হাওয়াই মিঠাই |
সেদিন দুপুরে খাওয়ার পরপরই রাফি মীরাকে ঢাকায় পৌঁছে দেয়ার জন্য বেরিয়ে পড়েছিল। সাধারণত ব্যাংক টাউন থেকে ঢাকা আসতে প্রায় এক ঘন্টা লাগে। কিন্তু গাবতলী আমিনবাজারে মাঝেমধ্যে ভয়ানক জ্যাম পড়ে। তাই রাফি কোনো রিস্ক নিতে চায়নি। মীরাকে যেকোনো ভাবেই সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরতে হবে।
কিন্তু ভেজালটা লেগে গিয়েছিল৷ আমিন বাজার পৌঁছানোর একটু আগেই জ্যামে পড়লো। এই বুঝি জ্যাম ছুটে যাবে, এই অপেক্ষা করতে করতে বিকেল ৩ টা বেজে গেল। মীরা এবার ভয় পেতে শুরু করলো। ভয় ভয় চোখে রাফির দিকে তাকিয়ে বলল,
"ঢাকার জ্যাম তো মাস্ট থাকবে। বাসায় যদি সন্ধ্যার আগে পৌঁছাতে না পারি?"
"চিন্তা করো না। এখনো অনেক সময় আছে।"
"কোথায় সময় আছে? এখন তো ৫ টা বাজলেই সন্ধ্যা হয়ে যায়।"
রাফির চোখেমুখেও চিন্তার ছাপ। প্রতিদিন এই রাস্তায় সে ভার্সিটিতে যায়। বেশি হলে এমন জ্যাম বছরে একদিন লাগে। সেই দিনটা আজ না হলেই কি হতো না?
অপেক্ষা করতে করতে ৪ টা বেজে গেল। মীরা বলল,
"আচ্ছা রাফি, অলটারনেটিভ কোনো রাস্তা নেই?"
"গাবতলী আমিন বাজার ছাড়া সাভার থেকে ঢাকা যাওয়ার আর কোনো রাস্তা নেই মীরা। থাকলে কি এখনো বসে থাকতাম তোমাকে নিয়ে!"
বাস এতক্ষণে এক কিলোমিটারও সামনে আগায়নি। রাফি একবার বাস থেকে নেমে দেখে আসতে চাইলো সামনের অবস্থা কেমন, জ্যাম ঠিক কতদূর পর্যন্ত। পরে আবার মীরাকে একা রেখে গেলো না। কিছুক্ষণ পর মীরাকে সাথে নিয়েই বাস থেকে নামলো। সামনের অবস্থা এত ভয়াবহ যে রাফির মনে হলো যদি এভাবে বসে থাকে তাহলে রাত ১০ টায়ও পৌঁছানো যাবে না। রাফি বলল,
"হাঁটতে পারবে মীরা? বেশিদূর না, জাস্ট আধা ঘন্টার মতো। গাবতলীর ব্রিজটা পার হতে পারলে অনেক রাস্তা। কোনোভাবে চলে যাওয়া যাবে।"
"পারবো। চলো তুমি।"
রাফি-মীরা হাঁটতে শুরু করলো। প্রথমে মীরার হাঁটার গতি যেমন ছিল পরেও যদি তেমন থাকতো তাহলে ১৫ মিনিটের বেশি লাগতো না গাবতলী পৌঁছাতে। কিন্তু পরে মীরার হাঁটার গতি ধীর হয়ে যাওয়ায় আধা ঘন্টা লেগে গেলো। রাফি হন্যে হয়ে সিএনজি খুঁজছে কিন্তু পাচ্ছে না। ওদিকে রাস্তার যে অবস্থা তাতে বাসগুলো রাস্তায় ইঞ্জিন বন্ধ করে বসে আছে। যদিও সিএনজি নিলে মেইন রোড দিয়ে না গিয়ে মীরপুর ব্রীজ রোড দিয়েও যাওয়া যাবে। মীরার এবার টেনশনে কাঁদোকাঁদো অবস্থা। রাফি মীরাকে একটা কনফেকশনারি দোকানের সামনে দাঁড় করিয়ে বলল,
"মেয়ে দেখলে সিএনজি ওয়ালাগুলার ভাব বাড়ে। তুমি এখানে দাঁড়াও, আমি ঠিক করে নিয়ে আসছি।"
মীরা দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু রাফি সেই যে গেলো আর আসার নাম নেই। কিছুক্ষণের মধ্যেই পাশের চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে থাকা কয়েকটা ছেলে মীরাকে উদ্দেশ্য করে আজেবাজে কথা বলতে লাগলো। মীরা কিছু কথা বুঝলেও বেশিরভাগ কথাই বুঝতে পারেনি। ভাগ্যিস মীরা এত আজেবাজে কথা তখন বুঝতো না। বুঝলে ওই মুহুর্তে সে কীভাবে নিজেকে সামলাতো জানেনা। যা বুঝেছিল তাতেই অস্বস্তি লাগতে শুরু করলো এবং মীরা সেখান থেকে সরে গেল। কিন্তু কিছুতেই আর রাফিকে খুঁজে পাচ্ছিলো না। এবার মীরা কান্নাই করে দিলো। কিছুদূর হেঁটে সামনে গিয়ে মীরা একটা ফোনের দোকান দেখতে পেল। সেখান থেকে রাফিকে ফোন করলো। রাফি জানতে চাইলো,
"সিএনজি ঠিক করে লোকটাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছি। তুমি কোথায় গেলে?"
মীরা কাঁদতে কাঁদতে বলল,
"রাফি তুমি কোথায়? আমি খুঁজে পাচ্ছি না।"
"আরে! কাঁদে না। যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলে সেখানে চলে আসো আবার।"
"আমি সেই জায়গাটাও খুঁজে পাচ্ছি না।"
"কি বলো!"
"আমি হারিয়ে গেছি।"
মীরার কান্না বেড়ে গেল। রাফি বললো,
"পাগলের মত কাঁদছো কেন? কোথায় আছো সেটা বলো আমি আসছি।"
মীরা বললো,
"আমি একটা ফোনের দোকানে। সামনে রাস্তা, অনেকগুলো বাস জ্যামে।"
"এভাবে বললে জীবনেও খুঁজে পাবো না। তুমি দোকানদারকে দাও। আমি ওনার কাছ থেকে ডিরেকশন নিচ্ছি।"
দোকানকদারের কাছ থেকে ডিরেকশন নিয়ে রাফি মীরাকে খুঁজে বের করলো। ততক্ষণে সোয়া ৫ টা বেজে গেছে। মীরা অনেকটাই সামনে এগিয়ে গিয়েছিল, জ্যামের মধ্যে সিএনজি নিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিলো না, তাই রাফি সিএনজিওয়ালাকে ওখানেই দাঁড় করিয়ে রেখে গিয়েছিল। বলে গিয়েছিল ভাড়া বাড়িয়ে দেবে সে যেন না যায়। কিন্তু ফিরে গিয়ে দেখলো সে চলে গেছে। এবার রাফি আবার মীরাকে সাথে নিয়ে সিএনজি খোঁজা শুরু করলো। খুঁজতে খুঁজতে একসময় মাগরিবের আজান দিলো। ঘড়িতে সাড়ে ৫ টা বাজে। মীরা কেঁদেই চলেছে। অন্ধকার হয়ে যাওয়ার পর একটা সিএনজি পাওয়া গেলো। মীরার কান্না এবার কিছুটা কমেছে কিন্তু সে ভয়েই জড়োসড়ো হয়ে আছে। এতক্ষণ মীরাকে কিছুই বলেনি রাফি। এবার সিএনজি চলতে শুরু করতেই বলল,
"আচ্ছা তোমার ফোনটা কি বাসায় ফেলে এসেছো?"
মীরা বলল,
"না তো।"
"হারিয়ে গেছে?"
"না।"
"তাহলে তখন সিএনজি নিয়ে এসে তোমাকে দোকানটার সামনে না দেখে যে কল দিলাম ধরলে না যে? আবার আমাকেও ফোন করলে দোকান থেকে!"
"ফোন সাইল্যান্ট করা। আর আমার খেয়ালই ছিল না যে আমার কাছে ফোন আছে। সরি।"
রাফি কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। তারপর মীরার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
"ইটস ওকে। টেনশনে আছো তাই এমন হয়েছে। ওখান থেকে চলে গেলে কেনো?"
"পাশের চায়ের দোকানে ছেলেগুলো বাজে কথা বলছিলো।"
"তুমি কিছু বলোনি?"
"আমি কী বলবো?"
"কেউ বাজে কথা বললে প্রতিবাদ করবে। লোকজন ডেকে মার খাওয়াবে। পালাবে না আর কখনো।"
"আমার ভয় করে।"
"ভয়ের কিছু নেই। তোমরা এভাবে চুপ থাকো বলেই ওরা বাজে কথা বলে মজা নিতে থাকে। ওরা তোমার এলাকার ছেলে না যে একদিন প্রতিবাদ করলে আরেকদিন তোমার ক্ষতি করতে পারবে। একদিন লোকজন ডেকে মার খাওয়ালেই এই জানোয়ারগুলো একদম সোজা হয়ে যেতো।"
মীরা চুপ। রাফি বলল,
"যাকগে, বাদ দাও। এগুলো পরে তোমাকে শিখিয়ে দেব। এত দেরি হয়ে গেলো। বাসায় কী বলবে?"
মীরা উদ্বীগ্ন গলায় বলল,
"আমি জানি না। রাফি তুমি বলে দাও কী বলব।"
রাফি একটু ভাবলো। তারপর বলল,
"বলবে পিকনিক শেষে কোনো বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিলে।"
"মা মেরে ফেলবে আমাকে। আমার কোনো বান্ধবীর বাসায় একা যাওয়া নিষেধ।"
"তাহলে বলবে পিকনিক বাস জ্যামে পড়েছিল তাই আসতে দেরি হয়েছে।"
"এটা বলাই ভাল হবে।"
"আচ্ছা।"
মীরা সন্ধ্যা ৭ টায় বাসায় পৌঁছালো। বাসায় ঢুকেই দেখে বাসার সবাই ড্রয়িং রুমে বসে আছে। বাবা-মা, নজু চাচ্চু, থেকে শুরু করে ইরা পর্যন্ত সবাই। বাবা জিজ্ঞেস করলো,
"কোথায় ছিলে মীরা? সন্ধ্যা কখন হয়েছে?"
মীরা ভয়ে ভয়ে বলল,
"বাবা পিকনিক বাস জ্যামে পড়েছিল। তাই দেরি হয়েছে।"
নজু চাচ্চু বলল,
"থাপ্পড় দিয়ে তোমার সবকটা দাঁত ফেলে দেব। ৬ টার মধ্যেও তুমি আসছোনা বলে তোমার স্কুলে গিয়ে খোঁজ নিয়ে এসেছি। তোমার পিকনিক বাস ৫ টায় ফিরেছে। আর তুমি পিকনিকেও যাওনি। কোথায় ছিলে সারাদিন?"
মীরা'র এবার পা দুটো থরথর করে কাঁপতে শুরু করলো। মাথা কাজ করছে না। কী বলা উচিত বুঝতে পারছে না!
পর্ব ১৩ | পর্ব ১৫ |