!!১৬!!
"প্লিজ, আমাকেও আপনার সাথে নিয়ে যান। একটু সাহায্য করুন।" মাহার কাতর সুর।
অন্ধকার চারপাশে। দুইধারেই জঙ্গলে আবৃত। সার্থক ট্রেনের দরজা দিয়ে নিচে নেমে এসেছে। চারপাশে আহাজারি। ডাকাত হামলা করেছে ট্রেনে। এখনো তাদের বগিতে আসেনি। তবে আসতে কতক্ষণ! মোবাইলেও নেটওয়ার্ক নেই। সার্থকের অনেক ইচ্ছে করছিলো আশেপাশের বগিতে থাকা মানুষদের সাহায্য করতে। তা সম্ভব নয়। প্রত্যেক বগির দরজার সামনে ডাকাতের সদস্য দাঁড়িয়ে। তাদের বগিটা সবার শেষে। এই বগিতে মানুষও কম। এখনো ডাকাতের দল এদিকটায় আসেনি।
"কি ভাবছেন? একটু সাহায্য করুন।"
মাহার করুন কন্ঠে ধ্যান ভাঙ্গে সার্থকের।কেবিন থেকে বের হওয়ার সময় মেয়েটাও তার পিছন পিছন এসেছে। সার্থক বুঝতে পারছে এভাবে কাপুরুষের মতো পালিয়ে যাওয়াটা ঠিক হচ্ছেনা তার। তবে এখানে থাকলেও কি! সে তো কাউকে সাহায্য করতে পারবেনা! উল্টো জীবন হারাবে।
"আমাকে একটু নামিয়ে দিন।"
আবারো মাহার কন্ঠ। ট্রেনের দরজাটা অনেক উঁচুতে। সার্থক লাফিয়ে নেমে গেলেও থ্রি-পিস পরনে মাহা তা পারছেনা। সার্থকের মাথায় আসছেনা কি করে নামাবে। এদিকে বেশিক্ষণ থাকাটাও বিপদ।
"আপনার হাত দিন।"
নির্লিপ্ত ভাবে বলে সার্থক। যদিও মাহার এই অপরিচিত ছেলেটার সাথে যেতে ভয় লাগছে তবুও ডাকাতের থেকে সম্ভ্রম হারানোর চেয়ে তা অনেকটা ভালো।
"কি হলো হাতটা দিন।"
আবছা আলো এদিকটায়। বগির ভিতরের হলুদ বাতির আলোর ছিটে কিছুটা আসছে। দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগে হাতটা বাড়িয়ে দিলো মাহা। সার্থক ধরে টান দিবে এমন সময় তাদের দেখে ফেললো দুজন ডাকাত।
"ওস্তাদ ঐ যে, ঐ যে। দুইডা পোলা মাইয়া।" হইহই করে উঠলো দুজনে।
মাহা ভয়ে তটস্থ হয়ে গেছে। আল্লাহর কাছে চাচ্ছে কেবল এবার যেন বেঁচে যায়। হঠাৎ একটা হেঁচকা টানে তাকে কোলে তুলে নিলো সার্থক। ট্রেন প্রায় মাটি থেকে এক মিটার উঁচুতে। ভয়ে চোখ মুখ বন্ধ করে নিলো মাহা। এই বুঝি তার জানটা গেলো। অতঃপর তা হয়নি। শূন্যে ভাসছে সে। কারো উষ্ণ বুকের আওয়াজ আসছে তার কানে। ধুকপুক ধুকপুক।
ঘুটঘুটে অন্ধকারে ঘেরা চতুর্দিক। আশেপাশে কেবল জঙ্গল আর জঙ্গল। মাঝদিয়ে চলে গিয়েছে একটা রেলপথ। সেই রেলপথ ধরে মাহাকে কোলে নিয়ে ছুটছে সার্থক। তাদের পিছনে ছুটছে দুজন ডাকাত। মাহা ট্রেনে থাকাকালীন একনজর তাকিয়ে ছিলো। বিশাল দানবীয় শরীরের আকার। হাতে দাউদাউ করছে মশাল। আরেক হাতে বর্শা। পিছন থেকে হইহই আওয়াজ ভেসে আসছে। সেদিকে কান নেই সার্থকের। সে বুকের মাঝে একটা অপরিচিত মেয়েকে নিয়ে দৌড়াচ্ছে। প্রাণপণে দৌড়াচ্ছে।
বিপত্তি ঘটলো এবার। একটা পাথরে পা লেগে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে সে। মাহা ছিটকে পড়ে পাশে। দূরে মশালের আলো আর হাসির শব্দ ভেসে আসছে। দুটো নয় কয়েকজোড়া মশাল। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে মাহা। এবার কি তবে সব শেষ!
!!১৭!!
পাথরের ঘষায় পা ছিলে গিয়েছে সার্থকের। দূরে ডাকাতের দল দৌড়ে আসছে। অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছে কয়েক জোড়া মশাল। সামনে সরু ট্রেনের রাস্তা। দুইপাশে বন। নিজের কথা এখন ভাবছেনা সার্থক। ভাবছে মেয়েটার কথা। মেয়েটা ব্যথা পেয়েছে বোধহয়। অন্ধকারেও বুঝতে পারছে সার্থক। মেয়েটা ভয়ে ঠকঠক কাঁপছে। কি করা যায়! হাতে সময় আছে কয়েক সেকেন্ডেরও কম। নিজেকে শক্ত করে উঠে দাঁড়ালো সে। অন্ধকার সয়ে এসেছে চোখে। সে দৌড়ে গেলো মাহার পানে। শক্ত করে ডান হাতটা আঁকড়ে ধরলো তার। মাহা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হাতটা মনে হলো অনেক ভরসার। আবারো হেঁচকা টানে মাহাকে নিয়ে দৌড়ে বাম দিকের জঙ্গলে ঢুকে পড়লো সার্থক। এছাড়া আর কোনো উপায় নেই। মেয়েটাকে হয়তো সে কোলে নিতো। এমুহূর্তে পায়ের কারণে তা সম্ভব হচ্ছেনা। সার্থকের কালো হুডির একটা পাশ গাছের সরু ডাল লেগে ছিঁড়ে গিয়েছে। তার মাশালগুলো ফুলে ফেঁপে উঠছে। ডক্টর ফায়রাজ সার্থক এভাবে পালাবে কখনো কল্পনাও করা যায়না। তাহলে এর পিছনে কারণ কি! মাহার হাতটা তখনো শক্ত করে ধরে রাখা। পিছনে আর কেউ আসছেনা এখন। জঙ্গলের অনেকটা গভীরে চলে এসেছে তারা। হরেকরকম ডাক ভেসে আসছে চারদিক থেকে। জঙ্গলের উত্তরাংশ থেকে ভেসে আসছে পেঁচার ডাক। পাথরের মতো স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো মাহা। ভয়ে এবার কান্নাই করে দিলো। হঠাৎ বাঁধায় থমকে দাঁড়িয়েছে সার্থক। এত ক্ষণ কারো মুখেই কোনো কথা ছিলোনা।
"কি হয়েছে?"
সার্থকের নরম কন্ঠস্বর। এবার ফুঁপিয়ে উঠলো মাহা। নিকষকালো আঁধার ঠেলে উড়ে গেলো দু'একটা বাদুড়। অন্তর আত্মা কেঁপে উঠলো মাহার। আশেপাশের জঙ্গল, বড় বড় গাছপালা। সবকিছু দেখে কেমন মাথা ঘুরাচ্ছে তার। ডালপালায় ভরা চারদিক। আবার কিছু বাদুড়ের দল উড়ে যাওয়ার শব্দ হতেই সার্থক কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো মাহা। ঠকঠক করে কাঁপছে সে। শরীরটা বরফের চেয়েও বেশি ঠান্ডা।
"আমা....আমার ভয় লাগছে।"
সার্থকের একটা হাত চলে গেলো মাহার মাথায়। হাত বুলিয়ে দিচ্ছে সে।
"ওরা, ওরা কি আসছে?"
"না, এখন বোধহয় আর আসছেনা। তুমি টেনশন করোনা।"
নিস্তব্ধতা। অজানা জঙ্গল। ঘুটঘুটে অন্ধকারের মাঝে অজানা, অচেনা ছেলের বুকে মাথা রেখে একটা ভরসা খুঁজে পাচ্ছে মাহা। শক্ত বুকটা। অনেক চওড়া। কি সুন্দর ঘ্রাণ শরীরে। কি সম্মোহনী ঘ্রাণ! ঝাঁকড়া চুলের ছেলেটা। মাহা ভুলে গেলো সকল কিছু। সবকিছু। অন্ধকারের মাঝেও চোখে ছেয়ে গেলো আরেক অন্ধকার। ডক্টর ফায়রাজ সার্থকের শক্ত বুকের মাঝেই ঢলে পড়লো সে। যেন নিজেকে সঁপে দিলো সেই ফর্সা রঙা, অদ্ভুত কালো মণির ছেলেটার কাছে। মেয়েটাকে বুকে লুটিয়ে পড়তে দেখে ভরকে গেলো সার্থক।
!!১৮!!
আঁধারে ছেয়ে আছে চারিদিক। কোথায় কাউকে দেখা যাচ্ছেনা। একটা সরুরাস্তা। মাহা রাস্তাটা ধরে হেঁটে চলেছে। পরনে নীল রঙের একটা গোলজামা, কালো লেগিংস আর কালো জ্যাকেট। তার কুঁকড়া চুলগুলো ছেড়ে রাখা। সে হাঁটছে আর হাঁটছে। জায়গাটা কোথায়? কেবল অন্ধকার। পাশে কে যেন হাতটা দৌড়ে এসে আঁকড়ে ধরলো।
"মাহা, এই মাহা।"
চৈতির আওয়াজ না এটা। হুম, চৈতিরই তো! তার পাশে হাঁটছে। পরনে তার মতোই কাপড়। খিলখিলিয়ে হেসে কি যেন বলছে! মেয়েটা সত্যিই অনেক সুন্দর। হঠাৎ মাহার কন্ঠস্বর।
"সিলেট যাবি?"
নিজের কাঁধ সমান চুলগুলোকে দুলিয়ে দুলিয়ে দৌড়ে সামনে চলে গেলো চৈতি। চৈতি লম্বা বিদায় তার সাথে দৌড়ে পারছেনা মাহা। তাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো সে। চিৎকার করে প্রশ্ন করলো,
"কিরে বল?"
দৌড়াতে দৌড়াতেই পিছনে তাকালো চৈতি। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললো,
"যাবো তো। অবশ্যই যাবো।"
হাওয়ায় মিলিয়ে গেলো চৈতি। তারপর.....
তারপর আবার অন্ধকার। একটা পিচঢালা রাস্তা ধরে হাঁটছে মাহা। হাঁটছে আর হাঁটছে। এখন আবার ঘাষে ঢাকা এবড়ো থেবড়ো পথ। পা বোধহয় খালি তার। পায়ে লাগছে শিশির বিন্দু। আলোর দেখা পাওয়া গেলো এবার। দূরে। ঐ তো দূরে আলোর দেখা মিলেছে। আবার আশপাশটা আলোকিত হয়ে গেলো। মাহার হাঁটা থামেনি। সে চলছে। আলোর দেখা মিলতেই জামা পাল্টে গেলো তার। গেরুয়া রঙের থ্রি-পিস। উপরে মনিপুরী শাল। হাতে বড় ট্রলি। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে সে। আশেপাশে কত মানুষ! হকারদের ডাক। পাশে এক লোক হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করছে। অপরপাশে আরেকজন ভুট্টা বিক্রি করছে। একটা ছোট ছেলে ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছে। বুরকা পরা তার মা তাকে কোলে নিয়ে বলছে,
"না, না। বাবা, কাঁদেনা। কাঁদেনা।"
বারেবারে ঘড়ি দেখছে মাহা। চৈতি কোথায়! মেয়েটা সবসময় লেট!
"এই শসা। শসা। পাঁচ টাকা পিস। লবণ, মরিচ দিয়ে শসা।"
হাক ছাঁড়তে ছাঁড়তে পিছন দিক দিয়ে চলে গেলেন এক হকার। আর কতক্ষণ পড়েই ট্রেন ছেড়ে দিবে। কোথায় চৈতি! মোবাইলটা বের করলো মাহা। এমন সময় কে যেন পিছন থেকে চোখ চেপে ধরলো তার।
"এসবে চলবেনা। কানে ধর।"
চৈতি মুচকি হেসে কানে ধরলো। তবে নিজের না মাহার। মেয়েটা এতো দুষ্টু!
একটা ট্রেনের কেবিন। ছিমছাম সুন্দর ফার্স্ট ক্লাস কেবিন। ছোট ঘরটা। ট্রেন চলতে শুরু করেছে। যাত্রাপথ বোধহয় সিলেট। চিরায়ত ঢাকা শহর ছাড়তেই বুকটা ছ্যাঁত করে উঠলো মাহার। চৈতি পাশে বসে সমান তালে বকবক করে যাচ্ছে। মাহাও বলছে। কি বলছে মনে করতে পারছেনা। তবে সে বলছে। অনেক কথা বলছে। বাইরে হালকা রোদ। একটা ঠান্ডা হিমেল হাওয়ার ছড়াছড়ি। মনিপুরী সাদা আর কালোর মিশ্রণে শালটা নিজের সরিয়ে আরেকটু জড়িয়ে নিলো মাহা। অনেককিছু হচ্ছে। কি হচ্ছে খেয়াল নেই। তবে হচ্ছে। ট্রেন চলছে। ঝালবুট খাচ্ছে মাহা, চৈতি। ঐ তো দূরে একটা নদী। আচ্ছা, নদীটার নাম কি? কি সুন্দর নদীটা। ছলছল পানি। মাহা কি একটা নাম দিবে? নামটা যদি হয় "উদাসমনা স্রোতস্বিনী?"
আরো কত কি বাইরে। কত গাছপালা! কত দালান কোঠা। ঐতো দেখা যায় কৃষকেরা মাঠে কাজ করছে। পাশে বসে চৈতি। অনেক কথা বলছে দুজনে। অনেক গল্প! কি গল্প! শুনতে পাচ্ছেনা কেন মাহা! একটা শব্দ কানে বাজলো।
"অদলবদল।"
অনবরত সেই শব্দটাই উচ্চারণ করছে মাহা। চৈতি হেসে বলছে,
"কি রে আজ থেকে তুই তো চৈতি!"
মাহা, চৈতি কেন হতে যাবে? মেয়েটা সেই কখন থেকে বলছে চৈতি শুন। এই চৈতি এটা। এই চৈতি ঐটা। আর মাহা তাকে মাহা বলে সম্বোধন করছে। দুজনেই আবার হেসে লুটিয়ে পড়ছে। কিন্তু কেন! আবার অন্ধকার। একটা রাস্তা। এটা তো সেই রাস্তা যেটাতে হাঁটছিলো মাহা। চৈতি নাই। ট্রেন নাই। কান্না করা বাচ্চাটা নাই। ভুট্টা বিক্রেতা নাই। হাওয়াই মিঠাই ওয়ালা নাই। শসা বিক্রেতা নাই। কেবল মাহা। একা। চারপাশে অন্ধকার। ঘুটঘুটে অন্ধকার। এক ফোঁটা আলো নেই। এবার চিৎকার করে উঠলো মাহা। আবার চিৎকার করতে যাবে এমনি একটা শক্ত হাত মুখ চেপে ধরলো তার। একটা উষ্ণ স্থানে সে। কোথ থেকে যেন তবলার তাল ভেসে আসছে। নাকি এটা কারো বুকের শব্দ!
.
.
.
চলবে.............................