তুরানের দরজার সামনে হাতে তুরানের দেওয়া কালো শাড়ী আর নুপুর জোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রুপা। রুপার চোখে মুখে স্পষ্ট রাগের চিহ্ন। চোখে জল ছলছল করছে। দেখেই বুঝা যাচ্ছে একটু আগে খুব কেঁদেছে।
রুপা কে এই অবস্থায় দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে রুপার দিকে তাকিয়ে আছে তুরান। রুপা মুর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে এক দৃষ্টিতে তুরানের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ রুপার মুখের রাগান্বিত ভাবটা কেটে যায়, এখন রুপা কে দেখেই বুঝা যাচ্ছে তীব্র অভিমানে দাঁড়িয়ে থাকা এক রমনী। নিরবতা ভেঙে তুরান বলে,
-' কি হয়েছে? এভাবে তাকিয়ে রয়েছো কেন? আর হাতে শাড়ি,নুপুর কেন?'
তুরানের কথার প্রত্যুত্তর করছে না নুপুর। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়েছে। এভাবে কথা না বলে তাকিয়ে থাকা রুপার রাগ, অভিমান টা কে আরো তীব্র করে তোলে। তুরান এবার চিন্তিত হয়ে গেল। রুপার আগের সেই অসুখ টা দেখা দিয়েছে কি? সে জন্যই কি রুপা অস্বাভাবিক আচরণ করছে? নাকি রিং ফেরত দিয়েছি বলে?
-' কিছু বলবে তো? নয়ত বুঝবো কিভাবে?'
এতক্ষন রুপার চোখে জোরপূর্বক আটকে থাকা অবাধ্য জল ফোঁটা গাল বেয়ে গড়িয়ে পরলো। রুপা হাতে থাকা শাড়ীটা আর নুপুর জোড়া তুরানের দিকে ছুঁড়ে মারলো। এক মূহুর্ত না দাঁড়িয়ে দ্রুত পায়ে চলে যেতে লাগলো। তুরান দৌড়ে গিয়ে রুপার পথ আটকে দাঁড়ালো। পথ থেকে তুরান কে সরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে রুপা। তীব্র রাগ আর ক্ষোভে ফেটে পড়ছে যেন। এতক্ষন নিরবে দাঁড়িয়ে থেকে যে রাগ সঞ্চয় করেছে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে এবার।
তুরান ব্যস্ত হয়ে পড়ল রুপার রাগ ভাঙাতে।রাগের কারনে টা কি রিং ফেরত দিয়েছে সেটা?
-' বলবে তো আমি কি করেছি? না বলবে বুঝবো কিভাবে?'
এখনও চুপ করে আছে রুপা। চোখ দিয়ে যেন সমস্ত রাগ প্রকাশ করছে।
-' রুপা এভাবে তাকাবে না কিন্তু! ভয় পাই আমি।'
এ পর্যায়ে রুপার মুখ গম্ভীর হয়ে উঠে। ক্ষুব্ধ হয়ে বলে,
-' এত ভাব কিসের আপনার? রিং টা ফেরত দিলেন কেন? শপিং এ বসে শার্ট, প্যান্ট নিতে বললাম তখনো ভাব করেছেন।'
রুপার গম্ভীর মুখ টা ফ্যাকাশে হয়ে উঠে। কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবার বলে,
-' আপনি আমার দেওয়া কিছু নিতে চান না।আমি কেন নিবো?'
খুব জোরে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তুরান। রুপার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটিয়ে বলে,
-' এজন্য এত রাগ করা লাগে রুপা বাবু টার।'
-'চুপ একদম চুপ রং ঢং এর কথা বলে রাগ ভাঙানোর ব্যর্থ চেষ্টা করবেন না।'
তুরান কি ভেবে যেন একটু হাসলো। রুপার রাগ যেন উপভোগ্য কিছু। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে কাউকে না দেখে আচমকা রুপা কে পাঁজা কোলা নিয়ে রুমে চললো রুপা। রুপা অবাধ্য ভাবে হাত পা ছুড়তে শুরু করলো কোল থেকে নামার জন্য।
রুমে এনে রুপা কে জোর করে চেয়ারের উপর বসালো।রুপা ব্যর্থ চেঁচামেচি করতেই থাকলো। তুরান খুব আদুরে গলায় বলল,
-'এভাবে আমার রুমে বসে চেঁচামেচি করলে আমায় কিন্তু আজিজ চৌধুরী এ বাসা থেকে বের করে দিবে।'
অমনি চুপ হয়ে যায় রুপা। রুপার রাগটা পুনরায় অভিমানে পরিনত হয়।
-' আমি আপনার জন্য ভালোবেসে কিনলাম আপনি কিভাবে পারলেন সেটা ফেরত দিতে?'
-' সেটাই তো আমি এত অমানুষ কেন? আমি রুপার ভালোবাসা বুঝলাম না। আমার ফাঁসি হওয়া উচিত। হুকুম করেন আপনার
জল্লাদ কে মহারানী। আমার এখনই ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যেতে বলুন।'
তুরানের রসিকতা দেখে আর না হেসে পারলো না রুপা। রুপার হাসি দেখে তুরানের মন প্রশান্তি যে ছেয়ে যাচ্ছে।
-' তুমি একদম থ্রী,ফোরে পড়া বাচ্চাদের মত রাগ করো। তোমার ভালোবাসা ,রাগ,অভিমান সবই ইউনিক।'
কথাটা বলে রুপা কে আচমকা শক্ত করে জড়িয়ে ধরল তুরান। রুপা হয়ত এতক্ষন এটাই চেয়েছিল। রুপা তুরানের বুকে মিশে রইল। তুরান হেসে বলে,
-' মেঘ হলো, বিদ্যুৎ চমকালো, বজ্রপাত হলো, বৃষ্টি হলো এখন আবার রোদ। আবহাওয়া শুধু চেঞ্জ হয়।'
রুপাও হেসে উঠলো।
-' তখন যদি রিং টা নিতেন তাহলে মেঘ, বৃষ্টি কিছুই হতো না।'
-' এখন তো নিচ্ছি। কি ডেঞ্জারাস তুমি! শাড়ী,নুপুর সব ফেরত নিয়ে আসছো।'
রুপা ভেংচি কেটে বলে,
-'ভালোই করেছি।'
দুই জনেই আবার হেসে উঠলো। পৃথিবীর সবচেয়ে অদ্ভুত জিনিস বোধ হয় মেয়ে মানুষ। হাসতে সময় লাগে না, কাঁদতেও সময় লাগে না। পৃথিবীর প্রত্যেক টা মেয়েই বোধ হয় নিজ নিজ রহস্যে রহস্যমণ্ডিত। রুপা রহস্যে আর চার- পাঁচ টা মেয়ে মানুষের থেকে এক কাঠি সরেস।
অদ্ভুত রুপা! অদ্ভুত ধরনের রাগ! অদ্ভুত রকমের ভালোবাসা! ওঁদের ভালোবাসা টাও অদ্ভুত। এসব ভেবে আনমনে হেসে উঠে তুরান।
রুপা ইজি চেয়ারে বসে বসে দুলছে। ওর চেহেরায় দেখে এখন যে কেউ বলতে পারবে মেয়েটার মনে এখন কোন কারনে খুব আনন্দ কাজ করছে। হাস্যোজ্জ্বল চেহারা। মাঝে মাঝে মিটিমিটি হাসছেও। মৃদু বাতাসে ঘাড়ের কাছের চুল গুলো মুখে উড়ে এসে পড়ছে। অন্য সময় হলে বোধ হয় বিরক্ত বোধ করতো। কিন্তু এখন বাতাসে উড়ে আসা মুখের উপর পড়া চুল গুলো যেন রুপার রোমাঞ্চকর মনের চপলতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। বারান্দার টবে লাগানো ফুলের মৃদু ঘ্রান রুপার নাকে লাগছে। সব কিছু এখন রুপার কাছে এখন রোমাঞ্চকর লাগছে।
সাহেলা বেগম দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রুপার দিকে তাকিয়ে আছে। সাহেলা বেগম একজন দক্ষ সাইকিয়াট্রিস্ট। তাঁর বুঝতে বাকী নেই যে রুপার মনে কিছু একটা চলছে। অনেকক্ষণ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রুপার কান্ড দেখছে।
-'কি ভেবে এত খুশি আম্মা আপনি?'
চারদিকের নিরবতার মাঝে কারো কন্ঠ শুনে ধড়পড়িয়ে উঠে রুপা।
-' উফ আম্মু তুমি! এভাবে হঠাৎ কেউ এসে কথা বলে।'
-' তুই যে প্রতিদিন রান্না ঘরে গিয়ে আমায় ভয় দেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা করিস!'
-' তুমি তো ভয় পাও না।'
সাহেলা বেগম আগ্রহী কন্ঠে বলে,
-'তা এত রোমাঞ্চ রোমাঞ্চ ভাব কেন তোর মনে? প্রনয়নের কথা মনে পড়েছে বুঝি?'
মূহুর্তেই মুখ টা ফ্যাকাশে হয়ে যায় রুপার। কিছুক্ষণ সাপের মত ফুঁসে থাকে,এই বুঝি ছোবল দিবে।
সাহেলা বেগম হেসে বলে,
-' সরি,সরি মা মনি।আর বলবো না।'
-' আর বলবে না আর বলবে না! প্রতিদিনই তো বলো।'
সাহেলা বেগম হেসে হেসে কথা বলে রুপার রাগ কমানোর চেষ্টা করছে।
কালকে আজিজ চৌধুরীর বাসার তিন তালায় যে ফ্যামিলি ভাড়া থাকে তাঁদের মেয়ের বিয়ে। বিয়ে আগেই হয়েছে ঘরোয়া ভাবে,এখন আনুষ্ঠানিক ভাবে।
মেয়েটা চট্টগ্রাম থেকে লেখাপড়া করে,রুপার সাথে তেমন ভাব নেই। মাঝে মাঝে এখানে আসলে একটু আধটু কথা হত। লোকটা অনেক বছর ধরে আজিজ চৌধুরীর বাসায় ভাড়া থাকে সে সুবাদে আজিজ চৌধুরীর সাথে সম্পর্ক খুব ভালোই!
অনুষ্ঠান হবে কমিউনিটি সেন্টারে। মেয়েটার নাম নীড়া। দেখতে বেশ সুন্দরী! লেখাপড়ায়ও নাকি অনেক ভালো। নীড়া দের বাসায় মেহমানে ভরপুর। আজিজ চৌধুরী আর সাহেলা বেগমও গিয়েছে সে বাসায়। রুপা কে অনেক বার সেধেছে কিন্তু রুপা যাবে না। রুপার এমন আচরনে নতুন করে অবাক হচ্ছে সাহেলা বেগম। একা রুমে বসে বসে পাঁয়তারা করছে রুপা।
মনে চাচ্ছে নীড়া দের বাসায় যেতে। সবার সাথে ভাব জমাতে। কিন্তু ভার্সিটি তে যাওয়ার আগে তুরান বরাবরের মত একটা কাগজ ছুঁড়ে মেরেছে রুপা দের বারান্দায়। কাগজে লেখা ছিলো,
‘ আমি না আসা পর্যন্ত বিয়া বাড়িতে যাবে না । নীড়ার অনেক কাজিনরা এসেছে। তোমার দিকে অসভ্যের মত ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে।’
চিঠিটা পড়ে খুব হেসেছিল রুপা। কিন্তু পরমুহূর্তেই মন খারাপ হয়ে যায় বিয়ে বাড়ি যেতে পারবে না তাই।
একা রুমে থেকে থেকে রুপার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপলো। বিল্ডিং এর সবাই কম বেশি বিয়ের আনন্দে ব্যস্ত। রুপা একটা ব্লেড নিয়ে ছাদে চলে গেল। প্রথমে ছাদে রোদ দেওয়া প্রতিটা শার্টের পিঠে ব্লেড দিয়ে লাভ আকৃতি করে কেটে নিলো শুধু তুরানের শার্ট টা বাদে। আর মহিলা দের জামা কেটে শার্ট করে দিলো।
তারপর দ্রুত ছাদ থেকে নেমে গেল রুপা। রুমে গিয়ে হেসে হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
এর ভিতর শিষ বাজানোর শব্দ শুনতে পেল রুপা। তার মানে তুরান এসেছে। রুপা কে মাঝে মাঝে না দেখলে শিষ দিয়ে তুরান নিজের উপস্থিতির জানান দেয়।
হাসি থামিয়ে স্বাভাবিক হয়ে তুরানের কাছে যায়। মনে মনে এখন খুব ভয় পাচ্ছে। ছাদে রোদ দেওয়া সব জামা কাপড় কেটে ফেলেছে, তুরান জানলে খুব রাগাবে।
—
-'নীড়াদের বাসায় গিয়েছিলে একবারও?'
রুপা মাথা ঝাঁকিয়ে বললো,
-'না।'
-' তুমি কি বিয়ে বাসায় না গিয়ে চুপচাপ রুমে বসে থাকার মানুষ?'
রুপা তুরানের মাথায় হাত রেখে বললো,
-' আপনার মাথার দিব্যি যাইনি।'
-' হয়েছে.. হয়েছে! বিশ্বাস করেছি। সব সময় এমন কথা শুনবে বুঝলে?'
তারপর যেন কি যেন ভেবে হাসলো তুরান। রহস্যজনক হাসি। রুপা এমন হাসির কোন মানে খুঁজে পেলো না। তুরানের হাসির সাথে তাল মিলিয়ে রুপাও হাসছে।
তু্রান রুপা আর ওর হাইটের ব্যবধানের কথা ভেবে হাসছে। রুপা ছোট- খাটো পুতুল টাইপের মেয়ে। এসব মেয়েদের শর্ট বলে অপমান করাটা অপরাধ। একজন লম্বা মানুষ কে অনায়াসে ফ্রেন্ড বা পরিচিত মানুষেরা লম্বু বা এজাতীয় কোন কিছুর সাথে তুলনা করে মজা করতে পারে। এতে লম্বা প্রজাতির মানুষের কিছু মনে করে না। কিন্তু একজন খাটো মানুষকে খাটো বললে অপমান বোধ ধরে।
কি সব অপ্রাসঙ্গিক ভাবনা ভাবছে তুরান, নিজের এরকম ভাবনার কথা ভেবে নিজেই হাসছে তুরান। রুপা শর্ট,গায়ের রং শ্যামলা। কিন্তু এসব যেন রুপার সৌন্দর্য বাড়িয়ে দিয়েছে।
তুরানের এমন রহস্যময় হাসিতে বিরক্ত হচ্ছে রুপা।
-'কি ভাবছেন আর হাসছেন? আজব!'
রুপার কথায় তুরানের ভাবনার ছেদ হয়। আচমকা রুপার কোমড় জড়িয়ে ধরে রুপা কে একটু কাছে টেনে বলল,
-' তুমি আমার কাঁধ অব্দি লম্বা তাই না? তুমি যখন আমায় জড়িয়ে ধরো তখন আমার হার্টবিট শুনতে পাও তাই না?'
