!!২২!!
মাহাকে ছটফট করতে দেখে সার্থক তাকে ফিসফিসিয়ে বললো,
"প্লিজ, তুমি এমন নড়াচড়া করোনা।"
মাহার মাথাটা গরম হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। সে উঁচু গলায় কথা বলতে নিয়েও নিজেকে সামলালো। শান্ত কন্ঠে বললো,
"আমাকে নামিয়ে দিন।"
মাহাকে নামিয়ে দিতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো তার। সাথে সাথেই সার্থকের হাতটা জড়িয়ে ধরলো সে। সার্থক তাকে ধরে পাশে বসিয়ে দিলো।
"আপনি কি বাবুর স্ত্রী আছেন?"
কানুর কথার কিছুই বুঝলোনা মাহা। সে অবাক হয়ে তাকালো সার্থকের দিকে। সার্থক অসহায় চোখে কিছু একটা ইশারা করছে। মাহা কিছুটা বুঝতে পেরে বললো,
"জ্বি।"
সার্থক যেন এমনই একটা সুযোগের অপেক্ষায় ছিল।
"দেখুন ও যেহেতু বলে দিয়েছে নিশ্চয়ই আপনাদের আর কোনো সমস্যা নেই?"
"মাফ করবেন বাবু। আমাদের প্রধান যা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তার উপরে আমরা কিছুই বলতে পারবোনা।"
"মানে!"
কানু জবাব দেওয়ার আগেই দেওয়ান চলে এলেন। বয়সে হয়তো সাঁওতাল প্রধানেরও বড় হবেন। পরনে লুঙ্গি আর পাঞ্জাবি। মাথায় টুপি। ওদের একজনই তাকে আনতে গিয়েছিল। এসেই জগত মুর্মুর সাথে কুশল বিনিময় করলেন তিনি। এতগুলো পুরুষের সামনে নিজেকে অনেকটা অসহায় লাগছে মাহার। তার ওড়না কোথায় পড়েছে সে জানেনা। গাঁয়ে পানপাতা আর বেগুনি রঙের বাটিকের থ্রি-পিস উপরে সার্থকের কালো হুডিটা। যা মাহার হাঁটু ছুঁই ছুঁই । ডানপাশে একটা মাচায় বসে আছে সে পাশে ফায়রাজ সার্থক নামক ছেলেটা। সাঁওতাল প্রধান নিজের আসনে বসলেন। দেওয়ান অপরপাশে কানুদের সাথে বসলেন। একবার তাকালেন মাহা আর সার্থকের পানে। সাঁওতাল প্রধান সান্তালী ভাষায় কিছু বলতেই বিয়ে পড়ানো শুরু করেন দেওয়ান। মাহা মাথা নিচু করে কাঁদছে। এ কেমন পরিস্থিতি!
"আপনার নাম?"
দেওয়ান সার্থকে জিজ্ঞেস করলেন।
"খন্দকার ফায়রাজ সার্থক।"
"বাবার নাম?"
"খন্দকার ফিরোজ ফারহান।"
এবার মাহাকে ইশারা করলেন তিনি। নাম জানতে চাচ্ছেন। মাহা নিচু করে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সার্থক কোনো জবাব দিতে পারলোনা। সে তো মেয়েটার নাম জানেনা।
"মা, আপনার নাম?"
কোনো জবাব দিলোনা মাহা। দেওয়ান জগত মুর্মুর দিকে তাকালেন। জগত মুর্মু কনুকে সান্তালী ভাষায় কিছু জিজ্ঞেস করতেই সে সার্থককে বললো,
"আপনার বিবি কাঁদছেন কেন? তিনি কি বিয়ে করতে চান না?"
"আসলে...
কি জবাব দিবে সার্থক! এ কেমন পরিস্থিতি!
"আমার নাম মাহা। মাহা হোসেন। বাবা আজাদ হোসেন।"
দেওয়ান এবার সার্থককে জিজ্ঞেস করলেন,
"দেনমোহর কত দেওয়া হবে?"
এবারো জবাব দিলোনা সার্থক। তার খুবই বিরক্ত লাগছে। আশেপাশের সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। আজ পর্যন্ত নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছুই করেনি সে। আর আজ কিনা তাকে নিজের ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করতে হচ্ছে! দেওয়ান নিজের মতো একটা দেনমোহর দিয়ে দিলেন। কবুল বলার সময় বুক ফেটে কান্না আসছিলো মাহার। চেনা নেই, জানা নেই একটা অজানা ছেলের সাথে সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেলো!
তাদের একটি মাটির ঘর দেওয়া হয়েছে। ঘরটা জগত মুর্মুর বাড়িতেই। একটু আগে এসে একজন মহিলা খাবারও দিয়ে গেলেন। ঘরের এককোনায় কাঠের দরজার দিকটায় একটা মোমবাতি জ্বলছে। সারা ঘর জুড়ে কেবল ছোট একটা কাঠের চৌকি। পাশে একটা কাঠের টেবিল। সেখানে আপাতত খাবার ঢেকে রাখা। চৌকির একপাশে বসে নিঃশব্দে অঝোরে কাঁদছে মাহা। সার্থক দাঁড়িয়ে আছে জানালার কাছটায়। ছোট একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সে বললো,
"প্লিজ কাঁদবেন না।"
তুমি বলতে ইচ্ছে করছেনা তার। ছোট মেয়েটার জীবনই সে নষ্ট করে দিলো। মেয়েটার হয়তো মনের মানুষও আছে।
!!২৩!!
মাহা তার কথায় কর্ণপাত করলো কিনা কে জানে। চুপচাপ কাঁদতে কাঁদতে চৌকির একপাশে শুয়ে পড়লো।
"দেখুন আমি নিজের ইচ্ছেতে কিছুই করিনি। আসলে ব্যাপারটা যে এমন গোলমেলে হয়ে যাবে ধারণা ছিলোনা আমার। আমি যদি স্বামী-স্ত্রী পরিচয় না দিতাম তারা হয়তো আমাদের চরিত্রে আঙুল তুলতো। তাছাড়া এই শীতের রাত জঙ্গলে কাটানোর চেয়ে আমার কাছে মনে হয়েছে মিথ্যা বলে তাদের কাছে যদি কোনো সাহায্য পাই। আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন...
কথাটা বলতে বলতেই পিছু ফিরে তাকালো সার্থক। মাহা অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাইরে তাকালো সে। গাঁয়ে তার পাতলা একটা টি-শার্ট। শীতল বাতাস বইছে চারদিকে। তবুও যেন শীত লাগছেনা তার। আর কিছুক্ষণ পরেই হয়তো ভোর হয়ে যাবে। পায়ের কাটা স্থানটায় জ্বলছে। আবারো পিছনে ফিরে তাকালো সার্থক। মাহা অপরদিকে ফিরে শুয়ে আছে। মোমবাতির আলোয় কুঁকড়া চুলগুলো জ্বলজ্বল করছে। বড় ক্লান্ত লাগছে সার্থকের। ঘরে বসার মতো কিছুই নেই। দাঁড়িয়েও থাকতে পারছেনা। বাধ্য হয়ে ছোট চৌকিটার একপাশে গিয়ে বসলো সার্থক। ক্লান্ত, বিধ্বস্ত শরীরে ঘুমের দল নেমে এসেছে। মাহার পাশেই শুয়ে পড়লো সে।
মুরগ ডাকছে দূরে। টিনের চালে শিশির পড়ার টুপটুপ মোলায়েম শব্দ। বাইরে জ্বলজ্বলে মিষ্টি রোদ। বন্য তরুলতার মাতোয়ারা ঘ্রাণ ভেসে আসছে নাকে। চোখ মেলে তাকায় মাহা। উঠে বসেই অবাক হয় সে। তার পাশে একটা ছেলে ঘুমিয়ে আছে। ছেলেটার ঝাঁকড়া চুলগুলো কপালে এসে পড়েছে। ফর্সা কপালটা কুঁচকে রেখেছে সে। যেন একটা পাঁচ বছরের বাচ্চা। কি স্নিগ্ধ! কি পবিত্র! আচ্ছা? মাহা তো এতদিন জানতো ঘুমন্ত মেয়েরা সুন্দর। তবে কি সে ভুল! ঘুমন্ত ছেলেরাও অনেক সুন্দর হয়। আজ নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাসই করতোনা মাহা। হঠাৎ চোখ মেলে তাকালো সার্থক। চোখ দুটো হালকা লাল। ঘুম হয়তো হয়নি ঠিক মতো। মাহাকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সার্থক জিজ্ঞেস করলো,
"কিছু বলবেন?"
মুখটা অন্যদিকে ফিরিয়ে নিলো মাহা। আজ এই লোকের কারণেই একটা অদ্ভুত সম্পর্কে জড়িয়ে গেছে সে। কি হতো সত্য বললে! উঠে বসে নিজেকে কিছুটা সময় দিলো সার্থক। মাহা উঠে জানালার পাশটায় গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
"মাহা? মাহা না আপনার নাম?"
কোনো জবাব দিলোনা মাহা। সার্থক জবাব না পেয়ে বললো,
"দেখুন মাহা। গতরাতে যা ঘটেছে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা আমাদের দুজনের ইচ্ছের বিরুদ্ধে। ভালো হবে যদি আপনিও এটি ভুলে যান। আর আমিও।"
"আমি বাড়ি ফিরতে চাই।"
নির্লিপ্ত কন্ঠ মাহার।
!!২৪!!
মোবাইল, ব্যাগ সবকিছু ট্রেনে ফেলে এসেছে মাহা। সার্থকের মোবাইলটা অবশ্য তার পকেটে। কিন্তু এখানে নেটওয়ার্ক নেই। দরজায় টোকা পড়তেই খুলে দিলো মাহা। ইনি তো কালরাতের মহিলাটাই। হাসিমুখে খাবারের প্লেটের দিকে ইশারা করে নিতে বললেন তিনি। পরনে 'ফতা'। সাঁওতাল নারীরা এমন দু টুকরো কাপড়েরই পোশাক পরেন। উপরে একটা শাল। হাতে রূপার বালা, কানে ঝুমকা। হাতে করে একটা খয়রী রঙের শালও নিয়ে এসেছেন তিনি। মাহার দিকে এগিয়ে দিলেন তা। মহিলার এতটুকু আপ্যায়নে খুবই খুশি হলো মাহা। ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা মনের দিক থেকে অনেক ভালো। তারা অনেকটা সুশৃঙ্খলভাবে জীবনযাপন করে যা বাঙালির বড়ই অভাব।
"আপনি কি একটু বাইরে যেতে পারবেন?"
"যাচ্ছি।"
কোনো প্রশ্ন না করেই বেরিয়ে গেলো সার্থক। কালো হুডিটা খুলে শালটা ভালোভাবে গাঁয়ে জড়িয়ে নিলো মাহা। হুডিটা থেকে একটা মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসছে। এই ঘ্রাণটা ঐ ফায়রাজ সার্থক নামক ছেলেটার। মাহার গাঁয়েও তো লেগে আছে সে ঘ্রাণ!
"আপনার কি হয়েছে?"
"হ্যাঁ।"
ভেতরে প্রবেশ করলো সার্থক। তাকে কালো হুডিটা ফিরিয়ে দিলো মাহা।
"কালকে রাতের ঘটনাটুকু বাদে অনেকটুকু সাহায্য করেছেন আমার। দয়াকরে আমাকে স্টেশন অবধি পৌঁছে দিন। আমি বাড়ি ফিরতে চাই।"
কালো হুডিটার হাতের একটা দিক ছিঁড়ে গেছে। তবুও তা গাঁয়ে জড়ালো সার্থক। চেন লাগাতে লাগাতে বললো,
"আপনি খেয়ে নিন। কানুর সাথে কথা হয়েছে। এখান থেকে আধাঘন্টা হেঁটে গেলেই বাজার। বাজার থেকে লেগুনা করে স্টেশন যেতে পনেরো কি বিশ মিনিট লাগতে পারে।"
"আমি এখন কিছু খেতে চাইনা।"
অনেকটা রাগ নিয়েই কথাটা বললো মাহা। হলদে ফর্সা মুখটা লাল হয়ে উঠলো নিমিষেই। নাকটা একটু ফুলে উঠলো। কুঁকড়া চুলগুলো খোঁপা করেছে সে। এলোমেলো কয়েকটা অবাধ্য চুল ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মাহার সারা কপাল জুড়ে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য ডক্টর ফায়রাজ সার্থকের মাহার চুলগুলোর প্রতি বড় হিংসে হচ্ছে। হচ্ছে মানে হচ্ছে! কেন হচ্ছে তার কোনো উত্তর নেই তার কাছে।
গ্রামটা সুন্দর। তবে বাড়ি ফেরার তাড়নায়, বাবা কেমন আছেন তা জানার জন্য অস্থির মাহা সেসব খেয়ালই করেনি। লেগুনা তাদের স্টেশন নামিয়ে দিয়ে গেছে। রাজধানীর ট্রেন চলে আসবে কিছুক্ষণ পরেই। একটা স্টিলের বেঞ্চে পাশাপাশি বসে মাহা আর সার্থক। নিরবতা বিরাজ করছে তাদের মাঝে। গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে আছে সার্থকের। একটু পানি পান করা প্রয়োজন। মাহাকে রেখে যেতেও পারছেনা। ঢাকা পৌঁছে দেওয়া পর্যন্ত মাহা তার দায়িত্ব। আর স্টেশনেও ট্রেন থামে কেবল মিনিট তিনেকের জন্য।
"আমি একটু পানি খাবো।"
মাহার কন্ঠ শুনে তার দিকে তাকায় সার্থক। কতক্ষণ চুপ থেকে বলে,
"আচ্ছা, আমি নিয়ে আসছি।"
ট্রেন ততক্ষণে হুইসেল বাজাতে বাজাতে স্টেশনের দিকে ছুটে আসছে। সেদিকে খেয়াল নেই সার্থকের। যতক্ষণে স্টেশনে ফিরলো সার্থক ততক্ষণে ট্রেন স্টেশন ছেড়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। সার্থক সেদিকে তাকিয়ে রইলো নির্নিমেষ। বুঝতে আর বাকি রইলোনা মাহা ইচ্ছে করেই তাকে পানি আনতে পাঠিয়েছিলো। তার সাথে ঢাকা ফিরতে চায়না সে। পানির বোতলটা হাতে নিয়েই বেঞ্চে বসে পড়লো সার্থক। বিড়বিড় করে বললো,
"আর কি তোমার সাথে আমার কখনো দেখা হবে? অলকানন্দা?"
.
.
.
চলবে...........................