আমাদের ওয়েবসাইট ভিজিট করার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। অনুগ্রহ করে গল্প সম্বন্ধে আপনার মতামত অবশ্যই প্রকাশ করবেন। আপনাদের মতামত আমাদের এই ছোট প্রয়াসকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রেরণা যোগায়। শীঘ্রই আরও নিত্য নতুন গল্প আপডেট আসছে, সঙ্গে থাকুন। গল্পের ডায়েরি'তে প্রকাশিত প্রতিটি লেখা ও লেখার বিষয়বস্তু, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ও মন্তব্যসমুহ সম্পূর্ণ লেখক/লেখিকা'র নিজস্ব। প্রকাশিত সকল লেখার বিষয়বস্তু ও মতামত গল্পের ডায়েরি’র সম্পাদকীয় নীতির সাথে সম্পুর্নভাবে মিলে যাবে এমন নয়। লেখক/লেখিকা'র কোনো লেখার বিষয়বস্তু বা বক্তব্যের যথার্থতার আইনগত বা অন্যকোনো দায় গল্পের ডায়েরি কর্তৃপক্ষ বহন করতে বাধ্য নয়। গল্পের ডায়েরি'তে প্রকাশিত কোনো লেখা বিনা অনুমতিতে অন্য কোথাও প্রকাশ করলে তা কপিরাইট আইনের লংঘন বলে গণ্য হবে।

যদি তুমি জানতে (পর্ব ১৫)


দুই দিন পর কক্সবাজার থেকে ফিরলো রুপা'রা। এই দুই দিনে তুরানের পাগল প্রায় অবস্থা। তুরান না গেছে ভার্সিটি তে,না টিউশনি তে। রুপাকে ছাড়া সব কিছু বিষাদ লাগে তুরানের। রুপা কক্সবাজার থেকে ফিরে এসেই সোজা চলে গেলো তুরানের রুমে। তুরান একটা বেতের চেয়ারে বসে আছে । রুপার উপস্থিতি টের পেয়েও না এমন ভাবে বসে আছে যেন কেউ আসে নি রুমে। তুরানের চেহারায় রাগের ছাপ। রুপা নিজে থেকে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতেও পারছে না। রুপা আস্তে আস্তে খাটের এক কোনায় বসলো। সাহেলা বেগমের হঠাৎ জরুরি কাজ পড়লো কক্সবাজারে,সে জন্য আজিজ চৌধুরীও গেলো। রুপা কে তো আর একা বাসায় রেখে যাওয়া যায় না!
-' বিশ্বাস করুন আপনার সাথে রাগ করে যাই নি আমি। আম্মু-আব্বু দুই জনই যাবে তাই আমায়ও নিয়ে গেছে। আমি কেঁদেছি খুব, তাও জোর করে নিয়ে গেলো। আমি জানি আপনি অনেক কষ্ট পাবেন।'
এই পর্যায়ে তুরান রুপার দিকে অগ্নিবর্ন দৃষ্টিতে তাকালো। দাঁতে দাঁত চেপে বললো,
-' এত কৈফিয়ত আমি কারো কাছে শুনতে চাই নি। ভালোয় ভালোয় রুম থেকে বের হয়ে যাও।'
রুপার মন অভিমানে ছেয়ে যায়। ঠোঁটে ঠোঁট কামড়ে কান্না থামানোর চেষ্টা করছে। তুরান রুপার দিকে তাকাচ্ছেই না। অনেকক্ষণ ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে রুপা। চাপা স্বরে বলল,
-' সরি আমি। বিশ্বাস করুন কিছু করার ছিলো না আমি।'
এই টুকু বলে আচমকা তুরানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো রুপা। রুপার চোখে আষাঢ় ধারা নামতে থাকলো। প্রিয় মানুষের ছোঁয়ার রাগ মোমের মত গলে যায়, আরও যদি হয় কান্না মিশ্রিত ছোঁয়া। রুপা গায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে তুরান কে জড়িয়ে ধরলো। তুরানের ঠোঁট দুটো নিজের দখলে নিয়ে নিলো। তুরান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো। কাঙ্ক্ষিত মানুষ টার ছোঁয়ার কি যে অদ্ভুত শিহরণ! অব্যক্ত অনুভূতি! তুরানও আলতো করে চুমু খায় রুপার ঠোঁটে। রুপা মুহূর্তেই কেঁপে উঠলো। অনেকক্ষণ পরে তুরান বললো,
-' পাগলি ছাড়ো! দরজা খোলা কেউ আসতে পারে।'
রুপা দ্রুত তুরানের বুক থেকে সরে গিয়ে দূরত্ব রেখে বসলো। রুপা লজ্জা পাচ্ছে ভীষণ। তুরান মুখ টিপে হাসছে। দুই দিনের কষ্ট,রাগ কয়েক মুহূর্তেই শেষ। 
-' আচ্ছা তুমি একটা বার ও ভাবলে না কিভাবে থাকবো তোমায় ছাড়া?'
-' আমার তো কিছু করার ছিলো না।' 
তুরান চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ালো। রুপার শরীর ঘেঁষে বসে বললো,
-' তাঁরা যদি আরো কয়েক দিন থাকতো কক্সবাজার? কি অবস্থা হতো আমার?'
-' আমার বুঝি কষ্ট হয় নি?'
তুরান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-' আচ্ছা রুপা তুমি মোবাইল চালাতে পারো না? ফেসবুক, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার এসব? মাঝে মাঝে এমন অবস্থা হয় যে তোমার খোঁজ নেওয়ার উপায় ই থাকে না?'
রুপা খানিকটা চমকে গিয়ে বললো,
-' না,না আমার মোবাইল চালানো নিষেধ। আম্মু মারবে।'
-' মোবাইল চালানো নিষেধ কেন? এই যুগে মানুষ মোবাইল ছাড়া চলে কিভাবে? আর মোবাইল চালালে প্রবলেম কোথায়?
-' জানি না ওসব।'
তুরান কথা না বাড়িয়ে এক দৃষ্টিতে রুপার দিকে তাকিয়ে রইল। দুই দিন পর সেই চেনা মুখ টা দেখলো! মনে হচ্ছে কত শত বছর ধরে দেখে নি। রুপার চোখে চোখ পড়তেই লজ্জা পেয়ে চোখ নামিয়ে ফেলে রুপা। মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নেয়।
তুরান একটু হেসে বললো,
-' মুখটা এদিকে ঘুরালে কেন? দেখি না একটু! দুই দিন ধরে দেখিনি।'
-' ইস! এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমার লজ্জা লাগে।'
তুরান উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। রুপার আরও কাছে গিয়ে বসে রুপার থুতনি ধরে মুখটা উঁচিয়ে রুপার সৌন্দর্যবর্ধক কুচকুচে কালো তিলটায় চুমো খায়। রুপা চোখ বুজে ফেলে। সময়টা কে থামিয়ে রাখতে ইচ্ছে হচ্ছে রুপার । তুরানেয় ছোঁয়ার এত শান্তি কেন। 
হঠাৎ তড়িঘড়ি ভাব নিয়ে রুপা বললো,
-' সেই কখন আসছি আমি! আম্মু চেঁচামেচি করবে । যেতে হবে!'
রুপা এই টুকু বলে তুরানের দিকে তাকায়। তুরানের চুল গুলোতে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
-'ইস কি হাল হয়েছে চেহারার! মনে হচ্ছে কতদিন খাননি। গোসল সেরে বেশি করে খেয়ে সুন্দর একটা লুক নিয়ে বিকালে ছাদে আসবেন বুঝলেন?'
-' তুমি ছাড়া চেহারার হাল এর থেকে ভালো কিভাবে থাকবে বলো তো?'
-' হয়েছে হয়েছে ঢং।'
-' কোনটা ঢং কোনটা ভালোবাসা তাও বুঝো না দেখি?'
রুপা হেসে বলে ,
-' বুঝি তো! আমার শোকে দেবদাস সাজা হয়েছিল।'
তুরানও হেসে দেয়। 
রুপা রুম থেকে চলে গেলো। তুরান মনে শান্তি ফিরে পেলো। রুপা কে ছাড়া থাকতে এতটা কষ্ট হবে তুরান বুঝতে পারে না। মাঝে মাঝে প্রিয় মানুষ টার জন্য ভালোবাসা কিংবা মানুষ টার গুরুত্ব বুঝার জন্য হলেও এরকম দূরত্ব তৈরি হওয়া উচিত।
তুরান গোসল সেরে আসলো। এই দুই দিনে কেমন যেন নির্জীব হয়ে গিয়েছিল তুরান। তুরানের খুব ইচ্ছা করলো রুপার হাতে খেতে। তুরান রেস্টুরেন্ট থেকে বিরিয়ানি আর চিকেন রোস্ট নিয়ে এলো। রুপার হাতে খেলে মনে হয় সব কিছুর স্বাদ দ্বিগুণ বেড়ে যায়। ইদানিং রান্না করতে ইচ্ছে করছে না তুরানের। বেশির ভাগ সময়ই রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার কিনে এনে খায়। 
খাবার নিয়ে এসে রুপার জন্য অপেক্ষা করছে তুরান। রুপা কে রুমের বাইরে দেখছেই না। সাহেলা বেগম আর আজিজ চৌধুরী বাসায় তাই কোন রকম রিস্ক না নেওয়াই ভালো। কিন্তু রুপার হাতের মাখানো খাবার খাওয়ার ইচ্ছা দমাতে পারছে না তুরান। রুপার রুমের দিকে যেতেই দেখে বারান্দায় আজিজ চৌধুরী আর সাহেলা বেগম বসা। তু্রান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।কেন জানি তুরানের মনে হলো সাহেলা বেগম আর আজিজ চৌধুরী তুরান কে লক্ষ্য করছে। তাই তুরান স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করলো। কিন্তু কিছু কিছু মুহূর্তে স্বাভাবিক আচরণ করার চেষ্টা করলেও অস্বাভাবিক হয়ে যায়। আজিজ চৌধুরী হাত ইশারায় তুরান কে ডাক দেয়। তুরানের কলিজা কেঁপে উঠে। নিজের এমন ভয় পাওয়া নিয়ে নিজেই বিরক্ত হচ্ছে , এদিকে আসার মানে কি শুধু রুপার রুমের দিকে উঁকি ঝুঁকি মারা? কত কাজই তো থাকতে পারে। তাই তুরান সাহস জুগিয়ে সাহেলা বেগম আর আজিজ চৌধুরীর কাছে গেলো । তুরান কে চেয়ার টেনে বসতে বললো সাহেলা বেগম। তুরানও তাই করলো। 
-' তা তুরান তোমার লেখাপড়া কেমন চলছে? ফাইনাল এক্সাম কবে?'
তুরান হাসার চেষ্টা করে বললো,
-'এই তো আংকেল ভালোই।কয়েক মাস পরে ফাইনাল এক্সাম।'
তুরান একটু থেমে আবার বললো,
-' আপনাদের যে কয়েকদিন ধরে দেখিনি। কোথায়ও গিয়েছিলেন নাকি?'
সাহেলা বেগম হেসে বললো,
-' কক্সবাজার গিয়েছিলাম। হুট করে একটা কাজ পড়লো। আচ্ছা তুমি নিজে রান্না করেই খাও তাই না?'
সাহেলা বেগমের হেসে কথা বলার ধরনটা ভালোলাগে তুরানের। মানুষ টা অমায়িক! আজিজ চৌধুরী হেসে বললো,
-' ব্যাচেলর মানুষ নিজে রান্না করে খাওয়া ছাড়া উপায় কি? আমি ছাত্র জীবনে একটানা কয়েক বছর রান্না করে খেয়েছি।'
আজিজ চৌধুরী আর সাহেলা বেগম গল্প জুড়ে দিলো। তুরান নিজের অনিচ্ছাকৃত ভাবেও গল্পের প্রধান চরিত্রের ভূমিকা রাখছে। তুরানের পেটে প্রচণ্ড ক্ষুধা লেগেছে। কিন্তু কি আর করার?
আজিজ চৌধুরী তুরান কে উদ্দেশ্য করে বললো,
-' ইঞ্জিনিয়ারিং পাশের পর দেশে চাকরি করবা নাকি দেশের বাইরে চলে যাবে?'
-' যদি সুযোগ হয় দেশের বাইরে যাবো।'
-' চেষ্টা করো সুযোগ অবশ্যই হবে। তাছাড়া আর কতো ব্যাচেলর থাকবে? লেখাপড়া প্রায় কমপ্লিট বিয়ে করে নেও। অন্তত রান্না-বান্নার জামেলা থেকে বেঁচে যাবে।'
আড্ডার ভাবমূর্তির রক্ষা করতে ফিকে হাসলো তুরান। সাহেলা বেগম বললো,
-' দুপুরে খেয়েছো তো? মাঝে মাঝে রান্না করতে ইচ্ছে না করলে আমাদের বাসায় খেয়ে যাবে বুঝলে?'
-' না আন্টি খাই নি , রেস্টুরেন্ট থেকে খাবার এনেছি খাবো এখন।'
-' সেকি এখনো খাও নি? আমাদের বাসায় খাবে চলো।'
-' না,না আন্টি অন্যদিন।'
তুরান এই সুযোগের অপেক্ষায়ই ছিলো। তাড়াতাড়ি রুমে চলে যায় । রুপা বোধ হয় ঘুমাচ্ছে। রুপার হাতে খাওয়া হলো না আর আজ। সাহেলা বেগম আর আজিজ চৌধুরীর আজাইরা বকবক শুনে তুরানের পেটের ক্ষুধা যেন আরো বেড়ে গেছে। রুপা টা এত বেখেয়ালি কেন তুরান ভেবে পায় না। চোখের সামনে থাকতে পারে না সব সময়? রুমের ভিতর একদম ঘাপটি মেরে থাকে। তুরান খেয়ে নেয়। বিকাল ছাড়া আর রুপার দেখা পাওয়া যাবে না। আর সে পর্যন্ত না খেয়ে থাকলে ক্ষুধায় মরেই যাবে। তুরান খাওয়া শেষে বই নিয়ে বসলো। অনেকদিন ধরে পড়া হয় না। লেখাপড়া ইদানিং হচ্ছেই না তুরানের। এমন চলতে থাকলে পরীক্ষায় ফেল নিশ্চিত। তুরান কিছুক্ষণ পড়ে, বাজার করতে রওয়ানা হয়। 
প্রায় সব বাজারই ফুরায় গেছে। হাতে তেমন টাকা-পয়সাও নেই । এই মাস এভাবে কষ্ট করে টেনেটুনে চলতে হবে। রেস্টুরেন্টে খাওয়ার কারণে খাবার জন্য যে বাজেট নির্ধারণ করা তার চেয়ে বেশি টাকা খরচ হচ্ছে। এভাবে আর খাওয়া যাবে না । বাসায়ই রান্না করে খেতে হবে।
তুরান বাজার করা শেষে রুপার জন্য একটা গোলাপ ফুল কিনে নেয়। ফুল টার দাম পাঁচ- দশ টাকার বেশি না। কিন্তু রুপা অল্পতেই খুশি হয়। রুপা কে পায়ের নুপুর বানিয়ে দেওয়ার পর যেমন খুশি হয়েছে, দশ টাকার ফুল দেওয়ারও একই রকম খুশি হয়েছিল। 
যে মানুষ গুলো অল্পতে খুশি হতে পারে তাঁদের জীবনে হতাশা , কষ্ট কম। 


ভার্সিটি থেকে ফিরে ক্লান্ত শরীরে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো তুরান। কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে চুলোয় রান্না বসালো। হঠাৎ রুপা এসে হাজির। হাতে এক প্লেট ভাত আর একটা বাটিতে দুই টুকরো সরিষা ইলিশ। ভাত আর মাছ নিঃশব্দে টেবিলের উপর রাখলো। 
-' রান্না করতে হবে না আমি খাবার নিয়ে এসেছি।'
-' তুমি কখন আসলে? ভয় পেয়ে গেছি আচমকা কথা শুনে।'
উচ্চস্বরে হেসে উঠলো রুপা। তুরান ভ্রু কুঁচকে বললো,
-' হাসির জন্য অন্তত একটা কারন থাকা চাই। মানুষ কারন ছাড়া কিভাবে হাসে তা তোমায় না দেখলে বুঝতামই না।'
তুরান চেয়ার টেনে রুপার পাশে বসে আবার বললো,
-' লুকিয়ে এনেছো খাবার তাই না? তোমায় না কতদিন না করেছি।'
-' সব বিষয়ে না আমি মানি না। গরম করে এনেছি খাবার, খেয়ে নেন ঠান্ডা হয়ে যাবে।'
তুরান একটু হেসে বললো,
-' খেয়ে নিবো মানে ? পারবো না খেয়ে নিতে।'
রুপা আদুরে ভঙ্গিতে হাসলো। তারপর মাছ ভাত মেখে তুরানের মুখে তুলে দিলো। মাছের কাঁটা বাচতে বাচতে বললো,
-' সকাল থেকে টিউশনি তারপর ভার্সিটি, ভার্সিটি থেকে এসে আবার রান্না। বিরক্তিকর বিষয়! আর আমি খাবার নিয়ে আসলেও চেঁচামেচি করেন। তার চেয়ে বরং একটা কাজ করুন আম্মুর কাছে আমাদের বিয়ের কথা বলুন। আর কষ্ট করে রাঁধতে হবে না।'
-' আমার লেখাপড়া কমপ্লিট হতে আর মাত্র কয়েক টা মাস।তারপর বলবো।'
তুরান একটু থেমে বললো,
-' আচ্ছা আমাদের সম্পর্ক উনারা মানবে তো?'
রুপা ভাবলেশহীন ভাবে বললো,
-' কেউ মানলে মানুক, না মানলে নাই। আই ডোন্ট কেয়ার।'
রুপার কথা বলার ভঙ্গি দেখে তুরান না হেসে পারলো না।
-' বাব্বাহ এত সাহস!'
তুরান কিছুক্ষণ ভেবে আবার বললো,
-' আচ্ছা রুপা তোমার আসল গার্ডিয়ান তো তোমার মা-বাবা। তাঁরা মানবে তো?'
রুপা মুহূর্তেই মুখ ফ্যাকাশে করে বললো,
-' বললাম না কারো মানা ,না মানা দিয়ে আমার কিছু এসে যায় না।'
-' তুমি কি ছোট বেলা থেকে এখানে থাকো?'
কথাটা বলে জিব কাটলো তুরান। রুপা যদি রেগে যায়। কিন্তু তুরানের ভাবনা মিথ্যা হলো। রুপা স্বাভাবিক ভাবেই বললো,
-' না।'
কিছুক্ষণ থেমে রুপা আবার বললো,
-' আমার একটা অসুখ হয় তারপর থেকে আমি এখানে থাকি। আমি প্রথম প্রথম থাকতে চাই নি কিন্তু আমায় জোর করে এখানে রেখেছে। কয়েকদিন থাকার পর আমি বুঝলাম উনারা অনেক ভালো মানুষ। তাই আমি উনাদের মা-বাবা ডাকি। আর আমার যে অসুখ হয় ,সে অসুখের ডাক্তার সাহেলা আম্মু। এই দেশের সব চেয়ে ভালো ডাক্তার। এগুলো আমি প্রথম প্রথম বুঝতাম না, এখন এগুলো বুঝতে শিখেছি। সাহেলা আম্মু আমায় সব শিখাচ্ছে।'
তুরান থ হয়ে তাকিয়ে রইলো। নিজেকে সামলে বললো,
-' কি অসুখ হয়েছে তোমার?'
রুপা হেসে বললো,
-' এই যে ধরুন অদ্ভুত অদ্ভুত কান্ড করি, তাছাড়া আমার অনেক কিছু মনে থাকে না। এসব রোগ।'
রুপা এবার মুখ গম্ভীর করে বললো,
-' এ বিষয়ে আর কিছু জিজ্ঞাসা করলে ভালো হবে না। ভালোলাগে না আমার এসব নিয়ে কথা বলতে।'
তুরান আর কথা না বলে খেয়ে নেয়। রুপা যত্ন করে খাইয়ে দিচ্ছে। তুরান চিন্তিত মুখে খাচ্ছে। খাওয়া শেষ হলে রুপা চলে যায়। তুরান বারান্দায় পাতানো চেয়ারের উপর বসে। অনেক প্রশ্ন ঘোরপাক খাচ্ছে তুরানের মাথায়। রুপা একটু এবনরমাল। অনেক মানুষ জন্ম থেকেই একটু অদ্ভুত প্রকৃতির থাকে, তুরান ভেবেছে রুপা সে রকমেরই। রুপার প্রেমে এতটাই মগ্ন হয়েছে যে এসব নিয়ে জানারও চেষ্টা করে নি।
তুরান জানতো সাহেলা বেগম ডাক্তার, তবে কোন বিষয়ে তা জানতো না। তুরানের মনে হচ্ছে এগুলো সব জানা খুব জরুরী। রুপার বাবা-মা আছে, রুপার চলাফেরার ধরনে বুঝা যায় রুপা ভালো ফ্যামিলির মেয়ে। রুপার লেখাপড়া না করার কারনও বা কি? এমন তো না যে জন্মের পর স্কুলেই যায় নি। নিশ্চয়ই কোন কারন আছে। 
এতদিন তুরানের এসব প্রশ্ন মাথায় আসলেও, এতসব ভাবে নি। কিন্তু আজ কেন জানি ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। তুরানের প্রথম জানতে হবে সাহেলা বেগম কোন বিষয়ে স্পেশালিস্ট? তুরান অনেকক্ষণ বসে বসে ভাবলো।
.
রুপা বসে বসে হাতে মেহেদি লাগাচ্ছে আর গুনগুন করে গান করছে। যখন সময় কাটানোর কোন উপায় খুঁজে না পায় তখনই হাতে মেহেদি লাগাবে নয়ত আঁকা জোকা করবে। সাহেলা বেগম রুমে বরীন্দ্র সংগীত বাজাচ্ছে। রুপার কানে ভেসে আসছে গানের শব্দ। রুপা নিজের মনে হেসে বললো,' মন্দ নয়,ভালোই।'
রুপার হাতে মেহেদি লাগানো শেষ হতেই আস্তে আস্তে তুরানের রুমে যাওয়ার মনস্থির করলো। সাহেলা বেগম দেখলে বকবে। তাই পা টিপে টিপে তুরানের রুমের দিকে যাচ্ছে। হাতের মেহেদি তুরান কে না দেখানো পর্যন্ত শান্তি হচ্ছে না রুপার। রুপা তু্রানের রুমে গিয়ে চমকে গেলো। তুরান ব্যাগ গুছাচ্ছে। এই অসময়ে কোথায় যাবে তুরান?
রুপাকে দেখেই দীর্ঘ শ্বাস ফেলে তুরান বললো,
-' রুপা বাবা অসুস্থ হয়ে পড়েছে খুব। কথা বলতে পারছে না। আমি গ্রামের বাড়ি যাচ্ছি।'
তুরান ব্যতীত গলায় কথা গুলো বললো। তুরান কে খুব চিন্তিত দেখাচ্ছে। তুরানের চোখে পানি ছলছল করছে। 
রুপা কোন কথা বলছে না। এঅবস্থায় যে কাউকে সান্ত্বনা দিতে হয় এই দায়িত্বজ্ঞান টুকুও বোধ হয় রুপার নেই। তুরান রুপার কাছ থেকে কোন উত্তর না পেয়ে বললো,
-' আমার এক্ষুনি যেতে হবে। আমি তোমার কাছে বলে যেতাম, তা তুমিই এসে পড়লে। মন খারাপ করো না বাবাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি এসে পড়বো এখানে ডাক্তার দেখাতে।'
তুরান উদ্ভ্রান্তের মত করছে। রুপার চোখে বেয়ে জল গড়াচ্ছে। রুপা কান্না চেপে বললো,
-'তাড়াতাড়ি এখানে নিয়ে আসবেন বাবাকে। ডাক্তার দেখালে ঠিক হয়ে যাবে।'
তুরান রুপার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললো,
-' কেঁদো না পাগলি। আমি খুব শীঘ্রই এসে পড়বো। শুধু বাবার জন্য দোয়া করো। বাবার কিছু হয়ে গেলে আমার পৃথিবী থমকে যাবে।'
তুরান কিছুক্ষণ চুপ থেকে কষ্ট ভরা কন্ঠে আবার বললো,
-' আমায় নিয়ে বাবার অনেক স্বপ্ন,আমি বড় হবো অনেক। চাকরি করবো। পরিবারের হাল ধরবো, সব অভাব ঘুচে যাবে। সেদিন হয়ত বেশি দূরে না। বাবার এই স্বপ্ন গুলো যদি অপূর্ণ থেকে যায়..।'
তুরান এই পর্যন্ত বলে থেমে যায়। তুরানের চোখ বেঁয়ে একফোঁটা জল গড়িয়ে পরলো। রুপা তুরান কে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো। কিছুক্ষণ পর রুপা কান্না থামিয়ে বললো,
-' সব সময় ভালো চিন্তা করবেন। তাহলে সবকিছু ভালো হবে। আপনি বাবাকে নিয়ে তাড়াতাড়ি ফিরে আসবেন।'
-' তোমার সাথে তো যোগাযোগ করার কোন সুযোগ নেই। তোমার কাছে একটা মোবাইল থাকলে কোন প্রবলেম হতো না।'
তুরান ব্যাগ গুছিয়ে রওয়ানা হয়। রুপা ফ্যাকাশে মুখে দাঁড়িয়ে আছে। রুপা তুরানের সাথে গেট পর্যন্ত যায়। তুরান কে যতক্ষন দেখা গেছে ততক্ষন একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল রুপা। তারপর দৃষ্টি বিলীন হয়ে যায়। আর দেখা গেলো না তুরান কে, ভিড়ের মাঝে হারিয়ে গেলো।