রুপা কি বলবে বুঝতে পারছে না। অদ্ভুত শিহরণে শিউরে উঠছে রুপা। তুরানের কন্ঠ টা কেন জানি হঠাৎ নেশা ধরানো মনে হলো রুপার কাছে। তুরান কখনো এভাবে কাছে টেনে নেয় নি রুপাকে। এর আগেও অনেক বার জড়িয়ে ধরেছে কিন্তু এমন ফিলিংস আর হয় নি । রুপার নাকের ডগায় ঘাম জমেছে বিন্দু বিন্দু্। লজ্জায় মিইয়ে গেল রুপা।
তু্রান আবেগঘন কণ্ঠে আবার বলে,
-' আমার ঠোঁটে চুমু খেতে তোমার তো ছোট- খাটো একটা টুল লাগবে।'
রুপার হৃৎপিণ্ড বেয়ে যেন শীতল রক্ত স্রোত প্রবাহিত হতে লাগলো। লজ্জায় তুরানের দিকে তাকাতে পারছে না রুপা। তুরানের বলা কথা গুলোলো এভাবে ঝড় তুলছে কেন? প্রতিটি কথা ধারালো ছুরির মতো আঘাত করছে। এর আগে তো কখনো এমন হয় নি। রুপার হৃদস্পন্দন যেন কয়েক মুহূর্তের জন্য থেমে রইলো। রুপার ভারী হওয়া নিঃশ্বাস, নিঃশ্বাসের শব্দে চোখ বুঁজে অনুভব করছে তুরান। রুপার হাত-পা কাঁপতে লাগল। হঠাৎ তুরান কে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে রুমের দিকে দৌড়ে চলে গেল।
তুরান ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে রইলো। ঘোরের ভিতর ছিলো বোধ হয় এতক্ষন। রুপার লজ্জা পাওয়া, নাকের ডগায় জমা বিন্দু বিন্দু ঘাম,জোরে জোরে নিঃশ্বাস নেওয়া চোখ বুঝে আবার মনে করার চেষ্টা করছে তুরান। সত্যিকারের ভালবাসা গুলো বোধ হয় এমনই হয়? একটু আবেগঘন কণ্ঠে কথা বললেই দুইজনের হার্টবিট বেড়ে যায়।
তুরানের ঠোঁটে চিলতে হাসি এখনো লেগে আছে। হঠাৎ তুরান চিন্তিত হয়ে গেলো। রুপা হঠাৎ ওভাবে চলে গেল কেন? লজ্জা পেয়েছে নাকি তুরান কে খারাপ ভেবেছে?
রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিতে লাগলো রুপা। আর একটু তুরানের বুকে ওভাবে থাকলে বোধ হয় ভালো হত। কেন চলে আসলো? নিজের বোকামির জন্য নিজের চুল ধরে কয়েক বার টান দিলো রুপা।
তুরান রুমে পাঁয়তারা করতে লাগলো। না.. রুপা কে এসব কথা বলা ঠিক হয় নি। রুপা তো অত ম্যাচিউর মেয়ে না, বাচ্চা টাইপ একটা মেয়ে। সাহেলা আন্টি তো নীড়া দের বাসায়। রুপার রুমে গিয়ে একটু খোঁজ নিয়ে আসলেই হয়।
রুপা একটা বালিশ জড়িয়ে ধরে বসে রয়েছে। আর একা একা কি সব বলে যেন বালিশ টা কে শাসাচ্ছে। ইন্টারেস্টিং তো! তুরান দরজার আড়ালে দাঁড়ালো রুপার কথা শোনার জন্য।
রুপা বালিশ টা কে কিল , ঘুষি মারতে মারতে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলছে,
-' তোমার ঠোঁটে আদর খেতে আমার টুল লাগবে তাই না? টুল বানিয়ে দিবা একটা! এত কথা কিসের এটা নিয়ে আবার?'
এই বলে বালিশের উপর এমন ঘুষি মেরেছে বালিশ ছিঁড়ে তুলো বের হয়ে গেছে। তুরান হাঁ করে তাকিয়ে রইল। রুপার কথা শুনে যেমন বিস্ময়ের চূড়ায় পৌঁছে গেলো তেমনি ওর পাগলামি দেখে পেট ফেটে হাসি আসছে।
রুপা তুলো গুলো পুনরায় বালিশে ঢুকাতে ঢুকাতে বলল,
-'ইস তোমার পেট টা ফেটে গেল! পেট ফাটাবো না তো কি করবো বলো? তুমি তো ঠোঁটে চুমু খাও ই না। টুল লাগলে তিনটি বানাবো তবুও লম্বা মেয়েদের দিকে তাকাবে না বুঝলে? যদি তাকাও তাহলে কি করবো যানো?'
এই বলে পুরো বালিশটা টেনে ছিঁড়ে ফেললো। তুলো গুলো পা দিয়ে পিষেতে লাগলো।
-' যদি লম্বা মেয়েদের দিকে তাকাও তাহলে এভাবে ছিঁড়ে ফেলবো। মাঝে মাঝে এভাবে দুষ্টু দুষ্টু কথা বলে আমার হার্টবিট বাড়িয়ে দিবে বুঝলে?'
রুপার কথা আর পাগলামি দেখে রুপার প্রতি খুব বেশি ভালোবাসা অনুভব করছে। অন্য দিকে আর না হেসে পারছে না তুরান। এবার না হেসে থাকলে দম বন্ধ হয়ে তুরানও বালিশের মত ফেটে যাবো। হো হো করে উচ্চস্বরে হেসে উঠলো তুরান। তুরানের হাসির শব্দে যেন ঘর কাঁপছে।
রুপা তুরানের দিকে তাকিয়ে যথারীতি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তুরান সব শুনে ফেলেছে? রুপার লজ্জায় ফ্লোরের ভেতর ঢুকে যেতে ইচ্ছা করছে।
রুপার লজ্জা পাওয়া হঠাৎ ক্রোধে পরিনত হলো।
তুরানের গায়ে এলোপাথাড়ি কিল ঘুষি মারতে লাগলো।
-' কুত্তা, শয়তান,বিলাই অন্যের দরজায় লুকিয়ে থাকে।'
তুরান কোন মতে হাসি থামিয়ে বললো,
-' মেরো না। বালিশের মত ফেটে যাবো কিন্তু।'
রুপা কেঁদেই দিলো।
-' আপনি এত খারাপ আগে জানে নি! আমায় লজ্জা দিয়ে আপনার ভালো লাগে?'
তুরান অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল,
-' সরি সরি আমার হাসা একদম ঠিক হয় নি।'
-' হাসছেন আর বলছেন হাসা ঠিক হয় নি?'
তুরান রুপার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। রুপা তুরানের দিকে তাকালো না মাথা নিচু করে রইল। তুরান রুপার কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে,
-' লজ্জা পেতে হবে না রুপা বাবুটা। মাঝে মাঝে দুষ্টু দুষ্টু কথা বলে হার্টবিট বাড়িয়ে দিবো। টুল চারটা বানাবো।'
রুপা তুরানের শার্টের কলার খামচে ধরে বলল,
-'প্লীজ যান এখান থেকে।দেখেন না আমি লজ্জা পাচ্ছি।'
তুরান আবার হেসে উঠলো।
-' আচ্ছা। যাচ্ছি.. যাচ্ছি। আজকে নীড়ার মেহেদী সন্ধ্যা। সারাদিন তো যেতে দেই নি তোমায়। সন্ধ্যায় রেডী হয়ে থাকবে কিন্তু। শুধু ড্রেস পরবা চোখে ভুলেও কাজল দিবে না। আমি চাই না আর কোন ছেলে তোমার চোখ দেখে ধ্বংস হোক।'
এই বলে চলে গেল তুরান। আর রুপা অদ্ভুত ধরনের লজ্জা আর ভালোলাগায় মিলে গেল। বিড়বিড় করে বলল,
-' যেতে বলেছি বলেই কি যেতে হবে নাকি? আর একটু থাকলে কি হতো? ধ্যাত!'
রুমে গিয়ে রুপার কথা ভাবছে আর হাসছে তুরানের। অদ্ভুত এক ভালোলাগা বয়ে যাচ্ছে তুরানের মন জুড়ে। আবার নতুন করে মুগ্ধ হলো রুপার প্রতি। যে মেয়ে টা কে একটা সময় সব চেয়ে বিরক্ত লাগতো আর সেই মেয়েই তুরানের ভালোবাসা, ভালোলাগা, মুগ্ধতার কারন। মানুষের মন এত বেশী পরিবর্তনশীল কেন? রুপা এমন একটা মেয়ে যাকে ভালো না বেসে উপায় নেই। এই স্মৃতি গুলোকে তুরানের বাঁধিয়ে রাখতে ইচ্ছা করে, সময় টা কে থামিয়ে রাখতে ইচ্ছে করে। এত পাগলামি কিভাবে করে রুপা?
এসব ভাবতে ভাবতে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায় তুরান। তুরানের ঘুম ভাঙে ছাদ থেকে চেঁচামেচির শব্দ শুনে।
হঠাৎ ঘুম ভাঙার কারনে কিছুই ঠাওর করতে পারছে না তুরান। কয়েক মিনিট বসে বসে ঝিমাতে থাকে। তারপর হঠাৎ তুরানের মনে হলো ছাদে সবাই চেঁচামেচি করছে কেন? তুরান দ্রুত ছাদে যায়। জামা কাপড় ব্লেড দিয়ে কাটার অভিযোগ।
রুপাও সবার সাথে দাঁড়িয়ে আছে। তুরান কে দেখে ঘাবড়ে যায় রুপা। আর কেউ না বুঝলেও তুরান ঠিকই বুঝে যাবে। তুরান চোখ বড় বড় করে রুপার দিকে তাকাচ্ছে।
রুপা মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তুরান নিজের শার্ট টা হাতে নিয়ে দেখলো ওর শার্ট কাটে নি। মনে মনে হাসছে তুরান।
পাশের ফ্ল্যাটের এক ভাবী তুরান কে জিজ্ঞেস করলো,
-'তোমার শার্টও এই অবস্থা?'
সবার শার্ট কাটা সেখানে তুরানের শার্ট যদি কাটা না হয় তাহলে ব্যাপার টা সন্দেহজনক।
তুরান থতমত খেয়ে বললো,
-'জ্বী,জ্বী! আমার শার্টও একই অবস্থা।'
সবাই সবার শার্ট আর ড্রেস কত টাকায় কেনা তা বলছে আর আফসোস করছে।
এর ভেতর ছাদে আসে নীড়ার বাবা। সবাই কে অনুরোধ করে চুপ থাকতে বলে,কারন তার বাসায় মেহমান। পরে এটা নিয়ে আজিজ চৌধুরীর সাথে আলোচনা করা হবে। উনি যেহেতু এবাড়ির মালিক উনি অবশ্যই একটা পদক্ষেপ নিবে যাতে এমন আর না হয়।
সবাই তার কথা মত চুপ করে ছাদে থেকে চলে গেলো। সবাই সবার মত করে যে এই কাজ করলো তাঁকে গালি দিতে লাগলো।
সবাই চলে যাওয়ার পর ছাদে রুপা আর তুরান দাঁড়ানো। তুরান তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রুপার দিকে। তুরান কিছু বলার আগেই রুপা কেঁদে দিলো,
-' আর এমন করবো না। রাগ দিবেন না প্লীজ।'
কেউ যদি রাগ দেওয়ার আগেই কেঁদে দেয় তাঁকে আর কি বলা যায়? তুরান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,
-'তোমায় যে এভাবে গালি দিছে এসব শুনতে কি আমার ভালো লেগেছে বলো?'
রুপার কান্না আরও বেড়ে গেলো।তুরানের রুপার দুপুরের কান্ডর কথা মনে পড়ে রুপার প্রতি রাগ উবে গেল। রুপার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলে,
-' কাঁদে না রুপা বাবু টা। সাহেলা আন্টি এসব জিজ্ঞেস করলে বলবা তুমি এসব জানোই না। তুমি রুম থেকে বের হও নি সারা দিন।'
রুপা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
-' আচ্ছা।'
তুরান রুপার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
-' যাও যাও সন্ধ্যা হয়ে গেছে। রেডী হয়ে নেও। নীড়া দের বাসায় যাবো তো।'
রুপা হালকা গাঢ় সবুজ কালারের সিল্কের জামা, আর হালকা গোলাপি কালারের সেলোয়ার আর ওড়না পরেছে। তুরানের দেওয়া চুড়ি থেকে এক মুঠো সবুজ কালারের চুড়ি হাতে পরলো।
তারপর আয়নায় সামনে দাঁড়িয়ে যত্ন করে চোখে গাঢ় করে কাজল দিলো। পরক্ষনে মনে পড়লো তুরান কাজল দিতে নিষেধ করেছে। সাথে সাথে কাজল মুছে ফেলল।