--আপনি ছাড়বেন! নাকি ধাক্কা মারবো!
--মেরে ফেল। সঙ্কোচ নেই।
--আশ্চর্য! আপনি ত্যাড়ামি করছেন কেন?
--তোর থেকে শিখেছি। এখন আমি প্রয়োগ করছি।
--ঔষুধটা নিয়ে আসি, প্লিজ! আচ্ছা দশ পযর্ন্ত গুনতে থাকুন। আমি না আসলে টর্চার করে দিয়েন।
--নো!
--তাহলে পাচঁ।
--না।
--তিন। তিন পযর্ন্ত কনফার্ম। আমি তিন গুনার মধ্যেই চলে আসব।
--সত্যি?
--সত্যি।
উনি বামহাতটা একটু আলগা করলেই আমি হুড়মুড়িয়ে উঠে যাই। উনি গুণা শুরু করেছেন-- এক.। দৌড়ে টেবিলের শেষ ড্রয়ার থেকে ঔষুধের পাতা বের করি।--দুই. ফ্লোরে রাখা ওয়াটার বোতল নিয়ে উনার মাথার কাছে বসতেই উনি 'তিন' গুণে শেষ করলেন।
--উঠুন। আমি নিয়ে এসেছি।
উঠে বসে ঔষুধটা খেয়ে নিলেন মুগ্ধ। শরীরে জ্বর চলে এসেছে। পান্জাবী এখনো ভিজা, উনার কোনো পোশাক নেই, আবার কাথাও ওই রুমে রাখা। আমার ওড়নাটা নিয়ে আবার আগের মতো শুয়ে পড়ি। উনিও ব্যান্ডেজের হাতটা ধীরে ধীরে আমার উপর রাখলেন। উনার উপর ওড়নাটা দুইভাজে মোটা করে দিয়ে দেই। গায়ে জ্বর।
--জানালার ওখানে ভিজতে গেলেন কেন?
--বৃষ্টি ভালো লাগছিলো।
--এখন যে জ্বর আসলো?
--কার সাথে আছি দেখতে হবে না?? জ্বর সেদিনের মতোই চলে যাবে।
--ঘুমান মুগ্ধ। জ্বর সেরে যাবে।
--খালি গায়ে প্রেম প্রেম জাগছেনা? তোর হট হ্যান্ডসাম বর শুয়ে আছে তুই জাস্ট নরমাল! কয়েকটা চুমু চাইলে দিতে পারিস! আমি মাইন্ড করবো না।
--আল্লাহ! আপনার আবার সেদিনের মতো জ্বরের মাথা ধরলো!! আবোলতাবোল বলা শুরু করছেন!!
--আমি সেন্সে আছি ছাগল! ফুল অন এক্টিভ মাইন্ড। আচ্ছা কিস টিস করতে ইচ্ছে করে না?অন্য মেয়ে হলে তো বাসররাত বানিয়ে ফেলতো। হাও রোমান্টিক! "প্রতি বাইটেই চুমু!"
--রূপাকে ডাকবো !
--দিলি তো মুডটা বিগড়িয়ে। ওর নাম নেওয়ার দরকার কি ছিলো! ইরিটেটিং!
--আপনি লুতুপুতু শুরু করেছেন কেন! জ্বর এসেছে ধ্যান নেই!
--জ্বর জ্বরের কাজ করছে আমি আমার কাজ।
--দেখুন! আজেবাজে কথা বন্ধ করে ঘুমান!
নিশ্বাস গরম উত্তাপ। নাক দিয়ে, মুখ দিয়ে জ্বরের কবলে গরম শ্বাস ছাড়ছেন। কারেন্টও নেই, সামান্য বাতাস ছাড়লেই বিদ্যুৎ ঘায়েব। কপালে চুমু একে দিলাম। উনি চেপে ধরলেন।
--ডিভোর্সের কথাটা বলবি না। আমাদের মধ্যে যত মনোমালিন্য হোক ডিভোর্স আসবেনা। আমি আর পরেরবার বোঝাতে পারবো না।
--কোথায় যাবেন?
--মরেই যাবো।
--কি বললেন!
--ভর্তিকোচিংয়ে এডমিট করাবো?
--আপনি কথা ঘুরানো বন্ধ করবেন!
--কাল সকালে আমার পরিচিত একজনকে বলে দিচ্ছি তোর এ্যাপ্লিকেশন গ্রান্টেড করতে।
--দেখি ছাড়ুন! আমি বুঝেছি আপনি আমার কথার জবাব দিবেন না।
--না দিবো বল।
--আপনি কোথায় যাবেন!
--চিটাগাং যাবো।
কথাটা শুনে মাথা ঝিম ধরে আসলো। এতোদূর যাবেন? আমায় রেখে? আমার কি অবস্থা হবে!
--টিচাগাং যাবেন??? কেন? আমি! আমি কোথায় যাবো?
--স্পেশাল ট্রেনিং আছে। তিনমাসের মধ্যেই চলে আসব।
--তিনমাস! আপনি তিনমাসকে তিনদিন ভাবছেন! এতো সহজভাবে বলে দিলেন তিনমাসের মধ্যে চলে আসবেন!
--ট্রেনিংটা দরকার পাকনি। ওটা কমপ্লিট করলে নলেজ এন্ড প্রোমোশন দুটোই বাড়বে।
--আমি? একা থাকবো?
--একা কোথায়? আমি আছি তো। ফোনে ফোনে যোগাযোগ রাখবো। আর মনিরা সার্বক্ষনিক তোর সাথে থাকবে। ফ্ল্যাট বাসাটা খালি রয়ে গেছে। চাবিটা পকেটে রাখা, নিয়ে নিস।
--আপনি তিনমাসের জন্য চলে যাবেন! তিনমাস মুগ্ধ! আমি এখানে সবার মাঝে একা কিভাবে? মুখ চালানোর স্বভাব তো কারোর বন্ধ হয়নি!!
--পড়াশোনা। চব্বিশ ঘন্টা পড়াশোনা করবি। কোত্থাও মন দেওয়ার দরকার নেই। তুই মুর্খ না! না তুই কোনো ভুল করেছিস। রাদিফ মুগ্ধের বউকে কেউ কিছু বলবে... চটান করে মুখের উপর জবাব দিয়ে দিবি।
--আমি ইন্জিনিয়ারিংয়ে চান্স পাবো?
--পাবি না কেন। অবশ্যই পাবি! তোর পাওয়া লাগবেই! তুই পাবি!
--যদি না পেলাম?
--লুজারের মতো কথাবার্তা বলবি না! আমার মতো হতভাগার ভাগ্যে সাকসেস আসলে তোর কেনো হবেনা? লিসেন! যা দরকার যা প্রয়োজন আমি এফ্রড করবো! তুই জাস্ট আমাকে ইন্জিনিয়ারিং ভার্সিটিতে চান্স পেয়ে দেখা।
--আপনি প্রেসার দিচ্ছেন...
--যেটা ভাবিস!
এইচএসসির পর পড়াশোনা তো দূরে থাকুক, ধারের কাছেও যাইনি। ছুয়েও দেখিনি বইখাতার হালচাল কেমন। হুট করে সব প্রেসার নেওয়াটা কষ্টকর হলেও উনার কথা মান্য করা ছাড়া আমার মধ্যে অন্যথা কোনো উপায় নেই। উনি ডাক্তার। আমি কিছুই না। আমাকেও কিছু করতে হবে। সবার মুখে সেলাই লাগিয়ে মাথা উঠিয়ে চলতে হবে। তিনমাস দূরে থাকবেন, তিনমাস কাছে থাকবেন না। এই একটা মানুষ যে আমাকে সব বালা-মসিবত থেকে দূরে দূরে রেখেছেন উনি এখন ঢাকা থেকে দূর চিটাগাং পাড়ি দিবেন, তিনমাস। উনার কপালে ঠোট লাগিয়ে শুয়ে আছি, মাথা ভনভন করছে। কি করবো, কিভাবে টিকবো, স্বপ্নপূরনে পর্দাপন সহ বহুমুখী চিন্তা আমার মাথায় আষাঢ় ঘনিয়ে এসেছে। শরীরে উনার কিছুটা গরম কেটেছে। কিন্তু গরম। ঘুমিয়েছেন কিনা চেক করিনি। আমি চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। আস্তে করে উষ্ণ গলায় বললেন-
--মম পাকনি, মন ও মাথায় চাপ নিস না। সবসময় মনে রাখবি- "ভয়, ভরসা, ভালোবাসা"। তিনটা "ভ" দ্বারা গঠিত শব্দ তোর ও আমার তিনটা মাসের দূরত্বের মধ্যে কায়েম থাকবে। প্রথম মাসে, আমাকে ছাড়া তোর ভয় লাগবে। দ্বিতীয় মাসে, আমাকে নিয়ে ভরসা বাড়বে। তৃতীয় মাসে, আমাদের মধ্যে ভালোবাসাটা মজবুত হবে। এরপর নতুন করে আমরা পুরোটা শুরু করে হাসিখুশি থাকবো। তো...তিনটা মাসে তিনটা শব্দ নিয়ে তোর পড়াশোনা শুরু হোক!!
স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়লাম। মনটা কেমন শান্ত ঠান্ডা করে দিলেন, কোনো এক বিন্দু চিন্তাপ্রবণতা কাজ করছেনা। সব উবার সাগরে তলিয়ে গেছে। মনোবল, উৎসাহ, উদ্দীপনা বাড়িয়ে মুগ্ধ সাহেব পাগল বানিয়ে দিচ্ছেন।উনার কথাগুলো মনটা শান্ত করতে বলিয়ান। শান্তি শান্তি লাগে মনে। উজাড় করা শান্তি। মনের মধ্যে শব্দমালা চলছিলো, ভয়...ভরসা...ভালোবাসা...তিন 'ভ'-তে তিন মাস পার।
.
.
সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেশ হয়ে উনার জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। ডাক্তার সাহেব ঘুম থেকে উঠে গেছেন। আমি কফি নিয়ে রুমে ঢুকে দেখি উনি পান্জাবীর উল্টো পিঠ একহাতে ঠিক করছেন। বামহাত স্থির।
--ডাক্তার সাহেব!! থামুন। আমি পড়িয়ে দিচ্ছি। স্টিচে বেঘাত ঘটবে।
উনি হাসলেন। আমার মনোমুগ্ধকর ডাক্তার সাহেব হেসে দিলেন!! কফি টেবিলের উপর রেখে উনার হাত থেকে পান্জাবী নিলাম। পান্জাবীটা ঠিক করে দুইহাতে মাথা বরাবর ধরে উনার মাথা নিচে ঝুকাতে বললাম। উনি একগাল মুচকি হেসে আমার নাকটা টেনে মাথাটা ঝুকালেন। পান্জাবী ঠিক করে পড়িয়ে আমি কফির মগটা উনার দিকে বাড়ালাম উনি বিছানায় পা তুলে বসলেন।
--পান্জাবীর লেফট পকেটে হাত ঢুকা তো, কিছু পাবি।
কফি নিয়ে ধোয়া উঠা মগে এক আলতো চুমুক দিলেন। আমি উনার পান্জাবীর হাতা ফোল্ড করে পকেটে হাত ঢুকালাম, চাবি হাতে আসলো।
--বাসার চাবি। এখানে বিনা সিকিউরিটিতে না থেকে বাসায় গিয়ে থাকবি। আমি মনিরা, শিফাকে বলে দিয়েছি তোর সাথে আমাদের ফ্ল্যাটে থাকবে।
চাবির ঝোলা হাতে নিয়ে আমি প্রশ্ন গলায় বললাম,
--এখানে কি হবে? মাসের শুরুতে আমাদের ফ্ল্যাটে চলে গেলে ওয়ার্ডেন মহিলা বকবে।
--বকবে না। আমি বুঝিয়ে এসেছি।
--আজব! আপনি গিয়েছেন? কি বলেছেন? কি বলল মহিলা? বকা দেয়নি?
--রিল্যাক্স রিল্যাক্স। এক্সট্রা টাকা মহিলার হাতে দিয়েছি। কিছু বলবেনা। আমি আসি?
--কফিটা শেষ করুন।
--বসার টাইম কম। বিকেলে ফ্লাইট। ব্যাগ গুছাইনি, তোর এডমিশন নিয়ে কথা বলতে যেতে হবে।
উনি কফিটা এক চুমুকে খেয়ে পা নামিয়ে উঠে দাড়ালেন। আমি বাধা দিয়ে জোর দিয়ে বলতেও পারছিনা- "আপনার যাওয়ার দরকার?"। উনি কি মন খারাপের লুকানো মুখটা বুঝতে পেরে যাওয়া বাদ দিবেন!! নাকি চলে যাবেন? কাছে আসলেন, ডানহাতে বুকে জড়িয়ে ধরলেন।
--পড়াশোনা ঠিক মতো করবি। বাসার বাইরে যাওয়ার দরকার নেই। নিন্দুকের নিন্দা থাকবেই, নিন্দা কথা শোনাবেই। চুপচাপ কানে ঢুকিয়ে কান দিয়ে বের করে দিবি।
--হুম,
উনি আমার মাথা উঠিয়ে আমার দিকে উনার মাথাটা নামিয়ে সর্তকতার সাথে বললেন, খুবই সর্তকতা নিয়ে যেন দেয়ালেরও কান আছে। শুনলে বিপদ।
--কথা এখন যেটা বলবো তোর কাছে খাপছাড়া লাগতে পারে। মন দিয়ে শোন, মেয়েদের সাথে আছিস বলে চোখবন্ধ করে অন্ধবিশ্বাস করবি না। আগে একবার বলেছিলাম, রিপিট করছি। আমি ছাড়া তোর কেউ নেই। আমাকে ভুলেও ভুল বুঝবিনা।
--আমি ভুল কেন বুঝবো?
--তুই ভুল বুঝবি না পাকনি। তোর মাথাটা ওভাবে ওয়াশ করে দিবে। এমন ওয়াশ করবে তুই বাধ্য মেয়ের মতো আমাকেই ভুল বুঝবি।
--আপনি এগুলো কেন বলছেন?
--মেয়েদের মধ্যে হিংসার প্রভাব বেশী। চোখ মেলে দেখ, তোকে নিন্দাবাণী মেয়েজাতি বেশী শোনাচ্ছে, ছেলেরা না। এক মেয়ে আরেক মেয়েকে নিয়ে কখন হিংসার আগুনে জ্বলেপুড়ে মরবে তুই টের পাবিনা। কাজেই, তুই শিফা এবং মনিরাকে নিয়ে এলার্ট থাক। রেড জোন আসার আগেই স্টেপ নিয়ে নিবি।
--আপনার কথা কিছুই ঢুকছেনা মুগ্ধ! আপনি ওদের দুইজনকে নিয়ে কথা বলছেন! একজন আমার বেষ্টফ্রেন্ড মুগ্ধ!! ও ক্ষতি করবে? হিংসা করবে?
ধোয়ায় ঢাকা অন্ধকার লাগছিলো আমার। মাথায় পেচ লাগানো উসকে দেওয়ার মতো কথা। ওরা নাকি করবে হিংসা! মানলাম। মেয়েদের মধ্যে কোনো কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় হিংসার সৃষ্টি হয়, তাই বলে মনিরা শিফা হিংসায় প্রর্বতিত হবে? মুগ্ধ আমায় সর্তক করছেন? বন্ধুত্বের সম্পর্কে সংঘাত না?
উনি গালে ঠোট ছুয়িয়ে দিচ্ছেন। এলোপাথাড়ি চুমু। দুগালে অজস্র ঠোট ছুয়িয়ে দিতে বললেন,
--প্লিজ নিজের খেয়াল রাখিস। আমার কথা নিয়ে খামোখা মাথা ঘামানোর দরকার নেই। একটা কথা- ভালোবাসি পাকনি। চান্স কিন্তু চাই!কল করবো।
--হু,
উনি পকেট থেকে ক্রেডিট কার্ড বের করে আমার হাতে গুজে দিলেন। নাকে নাক ঘষে মাথায় ঘন করে চুমু দিয়ে দিলেন। গাল টেনে ঝকঝকে দাতের হাসিটা ফের দিলেন। মায়াবী হাসিটা। চোখবন্ধ করলেও যে হাসিটার ছবি মনে গেথে যায়। চোখ বন্ধ করলেও বুকের বা পাশে হাতটা রেখে সেই হাসিটার অনুভূতিতে হেসে দেওয়া যায়। হৃদস্পন্দন বাড়ানো স্নিগ্ধ স্নান হাসিটা। যাওয়ার আগে ঠোটে ঠোট ছুয়িয়ে প্রথমদিনের ন্যায় দুষ্টু হেসে চোখ টিপ দেওয়াটাও ভুললেন না মুগ্ধ। উনি ট্রেনিং সেন্টারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন। কিন্তু এখনো আমার মুগ্ধের কথায় কৌতুহলপ্রবন যায়নি। প্রশ্নের পর প্রশ্নচিহ্ন লাগছে বারবার! কি বোঝালেন হিংসা দিয়ে??