অরন্যবেলা - ফারহানা আক্তার ছবি - অনু গল্প

পড়ুন ফারহানা আক্তার ছবি'র লেখা একটি অনু গল্প অরন্যবেলা
অরন্যবেলা
অরন্যবেলা by ফারহানা আক্তার ছবি

আঁকাবাঁকা উঁচু নিচু পাহাড়ি পথটা সাপের মতন বেয়ে গেছে অনেকটা দূর। অরন্যের মনটাও আজ এই পাহাড়ি সর্পিল রাস্তার মতনই এঁকেবেঁকে চলছে এদিক ওদিক। গত বর্ষায় সিলেটের এক পাহাড়ি এমনই এক রাস্তায় দেখা মিলেছিলো বেলার। সে বেলা অরন্যের বেলা কে জানতো, তা ছিলো বেলার অন্তিম বেলা! বাইকে চড়ে প্লেনে উড়ার মত সুখের ঘুরনে ব্যস্ত অরন্য ছোট্ট একটা দূর্ঘটনার শিকার হয় সেই সর্পিল রাস্তায়। বাইকের সামনে পড়ে বেলা তাওহীদ। মায়ের সাথে হেঁটে বেড়াচ্ছিলো মেয়েটা একটুখানি স্বস্তিভর্তি নিঃশ্বাসের আশায়। কে জানতো সেই স্বস্তি পাহাড়ি প্রকৃতির উর্ধ্বে গিয়ে দূর্ঘটনা তাকে স্বস্তিময় সুখের সন্ধান দিবে! বাইকের সামনে পড়ে যাওয়া বেলাকে টেনে উঠাতে গিয়ে অরন্য টের পেল তার চোখের পাতা আর বুজতে চায় না। হৃদযন্ত্রটাও সেদিন বেঁকে বসেছিলো বেলাকে দেখে৷ ধক্ ধক্ করবে তো শুধুই বেলার জন্য আর বেলা, সে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে গিলে খেয়েছিলো অরন্যকে। পায়ে যে চোট বাইকের ধাক্কায় লেগেছিলো তারও অধিক লেগেছিলো অরন্যের হ্যাংলাপনা দৃষ্টিতে। অরন্য তখন জোর করেই হাসপাতাল অব্ধি বেলাকে নেয়। মুহূর্ত মুহূর্ত অস্থির কাটে অরন্যের কি করে মেয়েটাকে স্যরি বলা যায় তাই ভেবে। বেলার মা হাসিমুখে অরন্যকে দূর্ঘটনা থেকে দায়মুক্ত করতে চাইলেও অরন্য দায় ছাড়েনি। বেলার পা ব্যান্ডেজ করিয়ে আবার তাদের বাড়ি পর্যন্তও পৌছে দিয়েছিলো।
এরপর....

মাস দুই পরে আবার দেখা মিলল পাহাড়িকন্যা বেলার। অরন্য সেদিনও ঘটালো দূর্ঘটনা৷ তবে সেই দূর্ঘটনা আর কাউকে হাসপাতালে নয় নিয়ে গিয়েছিলো নির্জন পাহাড়ি অরন্যে। প্রথম দেখায় ভালোলাগা আর দ্বিতীয় দেখায় ভালোবাসা এতটুকু জানাতেই অরন্য বন্দিনী করে নিয়েছিলো বেলাকে। বেলা কি মনে করে যেন একটুও ঘাবড়ায়নি অরন্যের আচরণে। হয়তো নিজের জীবন প্রদীপের নিভু নিভু সলতেটার কথা ভেবেই সে চুপচাপ অরন্যের ঘটানো দূর্ঘটনায় চুপ ছিলো। নিরিবিলি নির্জন পাহাড়ি গাছে ভরা এক অরন্যে মুখোমুখি দাঁড়ায় বেলার। প্রকাশ করে তার মনের ভেতর চলতে থাকা সকল ঝড়ের। বেলা নিস্পৃহ ভাবেই সবটা শোনে; কি হবে এই ভালোলাগা আর হঠাৎ ভালোবাসার কথা শুনে! নিজেই যেন নিজেকে প্রশ্ন করে সে৷ অরন্য যখন নিজের মনের সকল আবেগ এক এক করে বেলাকে জানায় বেলা তখন ছলছল চোখে প্রকৃতিকে অবলোকন করায় ব্যস্ত। কাছেই কোথাও একটা পাখি ডাকছে কুই কুই করে। দিনটাও তখন পশ্চিমে হেলতে লাগলো। বেলার মনে হলো তার জীবনটাও ঠিক এই দিনের মতোই হেলে গেছে শেষ প্রান্তে। আর একটু বাদেই সন্ধ্যা নামবে ধরনীকে অন্ধকরারের চাদরে মুড়িয়ে। ঝাপসা চোখেই যেন বেলা গভীরভাবে দেখার চেষ্টা করলো অরন্যকে। হায়! শেষ সময়ে কি স্পষ্ট দেখা যায় নিজের অদৃষ্টকে? সামনের ছেলেটা ভালোবাসার মিষ্টি কথাগুলো তাকেই কেন বলতে এলো! তারই বা কেন এই হঠাৎ দেখা ছেলেটাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে করছে? সময় তো তার বিরুদ্ধে কথা বলছে। একটু একটু করে কেড়ে নিচ্ছে তার সময়টুকু। এখনই কেন আসতে হলো এই ছেলেটার তার জীবনতরীতে! বেলা নিঃশব্দে অরন্যের মনভবনের প্রতিটি ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষার কথা শুনলো। কি বলবে সে? কি বলা উচিত জানে না, তাই অরন্যের কথা শেষ হতেই চুপচাপ হেঁটে গেল নিজ গন্তব্যে। অরন্য তখনও জানতো এই মেয়টা এই সুন্দর পৃথিবীতে আর মাত্র কটা দিনের অতিথি। দুনিয়া ছেড়ে তো সবাই যাবে কিন্তু ক'জন আগেই জানতে পারে তার সময় কতটুকু? বেলা জেনেছিলো, কেঁদেছিলো কিন্তু আফসোস করেনি এই যাওয়ার সময়টা জেনে। অরন্য কেন আগে এলো না তার জীবনে? কেন একটুখানি ভালোবাসার ভাগ্য তার হলো না!

বাতাসে গা ছমছমে একটা ভাব। গাছের পাতায় পাতায় শিরশিরে আচরণ। আকাশে মেঘের দেখা নেই তবুও মেঘলা মেঘলা আঁধার প্রকৃতিতে। অরন্য রাস্তার কিনারায় ঘাসের ওপর পা ছড়িয়ে বসে পড়লো৷ ক্লান্ত লাগছে খুব, কিন্তু কেন? সে তো আজ সারাটাদিন কোন কাজে হাত দেয়নি। রাতের ট্রেনে ঢাকা থেকে সিলেটে এসেছে৷ হোটেলে উঠে ঘুম দিয়ে তবেই এই পাহাড়ি রাস্তায় এসেছে। আজ আর সে এই রাস্তায় তার বেলাকে খুঁজতে আসেনি। এসেছে বেলার দু'দিনের দু'টুকরো স্মৃতির সাথে সন্ধি করতে৷ হঠাৎ দেখা মেয়েটির স্বর্ণলতার মত মুখটাকে স্মৃতির পাতা থেকে টেনে একটুখানি দেখে নিতে৷ কল্পনা সে বেলাকে ঢাকার ইট পাথুরে দেওয়াল ঘরে বসেও করতে পারে। কিন্তু সেই কল্পনাতে বেলা মৃত, অচল অথচ সেই একই কল্পনা এই পাহাড়ি রাস্তার ধারে কিংবা নির্জন অরন্যে হয়ে ওঠে জীবন্ত। বেলা মারা গেছে বছরখানেক আগে অরন্য যেদিন তাকে তুলে নিয়ে জঙ্গলের পথে এসেছিলো। বলেছিলো মনের কোণে ভেসে ওঠা প্রতিটি শব্দদ্বয়। সে দিন পেরিয়ে রাতেই নিঃশ্বাসের ছুটি হয়েছিলো বেলার।

বহুদিন কাঁদেনি অরন্য৷ তার বেলার জন্যও না, কিন্তু আজ আকাশের মেঘরাশি চুপিচুপি বয়ে যাওয়ার বায়না করছে। সেই সাথে বায়না ধরেছে চোখের অশ্রুরা। কায়মনোবাক্যে অরন্য প্রার্থনা করছে নামুক বৃষ্টিরা, আসুক বেলাশেষের রাঙা আলো মুছিয়ে দিয়ে। ঘোর অন্ধকারে ডুবে যাক এই ধরা, অরন্য কাঁদবে আজ।


***(সমাপ্ত)***

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন