যদি বলি ভালোবাসি - পর্ব ৩২ - ফাবিয়াহ্ মমো - ধারাবাহিক গল্প



কোচিং থেকে এসে গোসল সেরে জানালা ধরে দাড়িয়ে আছি, কাল রাতে ঘুমাতে পারিনি। চোখ বন্ধ করলেই আকাশের নরকীয় চেহারা ভেসে উঠে, আমি ঘুমাতে পারিনা। কোচিংয়ে মন বসাতে পারিনি, ভয় যায়নি। মুগ্ধ মুখে বলেছেন রাগ করেননি কিন্তু উনি রেগে আছেন আমি জানি। ফোন করেছি ধরেননি। চোখের পানি সারারাত কেদেঁ শুকিয়ে গেছে আমার আর কান্না নেই। দুপুরে খাইনি, সকালেও গলা দিয়ে একগ্লাস ছাড়া কিছু নামাইনি। মেয়ে অপর মেয়েকে ক্ষতি কিভাবে করে স্বচক্ষে দেখলাম। বিপদ থেকে আল্লাহ উদ্ধার করেছেন। ওকে আমি আমার মতোই সহজ ভেবেছি, মিল করেছি...পরিণয় হিসেবে পেলাম আমার র্দুগতি। মুগ্ধ এসে শিফাকে কি করবেন আর আকাশকে কোথায় রাখবেন...উনি জানেন। কিন্তু মানুষের ক্ষতি করার জন্য একটা আলাদা বিচার উপর থেকে আল্লাহ দিয়ে দিবেন, এটা বিশ্বাস। মনিরার সাথে কথা বলিনি, যোগাযোগ করিনি। আমি এখনো ধাক্কায় আছি। কালরাত থেকে মুগ্ধের পর কেউ কল করেননি, হঠাৎ ভাবতে ভাবতেই কল চলে আসলো ফোনে। জানালার গ্রিল ছেড়ে ফোন নিয়ে কলটা রিসিভ করলাম, ডাক্তার সাহেব কল করেছেন-

--ব্যস্ত ছিলাম, ফোন দিয়েছিস রিসিভ করিনি। 

গম্ভীর গলায় বললেন মুগ্ধ। কোমলতার বড্ড অভাব, গলায় এখন কাঠ-কাঠিন্য সুর ধার্য হয়েছে উনার। 
--সমস্যা নেই। 
--কাল তোর বোর্ড এক্সামের রেজাল্ট দিবে.. চলে আসবো?
--আসার দরকার নেই। ট্রেনিং কমপ্লিট করে তারপর আসুন।
--ভয় কাটেনি? থাক বাদ দে। আমি আসলে ঘুরতে নিয়ে যাব। 
--বিপদ যেভাবে পাকড়াও করেছে, মরে টরে গেলে বিয়ে করে নিয়েন। রূপাকে করার দরকার নেই, আপনার অর্থ-সম্পত্তির লোভ ওর। আপনাকে দেখানো ভালোবাসা ছাড়া কিচ্ছু নেই। পারলে ভাইয়ুকে নিয়ে ভালো দুইটা মেয়ে দেখে দুজনে বিয়ে করে নিয়েন। 

মুগ্ধের নিঃশব্দে ফোনের অপরপ্রান্তে নিঃশ্বাসের ঘনকাল বেড়েছে। ঘন ঘন নিশ্বাস। চুপ উনি। কথা নেই। আমি কষ্ট দিয়ে কথা বললেও সত্যের তিক্ততা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। কাল আমি মরে যেতাম নিশ্চিত! শেষ সময়ে সাহায্যের হাত না আসলে আমি মরেই যেতাম। কতদিন বিপদ ছাড়া থাকবো ঠিক ঠিকানা নেই। হঠাৎ নিরবঞতার কোটর ভেঙ্গে চেচিয়ে বললেন উনি-

--তুই মরলেও আমি বিয়ে করবো না! কান খুলে শুনে রাখ! আমি কোনো বিয়ে করবো না! দরকার পড়লে তোর কবরের পাশে আরেকটা গর্ত খুড়ে ওখানে শুয়ে থাকবো তাও বিয়ে করবো না! আমি তোর সব কথা মানি বলে "বিয়ের" কথাও মানবো...আগেই আমি রেহাই চাই!আমাকে রেহাই দে!

বিছানায় বালিশ ঠিক করে সোজা হয়ে শুলাম।কানে ফোন, কপালে উপর  কবজির রেখে দিয়েছি। 

--আমি চলে আসি? তোর একা একা থাকা লাগবে না। আমি চলে আসি! বাসায় একা একা তাই তোর মন মেজাজ ভালো নেই। 
--প্লিজ কথা শুনুন, কাজ শেষ করুন, তারপর আসুন। আমি নিজের খেয়াল রাখছি। টেনশন করবেন না। মনিরার সাথেও কানেকশন রাখিনি, শিফার ব্যাপারে ভাইয়া দেখছে। আকাশকে খোঁজা হচ্ছে। আপনি ট্রেনিং শেষ করুন। 
--রেজাল্ট খারাপ হলে মন খারাপ করবি না। রেজাল্ট তোর একচুয়েল এবিলিটি ডিসাইড করেনা।আমি সত্যি দূরে কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাবো যেখানে তোর সব দুশ্চিন্তা দূরীভূত হয়ে যাবে। 
--আমি জানি মুগ্ধ আপনি কথা দিলে কথা রাখবেন। কিন্তু ট্রেনিংয়ে মনযোগ দিন প্লিজ। আমি সত্যি দুশ্চিন্তায় নেই, আপনার সাথে কথা হচ্ছে মন থেকে ভারী বোঝা কমে গেছে। 
--পাকনি সাজেক যাই? 
--হুম প্লেসটা সুন্দর, আমি রাজি। 
--তাহলে রেডি থাক ট্রেনিং শেষে, তোকে ইন্জিনিয়ারিং ভার্সিটিতে ভর্তি করিয়ে সাজেক যাবো ঘুরতে। 
--অবশ্যই। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে চান্স পাবো না। না পেলে কি করবেন? বকবেন? নাকি চড় লাগাবেন?
--কিচ্ছু করবো না। চান্স দিয়ে আমার যায় আসে না, সামান্য একটা চান্স না পাওয়াতে চড় দিবো? পাগল তুই?
--পাগল-ই। দেখলেন না কিভাবে একটা বাইরের মেয়েকে সহজ ভেবে বিশ্বাস করে ফেললাম। ভুলটা খুব ভুগিয়ে ছাড়ছে মুগ্ধ। 
--নিজের বোন বা কাছের বান্ধবীও ধোকা দেয় বুঝছিস। তুই  আমার কাছে ছোট্ট পাকনি লাগলেও আমি জানি তুই বড় বড় মামলা ডিল করতে পারবি। তাই ভয় নয়, জয় করবি। সমাজকে পরোয়া না করে একটা মেয়ে ছেলেকে বিয়ে করতে পারে, সে মেয়ে পাগল হলেও বোকা না মম পাকনি। তুই বোকা না, তোকে বোকা বানানো হয়েছে, আবিরের কাছ থেকে আকাশের পুরো ঘটনা শুনে এটাই বুঝলাম ছেলেটা বাজে, বখাটে। মেয়েদের ফাসিয়ে রুম ডেট করে, এখানে গন্ডগোল করেছে শিফা। শিফা মেবি মাইন্ডে রেখেছিল আকাশ হ্যান্ডসাম, চামিং  তাই রুম ডেট করতে বাধা নেই। শেষে যখন চাকা ঘুরে গেল ও তোকে ফায়দা বানিয়ে ছাড়লো। তো? কি শিখলি?? মানুষকে বিশ্বাস করলেও অন্ধবিশ্বাস করতে নেই। হোক সে আপন হোক সে পর।
--হু...
--এই এক মিনিট মিনিট!! আপন বলেছি দেখে আমাকেই অবিশ্বাস করবি! তা করলে চড় মারবো! 
--নাহ্ বিশ্বাস করি। অন্ধবিশ্বাসই করি। কিন্তু ভুল মানুষকে করছিনা। এবারটা ঠিকঠাক মতোই আছে। 
--ভেরি গুড। আকাশের চিন্তা বাদ দিয়ে পড়াশোনা কর। আমি কাল সকালে কল করবো। আবার বলছি! রেজাল্ট নিয়ে নো মন খারাপ! আমি রেজাল্টের খারাপে মন খারাপ দেখতে চাই না। 
--হুম, করবো না।মাথায় থাকবে। 

.
.

রেজাল্ট দিলো। পয়েন্ট ৪.১৭। জিপিএ ফাইভ নেই। আটকে গিয়েছি। ইন্জিনিয়ারিং ভার্সিটিতে পড়ার সুযোগ নেই, পয়েন্ট নেই। মন খারাপ না করলেও মন খারাপ নিজে থেকেই উড়াল দিয়ে আসে। মুগ্ধ সাপোর্ট করেছেন। যথাসাধ্য করেছেন, দূর থেকেই এটা ওটা বলে মন ভুলিয়ে মাইন্ড ডাইর্ভাট করার সর্বপ্রকার চেষ্টা করেছেন।। খারাপ রেজাল্টে কোনো জায়গাতেই ভালো ফল আসলো না, পাবলিক ভার্সিটি হিসেবে আশা নেই আর। মুগ্ধ এক সপ্তাহের মধ্যেই চলে আসবেন....দেখতে দেখতে দুই মাস পেরিয়ে তিনমাসের শেষ সপ্তাহ। আমার ভর্তি ডেটও কাছাকাছি চলে এসেছে, কিন্তু উনি নেই। হাতে দুইদিন বাকি প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার জন্য, পরে ভর্তি হতে চাইলে উনাদের ডিমান্ড বেড়ে যাবে আরো। মুগ্ধকে বললাম, উনি ভর্তির দায় দায়িত্ব ভাইয়ার হাতে দিয়ে দিলেন। ভর্তিও হয়ে গেলাম। উনার আসতে চারদিন বাকি। বৃহস্পতিবার আসবেন। 

"আজ রবিবার" নামটা দিয়ে হাস্যরসাত্মক একটা নাটক দেখেছি কিংবদন্তি হূমায়ূন আহমেদের। চমৎকার ছিলো! প্রচুর হেসেছি। কিন্তু আজ সত্যি সত্যি রবিবার!!! মুগ্ধ তিনমাস পর আমার কাছে ফিরে আসবেন তাতেই আমি বড্ডো বেশি খুশি!! উনি ফিরবেন!! সকাল সাড়ে দশটা বেজে গেছে,আমি মোবাইলে নাটক দেখছি। একা একা থাকতে কি যে আলাদা আনন্দ পুরোপুরি বুঝে গিয়েছি!! এখন শুধু উনাকে লাগবে। ডাক্তার  রাদিফ আবরার মুগ্ধ, নিউরোলজিস্ট। মনিরার সাথে এখনো কথা বলি না, ও আমার বাসার ঠিকানা জানে না। আবির ভাইয়াকে স্ট্যাপলার লাগিয়ে মুখ করতে বলেছি, রাফিন কোর্ট ম্যারিজে বিবাহিত। শ্বশুরবাড়ি বলে আমার কেউ নেই....বাবার বাড়ি বলেও আমার কেউ নেই। ক্ষমা - প্রার্থনা আর করবো না অনেক করেছি। মুগ্ধ যেহেতু পরিবার ছাড়া থাকতে পারবেন, আমি আরো আগে পারবো। কেন পারবো না? পারতেই হবে। আব্বুর মন নরম হলেও "কেমন আছো ভালো আছি" বলেই একমিনিটের কথায় কল কেটে দেন। আমি এখন কাউকে তোয়াক্কা বা কারো কথা গায়ে মাখি না। নিজের মতোই চলি। মুগ্ধ কল করলেন,

--এই শুনতো...মনিরা বাসায় আসবে, ভালোমতো খাতির যত্ন করবি!আমার কিউট শ্যালিকা কাল কেদেঁ কেদেঁ আবদার করেছে আমি নাকি তোকে ওর কাছ থেকে দূর করেছি!! দেখছিস? কেমন আরোপণ করলো?পাকনি প্লিজ তোর মুগ্ধের মানসম্মানের ব্যাপার  কিছু কর!!

মনিরার আসা নিয়ে আমি হচকিত হয়ে যাই! বলে কি? মনিরা বাসায় আসবে? মুগ্ধ মনিরাকে নিয়ে সন্দেহের উদ্বেগ ঘুচাচ্ছেন? কেন?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন