হঠাৎ তুমি এলে - পর্ব ১৮ - সুলতানা পারভীন - ধারাবাহিক গল্প


-ম্যাডাম, একটা ব্যাড নিউজ আছে। ঠিক একটা খারাপ খবর বললে ভুল বলা হবে। অনেকগুলোই খারাপ খবর আছে আপনার জন্য। 

কালো রঙের গাড়িটা প্রজ্ঞাকে মার্কেটের সামনে নামিয়ে দিয়ে শা করে চলে গেল। প্রজ্ঞা যে বোকার মতো ড্রাইভারের দিকে তাকিয়ে ছিল সেটা সেও ভালো করেই বুঝতে পেরেছে। প্রজ্ঞাকে কোনোরকম কৌতূহল প্রকাশ করার সুযোগ না দিয়েই লোকটা রীতিমতো ব্যস্ত মার্কেটের এরিয়া থেকে চলে গেছে। ঠিক চলে যাওয়া না, যাকে এক কথায় বলে পালিয়ে আসা। আধ ঘন্টার মতো পরেই নিজের গন্তব্যে ফিরে এসে কাউকে কল করে কথাগুলো বললো লোকটা। অপর প্রান্ত থেকে ইচ্ছেমতো গালি বর্ষণের অপেক্ষায় আছে লোকটা। ম্যাডামের গালি দিয়ে মেজাজ কিছুটা ঠান্ডা হলে তারপর নিজের বক্তব্যটা বলবে লোকটা। এ যেন তার প্রতিদিনকার রুটিন। আজও হলোও তাই। অপর প্রান্ত থেকে একটা রাগী কর্কশ কণ্ঠে বিশ্রি হাজারটা গালি ভেসে এলো লোকটার কানে। এতোগুলো বছর ধরে এই কর্কশকণ্ঠী গালিগুলো শোনার পরও কেন যেন হজম হতে চায় না লোকটার। তবুও অপমানে কান লাল হওয়ার পরও চুপচাপ ঝাড়িগুলো হজম করে নেয়। মাঝেমাঝে লোকটাও ভাবে, এতো কাজ করিয়ে নেয়, অথচ সামান্য এদিক ওদিক হলেই এমন সব কথা বলে যা শুনে মাঝেমাঝে ইচ্ছে হয় বাকিদের মতো একেও উপরের টিকিট ধরিয়ে দিই। 

-তোদের মতো দুই টাকার লোকদের দিয়ে একটা কাজও যদি কখনো ঠিকঠাক মতো হয়েছে। কি পারিস কি তোরা? গাণ্ডেপিণ্ডে গিলা ছাড়া আর কিছু করতে পারিস? কালকে সামান্য একটা কাজ দিলাম সেটাও করতে পারলি না। ওই বুড়ো যেন কোম্পানিতে কি চলছে না জানতে পারে তার দায়িত্ব দিলাম একজনকে, সে উল্টো বুড়োর সামনেই পারলে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে কেটে সব স্বীকার করে দেয়। আর তুই? তুই তো দলের আরেক অকাজের গরু। গরুও না, রাম গাধা। বারবার করে বলেছি প্রপার্টি দখল নেয়ার আগে সব খোঁজ খবর নিবি, মালিক বেঁচে আছে কি না, তার কোনো নোমিনি দেশে আছে কিনা, কেয়ারটেকারকে কিছু টাকা দিয়ে ব্যাপারটা ধামাচাপা দেয়া যায় কিনা। নিজের মতো কাজ করছি, এই ঢংয়ের কথা বলে আবার একটা গন্ডগোল বাঁধালি তো? এবার নিশ্চয়ই যে কাজটা দিয়েছিলাম সেটাও করতে পারিস নি, তাই তো? তোদের পিছনে মাসে মাসে এতো টাকা ঢেলে কি বালের লাভটা হচ্ছে আমার? এর থেকে আর সবার আগে তোদেরকেই উপরে পাঠাতে হবে মনে হচ্ছে। 

-ম্যাডাম, কাজটা হয়ে যেত আজই। আমার একটু লেইট হয়ে গিয়েছিল আসলে। গ্যারেজ থেকে একজন পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। তাই ওই মেয়েটার কাছে যেতে দেরি হয়ে গেছে। 

-মেরেছিস তো ওকে? আর কেয়ারটেকারটাকে? ওকে জীবিত ছেড়ে দিয়েছিস? তোদেরকে আগেই বলেছি দুটোকেই একসাথে শেষ করে দিতে-----।

-আমমমম। আসলে শেষ পর্যন্ত প্ল্যানটা ক্র্যাক করে নি ম্যাডাম। ব্যাপারটা পুরো এক্সিডেন্টের এংগেলে সাজিয়েও ফেলেছিলাম। শেষমূহুর্তে ধূসর স্যার এসে সব গন্ডগোল করে দিল। ওই রাস্তা দিয়েই স্যার কোথাও একটা যাচ্ছিলেন, বা কোথাও থেকে ফিরছিলেন, আমার গাড়িটা ওই মেয়েটার দিকে যাচ্ছে দেখে বেশ কয়েকবার হর্ন বাজায়। আমিও তাই মেয়েটাকে লিফ্ট দেয়ার বাহানায় নিজের গাড়িতে তুলে নিই।।

-ধূসর? ধূসর তোকে চিনতে পারে নি তো মুন্না? তাহলে কিন্তু সব শেষ হয়ে যাবে। ও যদি একটুও আন্দাজ করতে পারে ওইদিনের এক্সিডেন্টের পিছনে তোর হাত আছে তাহলে আমার নামটাও সামনে চলে আসবে। এমন কিছু ঘটলে তোকে সোজা গুলি করে মারবো আমি মুন্না।

-আরে না না ম্যাডাম। স্যার আমাকে চিনতে পারবে কি করে? উনি সেদিন মোবাইলে কথা বলায় ব্যস্ত ছিল। আর শেষ মূহুর্তে আমার ট্রাকটা উনার গাড়িতে ধাক্কা দেয়ার সময় এক নজর আমার দিকে ফিরেছিল ঠিকই, বাট তখন তো সব অন্ধকার হয়ে গেছে হঠাৎ ধাক্কা লাগায়। আর এক্সিডেন্টটা নিয়ে উনার মনে কোনো সন্দেহ হলে এতোদিনে জেলে থাকতে হতো আমাদেরকে।

-জাস্ট শাট আপ। তারপর কি হলো? ধূসর কোথায় গেল? ও কোথা থেকে আসছিল? আর মেয়েটা? মেয়েটাকে এখনও শেষ করিস নি কেন হ্যাঁ? 

-গাড়িতেই মেয়েটা আমার মোবাইল দিয়ে কেয়ারটেকারের নাম্বারে কল করে। তখনই সুযোগ বুঝে ওই মেয়ের ঘাড়টা মটকে দিতে চেয়েছিলাম। বাট পুরোটা রাস্তা ধূসর স্যার আমার গাড়িটা ফলো করেছিল। তাই আর কিছু করি নি। 

-ধূসর তাহলে নিশ্চয়ই কিছু আান্দাজ করতে পেরেছে। আহহহহহহ। এবার? এবার কি হবে? ও তো সব জেনে যাবে? ওই বুড়োটারও এখনই গোয়ান্দাগিরি করতে ইচ্ছে হয়েছিল। ওই বুড়োর নাটকেই তো সবাইকে কনভেন্স করেছি যে লোকটা অফিসের কাজে দেশের বাইরে যাচ্ছে। বাট ধূসর? ওকে কি করে সামাল দিব? একটা কাজও তোরা ঠিক মতো করতে পারিস না হারামজাদারা। আর বিপদে পড়ি আমি। 

-ম্যাডাম। উমমমমম। আমার মনে হয় না ধূসর স্যার আমাকে ফলো করছিল। তাহলে মেয়েটাকে ড্রপ করে দেয়ার পরও উনার গাড়িটা দেখতে পেতাম আশেপাশে কোথাও। বাট ধূসর স্যারের গাড়ির আর মোবাইলের লোকেশন ওই মার্কেটের ওখানেই শো করছে। আই থিংক, স্যার ওই মেয়েটাকেই ফলো করতে করতে আসছিল। আমাকে নয়।

-মেয়ে? কে ওই মেয়ে?! ওই ডাক্তার বুড়োটা তো নাকি বিয়েও করে নি। তাহলে এই মেয়ে কোথা থেকে আমদামি হলো? নাম কি ওর? আর ধূসরের সাথেই বা কি সম্পর্ক ওর?! এক প্রজ্ঞাকে ওর জীবন থেকে সরাতে পারছি না, এর মধ্যে আরেকজন এসে হাজির। আহহহহহহহ। 

-ম্যাডাম। আপনি টেনশন করবেন না একদম। আমি দেখছি মেয়েটার কোনো ডিটেইলস বের করতে পারি কিনা। আর তাছাড়াও হাতে বেশ কয়েক ঘন্টা সময় আছে। কাল সকালে কেয়ারটেকারের সাথে আসবে ওই মেয়েটাও। আপনার সাথে মিটিংয়ের এপয়নমেন্ট নিয়েছে শুনলাম।

-কাল সকালের মধ্যে ওই মেয়ের সমস্ত ডিটেইলস আমার চাই মুন্না। এর জন্য যা করতে হয় কর। আর ওই মেয়ের ব্যবস্থা আমি নিজে করছি কাল। তোরা শুধু ওর ডিটেইলস জোগাড় করে দে রাতের মধ্যে।

-ওকে ম্যাডাম। আর ম্যাডাম আপনার আঙ্কেল? উনি তো আবার সেন্সে ফিরলেই পালাতে চেষ্টা করবে। কতোক্ষণ আর পাহারা দিয়ে রাখা যাবে বলুন?

-ওই বুড়োকে কয়দিন ওভাবেই বেঁধে ফেলে রাখ। শুভ্রাকে ধোঁকা দেয়ার পরিণতি কি হতে পারে ওই বুড়োকে বুঝতে হবে। ওই বুড়োর সাহস কত বড় যে আমাকে ট্রাপে ফেলার জন্য লোকটা আমার আর ধূসরের এঙ্গেজমেন্টের এনাউনমেন্ট পর্যন্ত করে দিয়েছে। আমি এঙ্গেজমেন্টের আনন্দে সব ভুলে থাকবো আর সে আমার বিরুদ্ধে প্রমাণ জোগাড় করবে। প্রমাণ! হাহ্। এবার কর না প্রমাণ জোগাড়? পচে গলে মর ওই অন্ধকার গ্যারেজের মধ্যে। পালাতে চাইছে তো? চেষ্টা চালিয়ে যাক। তোরাও আবার হাত পা গুঁটিয়ে থাকিস না গর্ধবের দল। ওই বুড়ো যদি পালায় তাহলে আমি তোদের সবগুলো অকর্মার ঢেঁকিকে একসাথে জিন্দা জ্বালিয়ে মারবো, ওই গ্যারেজেই। কথাটা বাকি আহামক্কগুলোকেও বলে দিস। 

-পালাতে পারবে না ম্যাডাম। আমি গ্যারেজে চলে এসেছি। আপনার আঙ্কেলকে একটা ইনজেকশন দিয়ে তারপর বের হবো ডাক্তারের মেয়ের খোঁজ করতে। 

-কাল সকালের আগে কোনো স্টেপ নিবি না। যা করার দূর থেকেই করবি। শুধু ইনফর্মেশন জোগাড় করবি তুই। আর কিচ্ছু না। মনে থাকবে?

-ওকে ম্যাডাম।

-আর ধূসর কি করছে, কেন ওই মেয়েকে ফলো করছে সেটাও খোঁজ নে মুন্না। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে ওই মেয়েটার সাথে প্রজ্ঞার কোনো কানেকশন আছে। আচ্ছা মুন্না? ওই মেয়ে---ওই মেয়েটা প্রজ্ঞা নয়তো? 

মুন্নার সাথে কথা বলতে বলতে শুভ্রা এতোটাই রেগে গিয়েছিল যে শেষের দিকের কথাগুলো রীতিমতো চিৎকার করেই বলে ফেলেছিল। ওরা যে খালি পড়ে থাকা জায়গাটায় সুপার শপ বানানোর জন্য জমি দখল করেছিল সেটার বিষয়ে কথা বলতে কে বা কোথা থেকে এসেছে, আর সেই মেয়ের সাথে ধূসরের কি সম্পর্ক এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ প্রজ্ঞার নামটাই অজান্তে শুভ্রার মনে পড়ে যায়। নিজের সমস্ত অন্যায়ের সাক্ষী ওই মুন্না নামের লোকটাকে কথাটা বলার সাথে সাথেই পিছন থেকে কিছু একটা পড়ার শব্দ হলো। শুভ্রা বিদ্যুৎবেগে পিছনে ফিরতেই একটা আচমকা চড় এসে পড়লো ওর গালে। শুভ্রা গালে হাত দিয়ে মানুষটার দিকে একবার তাকিয়েই কলটা কেটে দিল। সামনে দাঁড়ানো মানুষটা বাঘের মতো ক্ষিপ্রবেগে শুভ্রার হাত থেকে মোবাইলটা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো। আর তার ব্যর্থতার রাগটা প্রকাশ পেল শুভ্রার গালে আরেকটা কষিয়ে থাপ্পর পড়ায়। শুভ্রার তাতে কোনো হেলদোল আছে বলে মনেই হলো না। 

-তুই এতোটা নিচে নেমে গেছিস শুভ্রা যে নিজের লোকজনকেও কষ্ট দিতে একবারও বাঁধছে না তোর? তোর সাহস হলো কি করে আমার ছেলে, আমার স্বামীর ক্ষতি করার চেষ্টা করার? বল ধূসরের বাবাকে কোথায় আটকে রেখেছিস?

-আমি যতই ভাবি আর নতুন করে এসব পচা কাজ করবো না ততই তোমরা সবাই মিলে আমাকে বাধ্য করাও করতে ফুপ্পি। তোমার ওই বুড়ো বরের কি দরকার ছিল আমার পিছনে টিকটিকি লাগানোর? অফিসের একটা লোকেরও সাহস নেই আমার বিরুদ্ধে কিছু বলার। ওরা জানে আমি কি করতে পারি না পারি। বাট তোমার ওই বুড়োর সাহসটা অতিরিক্ত বেড়ে গিয়েছিল। কি ভেবেছে আমি কিচ্ছু জানতে পারবো না আমার বিরুদ্ধে কি ষড়যন্ত্র চলছে? 

-তারমানে ধূসরের বাবা যা সন্দেহ করেছিল সেটাই ঠিক? তুই ধূসরের এক্সিডেন্ট, ট্রিটমেন্টের কথা বলে যত টাকা নিয়েছিস সব ধোঁকা ছিল? এক্সিডেন্টটাও তুই করিয়েছিস, প্রজ্ঞার কারণে হয় নি? এতো কিছু করেও তোর মন ভরে নি? আর কি চাই তোর? আমি কতোটা বোকার মতো তোকেই সাপোর্ট করেছি এতোদিন------। ভাবতেই নিজেকে গালে গালে থাপড়াতে ইচ্ছে করছে আমার। আহহহ।

-উফ। ফুপ্পি? তুমিও এবার শুরু করে দিও না তো। আমি কি এমন করেছি? যাকে ভালোবাসি, তাকে নিজের করে পেতে চাই, এতে দোষের কি আছে বলো তো? ধূসরের এক্সিডেন্ট করিয়েছি মানছি। কেন করিয়েছি? যাতে ওই মেয়েটা ধূসরের জীবন থেকে চলে যায়। খুন খারাবি করতে চাই নি। কিন্তু কি লাভ হলো? ওই মেয়েটা ধূসরের জীবন থেকে চলে গিয়েও ঠিকই আমাদের মাঝখানে রয়ে গেছে। আর তোমার ওই গুণধর বুড়ো স্বামী। নিজেকে বিশাল বড় ডিটেক্টিভ ভাবে তাই না? ওই বুড়ো কি জানে অফিসের, এই বাড়িতে, ধূসরের যেখানেই যায়, তার প্রতিটা কোণায় কোণায় আমার হুকুম চলে? আমার সাথে চালাকি করে প্রজ্ঞাকে খুঁজে বের করতে চেয়েছিল না? এবার ওই কালকুঠুরিতেই পচে মরুক। 

-শুভ্রা? ভদ্রভাবে কথা বল। উনি তোর আঙ্কেল হয়।

-আঙ্কেল মাই ফুট! আমার আর ধূসরের মাঝে যে আসবে তাদের কাউকেই ছাড়বো না আমি। তোমাকেও না ফুপ্পি। আর ওই প্রজ্ঞাকেও না।

শুভ্রা কথাগুলো বলতে বলতেই উল্টো হাত দিয়ে একটা ফুলদানি টেনে নিয়ে সজোরে সেটা দিয়ে আঘাত করলো ভদ্রমহিলার মাথায়। চোখের সামনে অন্ধকার ঘনিয়ে আসার আগে কয়েকটা কথাই শুনতে পেলেন ধূসরের মা।

-এতো সহজে তো আমি নিজের অধিকার ছেড়ে দিবো না ফুপ্পি। ধূসরকে পাওয়ার জন্য যদি আমাকে তোমাদের সবাইকে খুনও করতে হয় তবে আমি হাসতে হাসতে সেটাও করতে পারি। ধূসরের জন্য যেমন আমি নিজের জীবন দিতে পারি, তেমনি তোমাদের সবার জীবন কেড়েও নিতে পারি। তোমার, তোমার বুড়ো বরের, ওই প্রজ্ঞার, এমনকি খোদ ধূসরেরও।।
.
.
.
চলবে..............................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন