যদি তুমি জানতে - পর্ব ২০ - ইসরাত জাহান তানজিলা - ধারাবাহিক গল্প


কাঁদতে কাঁদতে নিস্তেজ হয়ে পড়লো রুপা। কোন কথা বলছে না ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। নিচু গলায় সাহেলা বেগম কে বললো,
-'আম্মু তুরান কি সত্যিই বিয়ে করেছে? নাকি মিথ্যা বলছো? ওর সাথে একবার দেখা করবো। ওর বাসার ঠিকানাটা দেও।'
সাহেলা বেগম অপ্রস্তুত ভাবে বললো,
-'মিথ্যা বলবো কেন তোকে? আর তু্রানের সাথে তোর কি সম্পর্ক ছিলো? থাকলে ভুলে যা ওসব। দেখলিই তো ছেলেটা কত স্বার্থপর!'
আজিজ চৌধুরী তীক্ষ্ণ চোখে সাহেলা বেগমের দিকে তাকিয়ে আছে। কি নিখুঁত অভিনয় করছে সাহেলা বেগম! 
রুপা জানালার গ্রিলের ফাঁক করে তাকিয়ে আছে আকাশের দিকে। কিছুই ভাবতে পারছে না।সাহেলা বেগমের কথাও বিশ্বাস করতে পারছে না। এরকম কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলো না রুপা। কষ্টে নির্বিকার হয়ে বসে রইলো। এ যেন তুরানের উপর তীব্র অভিমান। কেন করলো তুরান এমনটা? রুপার চোখ থেকে এখন আর পানি পড়ছে না অথচ হৃদয় রক্তক্ষরণ হতে লাগলো। রুপা কাঁপা কাঁপা গলায় আবার বললো,
-'আমি তুরানের সাথে দেখা করবো। তোমরা কিছু একটা করো। নয়ত আমি বাঁচতে পারবো.. কিছুতেই না।'
রুপার বাবা-মা সাহেলা বেগমের দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি তাঁদের! রুপার মা হাতের ইশারায় সাহেলা বেগম কে রুম থেকে বের হতে বললো। বারান্দায় চেয়ারে গিয়ে বসলো রুপার মা,সাহেলা বেগমও বসলো। রুপার মা ছলছল চোখে সাহেলা বেগমের দিকে তাকিয়ে রইল। আর সাহেলা বেগম অপরাধীর ভঙ্গিতে বসে রইলো। এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি কখনো হতে চায়নি সাহেলা বেগম তাই তুরান কে বাসা থেকে বের করে রুপা কে তাঁদের কাছে দিয়ে দিলো। অথচ আজ সেই পরিস্থিতিরই মুখোমুখি হতে হলো। রুপার মা অস্ফুট স্বরে বললো,
-' তুই জানিস না রুপার জীবনটা? নতুন করে মনে করিয়ে দিতে হবে তোকে? আমার মেয়েটার সাথে কেনই বা এমন হচ্ছে বলে? একটার পর একটা বিপদ তছনছ করে দিচ্ছে ওকে। তুই ওর দিকে একটু খেয়াল রাখবি না?'
-'আমি যথেষ্ট খেয়াল রেখেছি কিন্তু এমনটা হবে ভাবতে পারিনি।'
তারপর কিছুক্ষণ দুইজনের মাঝে নিরবতা বিরাজ করলো। দুজনই চিন্তিত মুখে বসে রইলো। নিরবতা ভেঙে রুপার মা বললো,
-'ওই ছেলেটার সাথে কত দিনের সম্পর্ক ওর? এখন কি করবো আমি বল? আর যন্ত্রণা নিতে পারছি না, আমার চোখের সামনে আমার মেয়েটা তিলে তিলে শেষ হয়ে যাচ্ছি।'
-' সম্পর্ক কতদিনের তা জানিনা। আমি যখন এ ব্যাপারটা জানতে পেরেছি তখনই তুরান কে বাসা থেকে বের করে দিয়েছে।'
-' শতরুপা যে বলছে ছেলেটা বিয়ে করছে?'
-' মিথ্যা বলেছি আমি। এ ছাড়া আর কি বললো বল?'
রুপার মা কিছুক্ষণ চুপ থাকলো আবার। তারপর বললো,
-'যা হওয়ার তা তো হয়েছিই। এখন এই সমস্যার সমাধান কি হতে পারে? রুপা কে দেশের বাইরে নিয়ে যাবো কয়দিন বাদেই। কিন্তু ও যদি আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে। ভয় হচ্ছে। তাই জোরপূর্বক কিছুই করতে চাচ্ছি না। তাছাড়া প্রনয় আসবে সামনের মাসে।'
সাহেলা বেগম প্রত্যুত্তরে কিছুই বলছে না। সাহেলা বেগম কে নিরুত্তর দেখে রুপার মা আবার বললো,
-'আরেকটা কাজ‌ করতে পারি আমরা।'
সাহেলা বেগম আগ্রহী গলায় বললো,
-'কি কাজ বল?'
-'আমরা ওই ছেলেটার সাথে এ ব্যাপারে কথা বললেই পারি। শিক্ষিত ছেলে আশা করি বুঝবে। রুপার অতীত , রুপার সব এক্সিডেন্টের কথা।'
-' ছেলেটা যদি না বুঝে?'
-'না বুঝলেও কিছু এসে যায় না। আর অবশ্যই বুঝবে। আর আমায় একটা কথা বল তো ছেলেটা কি জানতো না রুপা হিন্দু?'
-'হয়ত বা না।'
-' তুই আমায় ওর সাথে দেখা করার ব্যবস্থা কর। ছেলেটা কে তুই বাসা থেকে বের করে দিলি, এভাবে কোন সমস্যার সমাধান হতে পারে না । আর সম্পর্কে জড়ানোটা ভুলের তেমন কিছু না, এই বয়সে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু ভুল হলো ওদের দুইজনের এক পথে চলা সম্ভব না । ছেলেটা জানে না রুপার সম্পর্কে। এভাবে বাসা থেকে ওকে বের করে দেওয়া ঠিক হয়নি ,এটা এক ধরনের মূর্খতা।'
পূজা রায়ের কথা গুলো যৌক্তিক বটে। সাহেলা বেগম এভাবে কখনো ভেবে দেখেনি। আজিজ চৌধুরীর কাছে তুরানের ফোন নম্বর ছিলো। সাহেলা বেগম আজিজ চৌধুরীর কাছ থেকে ফোন নম্বর চেয়ে নিলো তুরানের। আজিজ চৌধুরী বুঝতে পারছে না সাহেলা বেগম কি করতে চাচ্ছে? আজিজ চৌধুরীর কোন কথার জবাব দিচ্ছে না সাহেলা বেগম। 
পূজা রায় নিঃশব্দে কাঁদছে। মেয়ের জন্য আর কত কাঁদতে হবে তার অন্য নেই! কি অসহ্য একটা যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছে মানুষ গুলো। 
পূজা রায় বললো,
-' ছেলেটা কে ফোন দিয়ে নিচ তলায় আসতে বল।‌ শতরুপা যেন না দেখে ওকে।'
.
রুপা বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় আছে। কাঁদতে পারছে না হাজার চেষ্টা করেও। চোখ থেকে এক ফোঁটা পানিও পড়ছে না। সব পানি যেন শুকিয়ে গেছে। বেঁচে থাকার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলেছে। সব কিছু বিষাদ আর যন্ত্রণাময় মনে হচ্ছে।‌‌‌এত যন্ত্রণা নিয়ে কি বেঁচে থাকা যায়? 
তুরানের সাথে কাটানো প্রতিটি মূহুর্ত।‌ তুরানের দেওয়া চিঠি গুলো, পায়ের নুপুর, কালো শাড়ি টা। কি নিদারুন যন্ত্রণা! তুরানের স্পর্শ এসব ভাবতেই তুরানের যন্ত্রণা আরও তীব্র হয়ে উঠছে।‌‌‌‌‌‌‌ আর যাই হোক এত তীব্র যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না। মুর্তির মত বসে আছে রুপা। নিস্তেজ হয়ে গেছে একদম। 
.
সাহেলা বেগমের ফোন পেয়ে খুব বেশি চমকে গেছে তুরান। কয়েকবার এসেছিলো রুপার খোঁজে কিন্তু দারোয়ান গেট দিয়ে ঢুকতে দেয়নি। সাহেলা বেগম নিষেধ করেছে দারোয়ান কে। হাজার চেষ্টা করেও রুপার সাথে দেখা করতে পারেনি তুরান।
গায়ে প্রচন্ড জ্বর তুরানের। সমস্ত শরীর যেন অবশ হয়ে গেছে, নির্জীব হয়ে পড়েছে তুরান। চোখের পানি আটকে রাখতে পারছে না হাজার চেষ্টায়, রুপার কথা ভাবতেই দুই এক ফোঁটা পানি আপনা-আপনি চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে। রুপার সাথে দেখা করার জন্য এত চেষ্টা করলো কিন্তু বরাবরই ব্যর্থ হলো তুরান। জীবন টা দিনে দিনে দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে তুরানের। এত টা কষ্ট বয়ে বেড়াতে যেন ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। তুরান এখন স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে সাহেলা বেগম মিথ্যা বলেছে, রুপা বিবাহিতা নয়।
সাহেলা বেগমের ফোন পেয়ে হতভম্ব হয়ে গেলো তুরান। কেন যেতে বলেছে সাহেলা বেগম? তুরান ভাবতে পারছে না কিছুই। হাজার প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে তুরানের মনে। রীতিমত ঘামতে শুরু করলো তুরান। কি এমন কারন থাকতে পারে যার জন্য সাহেলা বেগম ফোন করেছে? তুরানের ভাবনা শেষই হচ্ছে না । যদি এমনটা হয় রুপার সাথে সম্পর্ক মেনে নেয় সবাই নাকি খারাপ কিছু হবে? উত্তেজনায় দম বন্ধ হয়ে আসছে তুরানের। 
পড়নে যা ছিলো তাই পড়ে রওয়ানা হলো তুরান। পথ যেন শেষই হচ্ছে না তুরানের। হাত-পাও খানিকটা কাঁপছে। রুপার মুখটা কতদিন দেখছে না! কেমন আছে রুপাটা কে জানে? হয়ত খুব পাগলামি করছে। 
-'মামা একটু তাড়াতাড়ি রিকশা চালান না!'
রিকশাওয়ালা বিরক্ত হয়ে তুরানের দিকে তাকায়। এই নিয়ে কম হলে দশ বার এই কথাটা বলেছে‌ তুরান।
-'আপনের এতই যহন তাড়া হেলিকপ্টারেই তো যাইতে পারতেন।'
রিকশাওয়ালার কথার প্রত্যুত্তর করলো না তুরান। যেন পথই শেষ হচ্ছে না। কি বলতে ডেকেছে সাহেলা বেগম? তুরানের বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে উঠছে বার বার।
রিকশা এসে থামে চিরপরিচিত সেই বাড়িটার সামনে। তুরান রিকশাওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে বাড়ির গেটের ভিতরে ঢুকলো।
তুরান কে দেখে এগিয়ে আসলো সাহেলা বেগম। বাড়ির নিচ তলায় তিনটা চেয়ার পাতা। তুরান কে দেখে রুপার মা বললো,
-' বোস।'
সাহেলা বেগম চেয়ার টেনে বসলো। তুরান দাঁড়িয়ে রইলো। রুপার মা আবার বললো,
-'বসছো না কেন? আমি কে তাই ভাবছো? আমি শতরুপা রঙ্গন রায়ের মা। যাকে তুমি রুপা নামে চিনো।'
তুরান তীক্ষ্ণ ভাবে তাকিয়ে দেখছে পূজা রায়কে। সিঁথিতে সিঁদুর দেওয়া ,হাতে সাদা শাঁখা। তুরান অস্ফুট স্বরে বলল শতরুপা রঙ্গন রায়!


হাতে সাদা শাঁখা আর সিঁথিতে সিঁদুর দেওয়া মানুষ টা রুপার মা হয় কিভাবে? তুরান কিছুই বুঝতে পারছে না। চেয়ারে না বসে হতবুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রুপা রহস্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে।
রুপার মা পুনরায় বললো,
-'কি হয়েছে বসছো না কেন? এনি প্রবলেম?'
তুরান নিজেকে সামলে চেয়ারে বসলো। সাহেলা বেগম চুপচাপ বসে রইলো ,কোন কথা বলছে না। তিনজনের মাঝেই নিরবতা বিরাজ করছে। তিন জনই উদাস হয়ে বসে রইলো খানিকক্ষণ। নিরবতা ভেঙে রুপার মা বললো,
-'প্রথমেই আমি সরি সাহেলার আচরণের জন্য। তোমাদের বাসা থেকে বের করে দেওয়া বা গেটের ভিতরে ঢুকতে না দেওয়া এভাবে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে না।'
তুরান কিছু বলার ভাষা হারিয়ে ফেললো। কেমন নির্বাক , হতভম্ব হয়ে গেলো। নিজেকে সামলে বললো,
-'আপনি রুপার মা?'
পূজা রায় মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,
-'হ্যাঁ। খুব হতভম্ব হয়ে গেলে আমায় দেখে? তুমি হয়ত জানতে না রুপা হিন্দু তাই তো? আমিও এমনটা ভেবেছিলাম। আরো অনেক কিছু আছে তা তুমি জানো না। সবটা তোমায় জানিয়ে এ সমস্যার সমাধান করা উচিত। তাই তোমায় ডেকেছি।'
তুরানের চোখের কোণে জল জমছে। মাথার ভিতর ঝিমঝিম করতে লাগলো। কি হচ্ছে এগুলো তু্রান হিসাব মিলাতে পারছে না। মনে হচ্ছে সবটা স্বপ্ন, এক্ষুনি স্বপ্ন টা ভেঙে যাবে।
পূজা রায় বুঝতে পারলো তুরানের অবস্থা। তিনি আবার বললো,
-'আচ্ছা তুমি নাকি ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল ইয়ারে পড়ো? কত মেধাবী ছেলে তুমি! কিন্তু এরকম বোকার মত কাজ কিভাবে করলে?'
তুরান কাঁপা কাঁপা গলায় বললো,
-'কি করেছি?'
পূজা রায় ফিকে হেসে বললো,
-'এই যে একটা মেয়ের সাথে রিলেশন করলে তাঁর কাছে কি একবারও জিজ্ঞেস করো নি তাঁর অতীত? তাঁর লেখাপড়া? তাঁর ধর্ম?'
তুরান পূজা রায়ের প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছে না যেন ভিতর থেকে আটকে আসছে। অনেকক্ষণ পর তুরান বললো,
-' জিজ্ঞেস করেছি কিন্তু রুপা এড়িয়ে গেছে।'
-' এড়িয়ে যাওয়া টা অস্বাভাবিক কিছু না। শতরুপা তো নিজেই এসব প্রশ্নের জবাব জানে না। কারন ব্রেনে আঘাতের কারণে নিজের অতীত ভুলে যাওয়া মানুষ টা কিভাবে এসব জানবে বলো? একজন সাইকিয়াট্রিস্টের বাসায় ট্রিটমেন্টের জন্য থাকা একটা মেয়ের সাথে তোমার মত একটা মিউচুয়াল ছেলে কিভাবে সম্পর্কে জড়ালে?'
তুরানের মাথায় আবার যেন বাজ পড়লো। অস্ফুট স্বরে বললো,
-'কি বলছেন এসব?'
-'এটাই সত্যি। এসব শুনার জন্য নিশ্চয় কোন রকম প্রস্তুত ছিলেনা? আর ধর্মের বিষয়টা না জানা আমি দোষের মনে করছি না ,কারন রুপা একটা মুসলিম ফ্যামিলি তে থাকতো। তুমি ভেবেছিলে রুপাও মুসলিম। রুপা হিন্দু সম্প্রদায়ের হতে পারে এটা হয়ত ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারো নি? সাহেলা আমার ফ্রেন্ড, বোনের চেয়েও বেশি।'
এতক্ষণ এই প্রশ্ন টাই তুরানের মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কিন্তু নির্বাক হয়ে কথা বলতে পারছিলো না। তুরানের কি বলা উচিত? কি করা উচিত? কিছুই বুঝতে পারছে না। পৃথিবীটা যেন থমকে দাঁড়িয়েছে তুরানের। 
পূজা রায় আবার বললো,
-' তোমাকে কিছু কথা বললো এখন মন দিয়ে শুনো।'
তুরান পূজা রায়ের দিকে তাকায়। তুরানের চোখে পানি টলটল করছে। এমন দুইজন মানুষের সামনে কিছুতেই চোখের জল ফেলতে চাচ্ছে না তুরান। খুব জোর করে আটকে রেখেছে। তুরান ক্ষীণ গলায় বললো,
-'বলুন!'
পূজা রায় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললো। 
-' আমার এক মেয়ে এক ছেলে। আমার ছেলের নাম অন্তিম। ছেলেটা ছোট। আর মেয়ে শতরুপা। 
শতরুপা তুখোড় মেধাবী। শতরুপার স্বপ্ন ডাক্তার হবে, মেডিকেলেও চান্স পায়। তুমি যে মেয়েটার সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছিলে সে মেয়েটা ছিলো অসাধারণ মেধাবী একজন মেডিকেল স্টুডেন্ট। দুই ছেলে মেয়ে নিয়ে শান্তির সংসার আমার, কোন ঝামেলা ঝঞ্ঝাট নেই। টাকা-পয়সা আছে বেহিসেবি। 
তারপর একদিন রাতে কি হয় জানো? যে রাতটা একজন মায়ের কাছে মৃত্যুর থেকেও যন্ত্রণাময় সে রাতের কথা বলছি। সে রাতে আমার মেয়েটা ধর্ষণ হয়।'
তুরান আঁতকে উঠে। পুরো শরীর কাঁপছে তুরানের। রুপার মা তুরানের অবস্থা বুঝতে পেরে বললো,
-'নিজেকে সামলাও। গল্প বাকি আছে তো।'
পূজা রায় আবার বলতে শুরু করলো,
-' আমার মেয়েটা ধর্ষণ হয়। অনুভব করতে পারো তুমি এর কষ্ট?এর থেকে বড় কষ্ট এক জন মায়ের জন্য আর কি হতে পারে? ধর্ষণকারী কাউকেই চিনতে পারেনি শতরুপা। আমরা কথিত সমাজের ভদ্র মানুষ। মেয়ে ধর্ষিতা হয়েছে লোকে জানলে কি লজ্জা! মেয়েটাও এই সমাজে আর মাথা উঁচু করে হাঁটতে পারবে না! এই বিশ্রী সমাজ ব্যবস্থার কাছে হেরে গিয়েছিলাম আমরা। সমাজের মানুষের বিশ্রী দৃষ্টিভঙ্গি, মনোভাবের কারণে সেই রাত নিয়ে আর আইনের শরনাপন্ন হয়নি। লোকে জানাজানি হয়ে গেলে আমার মেয়েটা যে আর সমাজে মুখ দেখাতে পারবে না! 
ভুলে থাকতে চেষ্টা করলাম আমরা! কিন্তু শতরুপা ভুলতে পারেনি কিছুতেই। আত্মহত্যা করার চেষ্টা করে, ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেলেও ব্রেনে আঘাত খায়। নিজের অতীত ভুলে যায়, মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে। এত উঁচু বংশের মানুষ আমরা মেয়েকে মেন্টাল হসপিটালে ভর্তি করানো কি শোভা পায়? অসহ্য পাগলামি করতো শতরুপা! বাসায় আগুন লাগিয়ে দিতো, রুমের সব জিনিসপত্র ভেঙে ফেলতো। মানুষ কে ছুড়ি দিয়ে আঘাত করতো! কাউকেই চিনতো না ও! মাঝে মাঝে ওর পাগলামি তে অসহ্য হয়ে একটু রাগ দিতাম । তাই আমাদের সহ্য করতে পারতো না ও। অনেক চিকিৎসা করিয়েছি, কিন্তু কাজ হয়নি। শেষে সাইকিয়াট্রিস্ট এর কাছে যাই। সাইকিয়াট্রিস্ট সাহেলা বেগম! সাহেলা আমার বাসায় গিয়ে গিয়ে শতরুপার চিকিৎসা করতো, একটা সময়ে শতরুপা সাহেলার দারুন ভক্ত হয়ে যায়। সাহেলা ছাড়া আর কাউকে সহ্য করতে পারত না। সেই থেকে সাহেলার বাসায় থাকতো ও।'
পূজা রায় একটুকু বলে থেমে যায়। বার বার চোখ মুছতে লাগলো। তুরানের দিকে তাকায় ! তুরানের চোখ বেঁয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। পূজা রায় কিছুক্ষণ তুরানের দিকে তাকিয়ে আবার বললো,
-'আরে একটা বিষয় বলা দরকার তোমায়। সাহেলা বলেছিলো রুপা বিবাহিতা। আসলে বিষয়টা একদমও মিথ্যা না। একটা ছেলের সাথে রুপার চার বছরের সম্পর্ক ছিলো। পারিবারিক ভাবে ওঁদের আশীর্বাদও হয়েছে। আশীর্বাদের পর ছেলেটা দেশের বাইরে যায় লেখাপড়ার জন্য। শতরুপা কে ভীষণ ভালোবাসে! শতরুপা ধর্ষণ হয়েছে জেনেও বিন্দু মাত্র দ্বিধায় পড়ে নি শতরুপাকে ভালোবাসতে। কতটা ভালোবাসলে এটা সম্ভব বলতে পারো? শতরুপার এ অবস্থা শুনে পাগলের মতো চিৎকার করে কাঁদছে।ঠিক যতটা কষ্ট আমরা পেয়েছি ঠিক ততটা কষ্ট প্রনয় পেয়েছে। দেশে আসার জন্য কত চেষ্টা করেছে কিন্তু প্রবলেমের কারণে আসতে পারেনি। কয়েকদিন বাদে আসবে, শতরুপা কে দেশের বাইরে নিয়ে যাবে ট্রিটমেন্টের জন্য।'
তুরান কথা বলা ভুলে গেছে যেন। হুঁশ , জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে বোধ হয়! এর থেকে বিস্মিত পৃথিবীতে কে হয়েছে কবে? এমন হৃদয়ে রক্তক্ষরণ কার হয়েছে? এত আঘাত! এত নিদারুণ অসহায়ত্ব, যন্ত্রণা, কষ্ট, মূর্ছনা কিভাবে সহ্য করা যায়? 
তুরানের শরীর কাঁপছে, ঘেমে একাকার হয়ে গেছে। এত বাধা পেরিয়ে কিভাবে পাবে রুপা কে? কত বাধা,কত বিপত্তি, কত শত দেয়াল! যে রুপা কে সারাদিন চোখের সামনে দেখেছি, যে রুপার পাগলামি যে মুগ্ধ হয়েছে হাজার বার, যে রুপার মুখের দিকে তাকিয়ে খুঁজে পেয়েছে সহস্র বছরের ভালোবাসা! সে রুপা কে ছাড়া কিভাবে সম্ভব? ছোট এই জীবনে এত পূর্ণতা নিয়ে কিভাবে বেঁচে থাকা সম্ভব?
রুপা হিন্দু, রুপা ধর্ষিতা, রুপার আশীর্বাদ হয়েছে, রুপার অতীত, রুপার ভালোবাসার মানুষ! আর কত শত রহস্য রুপা তে? হোক রুপা ধর্ষিতা! তাতে কি ভালোবাসা থেমে থাকবে? কিন্তু আর সবকিছু?
অঝোর ধারায় কাঁদছে তুরান।ভুলে গেছে ওর সামনে দুই জন মানুষ বসে আছে।
এত কান্না,এত যন্ত্রণা, এত ব্যাথা সহ্য করার মতো না। কি নির্মম বাস্তব, কি পরিহাস!

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন