!!২৮!!
"বাবা।"
আজাদ হোসেন শুয়ে আছেন খাটে। শরীরটা নেতিয়ে আছে তার। শুকিয়ে রোগা হয়ে গিয়েছেন অনেকটা। মাহা বাবার পাশে এসে দাঁড়ালো। একদম শিয়রের কাছে। ডান হাতটা মাথায় বুলিয়ে আস্তে করে ডাকলো,
"বাবা?"
চোখ খুলে তাকালেন আজাদ সাহেব। মলিন হাসি দিয়ে মেয়ের মুখটা ছুঁলেন। চোখ ভিজে উঠলো তার। মেয়েটার যে এই পৃথিবীতে তাকে ছাড়া আর কেউ নেই।
"মাহা মা।"
ভিজে উঠা সিক্ত গলায় নিজের নাম শুনে ; অশ্রুর দলকে থামাতে ব্যর্থ হয় মাহা।
"বাবা"
বলেই কেঁদে দেয় সে। এই পৃথিবীতে সে যে বড্ড একা। কাঁপা কাঁপা হাতে মেয়ের চোখের পানি মুছিয়ে দেন আজাদ সাহেব।
"মা না আমার। কাঁদেনা মা।"
ছেঁচকি তুলতে তুলতে মাহা বলে,
"আমার যে ভিষণ কষ্ট হচ্ছে! বাবা।"
আজাদ সাহেব একটু উঠে মেয়ের কপালে চুমু খান। আরো ফুঁপিয়ে উঠে মাহা।
"আহ্লাদ শেষ হইলে ঔষুধ খেয়ে আমাকে উদ্ধার করেন।"
দরজায় দাঁড়িয়ে খেঁকিয়ে উঠেন দিনা। মাহাকে ছেড়ে দিয়ে বিছানায় হেলান দিয়ে বসেন আজাদ সাহেব। চোখটা হালকা বুজে গম্ভীর গলায় বলেন,
"মাহা, তুমি অনেক জার্নি করে এসেছো। যাও রেস্ট করো।"
মাহা কিছু না বলেই বাবার ঘর থেকে বেরিয়ে আসে। তার ঘরটা এখন মাহিনের। বারান্দার পাশে ছোট একটা স্টোর রুম ছিলো। সেখানে তার জিনিসপত্র রেখে দিয়েছিলেন দিনা। একটা চৌকি পেতে রাখা। মাঝে মাঝে বাসায় আসলে এই ছোট ঘরটাতেই সবটা সময় কাটে মাহার। কি অদ্ভুত! এই যে তার হাতে ব্যাগ নেই, মোবাইল নেই। একবার তো কেউ জিজ্ঞেস করলোনা এসব কোথায়! একবারও কেউ জানতে চাইলোনা তার কেন আসতে দেরি হলো! এমনকি বাবাও না। একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাহা। এই পৃথিবীর এতিম সন্তানগুলোই কেবল বুঝে মা আসলে কি। ড্রয়িং রুমের বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে পুরনো একটা জামা গাঁয়ে দিয়ে চৌকিতে শুয়ে পড়ে মাহা। শরীর ক্লান্ত, মন ক্লান্ত, মস্তিষ্ক ক্লান্ত।
________________
একটা বিশাল বড় মাঠ। চারদিকে ঘেরা পাহাড়। পাহাড়ের পাশেই নদী। মাহা একটা সাদা শাড়ি পরেছে। একেবারে ধবধবে সাদা শাড়ি। তার কুঁকড়া চুলগুলো ছেড়ে রাখা সারা পিঠময়। মিঠা রোদে ঝলমল করছে তার চুলগুলো। মাঠের দুপাশে সাদা ফুলের বাগান। মাহা মুগ্ধ নয়নে চারপাশ দেখছে। হঠাৎ একটা চিৎকার ভেসে এলো মাহার কানে। মাহা হন্তদন্ত হয়ে তাকাচ্ছে চারপাশে। কার আওয়াজ। এতোটা করুণ! কার আর্তনাদ! আবার আওয়াজটা ভেসে এলো কানে। মাহার নাম ধরেই তো চিৎকার করছে। মাহা ছুটে যাচ্ছে শব্দের উৎসের দিকে। একটা বিস্তৃত নদী। নদীর মাঝামাঝি একটা মেয়ে। পানিতে ডুবে যাচ্ছে সে। পরনে নীল শাড়ি। মাহাকে দেখে চিৎকার করলো,
"মাহা, মাহারে। বাঁচা। আমাকে বাঁচা। ভিষণ কষ্ট হচ্ছে আমার। শরীরটা ভিষণ জ্বলছে আমার।"
এটা তো চৈতি! তার প্রিয় বান্ধবী আতিয়া জামান চৈতি! মাহা লাফ দিলো নদীতে। সে তো সাঁতার জানেনা! তবুও ভাসছে কিভাবে! কাছাকাছি যেতেই নদীর গহীনে তলিয়ে গেলো চৈতি। মাহা সেখানে পৌঁছাতে পারলোনা। তার আগেই তার মুখ চেপে ধরলো একজোড়া কালো হাত। টেনে নিয়ে গেলো নিজের সাথে। ঘাড়ে একটা বিষ পিঁপড়ে কামড়ানোর মতো ব্যথা পেলো মাহা। ভিষণ জ্বলছে ঘাড়টা ভিষণ। কালো হাতদুটোতে সজোরে কামড় বসিয়ে দিলো মাহা। নদীতেই ভেসে বেড়াতে লাগলো উদভ্রান্তের মতো। হঠাৎ....
হঠাৎ নৌকা নিয়ে এগিয়ে আসছে এক যুবক। সাদা পাঞ্জাবি পরনে ফর্সা মতন লোকটা। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। অদ্ভুত কালো চোখের মণি। কি মায়াময় তার চেহারা। নৌকাটা ভরা হলুদ রঙা ফুলে। কি সুন্দর ফুল! চোখ ধাঁধিয়ে, মন নাড়িয়ে দেওয়া সৌন্দর্য।
!!২৯!!
এই মায়াবী পুরুষটাকে তো মাহা চিনে। ফায়রাজ সার্থক। গুরুগম্ভীর যার কন্ঠস্বর। এই সুরটাও তো মাহা চিনে। খুব করে চিনে। মাহার ঠোঁটে ফুটে উঠলো এক অভূতপূর্ব হাসি। মনের সুখে নিজেকে বিলিয়ে দিলো নদীর ঝলমলে পানিতে। এবার তো ডুবে গেলেও তার শান্তি। উঁহু, না তো। মাহা ডুবলো নাতো। একজোড়া বলিষ্ঠ হাত তাকে টেনে নিলো বুকে। একেবারে বুকের মাঝে। ফিসফিসিয়ে বললো,
"তোমার মরণ হওয়ার আগে আমার মরণ হোক। এই বুকটা ঝাঁঝড়া করে দিয়ে তুমি কোথাও যেতে পারবেনা। আমার বুকটাকে শেষ করতে পারলেই তুমি ছাড়া পাবে, অলকানন্দা।"
অতঃপর নৌকাটা চলতে লাগলো। দূর-দূরান্তে। ঝাঁকড়া চুলের মানুষটার বুকে মাথা দিয়েই আবারো চোখ বুজলো মাহা। এই তো তার স্থান। পরম সুখের স্থান। এই স্থানে মরলেও মাহার কোনো দুঃখ নেই।
"আপু, আপু। এই মাহা আপু?"
ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে মাহা। কোথায় সে। আশেপাশে তাকিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে মাহা। এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলো সে। মাহিন খাবারের প্লেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চিকন গড়ন। মুখে কৈশোরের ছাঁপ। মাহাকে হতভম্ব হয়ে চারপাশ তাকাতে দেখে মাহিন জিজ্ঞেস করে,
"তুমি কি ঠিক আছো?"
"হুম।"
"মা, খাবারটা পাঠালেন। তুমি খেয়ে নাও।"
বলে চৌকিতে খাবার রাখলো মাহিন। তার আরো অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে করছে। মাহা আপুকে অনেক ভালোলাগে তার। কতটা আদর করে তাকে। মায়ের ভয়ে কথা বাড়ায়নি মাহিন। চুপচাপ বেরিয়ে এলো। মাহার একদম খেতে ইচ্ছে করছেনা। তবুও হাত ধুঁয়ে কয়েক লোকমা ভাত খেলো। মাথাটা বড্ড ধরেছে। কফি প্রয়োজন। হলে থাকলে হয়তো নিজেই বানিয়ে খেতো। নিজের বাড়িতেও যেন শ'খানেক বাঁধা তার। কালো রঙের ওড়নাটা মাথায় দিয়ে ড্রয়িং রুমে বেরিয়ে এলো মাহা। দুপুর গড়িয়ে গেছে। অনেকক্ষণ ঘুমিয়েছে সে। ড্রয়িং রুমে বসে পান চিবুচ্ছেন দিনার মা। দিনা সোফায় বসে দিয়ার চুলে তেল দিয়ে দিচ্ছেন। মাহাকে দেখে মুখ বাঁকালেন দিনার মা। মাহা দেখেও না দেখার ভান করে দরজা খুলে বেরিয়ে এলো।
ছাদে যাওয়া প্রয়োজন।
!!৩০!!
বামপাশের ফ্ল্যাটে থাকে দিনার বড় ভাইয়ের পরিবার। মাহা সিঁড়ি দিয়ে উঠবে এমন সময় তাকে পিছু ডাকলো এশা। দিনার ভাইঝি।
"আরে মাহা আপু যে! কেমন আছো?"
মলিন হাসলো মাহা। হাসি মুখে জবাব দিলো,
"হুম। ভালো আছি। তুমি কেমন আছো?"
"ভালো।"
"ছাদে যাচ্ছিলে?"
"হ্যাঁ।"
"যাক ভালোই হলো। চলো আমিও যাবো।"
মাহা না করতে পারলোনা। তার একটু একা থাকতে ইচ্ছে করছে। একা শ্বাস নিতে ইচ্ছে করছে। এশা মাহার চেয়ে লম্বা। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে এবার প্রথম বর্ষে পড়ছে। শ্যামলা গাঁয়ের রঙ। মায়বী চেহারা। করুনাময় কখনো কাউকে অসুন্দর করে পৃথিবীতে পাঠান না। তারই দৃষ্টান্ত এশা। দীঘল কালো হাঁটু ছাড়িয়ে চুল তার। মায়াময় চেহারার দিকে একবার কেউ তাকালে দ্বিতীয়বার তাকাতে বাধ্য। হালকা শীত পড়েছে। শীতল মিষ্টি হাওয়া বইছে চারদিকে। ছাদের এককোনায় পেতে রাখা দোলনায় দোল খাচ্ছে মাহা। এশা রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে। কথায় কথায় এশা বললো,
"আপু? খবরে দেখালো সিলেট থেকে আসার পথে ট্রেনে নাকি ডাকাতের দল হামলা করেছিল। পাঁচজন মেয়ে নিখোঁজ। দুইজনকে মেরে ফেলেছে। যাত্রীদের সকল টাকা পয়সা নিয়ে পালিয়ে গেছে ডাকাতের দল।"
এশার কথায় চমকে তার দিকে তাকালো মাহা। নিজেকে ধাতস্থ করে বললো,
"ভয়াবহ ব্যাপার!"
"আর বলতে। আমার তো মেয়েগুলোর জন্য কষ্ট হচ্ছে আপু। নির্ঘাত তাদের শয্যাসঙ্গী করার জন্য নিয়ে গেছে। যুবতী মেয়েগুলোকে বেছে বেছে ধরে নিয়েছে। "
মাহা জবাব দিলোনা। আজ হয়তো সেও সেই মেয়েদের দলে থাকতো। যদি না সার্থক তাকে সাহায্য করতো! আচ্ছা, এভাবে না বলে চলে আসাটা কি ঠিক হয়েছে মাহার!
"মাহা?"
রেজওয়ান এসেছে। ইউনিফর্ম নেই গাঁয়ে। একটা সাদা টি-শার্ট আর কালো টাউজার পরনে। পকেটে হাত গুঁজে রাখা। এশা মাথা নিচু করে নিলো। তার শ্যামলা চেহারায় লজ্জার আভা। রেজওয়ানকে দেখে উঠে দাঁড়ালো মাহা। রেজওয়ান এগিয়ে এসেছে মাহার দিকে।
"তোমাদের বাসায় গেলাম। আন্টি বললো তুমি ছাদে। তাই ছাদে এলাম।"
অতঃপর সে তাকালো এশার পানে। কপাল কুঁচকে বিরক্তির সুরে আবার বললো,
"তোমার সাথে আমার কিছু জরুরী কথা আছে মাহা।"
"জ্বি, বলুন ভাইয়া।"
পরে মাহার মনে পড়লো এখানে এশা উপস্থিত। ওর সামনে তো সব কথা খুলে বলতে পারবেনা। এশা তখনও দাঁড়িয়ে। মাহা কিভাবে এশাকে চলে যেতে বলবে বুঝতে পারছেনা। রেজওয়ানই বললো,
"তুমি একটু বাসা থেকে ঘুরে এসো এশা। আমার কিছু জরুরি কথা আছে মাহার সাথে।"
এশা মাথা নিচু করে বেরিয়ে গেলো। তার চোখ বেয়ে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো কি? তার মনটা বারেবারে বলে উঠলো কি 'আপনি অনেক খারাপ'?
ছাদের দক্ষিণ দিকে বেতের চেয়ার সাজিয়ে রাখা। সেখানে পাশাপাশি বসলো তারা। কিছু্ক্ষণ নিরবতা।
"চৈতির ব্যাপারটা আমাকে একটু খুলে বলোতো মাহা।"
_________________
গুলশানের এক বহুতল বিল্ডিং। দুইতালা আর তিনতালা মিলিয়ে ডুপ্লেক্স বাসাটা সার্থকের। রাজকীয়ভাবে সাজানো সবটা। এখন সব তছনছ। ড্রয়িং রুমের সবগুলো শো-পিছ ভাঙা। নিজের ঘরে দুটো ঘুমের ট্যাবলেট খেয়ে ঘুমিয়ে আছে সার্থক। সার্থকের বন্ধু লুবান, সেক্রেটারি মুইংচিন আর বোন নিভা, বোন জামাই রবার্ট। সবার মুখই চিন্তিত। সার্থক এতো রেগে আছে কেন!
"আমাকে তুমি কষ্ট দিলে অলকানন্দা!"
ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করলো সার্থক। মেয়েটার কতবড় সাহস! সার্থক কে মিথ্যা বলে! এই ফায়রাজ সার্থক কে! ঘুমের ঘোরেই মাথার দুপাশের শিরা দুটো ফুলে উঠে সার্থকের।
.
.
.
চলবে...........................