অলকানন্দা - পর্ব ০৫ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প

!!১৩!!

"এই যে মিস? এই সিট টা আমার।"
"তো?"
মেয়েটার এমন নির্লিপ্ত প্রতিক্রিয়া দেখে সার্থকের মেজাজ চড়ে গেলো। আচ্ছা বেয়াদব মেয়ে তো। একে তো উচিত জবাব দিতেই হয়।
"তো মানে! আমার সিট থেকে উঠুন।"
"সামনের সিট খালি আছে ঐখানে গিয়ে বসুন।"

আবারো হলদে ফর্সা মেয়েটার এমন নির্লিপ্ত উত্তর দেখে যারপরনাই ভরকে গেলো সার্থক। এতটা বেয়াদব মেয়ে সে কখনো দেখেনি। এর সাথে কথা বলার আর কোনো মানে নেই। মেয়েটা অতিশয় অদ্ভুত! অগত্যা নিজের কাঁধ থেকে ব্যাকপ্যাকটা নামিয়ে সামনের সিটে বসে পড়লো সার্থক। মেয়েটা উদাস মনে এক নজর তাকালো সার্থকের দিকে। লম্বা সুঠামদেহের অধিকারী সার্থক, মাথা ভরা ঝাঁকড়া চুল, আর একটা খাড়া নাক। অদ্ভুত কালো মণি যুক্ত দুখানা চোখ। মেয়েটা কতক্ষণ তার দিকে তাকিয়েই রইলো। নাইকের ট্রাউজার, পায়ে ক্যাজুয়াল স্নিকার্স আর কালো হুডি পরনে সে । হাতে একটা ঘড়ি। ফর্সা হাতটায় বেশ মানিয়েছে। মেয়েটা কতক্ষণ যাবত তার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা যে তার ঘড়িতে কি দেখছে ভেবে পেলোনা সে। সার্থক বার দুয়েক তাকালো ঘড়ির দিকে। আদোও কিছু আছে কিনা রহস্যময়ী তা উন্মোচনের বৃথা চেষ্টা যাকে করলো। তবে আফসোস কিছুই খুঁজে পেলোনা সে। ফোন বেজে উঠলো তার।
 
"হ্যালো, ডক্টর ফায়রাজ সার্থক স্পিকিং।"

ফোনের রিংটোনে ধ্যান ভেঙেছে হলদে ফর্সা মেয়েটার। ট্রেন চলতে শুরু করেছে। কেবিনে আর কেউ নেই। তারা দুজনই মুখোমুখি বসে। মেয়েটার চোখ জানালা ছাড়িয়ে চলে গিয়েছে দূরান্তে। পাহাড় আর পাহাড় ঘেরা চারপাশ। ট্রেন চলার সাথে সাথে পাহাড়গুলোও যেন চলছে। সময়টা বিকেল। শীতের কুয়াশারা চাদর বিছিয়েছে দিগন্ত থেকে দিগন্তে। আকাশের তিনটে রঙ দেখা যাচ্ছে। উপরে হালকা নীল। একটু নিচে কুয়াশার ধূসর, মেঘেদের সাদা আর চিরায়ত নীলের একটা মিশ্রণ রঙ। আরো একটু নিচে ঐতো পাহাড় ঘেঁষে কেবল ধূসর আর ধূসর রঙের ছড়াছড়ি। পাখিরা চলেছে নীড়ে। মেয়েটাও ফিরছে তার নীড়ে। 

কথা শেষে সার্থক আড়চোখে তাকালো মেয়েটার পানে। হলদেটে ফর্সা গাঁয়ের রঙ, কোমড় সমান চুল বোধহয়। চুলগুলো কুঁকড়া ছেড়ে রাখা। গাঁয়ে বেগুনি আর পানপাতা রঙের বাটিকের থ্রি-পিস। উপরে একটা কাশ্মীরী চাদর। ঠিক যেন চিরায়ত কোনো বাঙালি মেয়ে। সার্থক তার ঠোঁট জোড়া দিয়ে আলতো করে উচ্চারণ করলো,
"অলকানন্দা।"

ঝকঝক শব্দ তুলে ট্রেন চলেছে রাজধানীর পথে। সার্থক খেয়াল করেনি, সময় হিসাব করেনি কেবল পলকহীন তাকিয়ে ছিলো হলদে সাদা, কুঁকড়া চুলের, অহংকারী মেয়েটার দিকে। 
"কিছু বলবেন?"
"না, মানে।"

মেয়েটার এহেন হঠাৎ প্রশ্নে থতমত খেয়েছে সার্থক। কি জবাব দিবে খুঁজে পেলোনা সে। এই প্রশ্নটা এত কঠিন কেন! এনাটমির জটিল ক্লাসগুলোও তো এতটা কঠিন না! 
"না, মানে কি? কি দেখছিলেন তাকিয়ে তাকিয়ে?"

এবার খানিকটা বিরক্ত হলো সার্থক। মেয়েটা যথেষ্ট ত্যাড়া। তাই সেও ত্যাড়া জবাব দিলো,
"আমার চোখ আমি যেদিকে ইচ্ছা সেদিকে তাকাবো।"
"না, তাকাবেন না।"
"অদ্ভুত মানুষ তো আপনি। আমা....

তখনই ফোন বেজে উঠলো মেয়েটার। ঝগড়াটা জমে উঠেছিলো। সত্যি বলতে সার্থকের ভালোও লাগছিলো। মেয়েটার কন্ঠ অভূতপূর্ব। এতটা সুন্দর কন্ঠ শুনতে সে হাজার বার ঝগড়া করতে রাজি।

!!১৪!!

নাম্বারটা দেখেই অপরাধবোধ জেগে উঠলো মেয়েটার। ফোনের রিংটোনটা তখনো বেজে চলেছে,
"ভালোবেসে, সখী, নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো
তোমার মনের মন্দিরে....

"হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম। রেজওয়ান ভাইয়া।"
"ওয়ালাইকুম আসসালাম, মাহা। তুমি কোথায় এখন?"
"ট্রেনে আছি। ভাইয়া চৈতির কোনো খবর পেয়েছেন?"
"সিলেটে পুলিশ ফোর্স কাজ করছে। দেখি কি হয়।"
"আমার নিজেকে বড় অপরাধী মনে হচ্ছে রেজওয়ান ভাইয়া। আমি আসলে কিছু মনে করতে পারছিনা।"
"তোমার কোনো দোষ নেই মাহা। যা হবার ছিলো তাই হয়েছে। একটা কথা বলোতো চৈতি মূলত কোথায় গিয়েছিলো?"
"আমার মনে পড়ছেনা ভাইয়া। আমার কিছুই মনে পড়ছেনা।"
"আচ্ছা, থাক। তুমি ঢাকা আসো। তারপর কথা হবে। সাবধানে এসো।"

এএসপি রেজওয়ান চৌধুরীর সাথে এতক্ষণ কথা বলছিলো মাহা। সব কেমন অদ্ভুত আর প্যাঁচানো লাগছে তার। সামনের ছেলেটা ফায়রাজ না কি নাম কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে। মাথাটা সবুজ রঙা সিটে হেলান দেওয়া। চোখদুটো বন্ধ। তার ঝাঁকড়া চুলগুলো ট্রেনের ঝাঁকুনির তালে তালে কপালে চলে এসেছে। সুদর্শন হলে কি হবে! এক নাম্বারের বেয়াদব ছেলে! মুখটা কুঁচকে বাইরের দিকে তাকালো মাহা। তার আসলে কিছুই মনে পড়ছেনা। সিলেট কেন এসেছিলো তাও মনে নেই। রুমানা বলছিলো সে আর চৈতি নাকি একসাথে সিলেট এসেছে প্রায় তিনদিন। চৈতি মেয়েটা মাহার বেস্টফ্রেন্ড। আগুন সুন্দরী। কাঁধ সমান চুল। লম্বায়ও অনেক। পাঁচফুট সাতের কাছাকাছি। আর সে তুলনায় মাহা একটু খাটো। চৈতির থেকে দুয়েক ইঞ্চি কম তার উচ্চতা। মাহা আর চৈতি নাকি একসাথে সিলেটও ঘুরেছে। রুমানা আরো কি কি বললো। চৈতিকে নাকি কোন পাগলী হাতে খামছি দিয়েছে, চৈতির নাকি ট্রাকের সাথে এক্সিডেন্ট হতে যাচ্ছিলো। মাহা নাকি বাঁচিয়েছে। আরো কত কি! মাহা নিজেও মুখে হ্যাঁ, হ্যাঁ করলেও বাস্তবিক অর্থে তার কিছুই মনে পড়ছেনা। কালরাতে যখন ঘুমিয়েছিলো জাহানারা ইমাম হলের তার ঘরটায় তখন মাথায় কেবল ঘুরছিলো আগামীকাল পরীক্ষা। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের পরীক্ষা। সে চোখ খুললো একটা ছেলের আওয়াজে। 
_________________

"আপু? আপু? ঠিক আছেন?"

চোখের পাতা এতটা ভারী লাগছে মনে হচ্ছে কেউ যেন একশমণের ভারী দুটো বস্তু রেখে দিয়েছে মাহার চোখে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে তার। প্রথমে যখন চোখ খোলার চেষ্টা করলো তখন তা পারলোনা সে। চোখটা বন্ধ হয়ে গেলো তার। এবার মনে হলো মাথাটা কারো কোলে। কন্ঠস্বরটা পরিচিত। 
"মাহা, এই মাহা। এই কোকিল? কোকিল?"

রুমানার কন্ঠ এটা। অবচেতন মস্তিষ্ক ধরে ফেলে পরিচিত আওয়াজটা। আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায় মাহা। আশেপাশে কৃত্রিম আলোর ছড়াছড়ি। এটা কি কোনো রাস্তা? মাহাকে চোখ খুলে তাকাতে দেখে রুমানা বলে,
"ঠিক আছিস? কোকিল?"

মাথাটা ধরে উঠে বসে মাহা। একটা পিচঢালা রাস্তায় বসে আছে সে। সামনে বিস্তৃত মাঠ। পাশে দু’তালা একটা বিল্ডিং। সময়টা বোধহয় রাত। অন্ধকার চারপাশে। শীতের হিমেল হাওয়া বইছে। পাশে উদ্বিগ্ন চেহারা নিয়ে চারজন অপরিচিত মানুষ দাঁড়িয়ে। 
"আমি এখানে?"

!!১৫!!

মাহাকে ধরে দাঁড় করায় রুমানা। ঘরে নিয়ে যায় তাকে। সোফায় বসলে পানি খেতে দেন একজন মহিলা। অনেকটা রুমানার মতোই দেখতে। এটা কি রুমানার মা? বাকি একজন মহিলা, একটা ছোট মেয়ে। কেমন ড্যাবড্যাবিয়ে তাকিয়ে আছে। আরেকটা কিশোর বয়সী ছেলে। মাহা কিছুই বুঝতে পারছেনা। তবে স্বস্তি লাগছে এই ভেবে যে রুমানা আছে।
"আমার কি হয়েছিলো রুমানা?"
"আমি বিকালে তোদের বলেই তো আম্মুকে নিয়ে চেকআপে গেলাম। তারপর ফিরতে ফিরতে রাত দশটা বেজে গেলো। জিদান বললো তোরা নাকি ঘুমিয়ে পড়েছিস। আমিও গিয়ে দেখলাম দরজা ভিতর থেকে লক। তাই আর তোদের বিরক্ত করিনি।"
"এখন কয়টা বাজে?"
"এখন তো রাত সাড়ে তিনটা।"
"আমি রাস্তায় কিভাবে...কিছুই তো বুঝতে পারছিনা!"
"ঘুমিয়েছিলাম। হঠাৎ তোর একটা চিৎকার ভেসে এলো কানে। আমি বাইরে এসে দেখি তুই নিচে পড়ে আছিস। আর জিদান তোকে ডাকছে!"
"আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। আমার মাথাটা অনেক যন্ত্রণা করছে রুমানা।"

বলেই মাথাটা চেপে ধরলো মাহা। রুমানা তার পাশে বসে। এতকিছু হয়ে গেলো অথচ চৈতি নিচে নামেনি। ব্যাপারটা অনেকটা খটকা লাগলো রুমানার। সবাইকে রেখে দৌড়ে উপরে গেলো সে। না, চৈতি কোথাও নেই! সারাবাড়ি মাথায় তুলে ফেললো রুমানা। "টুকি, টুকি কোথাও নেই!"

মাহা ঘাবড়ে গিয়েছে অনেকটা। কোথায় গেলো চৈতি। এতকিছুর মাঝে ঘাড়ের চিনচিন ব্যথাটা তোয়াক্কাই করেনি মাহা। 

তারপর কতকিছু ঘটে গেলো। মাহা তার বাবার বন্ধুর ছেলে এএসপি রেজওয়ানের সাথে কথা বললো। সিলেট পুলিশ স্টেশনে ব্যাপারটা অবগত করা হলো। কেটে গিয়েছে দুইদিন। মাহার ভাই মাহিন ফোন করে জানিয়েছে বাবা অসুস্থ। তাই সবকিছু ছেড়ে ছুঁড়ে ঢাকা ফিরে যাচ্ছে মাহা। কি হচ্ছে! কেন হচ্ছে! চৈতি কোথায় কিছুই বুঝতে পারছেনা মাহা। পুলিশ তাকে বেশি জিজ্ঞেসাবাদ করেনি। রেজওয়ান ওদের সাথে কথা বলেছেন। তাছাড়া জিদান নাকি নিজ চোখে দেখেছে মাহা নিজের ঘর থেকে বের হচ্ছে। তার ডাকও তোয়াক্কা করেনি সে। বাড়ির সামনের রাস্তায় গিয়ে একটা চিৎকার দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তাই পুলিশও ব্যাপারটা সাময়িক তাই ধরে নিয়েছে। ইনভেস্টিগেশন চলছে। রুমানার মা অসুস্থ হয়ে পড়ায় একাই ঢাকা ফিরছে মাহা।

________________

মেয়েটা কি ভাবে এত! সেই কখন থেকে একধ্যানে বাইরে তাকিয়ে আছে। সার্থক বাইরে তাকিয়ে দেখে কেবল অন্ধকার আর অন্ধকার। দেখার মতো কিছুই নেই। মেয়েটার কন্ঠটা ভয়ংকর সুন্দর। আবার শুনতে মন চাইছে তার। কি বলে কথা শুরু করা যায়! নিজের কর্মকাণ্ডে নিজেই অবাক ডক্টর ফায়রাজ সার্থক। কানাডা থেকে এমবিবিএস, এফসিপিএস ডিগ্রি অর্জন করে দেশে এসেছে সে। কত মেয়ে দেখেছে জীবনে! এমন অনেক মেয়েও আছে যারা তার কাছে নিজেকে সঁপে দিতে চায়। কখনো তাদের জন্য তো এমন লাগেনি তার! তাহলে আজ কেনো! এই সাধারণ মেয়েটা, হলদে ফর্সা মেয়েটা। পরনে বেগুনি আর পানপাতা রঙা থ্রি-পিস। কি আছে মেয়েটার মাঝে! ইজ ইট লাভ এট ফার্স্ট সাইট? কি অদ্ভুত ব্যাপার! ডক্টর ফায়রাজ সার্থক তার জীবনের আটাশ বসন্ত পাড় করলো। ঊনত্রিশ তম বসন্ত আসতে চললো আর সে কিনা একটা গম্ভীর, অহংকারী মেয়ের প্রেমে পড়েছে! নিজেকে ইচ্ছে মতো কষে মনে মনে দুয়েকটা চড় মারলো সার্থক। এটা কখনো সম্ভব না। মাহা তাকিয়ে আছে বাইরে আর সার্থক আড়চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। এমন সময় হঠাৎ থেমে গেলো ট্রেনটা। কতক্ষণ নিরবতা। অতঃপর আওয়াজ ভেসে আসছে, 

"ডাকাত! ডাকাত!"
.
.
.
চলবে...........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন