মেঘফুল - পর্ব ৩১ - মিশু মনি - ধারাবাহিক গল্প


ভায়োলেটের উঠতি যৌবন, চেরীফুলের ন্যায় বিশুদ্ধ ও নির্মল আবেগে ভরপুর। তার সমস্ত আবেগ উথলে উঠল চিঠিতে। রুশোর কাছে নিজেকে জগতের শ্রেষ্ঠ প্রেমিকা হিসেবে উপস্থাপন করার চেষ্টা চালিয়ে গেল সে।

চিঠির মাধ্যমেই কথা চলতে লাগল দুজনের। যে কথা না বললে অস্থিরতা কমে না, যে কথা ভাবলেই বুকের ভেতর টালমাটাল স্রোত বইতে থাকে, যে কঠিন অপেক্ষায় কেটেছে রুশো'র চারটা বছর - সমস্তকিছুই লিখে ফেলল চিঠিতে। রোজ রাতে ভায়োলেট পড়াশোনা শেষ করে নিয়ম করে চিঠি লিখতে বসতো। 
প্রায়ই হুটহাট সে ভায়োলেটকে চমকে দিতো। কলেজ থেকে বেরিয়ে ফুটপাত ধরে হাঁটছে ভায়োলেট, হঠাৎ পাশে রুশোর গলা শুনতে পেতো। সহজ স্বাভাবিক ভঙ্গীতে যে জানতে চাইতো, 'চেয়ারে বসবে নাকি ঘাসের ওপর?'

ভায়োলেট চমকে মুখ ঘুরিয়ে রুশোকে দেখে চোখ বড়বড় করে ফেলত। রুশো বলত, 'মানে রেস্টুরেন্টে বসবে নাকি খোলা আকাশের নিচে কোথাও?'

ভায়োলেট মুচকি হেসে রুশোর বাহু চেপে ধরে বলত, 'তুমি আসবে বলো নি তো?'
' বলে আসতে হবে?'
' যদি আমি আজকে কলেজে না আসতাম।'
' গত রবিবার তো আসোনি। আমি যে দেড় ঘন্টা অপেক্ষা করে ফিরে গেছি, তারপর যখন শুনেছি তুমি কলেজে আসোই নি, আমি কী কিছু বলেছি?'

ভায়োলেট ভীষণ অবাক হয়ে বলতো, 'সে কী! তুমি রবিবার এখানে এসেছিলে? আমাকে বলোনি কেন?'
'সব কিছু বুঝি তোমায় বলতে হবে?'
'এই কাঠফাটা রোদে অপেক্ষা করবে আর আমাকে বলতে হবে না?
'কাঠফাটা রোদ, রুশোর তালুফাটা রোদ তো নয়।'
'মারবো রুশো। খুব মারবো তোমাকে।'
'রাস্তায় মেরো না, লোকজন আমাকে ইভটিজার ভাব্বে।'
'চুপ।'

ভায়োলেট কিঞ্চিৎ অভিমান করতো। রুশোর হাত ছেড়ে দিয়ে সে নিজের মতো হাঁটত। পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে মনে হতো, এই পথচলা প্রশান্তির। যেন স্বর্গের উদ্যান বেয়ে হেঁটে চলেছে দুজনে। ঢাকা শহরের কোলাহল, ফুটপাতে ভীড় ঠেলে যাওয়া মানুষ, হকারের বেচাকেনার সুর, সবকিছুই ভালো লাগার পরশ মেখে দিতো। 

একদিন খুব ভোরে ভায়োলেট বাড়ির পাশে পার্কে দৌড়ানোর জন্য বেরিয়েছিল। গাছের পাতায় শাড়ির মতো জড়ানো কুয়াশা দেখে মুগ্ধ হয়েছিল সে। রুশোকে চিঠিতে জানিয়েছিল সেই কথা। দুদিন পর সে আবার যেদিন পার্কে এলো, আচমকা রুশোকে দেখে হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। সঙ্গে ছিল মেজো আপু সামার। ভায়োলেট ইশারায় রুশোকে বলল, 'আমার বড় আপু।'

খানিক বাদে রুশো সামারের সামনে এসে হাজির। জানতে চাইলো, 'আপু, এই ইয়োগা আমাকে শেখাবেন?'

সামার চোখ তুলে রুশোকে এক পলক দেখে নিলো। রুশো হাসিমুখে বলল, 'আমি রুশো। আপনাকে আপু ডাকতে পারি? এই ইয়োগা শেখার অনেক ইচ্ছে আমার। যদি আপনার আপত্তি না থাকে।
ঝাকড়া চুলের রুশোকে দেখে সামারের মন গলে গিয়েছিল বটে। সামার বড্ড মিশুক একটা মেয়ে। রুশোকে ইয়োগা শেখাতে শেখাতে দুজনের দারুণ ভাব জমে গিয়েছিল। রুশো ভায়োলেটের সঙ্গেও পরিচিতি হল। ভাবটা এমন, আজকেই প্রথম দেখা তাদের। এরপর থেকে প্রায়ই মেজো আপুর সঙ্গে রুশোর দেখা হতো। দুজনে একসঙ্গে ইয়োগা করত, পাশে দাঁড়িয়ে থাকত ভায়োলেট। 

যেদিন সামার অনেক বেলা অবধি ঘুমাতো, ভায়োলেট একাই বেরিয়ে পড়ত জগিংয়ে। সেদিন দুজনে শিশির ভেজা ভোরে একসঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে মন খুলে কথা বলতো। কতই না মধুর ছিল সেই সকালগুলো! ভায়োলেটের খুব ইচ্ছে করে এমন সকাল গুলো আবার ফিরে পেতে। 

জাহ্নবী একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ' তোর রুশোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে রে আমার।'
' রুশোর সঙ্গে আমার কৈশোরের প্রেম। এতটা মায়ায় ভরা! ও আমাকে অসংখ্য সারপ্রাইজ দিতো আপু। আমরা হাসতে হাসতে পথ চলতাম। বৃষ্টিতে পলিথিন গায়ে মুড়িয়ে রিকশায় চেপে ঘুরতাম। ও আমাকে চমকে দিতো খুব। কখনো কখনো আমার ক্লাস রুমে এসে হাজির হতো। বলত, আতিক নামে একজনকে খুঁজতে এসেছি। এখানে কি আতিক নামে কেউ আছে? আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই চলে যেত। এত পাগলামি করত এই ছেলেটা।'

ভায়োলেট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। কৈশোর পেরিয়ে তার ধীরেধীরে যৌবনে পদার্পণ। উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে লম্বা ছুটি পেয়েছিল সে। সেবার গ্রামে ঘুরতে গিয়েছিল। গ্রাম থেকে রুশোকে চিঠি লিখেছিল একবার। একদিন রুশো সেই গ্রামে এসে হাজির!
গ্রামের মেঠোপথ ধরে তারা একসঙ্গে হেঁটেছে, রুশো ধানক্ষেত থেকে ধানের শিষ ছিঁড়ে তার বেণীতে দুলিয়ে দিয়েছে। সে এক অন্যরকম গল্প!

জাহ্নবী জানতে চাইলো, 'কীভাবে রে? তোর পরীক্ষার পর তুই আর আম্মু যশোরে গিয়েছিলি তাইনা? ওখানে রুশো কিভাবে গেল?'

ভায়োলেট হেসে বলল, ' চিঠি পোস্ট করেছিলাম যেই ঠিকানা থেকে, সেখানে এসে হাজির। কীভাবে যেন বাড়িও খুঁজে বের করেছে। একদিন বিকেলে নানুভাইয়ের সঙ্গে বসে নারকেল দিয়ে ছাতু খাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখি রুশো আসছে। সঙ্গে একটা লোক। আমি তো চিৎকার দিতে দিতে নিজেকে সামলেছি। লোকটা এসে নানুভাইয়ের সঙ্গে রুশোকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন, এই ছেলেটা একটা কাজে এসেছে। কিছুদিন থাকবে এখানে। আপনার গল্প শুনেছে যেন কার মুখে। তাই এসেছে আপনার সঙ্গে দেখা করতে। পরে মনে হল, নানুর গল্প আমিই করেছিলাম ওর কাছে। ও নানুভাইয়ের নাম জানতে চেয়েছিল, আমি নামও বলেছি। তখন কী আর জানতাম এই পাগলটা নানুবাড়ি খুঁজে বের করবে।'

ভায়োলেট পুরনো স্মৃতি স্মরণ করে হেসে উঠল। জাহ্নবীও হাসছে। কিছু প্রেম এত সুন্দর হয়! ছবির মত দেশ বলে যেমন একটা কথা আছে, তেমনই এ যেন গল্পের মতো প্রেম। 

স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে চোখ ভিজে উঠতে লাগল ভায়োলেটের। রুশোকে নানুভাই খুবই পছন্দ করেছিলেন। ওর মতো মিশুক একটা মানুষকে পছন্দ না করে থাকতে পারে বুঝি কেউ? 

রুশো নানুভাইকে দেশ বিদেশের প্রাচীন ইতিহাসের গল্প শোনাতো। ফলে লাভ হল একটা। নানুভাই রুশোর সঙ্গে গল্প করার জন্য দুদিন পরপরই রুশোকে ডেকে পাঠাতেন। আড়ালে দাঁড়িয়ে ভায়োলেট রুশোকে দেখত। চোখ বুজলেই মনে হত, সে রুশোর বুকে উষ্ণ আদরের স্পর্শ পাচ্ছে। কখনো নানুভাইয়ের পাশে বসে সেও মন্ত্রমুগ্ধের মতো রুশোর গল্প শুনতো।

'সেবার ছুটিতে দুজনে স্বপ্নের মতো দিন কাটিয়েছিলাম!' বলতে বলতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ভায়োলেট। 
জাহ্নবীর বুকে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল সে। জাহ্নবী কখনো ভায়োলেটকে কাঁদতে দেখে নি। হতবিহ্বল হয়ে ভায়োলেটের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সে বলল, রুশো তোকে অনেক ভালবাসত তাই না রে?
' বুঝতে পারছ না এখনো? বেশী ভালবাসা সবসময় সুখের কারণ হয়না রে আপু।'
' তোরা কেন আলাদা হয়ে গেলি ভায়োলেট?'
' খুব তুচ্ছ একটা কারণে। খুব ছোট্ট একটা গল্প। শুনলে তুমি বলবে, এমন তুচ্ছ কারণে কেউ কাউকে ছেড়ে চলে যায় নাকি? কেউ কেউ যায়। রুশো খুব অভিমানী, জেদী। সবচেয়ে সুন্দর সম্পর্ক গুলো হয়ত তুচ্ছ কারণেই ভেঙে যায়। কিন্তু আমার মনে হয় কী জানো আপু? এখনো রুশো আমার। যেন ও আমাকে ঘিরে রেখেছে সবসময়। ওর ভালবাসার স্পর্শ এখনো অনুভব করি আমি। ও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে এটা কখনো মনেই হয় না।'

জাহ্নবী বলল, 'কাঁদিস না লক্ষী বোন আমার। আমি তো জানিনা কী কারণে তোরা আলাদা হয়ে গেছিস। কারণটা আমাকে বলা না গেলে বলিস না। কিন্তু তুই রুশোকে যেভাবে এখনো অনুভব করিস, আমার মনেহয় সেও তোকে একইভাবে মিস করে।'
ভায়োলেট ডুকরে কেঁদে উঠল, 'এত দিন হয়ে গেল আপু! ও আমাকে মিস করলে ঠিকই একবার আমার কাছে আসত ই। যতই রাগ থাকুক, কষ্ট থাকুক। ঠিকই আসতো। আমাকে ও যেভাবে ভালবাসতো, তাতে কখনো এতদিন রাগ করে থাকা যায় না।'
'ও হয়তো কোনো সমস্যায় জড়িয়ে আছে। ভুল বুঝিস না।'
' মাঝেমাঝে আমিও তাই ভাবতাম। এখন আর ভাবি না। কখনো মনেহয়, রুশো হয়তো আমাকে ভুলে যেতে পেরেছে। হয়তো কাউকে বিয়ে করে সুখে সংসার করছে।'
'ভায়োলেট!'
' যখন ভাবি যেখানে আমার থাকার কথা ছিল সেখানে রুশোর সাথে অন্য কেউ, আমি ভাবতে পারি না কিছু।'

জাহ্নবী বলার মতো কিছু খুঁজে পেল না। চোখ মুছল ভায়োলেট। উঠে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে এসে বসলো। ঘরের আলো জ্বালিয়ে দিয়ে স্বাভাবিক গলায় বলল, 'আপু, এত রাতে কি চায়ের দোকানটা খোলা আছে?'
'আমি চা করে দেই?'
'আচ্ছা দাও। চিনি বেশী করে দেবে।'

জাহ্নবী চমকে উঠলো। তার পান্নাবাহারের কথা মনে পড়ে গেল। পান্নাবাহার চায়ে চিনি বেশী খায়। তার গোলগাল মুখটা ভেসে উঠছে জাহ্নবী'র চোখের সামনে। 

রান্নাঘরে ঢুকে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল জাহ্নবী। রুশোর মতো পাগল প্রেমিকের কথা মনে পড়ছে তার। কী এমন তুচ্ছ কারণে ওরা এত কষ্ট পাচ্ছে? ভায়োলেট যতটা কষ্ট পাচ্ছে, একই কষ্ট কী রুশোও পায় নি? 
ভায়োলেটের কথা শুনে মনে হচ্ছে রুশোর সঙ্গে তার বেশ আগেই বিচ্ছেদ হয়েছে। যখন রুশো তাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে, কীভাবে সহ্য করছিল মেয়েটা? কতটা কষ্ট হয়েছিল তার, ভাবতেই জাহ্নবীর মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। আজ রাতে রুশোর প্রসঙ্গে আর একটা কথাও বলবে না ভেবে মনস্থির করল সে। 

চা নিয়ে এসে জাহ্নবী দেখল ভায়োলেট ঘুমিয়ে পড়েছে। খুব দ্রুত মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়তে পারে। এতদিন ধরে ভায়োলেটের ঘুমন্ত মুখ দেখে জাহ্নবী'র মনে হতো, ভায়োলেট জগতের সবচেয়ে সুখী মেয়ে। তার মতো করে ঘুমাতে না পারার আক্ষেপ হতো তার। এই প্রথম ভায়োলেটকে দেখে জাহ্নবী'র মনে হচ্ছে, মেয়েটা ভীষণ দুঃখী। ওর চোখে ঘুম নয়, দুঃখ লেগে আছে। 
.
.
.
চলবে.......................................................................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

WhatsApp