জানালার কপাট গুলো আস্তে আস্তে ফাঁক করে রুমের দিকে উঁকি দেয় তুরান। শরীর কাঁপছে তুরানে। এভাবে উঁকিঝুকি দেওয়ার অভ্যাস কোন জনমেই ছিলো না। একে তো আজ রুপা ওর জন্য মার খেলো। কেউ যদি আবার এখন দেখে তাহলে খারাপ হবে। এত রিস্কের মাঝেও কৌতূহলি মনকে দমাতে পারছে না তুরান। জানালার পর্দা সরালেই রুমের ভিতরে রুপা আছে নাকি দেখা যাবে। তুরান তাই করলো। খাটের উপর বালিশ হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় আছে রুপা। রুপার চুলের দিকে তাকালেই তুরানের মন খারাপ হয়। রুপার মুখ জুড়ে বিষন্নতা। চুল গুলো উস্কখুস্ক। চোখ ফুলে রয়েছে। মায়া হচ্ছে বড্ড তুরানের। একা একা বসে বসে ফুঁসছে রুপা। রুপার হাতে ব্লেডের কাটা দাগের অভাব নেই। কি বাজে অভ্যাস মেয়েটার! কিছু হলেই হাত-পা কাটে। ইভেন চুল গুলো কেটে ফেললো। কবে যে নিজের গলা কেটে ফেলে কে জানে! এটাও ওর কাছে অসম্ভব কিছুই না।
তুরান চাপা কন্ঠে ডাক দিলো,
-'রুপা।'
ধ্যানে বসেছে বুঝি রুপা। ডাকছে সেদিকেও খেয়াল নেই। তুরান আগের বারের তুলনায় একটু জোরে বলে,
-'রুপা।'
কোন দিকে খেয়াল নেই তাঁর । হলো টা কি? এই মেয়ে কে যাদুঘরে রেখে আসলেও মন্দ হয় না।
তুরান পায়ের কাছে পড়ে থাকা একটা কাগজের টুকরো কুড়িয়ে ছুঁড়ে মারলো রুপার দিকে । কাগজের টুকরো টা রুপার মাথায় উপর পরলো। এবার রুপা আশেপাশে তাকালো। এক পর্যায়ে জানালার কাছে তুরান কে দেখে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। মুচকি হেসে দিলো তুরান। রুপা দৌঁড়ে রুম থেকে বের হয়ে তুরানের কাছে গেলো । আচমকা জড়িয়ে ধরলো তুরানকে। কান্না ভেজা কন্ঠে বলে,
-'উনারা কত মেরেছে আমায়। আপনার জন্য ওয়েট করতে ছিলাম,কোথা থেকে উনারা এসে আমায় গুলো বাসায় নিয়ে আসলো।'
কেঁদে ফেলে রুপা। এই মেয়েটা হয়ত বেখেয়ালি মনে তুরান কে জড়িয়ে ধরেছে। কিন্তু তুরানের পুরো শরীর জুড়ে শীতল রক্ত প্রবাহিত হচ্ছে । অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে । এর আগেও তো রুপা একদিন জড়িয়ে ধরেছিলো তুরান কে,তখন তো এমন অনুভূতি হয় নি। রুপা এত শক্ত করে জড়িয়ে রেখেছে ছাড়ানোরও উপায় নেই। ফুঁফিয়ে ফুঁফিয়ে কেঁদেই চলেছে। মনের মাঝে শান্তি অনুভব করছে তুরান,কাঙ্ক্ষিত অনুভূতি হচ্ছে । থাক না রুপা এভাবে জড়িয়ে ধরে,কি হবে এমন? আবেশ জড়ানো কন্ঠে তুরান বলে,
-'কেঁদো না পাগলী। সরি আমার জন্য মার খেতে হলো । মাফ করে দেও আমায়।'
তুরানের বুক থেকে মুখ তুলে রুপা বলে,
-'আপনার কি দোষ? আমিই তো আপনার সাথে যেতে চেয়েছি। কি এমন হয়েছে যে তাতে আমায় মারতে হবে?'
রুপার চোখের পানি স্ব-যত্নে মুছিয়ে দিলো তুরান ।
-'মা-বাবা সন্তান কে মারতেই পারে । তুমি চুল গুলো কাটলে কেন? তোমার চুল গুলো কত সুন্দর ছিলো সে তুমি জানো?'
গাল ফুলিয়ে রুপা বলে,
-'কই একদিনও তো বলেন নি আমার চুল সুন্দর ।'
হেসে দেয় তুরান। মানুষ আসতে পারে। এভাবে দেখলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে তুরান। আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো রুপা।
-'আপনার বুকে অনেক শান্তি। ছাড়বো না।'
রুপার বলা কথা গুলো তীরের মত আঘাত করে তুরানের বুকে । প্রেমের তীর যেন।
-'তোমার জন্য কালো শাড়ী এনেছি।'
বিস্ময়ের মুখ হাঁ করে ফেলে রুপা।
-' এভাবে মুখ হাঁ করো না ডেঙ্গু মশা ঢুকবে মুখে।'
তুরান কে ছেড়ে উচ্চস্বরে হেসে উঠে রুপা। খুশিতে আটখানা দিয়ে গিয়েছে রুপা। রুপার এই আনন্দিত মুখটাই দেখতে চেয়েছিলো তুরান । উৎকন্ঠিত হয়ে রুপা বলে,
-'কোথায় শাড়ী? কখন কিনলেন?'
-'তোমায় ওখানে ওয়েট করতে বলে শাড়ী কিনতে গিয়েছিলাম।'
তর সইছে না রুপার।
-'দেন,শাড়ী দেন তাড়াতাড়ি।'
-'শাড়ী তো রুমে ,তুমি দাঁড়াও আমি নিয়ে আসছি।'
রুপাও তুরানের পিছনে পিছনে রুমে গেলো। শাড়ী পেয়ে রুপার খুশি আর দেখে কে! হঠাৎ মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায় রুপার।
-'কি হয়েছে মুখটা হুতুম পেঁচার মত হয়ে গেলো কেন?'
-'আংকেল-আন্টি চলে গিয়েছে?'
-'তোমার বাসায় তো তখন হরতাল চলে তাই বলে যেতে পারে নি। আম্মু তোমার চুল গুলোর জন্য রাগ করেছে খুব।'
মাথা নিচু করে ফেলে রুপা।
-'আমি কি ইচ্ছা করে চুল কেটেছি। রাগ হলে তো সব ভুলে যাই।'
তুরান রুপার একটু কাছে গিয়ে বলে,
-'শাড়ী পছন্দ হয়েছে তো রাগিনী?'
-'খুব।'
-'আর কখনো চুল কাটবে না,হাত,পা কাটবে না।'
ঘাড় বাঁকিয়ে রুপা বলে,
-'আচ্ছা ।'
একটু পরে রুপা আবার বলে,
-'শাড়ী পড়িয়ে দিবেন? শাড়ী পড়তে পারি না তো আমি।'
রুপার কথা শুনে জিহ্বায় কামড় দেয় রুপার। কি ব্রেকলেস কথা বলে? তুরান রুপাকে বুঝিয়ে সুজিয়ে বলে,
-'না, না আমি ও পারি না। তুমি এখন বাসায় চলে যাও। আমার রুমে তোমায় কেউ দেখলে বাজে ভাব্বে।'
-'আপনি শাড়ী এনে দিয়েছেন আপনায় পড়ে দেখাবো না?'
-'এখন পড়ে দেখাতে হবে না। তুমি সাহেলা আন্টির কাছ থেকে শিখে নিও। আর রাতে সবাই ঘুমানোর পর শাড়ী পড়ে ছাদে এসো সেদিনের মত গল্প করবো ।'
বিস্ময়ের সুরে রুপা বলে,
-'সত্যি!'
