রাত তিনটে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে দেখি ফ্লোরে রক্ত ছিটানো। টপটপ রক্তে সারা ফ্লোর লেপ্টে আছে। আমার রুমের লাইট জালানো, জানালা খোলা, দরজা ভেতর থেকে আটকানো।।হঠাৎ রক্ত দেখে ওয়াশরুমের দরজার সাথে জোরে ঠেকে গেলাম। বিছানায় চোখ পড়তেই শিরকাটা দিয়ে উঠল। বাসন্তী রঙের চাদরটায় রক্ত মাখানো! বিছানায় কেউ কাথা মুড়ে শুয়ে আছে। আমি রক্ত দেখে প্রচুর ভয় পাই। আমার আত্মা যেন সাথে থাকেনা।আমার ব্লাড সাইট ফোবিয়া আছে। অনেক সময় সহ্য করতে না পারলে সেন্সলেস হয়ে যাই।
আমার সমস্ত শরীর বরফের মতো থরথর করে কাপছে।। ভয়ে হৃৎপিন্ডটা উল্কাপিণ্ডের মতো দ্রতবেগে ছুটছে।। আমার শরীর ঠান্ডায় অসার হয়ে আসছে! মাঝরাতে আমার রুমে রক্তাক্ত অবস্থায় কেউ শুয়ে! আমি চিৎকার দিয়ে সবাইকে ডাকব সেই হুশ আমার নেই। রক্তে ভরা বিছানার কাছে একপা একপা করে এগুচ্ছি। বিছানার কাছে আসতেই এক ঝটকায় কাথা সরিয়ে দিলে দেখি একটা ছেলে রক্তে মাখামাখি হয়ে শুয়ে আছে। মাথা বেয়ে রক্ত! আমি গলা ফাটিয়ে এক চিৎকার দিব সে হুট করে চোখ খুলে বিছানা থেকে উঠে আমার মুখ শক্ত করে চেপে ধরল!
-সিনু চুপ চুপ প্লিজ!! চিৎকার করিস না সবাই জেগে যাবে!!
-উমমম! উমমম...
-সিনু! ফর গড সেক চুপ কর প্লিজ!! হাতে কামড় দিস না। চুপ কর!
আমি ছোটাছোটি শুরু করলে সে বিছানা থেকে নেমে আমাকে এক ধাক্কায় দেয়ালে চেপে ধরে। আমি পিঠে এবং ঘাড়ে জোরে ব্যাথা পেয়ে কেদে দেই। সে আমার মুখ চেপে দেয়ালে হাত শক্ত করে চেপে ধরেছে...
-সিনু প্লিজ প্লিজ চিৎকার চেচামেচি করিস না।। সবাই উঠে যাবে! আমি এক্সিডেন্ট হয়েছি! ব্লেডিং হচ্ছে প্লিজ!!
আমি স্থির হয়ে শান্ত হয়ে যাই। কয়েক মিনিটের জন্য চিন্তায় ডুব দেই...এই ব্যক্তি আমার ডাকনাম জানে! অথচ আমি তাকে চিনি না কে সে! আমি চুপ হয়ে গেলে সে ছেড়ে দেয়। মাথায় হাত দিয়ে চোখ কুচকে বিছানায় যেয়ে বসে।
-সিনু? আমাকে চিনতে পারিস নি? আমাকে ভুলে গেলি?
আমার নাম স্নিগ্ধা মম। এবার ইন্টার ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছি। আব্বু, আম্মু, বড় ভাইয়া আবির আহমেদ, আর জেঠাতো বোন নওশীন মিরা সহ তিনতলা ফ্লাটে নারায়ণগঞ্জ শহরে থাকি। প্রতিদিনের মতো আজও রাত জেগে ফেসবুকে স্ক্রলিং করছিলাম। মাঝরাতে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি সারা রুম রক্তে লেপ্টানো। এই অচেনা ব্যক্তি কে তা আমি জানি না। আমার নামটা বড় ভাইয়া শুধু "সিনু" বলে ডাকেন।
-সিনু প্লিজ ব্যান্ডেজ করে দে...প্রচুর রক্ত পড়ছে....সিনু? শুনছিস?
-আপনি কে! আর এখানে কি করেন! আমাকে সিনু কেন ডাকছেন!
সে মাথা ধরে ফ্লোরে তাকিয়ে ঝুকে বসে আছে। যে হাত দিয়ে ধরেছে সে হাত রক্তে ভেসে যাচ্ছে। আমি দৌড়ে আলমারি থেকে টাওয়েল বের করি। ওয়াশরুম থেকে পানি এনে উনার সামনে বসে টাওয়েল ভিজিয়ে মাথায় চেপে ধরি। উনি বিছানায় আর আমি ফ্লোরে বসে। উনি আমার দিকে মুচকি হাসিতে তাকিয়ে আছেন।
-আমি রাদিফ আবরার। এখন চিনেছিস?
আমি থ! হাত থেকে টাওয়েল ছেড়ে থুতনি ঝুলিয়ে তাকিয়ে আছি! উনি আমার হাত টেনে টাওয়েল ধরিয়ে নিজে নিজেই কপালে চেপে ধরলো। চোখ টিপ মেরে হাসি দিয়ে বলে উঠল-
-হা করে থাকিস না মম!! আমি এসে গেছি!! রাদিফ আবরার ইজ ব্যাক!
আমি আশ্চর্য হয়ে গেছি। উনি নাকি সেই রাদিফ ভাইয়া! আম্মুর বান্ধবীর ছেলে এবং আবির ভাইয়ার খাস বন্ধু ! একসময় আমাদের বাসাই উনার জন্য সব ছিলো! অপলক চাহনিতে তাকে দেখছি। ডিপ ব্লু রঙের শার্ট গায়ে... উপরে কালো হুডির জ্যাকেট। হাতা কিছুটা উঠানো। ছোট ছোট ফর্সা চামড়ার উপর পশম দোলায় মিশে আছে। বামহাতে ওয়াচ। ঠোটের উপরসহ গালের চারপাশে খোচা খোচা শেপ দাড়ি। সুন্দর ভ্রুজোড়ার নিচে পাপড়ি ভরা চোখ। ব্যাথায় চোখদুটো বন্ধ করলে বড় বড় পাপড়ির পরশ বোঝা যায়। পুরো চেহারা জুড়ে নিষ্পাপ ছোয়ার রেশ। দুনিয়াতে কিছু ছেলে আছে যাদের চেহারার সৌন্দর্য ব্যক্ত করার মতো না!! কোনো এক অজানা মুগ্ধতা থাকে তাদের মাঝে!! উনার মধ্যেও তাই। চুলগুলো স্ট্রেট হয়ে কপালে মেলে আছে। মাথার মধ্যভাগের কিছু অংশে চুল দাড়িয়ে ফ্যানের বাতাসে ছোটাছুটি করছে।
-সিনু মেডিসিন লাগিয়ে দে এভাবে টাওয়েল চেপে ধরলে রক্ত পড়া বন্ধ হবেনা।
উনি আমার হাত ছেড়ে দিয়ে মেডিসিন আনতে আজ্ঞাপন করলেন। আমি ডেস্কের ড্রয়ার থেকে চিকিৎসা বাক্স এনে স্যাভনল বের করে নেই। তুলো ছিড়ে স্যাভনলে ডুবিয়ে উনার কপালে ধরব উনি আমার হাত ধরে থামিয়ে দিলেন। আমি কপালকুচকে কিছু বলতে নিব উনি টান মেরে উনার পাশে বসিয়ে নিলেন। আমার দিকে ঘুরে বসলেন। ঘটনাস্থলে আমি কেন যেন প্রতিক্রিয়াহীন ছিলাম। হয়তো আহত মানুষ দেখে খারাপ কিছু করতে চাইনি। চিৎকার করে কাউকে ডাকিনি।
-নে এখন দিয়ে দে। তোকে দেখবো আর তুই আমাকে স্যাভনল লাগিয়ে দিবি।। আস্তে আস্তে দিস প্লিজ...এগুলো বারুদের মতো জ্বলে....
আমি তুলোখন্ড কাটা জায়গায় বসিয়ে দিতেই উনি ঠোট চেপে খিচে আছেন। ধীরে ধীরে জায়গাটা জীবাণুমুক্ত করলে উনি বলে উঠেন-
-মম কিছু বলবিনা? সেই যে চুপ করে আছিস!! আগে তো কথার ঝুলি আমাকে ছাড়া শেষই হতো না। কোলে চড়ে বকবক করতি!! এখন আমি আসলাম আর তুই চুপ? এটা কি হয় বলতো? প্লিজ জবাব দে?
কিছু বললাম না। উনার মাথায় ব্যান্ডেজ পেচিয়ে চিকিৎসা বাক্স ঠিক করে রাখতে গেলে উনি হাত মুচড়ে ধরেন। এক টানে নিজের মুখের কাছে এনে বলে উঠেন-
-পাকনি তুই আগের থেকে অনেক পাল্টে গেছিস বুঝলি!! আগে একটা শাকচুন্নি ছিলি আর এখন পাল্টে পেত্নি হয়েছিস।। সিনু!! আমার সামনে এমন পোশাকে না আসলেও পারতি। ওড়না ছাড়া। হোয়াইট টিশার্ট উইথ ব্লু কালার প্লাজো নট ব্যাড!
উনি দুষ্টু হাসিতে তাকিয়ে আছেন। আমি হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করছি। উনি হাত ছাড়ছেন না। রাগী গলায় বলে উঠলাম-
-হাত ছাড়ুন রাদিফ ভাইয়া! আমি কোনো বাচ্চা না যে এখনো আগের মতো বড়াই করবেন! আমি সব সহ্য করবো! বাট ফাজলামি না! ছাড়ুন হাত বলছি!
-হাতটা একবার ছেড়ে দিয়ে বড় ভুল করেছি পাকনি!! আর না। এখন আর হাত ছেড়ে কোথাও যাচ্ছি না সিনু!! তোর জন্য এয়ারপোর্ট থেকে ডিরেক্ট এখানে এসেছি। রাস্তায় এক্সিডেন্ট!! কত কষ্ট হয়েছে তোর আন্দাজ আছে??
-আপনি হাত ছাড়ুন বলছি! নয়তো আমি সবাইকে চিৎকার করে ডেকে আনবো! যদি আবির ভাইয়া এখানে দেখে! আপনাকে খুন করে বস্তা ভরে দিবে!
-হোয়াটএভার ! তোর সাথে রোমান্স করার জন্য তোর ভাই নিজে আমাকে এ রুমে পাঠিয়েছে!