রুপা রুমে এসে ধপ করে বিছানায় বসে পরলো। পৃথিবীর সমস্ত একাকিত্ব , শূন্যতা যেন ভর করেছে রুপার উপর। তুরান কখন ফিরবে? যদি কখনো না ফিরে? অদ্ভুত অদ্ভুত ভাবনায় তলিয়ে যাচ্ছে রুপা। 
তুরান কে ছাড়া থাকার কথা ভাবতেও পারে না রুপা। যেমন টা চলছিলো, এমন ভাবেই যদি সারাটা জীবন চলতো! রুপা নিঃশব্দে কাঁদছে। ধীরে ধীরে কান্নার বেগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। রুপা কাঁদতে কাঁদতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লো। 
রুপার ঘুম ভাঙে সাহেলা বেগমের ডাকে।রুপা ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসলো । রুপার চোখ গুলো ফুলে আছে। চুল গুলো উস্কখুস্ক দেখাচ্ছে। চেহেরায় ক্লান্তির ছাপ।
সাহেলা বেগম রুপার পাশে বসলো। রুপার চুলে হাত বুলিয়ে বললো,
-' কি হয়েছে? এমন দেখাচ্ছে কেন তোকে? শরীর খারাপ লাগে নাকি? কোন বিষয়ে মন খারাপ?'
রুপা শুকনো মুখে বললো,
-' না কিছু হয় নি।'
সাহেলা বেগম রুপার সাথে আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে বসলো,
-' রুপা তুই বোধ হয় ভুলে যাচ্ছিস আমি একজন সাইকিয়াট্রিস্ট। মানুষের চোখ দেখেই বুঝতে পারি মনে কি চলে।'
রুপা একটু ঘাবড়ে গিয়ে বললো,
-' ঘুম থেকে উঠেছি তো তাই একটু শরীর খারাপ লাগছে।'
সাহেলা বেগম কথা না বাড়িয়ে বললো,
-'পূজা আসবে আজকে।'
রুপা প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে সাহেলা বেগমের দিকে তাকালো। সাহেলা বেগম আবার বললো,
-' আরে তোর আম্মু আসবে।'
রুপা মাথা নিচু করে বললো,
-'ও।'
সাহেলা বেগম কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-' তোর মায়ের সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করবি না। যদি এবার কোন উল্টাপাল্টা করিস তো খারাপ হবে। তোর মা কতদিন তোকে দেখতে এসে আড়াল থেকে দেখে গেছে। তোর সামনে আসে নি।একজন মায়ের জন্য এটা কত কষ্টের তা কি তুই জানিস?'
রুপা আনমনে বললো,
-' করবো না খারাপ বিহেভ। যদি আমায় আলতু-ফালতু কথা জিজ্ঞেস না করে। তাঁরা এমন সব কথা বলে যে আমার মাথায় পেইন শুরু হয়ে যায়।'
এই টুকু বলে আবার তু্রানের কথা ভেবে মন খারাপে তলিয়ে যায় রুপা। কারো সাথে কোন রকম কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। রুপার সমস্ত চিন্তাভাবনা তুরান কে ঘিরে।
Author, Publisher & Developer

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

উফ!
মনে হচ্ছে আপনার ইন্টারনেট সংযোগে কিছু সমস্যা আছে। অনুগ্রহ করে আগে আপনার ইন্টারনেটের সংযোগ ঠিক করুন এবং তারপর আবার ব্রাউজিং শুরু করুন৷
AdBlock সনাক্ত করা হয়েছে!
আমরা শনাক্ত করেছি যে আপনি আপনার ব্রাউজারে অ্যাডব্লকিং প্লাগইন ব্যবহার করছেন৷ আমরা আপনাকে আপনার অ্যাডব্লকিং প্লাগইন বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করছি, কারন বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আমরা যে রাজস্ব আয় করি তা এই ওয়েবসাইট পরিচালনার জন্য ব্যবহৃত হয়।