-'হ্যাঁ।'
খানিকক্ষন কি যেন ভেবে রুপা বলে,
-'আন্টির কাছে শাড়ী পড়া শিখবো? আন্টি যদি জিজ্ঞেস করে শাড়ী কোথায় পেয়েছি? আমার পা ভেঙে রুমে বসিয়ে রাখবে।'
চোখ কপালে উঠে গেল তুরানের।
-'তাই তো। মাথায় ছিলো না একদম। তুমি যেভাবে পারো পেঁচিয়ে পড়ো। ভুলেও সাহেলা আন্টির কাছে যেয়ো না। শাড়ীর কথা সে যেন না জানে।'
.
সন্ধ্যা বেলায় ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো আফজাল সাহেব। হাতে শরবতের গ্লাস নিয়ে রুমে আসলো সাহেলা বেগম। বেলের শরবত আজিজ চৌধুরীর পছন্দের।
আড়মোড়া হয়ে উঠে বসলো আজিজ চৌধুরী । শরবত খেয়ে গ্লাস টা বেড সাইডে রাখলো।
-'আজকে রুপার বাবা-মা কি কান্ডটা করলো? রুপার যে মেন্টালিটি অবস্থা । ও প্রেম ভালোবাসার কি বুঝে বলো?ও যা করে খামখেয়ালির বশে করে।'
রুপার বাবা-মা কে নিয়ে আজিজ চৌধুরীর কাছে বড় গলা করার উপায় নেই সাহেলা বেগমের। ঠান্ডা গলায় বলে,
-'সবার জ্ঞান তো এক না। আমরা নিঃসন্তান তাই রুপার প্রতি আমাদের ভালোবাসা টা বেশী, আমরা অন্যায়টাকেও পজেটিভ সেন্সে দেখি। কারন সন্তানের মোহে আমরা অন্ধ।'
তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে আজিজ চৌধুরীর ।
-'তোমার লজিকাল কথা-বার্তা শুনে না হেসে পারি না। আর একটা কথা কি জানো?'
কৌতূহলি চোখে আজিজ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে সাহেলা বেগম বলে,
-'কি?'
-'পর কখনো আপন হয় না। যতই তুমি বোন বোন ডাকো বান্ধবী কখনো বোন হয় না । তোমার বোনের মেয়েকে তুমি জোর খাটিয়ে যা ইচ্ছা তাই বলতে পারবে,রুপা কে যদি কিছু বলো তাহলে ওর বাবা-মা বাজে রিয়েক্ট করবে ।'
মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায় সাহেলা বেগমের,
-'বাদ দেও ওসব।'
-'ওটা ওঁদের ধর্মের দোষ ।'
চোখ লাল করে আজিজ চৌধুরীর দিকে তাকায় সাহেলা বেগম,
-'ফালতু কথা না বললে হয় না তোমার?'
আবার হেসে দেয় আজিজ চৌধুরী।
-'নিজেদের সুবিধার জন্য রুপাকে তোমার কাছে রেখেছে। রুপা সুস্থ হলে তোমার আর খোঁজ নিবে না। এই যে দেখো ভাইদের আমি কত কষ্ট করে লেখাপড়া শিখালাম,চাকুরী পেয়ে এক এক জন আমার প্রতি বিমুখ। একবার লসে পড়েছিলাম আত্মীয়-স্বজনের ভাবটা দেখছো তখন? পৃথিবী টা বড়ই স্বার্থপর সাহেলা ।'
আজিজ চৌধুরীর কথা গুলো তিক্ত মনে হচ্ছে সাহেলা বেগমের কাছে। কথা না বাড়িয়ে শুয়ে পরলো।
বিছানায় শুয়ে চোখ বুঁজে আছে তুরান। পড়ায় মন বসছে না। কখন রুপা ছাদে আসবে মন সেদিকে। এমন ছটফট ভাব কখনো হয়নি তুরানের । আজ হচ্ছে ।
হঠাৎ চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়ে তুরান। রুপার সম্পর্কে কিছুই জানে না। ও কি লেখাপড়া করে? ওর অতীত? ওর ফ্যামিলি?
এভাবে হুট করে মায়ায় জড়িয়ে গেলো। মায়া তো আর বলে আসে না। জেনে জড়ানোর টাইম কোথায়?
হঠাৎ টোকা পড়লো তুরানের দরজায়। রুপা এসেছে? দরজা খুলে দেয় তুরান।
সামনে একটা পুতুল দাঁড়িয়ে আছে। অবাক হয়ে গেলো তুরান। লম্বা চুলে রুপা কে যেমন সুন্দর লাগতো,ছোট চুলেও তেমন সুন্দর লাগছে। শাড়ীটা কোন রকম পেঁচিয়ে পরা। গুছিয়ে পরলে হয়ত এত সুন্দর লাগতো না। পছন্দের মানুষটা সব অবস্থা তেই সুন্দর, তাই বোধ হয় এমন হচ্ছে ।
বিস্ময় কাটিয়ে তুরান বলে,
-'ছাদে যাবে না?'
মুচকি হেসে দেয় রুপা।
-'যাবো তো।'
দুইজন পা বাড়ায় ছাদের দিকে । রুপা তুরানের হাত ধরে হাঁটছে।
-'আপনায় আমার খুব ভালোলাগে।'
রুপার কথার উত্তরে কি বলা উচিত জানে না তুরান। একটু চুপ থেকে তুরান বলে,
-'সাহেলা আন্টি ঘুমিয়েছে তো?'
-'হ্যাঁ ঘুমিয়েছে তো। আপনি সাহেলা আন্টি কে এত ভয় পান কেন বলেন তো?'
—
আকাশ জুড়ে অন্ধকার। পূর্নিমা রাত হলে কি ক্ষতি হতো? অন্ধকারে সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠা রিস্ক। আর রুপা শাড়ী পড়ে ঠিক মতো হাঁটতে পারছে না। যেকোন মুহূর্তে পরে যেতে পারে। ফোনের ফ্লাশ লাইট অন করলো তুরান। ছাদে শো শো বাতাস। রুপার চুল গুলো বার বার উড়ে এসে মুখে পরছে। তুরান হেসে বলে,
-'চুল গুলো এভাবে না কেটে একদম ছেলেদের মত করে কাটলেই তো পারতে।'
-'কাটবো ছেলেদের মত করে?'
-'তুমি যদি আর কখনো চুল কাটো আমি তোমার সাথে কথাই বলবো না।'
রুপা হেসে বলে,
-'আচ্ছা কাটবো না।'
এ পর্যায়ে মুখ ভার করে রুপা বলে,
-'শাড়ীতে আমায় কেমন লাগে তা তো বললেন না?'
তুরান দুষ্টুমির ছলে গান ধরে বলে,
-'সব কথা বলে না হৃদয় ,কিছু কথা বুঝে নিতে হয়।'
হো হো করে হেসে উঠে রুপা।
-'এই কন্ঠে গান করেন না,লোক জন মনে করবে ছাদে কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে ।'
-'এই তুমি কি মনে করেছো আমি গান করতে পারি না? আমার কন্ঠে অত খারাপ না। অনেক পুরষ্কার পেয়েছি গান করে।'
-'আপনি তো ঠিক ভাবে কথাই বলতে পারেন না আবার গান!'
হেসে দেয় তুরান।
-'আমাকে ক্ষ্যাপাতে চাচ্ছো তাই না? অত সোজা নয়। আর আমি তোমার মত অপ্রয়োজনে কথা বলি না।'
কিছুক্ষন চুপ থেকে রুপা বলে,
-'আচ্ছা আমায় ছাদে আসতে বললেন কেন ?'
থতমথ খেয়ে যায় তুরান। এই প্রশ্নের ফেস করার জন্য বোধ হয় প্রস্তুত ছিলো না। এর যুক্তিসংগত কোন উত্তর নেই। রুপার সাথে সময় কাটাতে ভালো লাগে তাই আসতে বলেছে। তুরান কে নিরুত্তর দেখে রুপা বলে,
-'কি হলো চুপ মেরে গেলেন কেন?'
-'তুমি আমায় ওই দিন রাতে ঘুম থেকে তুলে ছাদে নিয়ে আসলে কেন?'
-'আমার তো মাথায় সমস্যা তাই যা ইচ্ছা করি। আপনারও কি মাথায় সমস্যা আছে?'
তুরান একটু রেগে বলে,
-'আচ্ছা তোমার ভালো না লাগলে ছাদ থেকে চলে যাও।'
-'মেয়ে মানুষের মত কথায় কথায় রাগ করবেন না তো। আমার তো আপনার সাথে থাকতে ভালোই লাগে।যাবো কেন ছাদ থেকে?'
-'তো এত কথা বলো কেন?'
-'কবেই কম কথা বলেছি?'
হতাশ হয়ে যায় তুরান । মেয়ে মানুষের সাথে তর্ক করে পারা এত কি সহজ? মুচকি হাসে তুরান। রুপা আজ বেশ স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে। তুরান কিছুক্ষন রুপার দিকে তাকিয়ে থেকে বলে,
-'তোমার বাবা-মা কি ছোট বেলা থেকে তোমায় এমন মারে?'
বরাবরের মত মুখ ফ্যাকাশে হয়ে যায় রুপার। রুপা বোধ হয় এসব প্রশ্নের উত্তর দিতে ইচ্ছুক না।
-'এসব কথা না বললে হয় না?'
-'রুপা আমি তো তোমার বন্ধুর মত। আমার কাছে এসব বললে সমস্যা কি?'
-'বন্ধুকে তো মানুষ তুই করে বলে। আমি কি আপনায় তুই করে বলি না তাই সমস্যা ।'
কেমন বাচ্চা দের মত লজিক দেখালো রুপা। মনে মনে হাসছে তুরান । রুপার ফুরফুরে মুডটা নষ্ট না করাই ভালো।
-'আচ্ছা সরি এসব জিজ্ঞেস করবো না আর। তবে আর একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?'
-'কি?'
-'তোমার লেখাপড়া? ফ্যামিলি? অতীত?'
চোখ ছলছল করে উঠলো রুপার। চাপা কন্ঠে বলে,
-'ঘুরিয়ে ফিরিয়ে কথা তো একই হলো। আচ্ছা এসব বিষয় জানা কি খুব জরুরী? আমি একটা মানুষ সে হিসাবে কি আমার সাথে কথা বলা যায় না? ধরে নেন আমার লেখাপড়া, ফ্যামিলি, অতীত কিছু নেই।'
খুব সিরিয়াস ভাবে কথা গুলো বলছে রুপা। এর আগে কখনো এভাবে কথা বলে নি রুপা। তুরান বুঝতে পারছে না রুপার সমস্যা কোথায়? হয়ত এটা রুপার দুর্বল পয়েন্ট। রুপা এটা নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। কিন্তু কেন এমন টা?
রুপা আকাশের দিকে তাকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে। দুই হাতে মাথা চেপে রেখেছে। চোখ দিয়ে গড়িয়ে পানি পরছে।
ভাবনার জগৎএ ছিলো তুরান । এতক্ষন রুপার দিকে খেয়াল করে নি। রুপাকে এমন অবস্থায় দেখে আতকে উঠে তুরান ।
-'রুপা এমন করছো কেন? সরি আর কখনো জিজ্ঞেস করবো না। আমি ভয় পাচ্ছি কিন্তু। রুপা স্বাভাবিক হও। কি হয়েছে মাথা ব্যাথা করে?'
এক নাগাড়ে প্রশ্ন করেই যাচ্ছে তুরান । রুপার কাছ থেকে কোন উত্তর পাচ্ছে না। রুপার কান্না ক্রমশ বাড়তেই লাগলো। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে। বোধ হয় রুপার শ্বাস কষ্ট হচ্ছে । রুপাকে এসব প্রশ্ন করার দরকার কি ছিলো? মেয়েটা এমনিতেই তো একটু অন্যরকম। নিজের বোকামীর জন্য নিজের উপর রাগ হচ্ছে তুরানের।
তুরান রুপার কাঁধে হাত রেখে বলে,
-'কি হলো কথা বলছো না কেন? শরীর খারাপ লাগে তোমার? চলো বাসায় দিয়ে আসি।'
রুপার কাঁধে হাত রাখতেই রুপা তুরানের উপর ঢলে পরে। বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে উঠলো তুরানের। ঘামতে ঘামতে শুরু করলো। হঠাৎ এমন কেন হলো? রুপা সেন্স লেস কেন হলো?
তুরান রুপাকে পাজা কোলে নিয়ে আস্তে আস্তে সিঁড়ি বেয়ে নামছে। রুপার হুঁশ ফিরবে কিভাবে? ওকে কি ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে? তুরান কিছু ভেবে পাচ্ছে না।
ছাদ থেকে নেমে আবার চিন্তায় পরে গেলো। রুপাকে ওর রুমে দিয়ে আসা রিস্ক। তুরানের রুমে নেওয়া কি ঠিক হবে? সকাল বেলা সাহেলা বেগম যদি রুপাকে রুমে না দেখে? বিষয় টা খারাপ হবে খুব।
তুরানের মাথায় আর একটা বুদ্ধি আসলো । রুপার জ্ঞান ফিরার পর সকাল হওয়ার আগেই রুপা যদি ওর রুমে চলে যায় তাহলে বিষয়টা ভালো হবে।
তুরান রুপাকে নিয়ে তুরানের রুমে শুইয়ে দিলো।গ্লাসে করে পানি এনে রুপার মাথায় দিলো । এত রাতে ডাক্তার কোথায় পাবে? খুব বেশী ভয় হচ্ছে তুরানের, চিন্তার ছাপ মুখে। রুপার মাথার কাছে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে । মুখটা একদম শুকিয়ে গিয়েছে রুপার। মুখের উপর থাকা চুল গুলো কানের কাছে গুঁজে দিলো তুরান । অদ্ভুধ ভালোবাসা কাজ করছে রুপার প্রতি। ভালোবাসা এমন আজব কেন ভেবে পাচ্ছে না তুরান। তুরান রুপার মুখে পানি ছিটিয়ে দিচ্ছে । রুপার জীবনটা এমন কেন? কিছুই জানে না ওর সম্পর্কে তুরান । রুপা কে ভালোবেসে তো কোন ভুল করে নি? রুপা তো মানসিক ভাবে অসুস্থ । এই অসুস্থার পিছনে কি কোন কারন রয়েছে? এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর কোথায় পাবে তুরান? সাহেলা বেগমের কাছে এসব জিজ্ঞেস করাটা বেমানান!
-'বলেছি না আমায় ওসব জিজ্ঞেস করবেন না।'
রুপার কথায় ভাবনার ছেদ হয় তুরানের । স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে তুরান । এতক্ষনের চিন্তার অবসান হয়।
-'কি হয়েছিলো তোমায় এমন করলে কেন? আমি কত ভয় পেয়েছি!'
শোয়া থেকে উঠে তুরান কে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে রুপা। তুরানের বুকে কিছুক্ষন চুপ-চাপ থেকে রুপা বলে,
-'কোন কিছু নিয়ে ভাবলে এমন হয় আমার। ভয় পেয়েছেন?'
-'এমন করলে সবাই ভয় পায় । কি নিয়ে ভাবছিলে এত?'
-'আপনি যা জিজ্ঞেস করছেন তাই নিয়ে।'
কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায় তুরান। রুপা জড়িয়ে ধরে রেখেছে তুরানকে। রুপা কি তুরান কে ভালোবাসে? নাকি এসবও রুপা বেখেয়ালে করছে? মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছে তুরানের। তুরানও রুপাকে বুকের মাঝে আগলে রেখেছে। এর থেকে শান্তি বুঝি পৃথিবীতে হয় না!
চুপ করে আছে দুইজন। এই নিরবতারও বোধ হয় ভাষা আছে। এই নিরবতায় মুখে কথা হয় না,কথা হয় অন্তরে অন্তরে।
নিরবতা ভেঙে রুপা বলে,
-'আপনার বুকে অনেক শান্তি।'
-'সারা জীবন থাকবে আমার বুকে?'
কিছুক্ষন চুপ থেকে রুপা বলে,
-'থাকবো।'
আবেশ জড়ানো কন্ঠে তুরান বলে,
-'ভালোবাসো আমায়?'
-'ভালোবাসা টালোবাসা বুঝি না।'
রুপার এমন উত্তরে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায় তুরান।
-'সারা জীবন আমার বুকে থাকবে অথচ ভালোবাসা বুঝো না? ভালোবাসায় হাবুডুবু খাচ্ছো আর বলছো ভালোবাসা বুঝো না?'
কোন কথা না বলে মুচকি হেসে দেয়। অন্য রকম প্রশান্তি পাচ্ছে তুরান। ওভাবে কতক্ষন দুই জন দুই জনকে জড়িয়ে রেখে ছিলো হিসাব নেই।
আজানের ধ্বনিতে হুঁশ ফিরে তুরানের । ভালোবাসার রাত গুলো এত তাড়াতাড়ি শেষ হয় কেন?
-'রুপা।'
ঘুম ঘুম চোখে রুপা বলে,
-'হুম।'
-'উঠো এখন বাসায় যাও। সকাল হয়ে গিয়েছে।'
জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে তুরান কে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,
-'উঁহু বাইরে এখনো অন্ধকার যাবো না।'
-'সাহেলা আন্টি যদি তোমায় রুমে না দেখে তাহলে কি হবে জানো না।'
সাহেলা বেগমের কথা শুনতেই দড়পড়িয়ে উঠে বসলো রুপা। চোখ কচলাতে কচলাতে বলে,
-'আমার হেঁটে যেতে ইচ্ছা করে না,কোলে নিয়ে দিয়ে আসেন।'
-'যদি কেউ দেখে ফেলে?'
রুপা তুরানের কথা মানতে নারাজ। সে তুরানের কোলে চড়েই রুমে যাবে। এ দিকে প্রায় সকাল হয়ে যাচ্ছে । রুপাকে কোলে নেওয়ার চান্স মিস করতে চাচ্ছে না তুরান। সাত-পাঁচ না ভেবে পাজা কোলে নিলো রুপাকে। তুরানের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে রুপা।
রুপাকে রুমে দিয়ে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো তুরান ।
ভাবতে লাগলো আজকে রাতটা। রুপার ছোঁয়া লেগে আছে তুরানের শরীরে। রুপার শরীরের ঘ্রান লেগে রয়েছে তুরানের শার্টে।
সারা রাত রুপা জড়োসড়ো হয়ে তুরানের বুকে ছিলো। প্রশান্তি,মায়া,ভালোবাসায় ভরা ছিলো রাতটা। রুপার বাচ্চা দের মত কথা বলা অন্য মাত্রা যোগ করে সব সময়।
জীবনের প্রতিটি রাত এমন হলে ক্ষতি কি? হবে কি এমন? রুপাকে নিজের করে পাবে তো? শঙ্কা জাগে তুরানের মনে। এত ভালোবাসা কেন রুপার মাঝে? সারা রাত ঘুম হয়নি। রুপার কথা শুনতে শুনতেই রাত কেটে গিয়েছে। এসব ভাবতে ভাবতেই গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় তুরান ।
সারা রাত সজাগ থেকে চোখ লাল হয়ে রয়েছে তুরানের। চোখ দুটো জ্বলছে খুব। ঘুমিয়ে থাকারও জো নেই টিউশনি,ভার্সিটি। সকালে ঘুম ভাঙতেই রুপার কথা মনে পরলে ঠোঁটের কোনে চিলতে হাসি ফুঁটে তুরানের । তাড়াহুড়া করে রান্না করছে তুরান। আজকে বোধ হয় টিউশনিতে যেতে পারবে না।