছে। ধূসরের এক সেকেন্ডের জন্য মনে হলো গাড়িটা সোজা যেন প্রজ্ঞার দিকে তেড়ে গিয়ে ধাক্কা দিবে। ধূসর খানিকটা দূরে ছিল বলেই কি করবে ভেবে না পেয়ে গাড়ির হর্ন চেপে ধরলো। আর প্রায় সাথে সাথেই যেন গাড়ির ড্রাইভার সম্ভিত ফিরে পেয়ে গাড়িটা ব্রেক করে প্রজ্ঞার সামনে দাঁড় করিয়েছে। প্রজ্ঞা সেই গাড়িটায় উঠে চলে যাওয়ার সময়ও ধূসর বেশ খানিকটা দূরেই ছিল। তাই প্রজ্ঞাকে আটকাতে পারে নি ছেলেটা। অথবা প্রজ্ঞা রাগ করেই ধূসরকে দেখেও না দেখার ভান করে ওই লোকটার সাথেই চলে গেছে। কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই প্রজ্ঞা যে গাড়িটায় উঠেছে সেটার ড্রাইভারের সাথে চোখাচোখি হয়ে গেল ধূসরের। আর সাথে সাথেই ধূসরের কেন জানি মনে হল এই লোকটাকে ধূসর চিনে, কোথাও দেখেছে লোকটাকে। কিন্তু কোথায় দেখেছে সেটাই মনে করতে পারছে না বেচারা।

অন্যদিকে, কালো রঙের গাড়িটা হঠাৎ একদম সামনে এসে থামতেই প্রজ্ঞা নিজেও চমকে উঠেছিল। ভয়ে ভয়ে সাহস করে ড্রাইভারের দিকে চোখ পড়তেই লোকটা একটু অপরাধীর মতো মাথা চুলকালো দেখে নিমিষেই ভয়টা কেটে গেল প্রজ্ঞার। মার্কেটের দিকে যাবে বলতেই লোকটা প্রজ্ঞাকে গাড়িতে উঠতে বলে পিছনের সিটের ডোর লকটা খুলে দিল। সুনশান রাস্তায় হঠাৎ লিফ্ট নিবে কি নিবে না ভাবতে ভাবতেই শেষে গাড়িতে উঠে পড়লো প্রজ্ঞা। আবার কখন আরেকটা গাড়ি আসবে কে জানে। লোকটাকে দেখে খারাপ বলে মনেও হচ্ছে না। গাড়ির ড্রাইভার পাশের একটা গাড়িকে হাতের ইশারা করে সামনের দিকে আবার ফুলস্পিডেই গাড়ি ছোটালো। 

-আমি অনেক অনেক লজ্জিত ম্যাডাম। আসলে আমি মোবাইলে আমার মালকিনের সাথে কথা বলছিলাম তো তাই খেয়াল করি নি আপনি লিফ্টের জন্য ইশারা করেছেন যে। সরি ম্যাডাম। 

-ড্রাইভিং করার সময় মোবাইলে কথা বলাটা এজন্যই রিস্কি। দয়া করে পরেরবার থেকে ব্যাপারটা খেয়াল রাখবেন। আজ বড় কোনো দূর্ঘটনা ঘটতে পারতো। নিজের জন্য বলছি না। আপনার নিজেরও কিন্তু কিছু একটা ঘটে যেতে পারে এভাবে বেখেয়ালে মোবাইলে কথা বলার সময়।

-আমি আসলেই লজ্জিত ম্যাডাম। পরের বার থেকে এমন যেন না হয় সেদিকে খেয়াল রাখবো।

-আমমমমম। আপনার মোবাইলটা কিছুক্ষণের জন্য ব্যবহার করতে পারি প্লিজ? আসলে আমার মোবাইলটা হারিয়ে গেছে, একটা আর্জেন্ট কল করতে হবে একজনকে।

-নো প্রবলেম ম্যাডাম। আপনি স্বাচ্ছন্দ্যে আমার মোবাইলটা ইউজ করতে পারেন। আই ডোন্ট মাইন্ড।

 ড্রাইভার লোকটা নিজের মোবাইলটা পিছনের সিটের দিকে এক হাত বাড়িয়ে দিতেই প্রজ্ঞা মোবাইলটা নিয়ে হামিদের নাম্বারটাই ডায়েল করলো। লোকটা ওকে খুঁজে না পেয়ে কি করছে কে জানে। দু বার কল হতেই অপর পাশ থেকে হামিদের অমায়িক কণ্ঠস্বরটা ভেসে এলো।

-হ্যালো হামিদ সাহেব? আমি প্রজ্ঞা--------।

-ম্যাডাম ম্যাডাম ম্যাডাম। আপনি কোথায় চলে গিয়েছিলেন? আমি যে কি পরিমাণ টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম আপনাকে বলে বোঝাতে পারবো না। আপনি ওয়াশরুম থেকে আসতে লেইট করছেন দেখে আমি আপনাকে খুঁজতে লেডিস ওয়াশরুমের ওইদিকে যাই। কি যে কেলেঙ্কারি অবস্থা কি বলবো? সুশীল সমাজের লোকজন আরেকটু হলেই আমাকে গণধোলাই দিত। ভাগ্যিস ওই মূহুর্তে কেউ একজন আপনার পার্স আর মোবাইলটা পায়, আর আমার কথা বিশ্বাস করে নেয়। বাট আশ্চর্য ব্যাপার হলো আজই ওদের ওয়াশরুমের বাইরের সিসিটিভি ক্যামেরাটা কাজ করছে না। 

-হামিদ সাহেব? হামিদ সাহেব? রিল্যাক্স? আমি ঠিক আছি। আপনি এখন কোথায় আছেন বলুন প্লিজ? আমি আসলে অন্য একজনের মোবাইল থেকে কল করেছি। বুঝতেই পারছেন ব্যাপারটা।

-আর বলবেন না ম্যাডাম। আপনাকে না পেয়ে কি করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। এদিকে ক্লাইন্টের সাথে মিটিংয়েও যেতে হবে। শেষে অনেক ভেবে লাঞ্চ করে ক্লাইন্টের সাথে দেখা করতে গেলাম। এতে খাড়ুস লোকগুলো, আমাকে পাক্কা দু ঘন্টা অফিসের ওয়েটিং রুমে বসিয়ে রেখেছে। এখন বিরক্ত হয়ে আমি চলে আসছি। বলে এসেছি কাল আবার আসবো। সকালের এপয়নমেন্ট নিয়ে এসেছি ম্যাডাম।

এতো কিছুর মধ্যেও ভদ্রলোক লাঞ্চের কথা ভুলে যায় নি শুনে এতো টেনশনের মধ্যেও প্রজ্ঞার হাসি পেল। কোনোমতে নিজের হাসিটা চাপার জন্য একটু কেশে গলা পরিষ্কার করে নিল।

-আপনি এই মূহুর্তে কোন জায়গায় আছেন হামিদ সাহেব? যিনি লিফ্ট দিচ্ছেন উনি মার্কেট পর্যন্ত লিফ্ট দিবেন তো। আপনি কি কষ্ট করে ওদিকে আসবেন?

-জি জি ম্যাডাম। আমি মার্কেটের ওই দিকটাতেই আছি। আপনি আসলেই আমাকে দেখতে পাবেন। 

-ঠিক আছে। আপনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। আমার বেশি সময় লাগবে না।

প্রজ্ঞার শেষের দিকের কথাগুলো শোনার আগেই হামিদ সাহেব কলটা কেটে দিল। ড্রাইভারের মোবাইলটা ফিরত দিতে গিয়ে একটু বিব্রত হাসলো প্রজ্ঞা। মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ড্রাইভার গাড়িটা মার্কেটের সামনে এসে ব্রেক করতেই প্রজ্ঞা ড্রাউভারকে ধন্যবাদ জানিয়ে নামতে নামতে হামিদ সাহেবকে ব্যস্ত চোখে খোঁজার চেষ্টা করলো। লোকটা মার্কেটের সামনের দিকেই তো থাকবে বলেছিল। গেলটা কোথায়? কথাগুলো ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ ড্রাইভারের গাড়ির হর্ন বাজানোয় চমকে তাকালো প্রজ্ঞা। প্রজ্ঞা তাকাতেই হাতের ইশারায় সামনের দিকে কাউকে দেখালো ভদ্রলোক।

-ওই যে ম্যাডাম, আপনার হামিদ সাহেব। আপনার অপেক্ষায় ফুটপাতে দাঁড়িয়ে লেবু চা খাচ্ছে। বড্ড আমুদে লোক বলতেই হবে। ভালো থাকবেন ম্যাডাম। আবার দেখা হবে আশা করছি।

ড্রাইভার লোকটা কথাগুলো বলে একটা রহস্যমাখা হাসি দিয়ে শাঁ করে নিজের গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিতেই প্রজ্ঞা কিছু একটা বলার চেষ্টা করলো। লোকটা অবশ্য প্রজ্ঞার কথা শোনার জন্য অপেক্ষা করলো না। আর প্রজ্ঞা মুখ ঘুরিয়ে একবার হামিদ সাহেবকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খেতে দেখে আবার গাড়িটার চোখের পলকে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলো ড্রাইভার লোকটা হামিদ সাহেবকে চিনলো কি করে?
.
.
.
চলবে............................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন