হাওয়াই মিঠাই |
সেদিন দুপুরে রাফি আঙুলের কড়া মেপে পানি দিয়ে ভাত বসাচ্ছিলাে। মীরা পাশেই দাঁড়িয়েছিল। সে বলল,
"এত কম পানি দিলে?"
"এটাতাে বসা ভাত।"
"তুমি বসা ভাতও রাঁধতে জানাে?"
রাফি হেসে বলল,
"তুমি জানাে না?"
মীরা মাথা দুলিয়ে বলল,
"আমি সব কাজ পারি রান্নাবান্না ছাড়া। কারণ মা আমাকে আর ইরাকে রান্নাঘরে ঢুকতেই দেয় না। যদি কোনাে অঘটন ঘটাই তাই।"
রাফি হেসে ফেলল। তারপর বলল,
"অবশ্য তােমাদের বড় ফ্যামিলি তাে। তুমিও সবার ছােট তাই হয়তাে তােমার এসব করা লাগে না।"
"হ্যাঁ।"
"আমাদের বাসায় ব্যাপারটা অন্যরকম। আমাদের বাসায় কাজের লােক নেই, সব আমাদেরই করতে হয়। তাই মা, আমি আর রাহি কাজগুলাে ভাগাভাগি করে করি। ছুটির দিনে বাবাও করেন।"
"বাহ দারুণ তাে!"
"আমার মা একটু অন্য ধরণের।"
মীরা কিচেন কেবিনেটের উপরে উঠে বসলাে। পা ঝােলাতে ঝােলাতে বলল,
"কেমন উনি?"
রাফি ভাতের চুলা ধরিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,
"ধরাে রূপ বারান্দার গ্রিল বেয়ে উপড়ে উঠছে। তুমি দেখতে পেলে যে ও পড়ে গেল। তখন তুমি কী করবে?"
"দৌড়ে গিয়ে উঠাব। আবার আমি কান্নাও করে দিতে পারি।"
"অথচ আমাদের বাসায় রূপ সারাদিন গ্রিল বায়। পড়ে গেলেও মা, আমি এবং রাহি কেউ দৌড়ে যাই না, ধরি না, উঠাইও না। একমাত্র বাবা থাকলে গিয়ে ওকে ওঠান।"
"বলাে কী! ব্যাথা পায় না? কেটে যায় না?"
"সবই হয়।"
মীরা চমকে উঠে বলল,
"এমন কেন করাে?"
"কারণ আমাদের মা এরকম চান। মা চান রূপ পড়ে গিয়ে একাই উঠুক। ব্যাথা পেয়ে ব্যাথা সহ্য করতে শিখুক, শক্ত হােক, সেল্ফ ডিপেন্ডেন্ট হােক। আর হয়ও তাই। রূপ পড়ে গিয়ে একাই ওঠে, ব্যাথা পেলেও কাঁদে না। আর বাবা যখন দৌড়ে গিয়ে উঠিয়ে আদর করেন তখন রূপ আহ্লাদে কেঁদে ফেলে। মা এই আহ্লাদগুলােই দিতে চান না। মায়ের আদরের ধরণ আলাদা। তিনি ছােটবেলা থেকে এভাবেই আমাদেরকে সেল্ফ ডিপেন্ডেন্ট বানিয়েছেন।"
"আরে বাপরে!"
বিস্ময়ে মীরার চোখগুলাে বড় বড় হয়ে গেল। রাফি বলল,
"সকালে শুনলে না রূপ একা একা উঠে নাস্তা করেছে?"
"হ্যাঁ।।"
"অবাক হওনি?"
মীরা মাথা চুলকে বলল,
"আসলে খেয়াল করিনি। সকাল থেকে আমার মাথা কাজ করছে না। তবে অবাক হওয়ার মত বিষয়।"
রাফি হেসে বলল,
"কোনাে ব্যাপার না। আমি বলছি শােনাে, মা আরাে আগে রূপকে শিখিয়েছে কীভাবে একা একা দাঁত মাজতে হবে। কীভাবে ফ্রিজ থেকে ব্রেড-বাটার বের করতে হবে, কীভাবে ব্রেডে বাটার লাগাতে হবে, কীভাবে টেবিলে ঢেকে রাখা খাবার খেতে হবে এগুলাে সব শিখিয়েছেন। এমনকি কীভাবে একা একা গােসল এবং পটি করতে হবে তাও শিখিয়েছেন। যেসব জিনিস উপরে ওর নাগালের বাইরে, সেগুলােকে টুল নিয়ে তার উপর দাঁড়িয়ে ওর নাগালের মধ্যে নিয়ে আসে। আমাদেরকেও ২ বছর হতেই এসব শিখিয়েছিলেন। এমনকি ১০-১২ বছরের মধ্যে মা আমাদের ধরনের টুকটাক রান্নাও শিখিয়েছেন। উদ্দেশ্য একটাই, যদি কখনাে মা অকালে আমাদের রেখে মারা যান তাহলে যেন আমরা একাই চলতে পারি, কারাে উপর নির্ভরশীল হতে না হয়। অথবা যদি কখনাে তাকে কোনাে কারণে আমাদের থেকে দূরে থাকতে হয় তাহলে তার যেন আমাদের জন্য তার চিন্তা করতে না হয়। এই যেমন দেখাে মা এখন খুব জরুরি প্রয়ােজনে টার্কি গেছে। আমাদের কাউকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। তাই একাই গেছে। অথচ সে না থাকলেও আমরা সবকিছু ঠিকভাবেই করতে পারছি। স্পেশালি রূপ। মা গেছে সপ্তাহখানেক হলাে, অথচ সে মায়ের জন্য এখনাে একদিনও কাঁদেনি। প্রতিদিন ভিডিও কলে কথা বলে ব্যাস এতেই সে খুশি।"
"এইটুকু বাচ্চা কত স্ট্রং!"
"মায়ের কঠিন ট্রেনিংয়ের কারণেই রূপ স্ট্রং হয়েছে। আমরা দুই ভাইও।"
রাফির কথাগুলাে শুনে মীরা মনে মনে ভাবতে লাগলাে তার হবু শাশুড়ি কতটা স্মার্ট! উল্টোদিকে সে কি ক্ষ্যাত! এমন শাশুড়ির বউ হতে হলে তাে তারও স্মার্ট হতে হবে। কিভাবে স্মার্ট হবে সে? রাফি ভাত দেখতে চুলার দিকে আগালাে। মীরা একই কথা ভেবে চলেছে। রাফি ভাতের চুলা কমিয়ে আবার মীরার সামনে এসে দাঁড়ালাে। বলল,
"কী ভাবছাে?"
"নাহ কিছু না।"
"ভাবছাে এ কেমন আজব ফ্যামিলি?"
"তা নয়।"
"তাহলে?"
"ভাবছি তােমাদের ফ্যামিলির সবাই কত স্মার্ট আর আমি!"
মাথা নীচু করে ফেলল মীরা। রাফি মীরার মুখটা তুলে হেসে বলল,
"তুমি হাওয়াই মিঠাই।"
অবাক হলাে মীরা। রাফির দিকে তাকিয়ে বলল,
"হাওয়াই মিঠাই?"
"হুম, আমার ব্যক্তিগত হাওয়াই মিঠাই।"
মীরা বােকার মত জিজ্ঞেস করল,
"মানুষ আবার হাওয়াই মিঠাই হয় কীভাবে?"
রাফি মীরার গালে হাত রেখে বলল,
"এই যে ছুঁলেই গলে পড়াে, তারপর মিষ্টি একটা ঘ্রাণে নিবিষ্ট করে ফেলাে আমাকে। একদম হাওয়াই মিঠাইয়ের মতাে।"
মীরা তখন এতই অবুঝ ছিল যে এই কথার মর্ম পুরােপুরি বুঝে উঠতে পারেনি সেদিন। বােকার মত শূণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল শুধু। অথচ আজ মনে পড়লে প্রচণ্ড বুকভাঙা কান্নায় নিঃশেষ হয়ে যেতে থাকে মীরা। এই জীবনে সে আর একবার হলেও রাফির সামনে যেতে চায়। রাফি আর একবার তাকে হাওয়াই মিঠাই বলুক!
পর্ব ১২ | পর্ব ১৪ |