আমার একটাই উনি - ইয়াসমিন তানিয়া - অনু গল্প

পড়ুন ইয়াসমিন তানিয়া'র লেখা একটি অনু গল্প আমার একটাই উনি
আমার একটাই উনি
আমার একটাই উনি by ইয়াসমিন তানিয়া

মার নাম মাহরুম সুবহা অন্তি। আমার পরিবারে আমার বাবা মা, আর আমরা দুই বোন। আর আমার একটা বড় ভাই আছে। আপুর নাম শান্তা বয়সে আমার বড়। আর আমাদের বড় ভাইয়ার নাম ফারহাদ। আমাদের পরিবারের আরেক সদস্য হলেন সায়ন ভাই। উনি আমার বড় ভাই ফারহাদের বেস্ট ফ্রেন্ড। সেই সুবাধে তার আসা যাওয়া হতো আমাদের বাড়ীতে। আমাদের পরিবারের সবাইও তাকে খুব পছন্দ করতো। সায়ন ভাই ও ফারহাদ ভাই ছিলো বাল্যকালের বন্ধু। তাই আমি ছোট থেকেই তাকে দেখে আসছি ভাইয়ার সাথে। কখনো আমাদের বাসায় বা কখনো এলাকায়। আমি যখন ক্লাশ ফাইবে পড়ি। কিছুটা বুঝতে শিখি। তখনই ক্রাশড খেয়ে বসি হঠাৎ সায়ন ভাইয়ের উপর। উনি তখন ক্লাশ টেন এর ছাত্র ছিলেন। দেখতেও মাশআল্লাহ অনেক সুন্দর ছিলেন। কিন্তু তার সাথে আমার তেমন কথা হতো না। কিন্তু তবুও কেনো জানি তার প্রতি একটা ভালোলাগা কাজ করতে লাগতো। সবথেকে বেশি ঘায়েল হয়েছিলাম তার মুখের হাসিটির উপর। উনি কখনো শব্দ করে হাসতো না, যখনই হাসতো মুচকি হাসি দিতো। যা মনে হয় হ্রদয়ে গিয়ে লাগতো।

উনার আমাদের বাসায় আসা যাওয়ার সুবাধে তার প্রতি আস্তে আস্তে আমি একটা টান অনুভব করতে লাগলাম। ছোট ছিলাম, ভালেবাসা কি তা তখনও ঠিক ভাবে বুঝতাম না। কিন্তু তার জন্য আমার এই ছোট মনটা কেমন যেনো করতো। এমন অনুভূতি গুলো আমার জন্য সম্পূর্ণ নতুন ছিলো, তাই বুঝে উঠতে পারতাম না। শুধু বুঝতাম কেনো জানি এই মানুষটিকে দেখে আমার মন খারাপ থাকলেও ভালো হয়ে যেতো। কিশোরী মনের এই আবেগের কথা সর্বপ্রথম শেয়ার করলাম আমার মামাতো বোন শানুর সাথে। ও আমার বেস্ট ফ্রেন্ডও ছিলো। আমার মনের অবস্থা বুঝে সেদিন শানুও আমাকে শান্তনা দিলো। আর সাথে আশ্বাস হয়তো সায়ন ভাইও আমাকে পছন্দ করে, কিন্তু ভাইয়ার ভয়ে বা বয়সে আমি ছোট বলে আমাকে বুঝতে দিতে চায় না। কেনো জানি ওর কথায় একটু আশা পেলাম। আর নিজেই সিদ্ধান্ত নিলাম আমি তার জন্য অপেক্ষা করবো।হাই স্কুলে উঠে তাকে নিজের মনের কথা জানাবো।

শুধু উনাকে একবার দেখার জন্য আমি নানু বাড়ী ছুটে যেতাম। কারণ নানু বাড়ীর পাশেই উনারা থাকতেন। আর আমিও প্রায়ই তাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম। আমি যখন ক্লাশ সিক্সে উঠলাম তার কয়েক মাস পরই উনি এস এস সি এক্সাম দিলো। বরাবরের মতো এবারও উনার রেজাল্ট ভালো হলো। গোল্ডেন এ প্লাশ পেলো। উনার পাশের মিস্টি আমি খুব আনন্দের সাথেই খেয়েছিলাম। উনার থেকে বেশি খুশি মনে হয় আমিই ছিলাম। কিন্তু কপাল আমার কে জানতো আমার খুশি বেশিদিন থাকবে না।

সায়ন ভাইকে এরপর আর দেখতে পেলাম না। আমাদের বাড়ীতে আসতো না, ভাইয়ার সাথেও ইদানিং দেখতে পেতাম না। উনাকে দেখতে না পাওয়ায় আমার মনটা ছটফট করতে লাগলো। কেমন দিশেহারা হয়ে গেলাম। ঠিক যেমন কোনও বাচ্চার হাত থেকে তার পছন্দের খেলনা নিয়ে গেলে কেঁদে দেয়। আমারও ঠিক তেমনি কাঁদতে মন চাইছিলো। কিছুুদিন পর অনেক কষ্টে জানতে পারলাম সায়ন ভাইয়ার বাবার চাকরীর জন্য সিলেট থেকে বদলি হওয়ায়, উনারা ঢাকায় চলে গিয়েছে। আমার তো তখন সত্যিই হাত-পা ছড়িয়ে কাঁদতে মন চাইছিলো। খুব কষ্ট হতে লাগলো। কিশোরী মনের প্রথম আবেগ বলে কথা।

এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেলো এভাবেই। কিছু দিন পর জানতে পারলাম সায়ন ভাই কোনও এক মেয়েকে পছন্দ করে। কিন্তু ভয়ে বা লজ্জায় নাকি মেয়েটিকে বলতে পারছিল না। কথাটি শুনে কেনো জানি কষ্ট হলো না। তার এভাবে দূরে যাওয়ার কষ্টটা এতো প্রখর ছিলো যে বাকি কষ্ট যেনো চোখেই পড়লো না আমার।

এরপর আরো ছয় মাস কেটে গেলো। হঠাৎ একদিন আমি তাকে দেখতে পেলাম আমাদের এলাকায়। আগের থেকে মাশাআল্লাহ আরো অনেক বেশি সুন্দর হয়ে গিয়েছে। সেদিন প্রথম আমি উনাকে পান্জাবী পরা অবস্থায় দেখেছিলাম। মাত্র দুমিনিটের দেখা ছিলো আমাদের। উনার মুখে সেদিনও সেই মারাত্মক হাসিটি লেগেছিলো। আর আমার মনে হলো সেই হাসিতেই আমি খুন হবো বারবার।

এভাবে কাটতে লাগলো সময়। উনি মাঝে মাঝে আসতো। তবে কেনো জানি দূর্ভাগ্যবশত আমার সাথে তার দেখা হতো না। মাঝে মাঝে তো এমন হতো আমি শুধু পিছন থেকে তার পিঠটা দেখার সোভাগ্য পেয়েছি। তার মুখটি দেখতেও পেতাম না। তবে একটা জিনিস খুব অদ্ভুত লাগতো, আমি দেখি বা না দেখি উনি আসলেই আমি বুঝতে পারতাম। সায়ন ভাই হয়তো এসেছে। আর আমি খোঁজ নেওয়ার পর কাকাতালিও ভাবে তা মিলেও যেতো।

এরপর শুরু হলো আবারও অপেক্ষা। দেখতে দেখতে আমার সপ্তম শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষা এসে পড়েছে। আর সেবার আমি তাকে লাস্টবারের মতো দেখতে পেলাম। সেদিন তার শরীরে ছিলো সাদা রং এর শার্ট, যার কারণে দেখতে তাকে ভীষণ চারমিং লাগছিলো। আমি তো চোখই সরাতে পারছিলাম না। কিন্তু কে জানতো এটাই ছিলো উনার সাথে আমার লাস্ট দেখা। এরপর উনাকে দেখার সৌভাগ্য আর হয়নি আমার। দিনের পর দিন অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার ছিলো না আমার। কারণ তখন আমার কাছে কোনও ফোন ছিলো না। আর তার খোঁজ নেওয়ার মতো কোনও পথ জানা ছিলো না। তাই শুধু নামায পড়ে আল্লাহর কাছে চাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় নেই আমার। তাকে ভীষণ দেখতে মন চাইতো, একবার ছুঁয়ে দিতে মন চাইতো। কিন্তু যাকে দেখাই দূর্লভ,তাকে ছোঁয়া তো আরও ইম্পসিবল। আমার ভীষণ কান্না পেতো। রাত দিন শুধু চোখের পানি ফেলতাম, কাউকে বলতে পারতাম না, আবার তার থেকে এভাবে দূরে থাকাটাও সহ্য হচ্ছিলো না।

প্রায় দেড় বছর কেটে গেলে এভাবেই। আমার জন্মদিন উপলক্ষে মামাতে ভাই সিয়াম এসেছিলো আগের দিন আমাদের বাসায়। ও আমার সম্পর্কে সবই জানতো। এমনকি সায়ন ভাইয়ার ব্যাপারটাও। এবার এসেই বলেছিলো, আমার কি চাই জন্মদিনে। যা চাইবো তাই নাকি দিবে। আমি সব সংকোচ ভুলে তার কাছে সায়ন ভাইকে একবার দেখতে চাইলাম। তাকে আনা তো সম্ভব না, তাই তার একটা ছবি হলেও চলবে। সে চেষ্টা করবে বলে চলে গেলো।

আমার জন্মদিনের দিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি সিয়াম আমার পাশে বসা। আমি উঠার পর আমার সামনে একটা ছবি ধরে। ছবিটি দেখে প্রথমে চিনতে কষ্ট হলেও পরক্ষনে আমি চিনে ফেললাম। এটা আমার সায়ন ভাই। সিয়াম ছবির সাথে উনার ফেসবুক আইডির লিংকটাও দিয়ে যায়। এরপর থেকে শুরু হয় এক নতুন গল্প।

মাত্র ক্লাশ নাইনে পড়তাম তখন আমি, তাই নিজের মোবাইল বলতে তখন কিছুই ছিলো না। তাই আম্মুর মোবাইল দিয়ে একটা নতুন আইডি খুলি এবং তাকে সাথে সাথে রিকোয়েস্ট পাঠাই। কিন্তু আফসোস, সাহেব আমার কোনও আননোন মেয়ের রিকোয়েস্ট একসেপ্ট করে না। তাই কি করবো, ভাবতে ভাবতে একটা গাধা মার্কা আইডিয়া এসে গেলো। তবে কাজ যে হবে তা আশা করিনি। আমি তার নামেই সেম আইডি খুলে এবার রিকোয়েস্ট করার পর একসেপ্ট করে নিলো। শুধু কি নিলো, আমাকে ম্যাসেজ করে ঝাড়তে লাগলো। আমি তার নামের সাথে নাম মিল রেখে কেনো আইডি খুলেছি। প্রথম প্রথম আমিও তার সাথে একটু দুষ্টুমি করি এরপর তাকে একদিন বলে দিই আমি তাকে ভালোবাসি। কিন্তু আমি তখনো উনাকে আমার পরিচয় দিই নাই। আসলে সাহসও পাচ্ছিলাম না। আমার কথা শুনে জানতে চায় আমি কোন ক্লাশে পড়ি। আমি যখন বললাম, আমি ক্লাশ নাইনে পড়ি। তখনই তার জবাব আসে, আমি তোমার মতো একটা পিচ্ছি মেয়ের সাথে প্রেম করতে যাবো কেনো। একথা বলেই আমাকে ব্লক লিস্টে পাঠিয়ে দেয়। হায়রে কপাল!

এরপর দিশা না পেয়ে আমি উনার ফ্রেন্ডসদের সাথে যোগাযোগ করি। আর জানতে পাই উনি নাকি একটা রিলেশনে আছে। প্রথমে বিশ্বাস হয়নি, পরে ভাবলাম সত্য হতেও পারে। কিন্তু এতে মনে হয় না আমার কোনও কিছু আসে যায়। কারণ ইম্পোর্টেন এটা নয় উনি আমাকে ভালোবাসেন কিনা, ইম্পোর্টেন তো এটা আমি উনাকে ভালোবাসি, সাথে শ্রদ্ধাও। এরপর আরও অনেক ফেক আইডি দিয়ে প্রায়ই উনাকে বিরক্ত করতাম। আর উনি বারবার আমাকে ব্লকে ঝুলিয়ে রাখতো।

আমার বাসার পাশে একটা হোস্টেল ছিলো। হোস্টেলের বারান্দায় একটা ছেলেকে প্রায়শই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতাম। ব্যাপারটা আমার ফ্রেন্ডসরাও খেয়াল করলো। তাই একদিন বলেই দিলো সায়ন ভাইকে ভুলে, যা একে ধরে ফেল। দেখতে খারাপ না, আর মনে হয় তোকে পছন্দ করে। এদের কথায় মাঝে মাঝে মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে যেতো। কিন্তু তখন আমার বেস্ট ফ্রেন্ড কেবল আমাকে শান্তনা দিতো। আর বলতো, যা ভাগ্যে থাকবে তাই হবে, আমি যেন মন খারাপ করে উল্টাপাল্টা কিছু না করি। ওর এসব কথাগুলো তখন মনকে শান্তনা দিতে খুব কাজে লাগতো। কিন্তু দিনদিন সায়ন ভাইয়ের অবহেলাও আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিলো। পাঁচ বছর ধরে যে মানুষটিকে ভালোবেসে আসছি তাকে ভুলা কি এতোই সহজ, ভুলতে পারছিলাম না। তবে একটা অভিমানের পাহাড় হৃদয়ে ঘর করছিলো।

এভাবেই দিন কাটতে লাগলো। বয়সের সাথে সাথে কিছু ম্যাচিউরিটিও আসতে লাগলো। মাঝে মাঝে নিজেকে তখন নিজেই প্রশ্ন করতাম, উনি আমার জীবনে না আসলে হয়তো আমার জীবনটা অন্য রকম হতো। আসলেই কি অন্যরকম হতো। ভাবতে পারতাম না কিছু। কারণ মন যে এখনো তার কাছেই পড়ে আছে। এরপর আস্তে আস্তে আমার এস এসসি পরীক্ষা সামনে এলো। আর তখনই একটা সত্য জানতে পারলাম, উনার সত্যি জিএফ আছে। এতোদিন এটা শুনে খারাপ না লাগলেও, এখন কেনো জানি একদম সইতে পারলাম না। তাই রাগে ফেসবুকে উনাকে একটা ম্যাসেজ করলাম। আর নিজের পরিচয় দিয়ে দিলাম। সাথে এটাও বললাম, আমি মরে গেলেও আর কোনও দিন উনাকে ম্যাসেজ করবো না। এরপর নিজেই উনার উত্তর জানার আগেই লগআউট হয়ে গেলাম।

মনকে এই বলে শান্তনা দিতে লাগলাম, উনি হয়তো কখনো আমাকে সেই নজরে দেখেনি। আমি শুধু শুধু মরিচিকার পিছনে ছুটে গেলাম। দিনদিন উনার প্রতি আরো অভিমান জমা হতে লাগলো। মুখে সবার সামনে হাসি রাখলেও, দিনশেষে যখন রাত হতো আমার কষ্ট তখন চোখের জলে গড়িয়ে পড়তো। এভাবে পার হয়ে গেলো কয়েক বছর, আমি এখন তারই শহরে ইন্টার্ন সেকেন্ড ইয়ারে পড়ছি। সব সময় ভাবতাম তার কলেজের আশেপাশেই ভর্তি হবো, আর তাই হলো। আমার কলেজ থেকে তার ভার্সিটি যেতে মাত্র ২০ মিনিট লাগতো। তবুও কখনো চেষ্টা করিনি আর তার সাথে দেখা করতে। কেনো করবো সে তো চায়না আমাকে। আমি চাই কিনা তাতে কি। যে আমার না, তার জন্য কাঁদা বৃথা। তাই চেষ্টা করতাম তাকে যাতে আর মনে না পড়ে।

আমার বিয়ের জন্য তখনও কোনও চাপ ছিলো না, কিন্তু হঠাৎ সব উলোটপালট হয়ে গেলো। আমি ভাবতেও পারিনি আমার জীবনে এমন কিছু হবে।

সময়টা ছিলো এইচ এসসি পরীক্ষার বিদায় অনুষ্ঠানের দিন। অনুষ্ঠান শেষে আমি বাড়ী চলে গেলাম। সবার কাছ থেকে দোয়াও চেয়ে নিলাম বেশি করে, যেন পরীক্ষা ভালো করে দিতে পারি। এরপর শানুকে সাথে নিয়ে একটু শপিং করতে বের হয়েছিলাম, কিন্ত কিছুক্ষণ পর মা ফোন দিয়ে তাড়া দিতে লাগলো, তাড়াতাড়ি বাড়ী যাওয়ার জন্য। আম্মুর তাড়া পেয়ে দুজন বাড়ীর দিকে আবার রওনা দিলাম। সন্ধ্যা হয়ে পড়ছিলো, এদিক দিয়ে একটা রিকশাও পাচ্ছিলাম না তাই আমি আর শানু দুজন হেঁটেই বাড়ীর দিকে চললাম। আমাদের বাড়ীটা মেন রাস্তা ছেড়ে গলির দিকে ছিলো, তাই আশেপাশে কোনও দোকানও ছিলো না। যথেষ্ট নিরব আর জনমানব শুন্য ছিলো। আর তখনই একটা গাড়ী হর্ণ বাজাতে লাগলো সাইড দেওয়ার জন্য। গলিটা এমনেই চিপা তার উপর এতোবড় গাড়ী ঢুকলে, কেমন লাগে। সাইডতো দিয়েছিলাম, কিন্তু রাগে একটা লাথিও মারলাম গাড়ীটিতে। এমনেই মেঝাজ চটে আছে তার উপর আমার মা জননীর কলের পর কল। উফ! সারা দুনিয়ার প্যারা কি আজই এলো।

বাড়ীর সামনে এসে আমি আশ্চর্যান্বিত। কারণ কিছুক্ষন আগে লাথি মারা গাড়ীটি দাঁড়িয়ে আছে আমার বাড়ীর সামনে। ব্যাপারটা আমি তেমন মাথায় নিলাম না। কিন্তু হঠাৎ আমার মা জননী দৌড়ে এলো, মনে হয় ম্যারাথনে অংশ গ্রহণ করেছে। এসেই আমাকে সামনের গেট দিয়ে ভেতরে না নিয়ে উল্টোদিক দিয়ে বাড়ীর ভেতরে ঢুকালো। আর আমি অবুঝ শিশু কিছু না বুঝেই ভেতরে ঢুকে নিজের রুমে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ পর আমার বোন আর ভাবী এলো আমাকে রেডি করাতে। আমি অবাক নয়নে তাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম কেনো। তারা যা বললো, তা শুনতে রেডি ছিলাম না আমি। মনে হয় আসমান হঠাৎ আমার মাথায় ভেঙ্গে পড়লো। আমাকে নাকি দেখতে এসেছে। কি বলে এসব। আমি রেগে যাই একটু, এসব কি বলছো আপু। ঠিকই বলছি, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে পড়। ওরা বসে আছে পছন্দ হলে নাকি আজই কাবিন করে ফেলবে। মগের মুল্লুক পাইছো, তোমরা জানো না, আমার কলেজে বিবাহিত মেয়েদের এলাউ করে না। তাহলে তোমরা কি করে এটা করতে পারলে। আমাকে একবার জিঙ্গেস না করে। আপু বললো, আপু জানে না। ছেলেকে নাকি ভাইয়া আর আম্মু চিনে। আর তাই ওকে জিঙ্গেস করার প্রয়োজন মনে করেনি। আমি এবার রেগে আমার ভাবীর দিকে তাকালাম, কয়েকটা কিল দিলাম ওর পিঠে। বেইমান আমার বান্ধুবী হয়েও আমার সাপোর্ট না করে, ভাইয়ের বউ হয়ে গেলি। ননদকে তাড়াবার এতো জলদি কেন তোর। ওকে কিছুক্ষণ বকেঝকে চুপ হয়ে গেলাম। খুব কান্না পাচ্ছে এখন আমার। এ কোন ঝামেলায় পড়লাম আমি। সত্যি বলতে, আমি না সায়ন ভাইকে ভুলতে পারিনি এখনও। উনার জায়গায় অন্য কাউকে কল্পনা করতেও কেমন জানি কাঁপুনি দিয়ে দিলো শরীরে।

সং সেজে বসে আছি পাত্র পক্ষের সামনে মাথা নতো করে। চোখ দিয়ে এখনো পানি পড়ছে আমার। তারা অনেক কথা বলছে কিন্ত তাদের কোনো কথা আমার কানে পৌঁছাচ্ছে বলে মনে হয়নি। অবশেষে তাদের আমাকে পছন্দ হয়েছে। তাই তারা মিলে ডিসাইড করলো আজ কাবিন করবে আর আমার পরীক্ষার পর উঠিয়ে নিয়ে যাবে। আমার কিছুই করার ছিলো না। অবশেষে বিয়েটা হয়ে গেলো। আমি কেমন ঘোরের মধ্যে ছিলাম। কার সাথে বিয়ে হলো, কেমন দেখতে কিছুই জানি না আমি। শুধু জানি আমি আজকের পর থেকে অন্য কারো। ভাবতেই মরে যেতে মন চাইছিলো। রাগ করে আমি আমার রুমের বেলকনিতে বসে কাঁদছিলাম। শানু আমাকে বারবার শান্তনা দিতে লাগলো। কিন্তু সব কিছু কেমন বিষাক্ত মনে হচ্ছে আমার কাছে। হঠাৎ একটা পুরুষালি কন্ঠ আমার কানে বারি খেলো। আমার বুঝতে বাকি রইলো না কে সে। কিন্ত আমার তার সাথে কথা বলার কোনও ইচ্ছা নেই। কিন্তু তার ত্যাড়ামো দেখে রাগে বসা থেকে উঠে কিছু বলতে নিবো, তার আগেই আমি ৪৪০ ভোল্টেজ শক খেলাম। এ তো সায়ন ভাইয়া। কি হলো আল্লাহই জানে, উনাকে এতো বছর পর দেখে সব রাগ অভিমান ভুলে জড়িয়ে ধরলাম। এরপর হঠাৎ মনে হলো আমার তো বিয়ে হয়ে গেছে। তাহলে উনি এখানে কেনো। আমি তখনই উনাকে ছেড়ে দুকদম পিছে চলো গেলাম। আপনি এখানে কি করেন। বাহিরে যান। কেউ দেখলে কি বলবে।

"আরে বাহ! আমার বউয়ের ঘরে আমি আসবো নাতো কে আসবে বলো।"

তার মুখে বউ শব্দটি শুনে আমি সব গুলিয়ে ফেলছি। কি বলে উনি।

"মানে!"

"মানে! কাকে বিয়ে করছো, নামটিও মনে হয় শুনোনি। আর নাম কি, চোখ তুলে বরকে তো একবার দেখলেও না। বর যদি কানা, বয়ড়া বা ট্যারা হতো তখন তোমার কপাল পুড়তো বুঝলে।"

তার মানে আমার বিয়ে উনার সাথে হয়েছে। হায় আল্লাহ! এটা কি সত্যি নাকি স্বপ্ন, আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। কেউ এসে আমাকে একটা চিমটি মারো। কিন্তু উনিতো স্বয়ং আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তাই অবিশ্বাসের কিছুই নাই। আমার এতো খুশি লাগছিলো কি বলবো। পারলে আমি এখন লুঙ্গি ডান্স দিই। কিন্তু আপাততো মনের খুশিকে মনেই দমিয়ে দিলাম। মুখে একটু মেকি রাগ দেখিয়ে বললাম,

"তাতে কি? আপনি আমার রুম থেকে আপাততো বের হন।"

কিন্তু উনি আমার কথা মনে হয় আমলেই নিলো না, রুমে গিয়ে আমার বেডে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো। আমি তো অবাক! আমাকে এভাবে দেখে উনি বললো,

"টেনশন নিয়ে লাভ নেই বউ। আজতো আমি এখানেই থাকবো। তাও আবার আমার বউয়ের সাথে।"

তাকে নিজের রুম থেকে বের করতে না পেরে, রাগে বিরবির করতে করতে মায়ের কাছে নালিশ দিলাম। মা আমাকে উল্টো ধমক দিয়ে রুমে পাঠিয়ে দিলো। রুমে এসে দেখি সাহেবে কি সুন্দর বিছানায় শুয়ে শুয়ে মোবাইল টিপছে। আমি গিয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রইলাম। হঠাৎ সায়ন পিছন দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরে। এই প্রথম তার স্পর্শ পেলাম। আমার পুরো শরীর মৃদ কেঁপে উঠে। উনি থুতনি ঘাড়ে রেখে বলে,

"এখনো কি রেগে আছো?"

তার এ কথায় জমে থাকা অভিমানটা আবারও যেনো দলা বেঁধে বের হয়ে এলো। এতো বছরের আমার কষ্টগুলো কি এতো সহযেই ভুলা যায়, না যায় না। তাই তাকে নিজের থেকে সরিয়ে, একটু জোর গলায়ই বললাম,

"আমার কাছে আসবেন না।"

কিন্তু উনি থামলেন না, বারবার আমার কাছে এসে বুঝাবার চেষ্টা করছে আমাকে। তার থেকে বাঁচার জন্য আমি ওয়াশরুমে ঢুকে গেলাম। বেশ কিছুক্ষন ওখানেই বসে রইলাম। কি কপাল আমার, এখন ওয়াশরুমে বিনা কারণে বসে থাকতে হয়। কিছুক্ষন পর বের হয়ে দেখি, উনি এখনো বিছানায় শুয়ে মোবাইল টিপছে। আমি চিন্তায় পড়ে গেলাম ঘুমাবো কোথায়। উনি আমার অস্থিরতা বুঝতে পেরে, টোন মেরে বললো,

"নো চয়েজ বউ, তোমাকে আমার সাথেই বিছানায় শুতে হবে।"

আমার মেজাজ বিগড়ে গেলো। আমি কোলবালিশটা মাঝখানে রেখে বিছানার একপাশে শুয়ে পড়লাম উল্টোদিক মুখ করে। হঠাৎ উনি বললেন,

"রাস্তায় তাহলে এসব করো।"

আমি বিস্মিত হয়ে উনার দিকে তাকালাম।

"মানে?"

"মানে এই যে, গাড়ীতে লাথি দেওয়া, বকা দেওয়া।"

আমি লজ্জা পেয়ে গেলাম। তখন যদি জানতাম গাড়ীতে উনারা ছিলো, তাহলে কি এই গাধামি করতাম। নো! আমি কিছু বলবো, তখন উনি আমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে ফেলে বলতে লাগলো,

"আমাকে তুমি ছোটবেলা থেকেই এতো পছন্দ করতে, তাহলে কখনো বলোনি কেনো? তুমি কি জানতে আমি একজনকে পছন্দ করি?"

আমি মাথা নাড়ালাম।

"জানো মেয়েটা কে?"

আমি আবারও মাথা নাড়িয়ে না বললাম।

"সেই মেয়েটি তুমি অন্তি। আমিও তোমাকে অনেক আগে থেকেই পছন্দ করতাম। কিন্তু তুমি ছোট ছিলে বলে, বলা হয়নি। এরপর তো আমাদের ঢাকায় চলে যেতে হয়েছিলো। তুমি ফেক আইডি দিয়ে আমাকে জ্বালাতে, পরিচয় দাওনি বলে, তোমার থেকে পিছা ছুটাতে বলি আমার জি এফ আছে। আর তুমিও বোকা মেয়ে বিশ্বাস করে, পরিচয় বলে দিলে। কিন্তু আমাকে কিছু বলার সুযোগও দিলে না। যদি দিতে তাহলে সেদিনই জানতে পারতে আমার মনের কথা। চেস্টা করেছিলাম, তোমার সাথে কন্টাক্ট করতে, কিন্তু পারিনি। এরপর কিছুদিন পরই আমাকে মালোশিয়াতে চলে যেতে হলো। তোমাদের পরিবারের সাথে আমাদের পরিবারের ভালো সম্পর্ক ছিলো বলে, প্রস্তাব দেওয়ার সাথে সাথে তারা রাজি হয়ে যায়। আর বিয়েটাও করতে সহজ হয়ে যায়।"

আমি একটু অভিমান নিয়ে বললাম,

"তাহলে আমাকে আগে কেনো জানালেন না? তাহলে তো এতো কষ্ট পেতে হতো না।"

"আরে পাগলী কষ্ট কেবল তুমি পাওনি, আমিও তো পেয়েছি। আমি তো জানতামই না তোমার মনের কথা, তাই তো নিজেই দূরে সরে সরে থাকতাম।"

এরপর উনি উনার লাইফের সব কথা বললো। সেদিনের পর থেকে অনেক ঝামেলায় ছিলো, তাই আমার সাথে যোগাযোগ করতে পারেনি। সারারাত আমরা গল্প করে কাটিয়ে দিলাম। ভোররাতে দুজনেরই চোখ লেগে গিয়েছিলো।
সকালে ঘুম থেকে আগে আমি উঠে পড়লাম, ফ্রেস হয়ে রুম থেকে বের হওয়ার পর সারাদিন আর তার সামনে যাইনি। কেমন যেনো এক অদ্ভুত ফিলিং এসে জড়ো হয়েছে মনে। যাকে পাওয়ার জন্য এতো অকুলতা ছিলো মনে সারা জীবন, সে মানুষটি থেকে আজ আমি লজ্জায় পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছি। কি আশ্চর্য!
তাদের যাওয়ার সময় হয়ে গিয়েছে বলে, আমার ভাগ্নিকে দিয়ে ডেকে পাঠালেন উনি। আমি যাচ্ছি না বলে, আমার ভাবি আর বোন মিলে আমাকে ঠেলে রুমে পাঠিয়ে দিলো। রুমে গিয়ে দেখি উনি রাগ করে বসে আছে, সারাদিন দেখা করিনি বলে। আমিও মেকি হাসি দিয়ে তাই জিঙ্গেস করলাম, ডেকে ছিলেন আমায়। কিন্তু কিছু বলছে না দেখে, আমি চলে যেতে নিলে আমাকে আটকিয়ে ফেলে। আমাকে নিজের একদম কাছে টেনে একটা কিস করে। আমি তো পুরোই শকড!

"কি হলো এটা?"

"প্রতিশোধ নিলাম। সারাদিন আমার থেকে পালানোর জন্য।"

উনি এটা বলেই চলে গেলো। আর আমি এখনো মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলাম।
ঠিক হলো আমার পরীক্ষার পর তুলে নিয়ে যাবে আমাকে। কথামতো তাই হলো। আমার পরীক্ষার পরই আমার আর উনার ধুমধাম করে বিয়ে হলো। তবে পরীক্ষার সময় উনি প্রতিদিন আমার সাথে দেখা করতে আসতো। আমাকে উনার বাইক দিয়ে শহর ঘুরাতো।
বর্তমানে আমি এখন মালোশিয়ায় আমার বরের সাথে। আমাদের ঘর আলো করে এসেছে আমার ছেলেমেয়ে, মানে টুইন বেবি। আমি এখান থেকেই আমার বাকি পড়াশুনা চালিয়ে যাচ্ছি। আলহামদুলিল্লাহ আমি সুখে আছি। মাঝে মাঝে সব কিছু স্বপ্নের মতো মনে হয়। আমি কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি আমার ভালোবাসা পরিপূর্ণ হবে। আল্লাহর রহমতে আমি পেয়েছি আমার প্রথম ভালোবাসাকে। আমার সারা জীবনের একটাই উনি।


***(সমাপ্ত)***

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন