!!০৭!!
"আমাকে জিজ্ঞেস করছে গলায় কি হয়েছে?"
"কি বললি?"
"বলেছি ঠান্ডা জনিত সমস্যা।"
"ঠিক আছে।"
কথোপকথনটা চললো রুমানার আড়ালে। সুবানঘাট থেকে লেগুনায় করে রুমানা, মাহা আর চৈতি চলেছে প্রকৃতিকন্যা জাফলং এর পথে। ঘননীল আকাশ। দুইপাশে সারি সারি সবুজেঘেরা পাহাড়। পাহাড়ের চূড়ায় থোকায় থোকায় আপনমনে বিন্যস্ত মেঘের কুন্ডলী। পাহাড়ের পাশ দিয়ে বহমান পিয়াইন নদী। নদীর পানির অদ্ভুত শব্দ কানে ভেসে বেড়াচ্ছে। ছলছল ছলছল। দিগন্ত থেকে দিগন্তে উড়ে বেড়াচ্ছে নাম না জানা অজানা পাখির দল। আহা! কিচিরমিচির কিচিরমিচির আওয়াজ। সে আওয়াজে কি অদ্ভুত মায়া। আকাশচুম্বী পাহাড়গুলোর বুক চিড়ে বয়ে চলেছে অবিরাম জলধারা। মাহা, চৈতি অবাক নয়নে, পুলকিত মস্তিষ্কে উপভোগ করছে সে দৃশ্য। বেলা এগারোটা ছুঁই ছুঁই। নদীর উপরে কুয়াশারা জমাট বেঁধেছে। আকাশে মেঘ আর তটিণী-র উপরে কুয়াশার মেলা যেন একই সূত্রে গাঁথা। মাহা ভুলে গেলো সকল মৃত্যু চেতনা, ভুলে গেলো অজানা আতঙ্ক। তার মন প্রকৃতির প্রেমে পুলকিত। রুমানার কাছে এসবই পুরাতন। তাই হয়তো ঢাকা শহরে বড় হওয়া মাহা আর চৈতির মতো তার মন অজানা অনুভূতিতে পুলকিত, শিহরিত হচ্ছেনা। তার রক্তে রক্তে অজানা কোনো স্রোত বয়ে বেড়াচ্ছেনা।
"অভূতপূর্ব।"
গানের সুরের মতো শুনায় চৈতির কন্ঠ। তার কোমড় সমান চুলগুলো এলোমেলো হয়ে উড়ছে বাতাসে। কালচে সবুজ কুর্তিটায় বেশ মানিয়েছে তাকে। রুমানা অবাক নয়নে চেয়ে আছে।
"কি রে কি দেখিস?"
"তুই অনেক সুন্দর রে কোকিল।"
খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো চৈতি। তার হাসির শব্দ ঝংকার তুললো পিয়াইন নদীর আনাচে কানাচে।
"তোর টুকির মতন অমন আগুন সুন্দরী রেখে শেষে আমাকে ধরেছিস?"
"টুকি সুন্দর। তবে তুই সুন্দর, মায়াবতী। তোর মুখে কি যেন আছে রে কোকিল।"
"তোর যত আজগুবি কথা।"
মাহা চুপ করে উপভোগ করছে সবকিছু। কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা তার। সবুজ সায়রে ডুবিয়ে দিয়েছে নিজেকে। পাশাপাশি বসে মাহা, চৈতি। সামনা সামনি বসে রুমানা। লেগুনাটা তাদের রিজার্ভ করা। আর মানুষ নেই তাতে। লেগুনার পাশ ঘেঁষে চলে গেলো একটা বাইক। বাইকে দুজন মানুষ বসে। চৈতির মনে হলো কেমন অবাক দৃষ্টিতে তারা তাকিয়ে ছিলো তাদের দিকে। তবে ভাবনাটা মাথা থেকে ঝরে ফেললো সে।
"টুকি? চুপ কেন? শরীর কি বেশি খারাপ লাগছে?"
"না, ঠিক আছি।"
নিরবতা। শো শো করে শীতল বাতাস বইছে। ঠান্ডা হাড় কাঁপানো অদ্ভুত হাওয়া যেন মনে প্রভাব ফেলে কোথায় মিলিয়ে যাচ্ছে। তিনজনে চলেছে মনোমুগ্ধকর এক গন্তব্যে। লেগুনা চলছে আপন গতিতে। গাড়িতে বসে দুইপাশের সৌন্দর্য দেখা যেন বিস্ময়কর এক অভিজ্ঞতা। পাহাড়ের পাশে নদী। অপর পাড়ে গজারিবন, সুপারীবনের মেলা।
"একটা গান শুনাবি? মাহা?"
রুমানার মনে হলো সে কিছু ভুল শুনেছে। মাহার দিকে ফিরে সে বললো,
"কি বললি? আবার বলতো?"
চৈতির ইশারায় কি যেন বলতে গিয়েও থেমে গেলো মাহা। লেগুনার ছোট দরজা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললো,
"কোকিলকে বলেছি একটা গান শুনাতে।"
"তাই বল। হ্যাঁ রে কোকিল। একটা গান শোনা প্লিজ।"
চৈতি অন্য মেয়েদের মতো ন্যাকা নয়। গানের গলা ভালো বিধায় অনেকেই গান শুনতে চায় তার কাছে। সেও আপনমনে শোনায়। কোনো বাহানা নেই তার মাঝে। চলন্ত লেগুনা তখন অতিক্রম করছে একটা বিস্তৃত সবুজ মাঠ। বাতাসে গানের নাচন শুরু হয়ে গেলো।
আমার ভিনদেশী তারা
একা রাতেরই আকাশে
তুমি বাজালে একতারা
আমার চিলেকোঠার পাশে
ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে
তোমার নাম ধরে কেউ ডাকে
মুখ লুকিয়ে কার বুকে
তোমার গল্পো বলো কাকে
আমার রাত জাগা তারা
তোমার অন্য পাড়ায় বাড়ী
আমার ভয় পাওয়া চেহারা
আমি আদতে আনাড়ী
আমার আকাশ দেখা ঘুড়ি
কিছু মিথ্যে বাহাদুরি
আমার আকাশ দেখা ঘুড়ি
কিছু মিথ্যে বাহাদুরি
আমার চোখ বেধে দাও আলো
দাও শান্ত শীতল পাটি
তুমি মায়ের মতই ভালো
আমি একলাটি পথ হাটি
আমার বিচ্ছিরি এক তারা
তুমি নাও না কথাখানি
তোমার কিসের এতো তাড়া
সে রাস্তা পার হবে সাবধানি
তোমার গায়ে লাগেনা ধুলো
আমার দু-মুঠো চাল চুলো
তোমার গায়ে লাগেনা ধুলো
আমার দু-মুঠো চাল চুলো
রাখো শরীরে হাতে যদি
আর জল মাখো দুই হাতে
প্লীজ ঘুম হয়ে যাও চোখে
আমার মন খারাপের রাতে
আমার রাত জাগা তারা
তোমার আকাশ ছোয়া বাড়ী
আমি পাইনা ছুতে তোমায়
আমার একলা লাগে ভারী
আমার রাত জাগা তারা
তোমার আকাশ ছোয়া বাড়ী
আমি পাইনা ছুতে তোমায়
আমার একলা লাগে ভারী
হুম হুম………………
!!০৮!!
এতটা আবেগ নিয়ে কখনো কোকিলকে গান করতে শুনেনি রুমানা। এতোটা আবেগ। কার জন্য এতো আবেগ! চোখ বুজে গান সেরে তখনো পল্লব খুলেনি চৈতি।
"এতটা গভীর হয়ে কার জন্যে গান করলি বলতো?"
"তেমন কেউ নেই।"
"সত্যি তোর কোনো ভিনদেশী তারা নেই?"
বলে হেসে দিয়েছে রুমানা। সাথে যোগ দিয়েছে মাহাও। নিচে তাকিয়ে মুচকি হাসছিলো চৈতি। আছে কি তার কোনো ভিনদেশী তারা?
পথিমধ্যে একবার লেগুনা বিগড়ে গিয়েছিলো। দু'ঘন্টার জার্নি। চারঘন্টায় সেরেছে তারা। জাফলং পৌঁছাতে পৌঁছাতে তখন বিকেল সাড়ে তিনটে।
"এটা কোনো কথা! জাফলং ঘুরবো কখন আর খাসিয়া পল্লী ঘুরবো কখন। পুরা মজাটার বারোটা বাজিয়ে দিসে।"
রুমানার কন্ঠে বিরক্তি।
"থাক বাদ দে।"
"কি বাদ দিবো টুকি। এটা কোনো কথা বল। আমার শহরের সবচেয়ে সুন্দর জায়গাটা তোরা দেখতে পারবিনা।"
মাহা, চৈতি চুপ করে আছে। আপাতত তারা ভারতের মেঘালয় ঘেঁষে খাসিয়া-জৈন্তা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত, পাহাড় আর নদীর অপূর্ব সম্মিলন জাফলং দেখতে ব্যস্ত। রঙ, বেরঙের পাথর চারপাশে। নদীর স্বচ্ছ পানির ভেতরে অপরূপ পাথুরে ঝলকের খেলা।
তিনজনে দাঁড়িয়ে উপভোগ করছে সব। তবে পেট তো আর কথা মানেনা। জানান দিলো খাদ্য দরকার তাদের।
"ক্ষুধা লেগেছে প্রচুর। নদী পেরিয়ে ওপারে গিয়ে সর্বপ্রথম খাবো। তারপর ঘুরবো। কি বলিস টুকি,কোকিল?"
"আচ্ছা।"
ছোট একটা ডিঙি দিয়ে স্বচ্ছ জলধারা পাড়ি দিলো তারা। কত রকমের পাথর নদীর গহীনে। নদীর এপাড়ে হরেক রকম খাবার নিয়ে বসেছে উপজাতি গোষ্ঠী। রুমানা ডিঙি থেকে নেমে দৌড়ে গেলো সেদিক পানে।
"আরে পাগলী আস্তে। তোর খাবার কেউ ছিনিয়ে নিবেনা।"
কে শোনে কার কথা। চৈতির কথা তোয়াক্কাই করলোনা রুমানা। রুমানার এহেন কান্ডে হেসে উঠলো দুজনে।
!!০৯!!
একটা টেবিল দখল করে খাওয়াও শুরু করেছে রুমানা। মাহা আর চৈতিও খেলো। ডিম ভোনা, আলুর ভর্তা, ডাল আর ভাত। নদীর তীরে অস্থায়ী পেন্ডেলে বসে খেতে ভালোই লাগলো তিনজনের। বিল দেওয়ার সময় একটা অদ্ভুত কান্ড ঘটলো। চৈতির মনে হলো হুন্ডারে থাকা লাল হুডী পরনে একজনকে দেখেছে সে। বিষয়টাকে এখন আর হেলায় ফেলায় নিলোনা চৈতি। অদ্ভুত ভয় ঝেঁকে ধরেছে তাকে। তবে তা প্রকাশ করলোনা সে। অটো করে খাসিয়া পল্লী ঘুরবে তারা। একটা অটো রিজার্ভ করে তাতে উঠে বসলো তিনজনে।
"আমি যখনই খাসিয়া পল্লী আসি আমার অনেক ভালোলাগে। এতটা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন তারা। মনে হয় যেন অন্য এক জগৎ এই খাসিয়া পল্লী।"
রুমানা স্থানীয় মানুষ। ঘুরে বেড়ানোটাই স্বাভাবিক। তবে অটো যখন আস্তে আস্তে ভিতরে ঢুকলো তখন দুইপাশের পানক্ষেত আর সুপারি ক্ষেত দেখে কেমন ভয় ভয় লাগছিলো চৈতির। তার নানি বলতো পানক্ষেতে নাকি জ্বীন থাকে। জুতা খুলে প্রবেশ করতে হয়। একটু উপর নিচ হলেই তারা মেরে ফেলে। হলদে সাদা মুখটা লালচে হয়ে উঠলো। কেউ তা লক্ষ্য করেনি। রুমানা আপন মনে বলছে।
"এটা হলো খাসিয়াদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কি সুন্দর না তাদের বাড়িঘর?"
সত্যিই অনেক সুন্দর। দুতালা পুরানো দিনের রঙ বেরঙের বাড়ি। অসাধারণ কারুকার্যময়। পুরানো ধাঁচে তৈরি। ভয়টা একটু ঘুচলো চৈতির। লোকালয়ে তারা এখন।
"দেখ টুকি এটা হলো খাসিয়াদের গীর্জা।"
হরেকরকম রঙের কাপড় পরা দুয়েকজন চ্যাপ্টা নাকের খাসিয়াও দেখা গেলো ততক্ষণে। নারীতন্ত্র খাসিয়া সমাজের নারীদের দেখলে মনে হয় একেকটা রাণী। তাদের ভাব গাম্ভীর্যই অন্যরকম।
অটো থামাতে বললো রুমানা।
"তোদের একটা চা বাগানে নিয়ে যাবো। একটু ভিতরে। হেঁটে যেতে হয়। পাশে তেজপাতা, গোলমরিচ আর কমলা ক্ষেতও আছে। কি রে টুকি মন ভালো হলো?"
"খুউব।"
অটো থামিয়ে তারা চললো খাসিয়া পল্লীর পাশে চা বাগানের ভিতর। কথা বলতে বলতে কিছু দূর আগাতেই তিনজন খাসিয়া পুরুষ পথ রুখে দাঁড়ালো তাদের। বাঁধা পেয়ে অবাক হলো তিনজনেই। তাদের ভাষার কিছুই বুঝলোনা তারা। কিছু সময় অতিক্রম হওয়ার পর একজন খাসিয়া নারী এগিয়ে এলেন। রুমানার সাথে কথা বললেন তিনি। তার কথার সারমর্ম এই যে,
"তাদের খাসিয়া একলোক চায়ের বাগানের পাশে এক গাছে গলায় দড়ি পেঁচিয়ে ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করেছেন দুদিন আগে। তার বউ, বাচ্চাকে পাওয়া যাচ্ছিলো না। অতঃপর কয়েক টুকরা শরীরের অংশ পাওয়া গিয়েছে তাদের।"
আবারও ভয় ঝেঁপে ধরলো মাহাকে। শরীর কাঁপছে তার। যেকোনো সময় পরে যেতে পারে সে।
"রুমা...রুমানা এখান থেকে চল।"
অতিশীঘ্রই খাসিয়া পল্লী ত্যাগ করলো তারা। সন্ধ্যা নেমে এসেছে। হাঁড় কাঁপানো শীত পড়েছে চারদিকে। লেগুনায় চৈতির কাঁধে মাথা দিয়ে বসে মাহা। মনটা আবার বিষিয়ে উঠেছে তার। হঠাৎই লেগুনাটা থেমে গেলো। তখন......
.
.
.
চলবে.............................