!!২৫!!
কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে মাহা। হাতে একটা টাকাও নেই। স্টেশন মাস্টার যেন টিকিট না ধরেন তাই ট্রেন থেকে নেমে লুকিয়ে বাইরে এসেছে। মাথায় কিছুই ঢুকছেনা মাহার। কেন সে সিলেট গিয়েছিলো! এটা এক গভীর ধোঁয়াশা তার কাছে। স্টেশনের সামনে লোহার গ্রিলের ধারে দাঁড়িয়ে সে। তার মনে হচ্ছে এখানে সে এর আগেও এভাবে দাঁড়িয়েছিলো। কারো জন্য অপেক্ষা করছিলো। উফ্! আর ভাবতে পারলোনা মাহা।
"আফা, ভুট্টা নিবেন?"
নীল চ্যাকের লুঙ্গি, সাদা ময়লাটে শার্ট। গলায় গামছা আর হাতে ভুট্টার প্যাকেটের থলি। মধ্যবয়স্ক একজন লোক। মাহার মনে হচ্ছে এই লোককে তো সে আগে দেখেছে। কোথায় দেখেছে!....
হ্যাঁ। স্বপ্নে দেখেছে। একটা সরু রাস্তা। সেই রাস্তা দিয়ে হাঁটার পর এমনই একটা রেলওয়ে স্টেশন। সেখানেই তো ছিলো এই লোকটা।
"ও আফা। নিবেন নাকি?"
লোকটার ডাকে ধ্যান ভাঙ্গে মাহার। হকচকিয়ে সে বলে,
"না, না। নিবোনা।"
লোকটা বিরক্ত নিয়ে তাকালেন। অতঃপর বিড়বিড় করতে করতে অন্য দিকে চলে গেলেন। আশপাশে অনেক মানুষজন। ঢাকা মেডিকেলে নেওয়া হয়েছে তার বাবাকে। মাহাদের বাড়ি হাজারীবাগ। কুলাল মহল জামে মসজিদের পাশে। বাড়ি যাওয়ার জন্য সিএনজি নিবে? নাকি মেডিকেলে যাওয়ার জন্য? বাবা কোন ওয়ার্ডে আছেন তাও তো জানেনা সে। ক্ষুধা ও ক্লান্তিতে শরীরও নেতিয়ে পড়েছে। দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছে মাহা। রেলস্টেশনের বাইরে ভূতগ্রস্তের মতো দাঁড়িয়ে আছে সে। চিরচেনা শহরটাকেও অচেনা লাগছে তার। এতটা দ্বিধা দ্বন্দ্বে মাহা কখনো ভুগেনি। সবাই বলে সে বুদ্ধিমতী। সব পরিস্থিতিতে মানিয়ে নিতে পারে। আজ কি তবে তার মাথায় জ্যাম ধরেছে!
"মাহা?"
নিজের নাম শুনে পিছনে ফিরে মাহা। ইউনিফর্মে দাঁড়িয়ে আছে এএসপি রেজওয়ান। চোখে কালো সানগ্লাস। রোদে ফর্সা মুখ লাল হয়ে আছে।
"রেজওয়ান ভাইয়া!"
মাহার দিকে এগিয়ে এলো রেজওয়ান। ঘামে একাকার অবস্থা তার। যদিও শীতল বাতাস বইছে চারদিকে।
"তোমাকে সেই সকাল থেকে স্টেশনে খুঁজে যাচ্ছি আমি। সারারাত তোমার মোবাইল বন্ধ ছিলো কেন?"
"আসলে আমাদের ট্রেনে ডাকাত হামলা করেছিলো। পরে....
তখনই ফোন বেজে উঠলো রেজওয়ানের। মাহা চুপ করে গেলো নিমিষে। কপাল একটু কুঁচকিয়ে ফোনটা ধরে রেজওয়ান। কথা বলার সময় চোখমুখ শক্ত হয়ে যায় তার। ফোনটা রেখে দিয়ে পকেট থেকে রুমালটা বের করে সে। কপালের দুপাশের ঘাম মুছে। মাহা রেজওয়ানের সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
"তুমি সিলেট-ঢাকা আন্তঃনগর ট্রেনে আসছিলে না, মাহা?"
"হুম।"
রেজওয়ানের মুখে বিস্ময়। আটাশবছর বয়সী এএসপি রেজওয়ান কি মনে মনে একটু ভয় পেলেন? আবার মানুষটাকে চোখের সামনে দেখে একটা ছোট স্বস্তির নিঃশ্বাস কি বেরিয়ে এলো তার!
"আচ্ছা, চলো তোমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে আসি। গাড়িতে উঠে বসো।"
"রেজওয়ান ভাইয়া? বাবা কেমন আছেন?"
"আংকেল, ভালো আছেন। বিপি হাই হয়ে গিয়েছিলো। এখন তোমাদের বাড়িতেই নিয়ে আসা হয়েছে।"
রেজওয়ানের পিছন পিছন গিয়ে গাড়িতে বসলো মাহা। স্টেশন ছেড়ে যাওয়ার সময় বুকটা চিনচিন ব্যথা করেছে তার। কালো হুডি পরা ঝাঁকড়া চুলের, কালো মণির ছেলেটাকে মিথ্যা বলে ঢাকা পালিয়ে এসেছে সে। ছেলেটা কি করছে এখন! আর কি কখনো দেখা হবে তাদের!
"মাহা?"
"হুম।"
"আমি বিকেলে তোমাদের বাসায় একবার যাবো। আমাকে একটু খুলে বলবে গতকাল কি কি হয়েছিল ট্রেনে। আর তুমি কি করে ফিরলে ঢাকা।"
"আপনি চাইলে আমি এখনই বলতে পারি ভাইয়া।"
"না, এখন তুমি ক্লান্ত। বাসায় যাও। রেস্ট করো।"
মাহা মাথা নিচু করে রাখলো।
!!২৬!!
রেজওয়ানকে সে ছোট থেকে চিনে। অনেকটা হাসিখুশি, প্রাণবন্ত মানুষ। মাহার খুবই পছন্দ এই লোকটাকে। বড় ভাইয়ের মতো প্রতিটা সময় মাহার পাশে আছে রেজওয়ান। রেজওয়ান মোবাইল দেখার ফাঁকে ফাঁকে মাহার হলদে ফর্সা মুখটা, লাল হয়ে যাওয়া নাকটা দেখছে। কতদিন পর দেখলো এই প্রিয় মুখ। মাসে একবারো দেখা পাওয়া যায়না। প্রতিদিন কি একনজর দেখার জন্য সাভার ছুটে যাওয়া সম্ভব! মেয়েটা কেন বুঝেনা!
"রেজওয়ান ভাইয়া?"
"কিছু বলবে মাহা?"
মাহার আকস্মিক ডাকে থতমত খেলেও নিজেকে সামলে নিলো রেজওয়ান।
"চৈতির কোনো খবর পাওয়া গেছে?"
"এখনো পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।"
"আমার খুবই টেনশন হচ্ছে। ও কোথায় গেলো!"
"চিন্তা করোনা তুমি। সিলেট পুলিশ কাজ করছে।"
বাইরে রাস্তার দিকে মনোযোগ দেয় মাহা। কত মানুষ! কত ব্যস্ততা তাদের! কেবল বাবার জন্যই বাড়িতে যাচ্ছে মাহা। নয়তো সে যেতোনা। এই পৃথিবীতে যার মা নেই তার কেউই নেই। সৎ মানুষ কখনো আপন হয়না। কথাটা হাড়ে হাড়ে বুঝে মাহা। বাবাও বদলে গেছেন। খরচ দিয়েই সব দায়িত্ব শেষ। একটু ভালোবাসা, একটু স্নেহের কাঙাল যে মাহা।
মাঝারি আকৃতির বিল্ডিংয়ের সারি। মাহাদের বাড়ি মেইন রোড থেকে ভিতরে। পুলিশ গাড়িটা ঢুকবেনা সেখানে। গাড়িটা থামতেই মাহা নেমে গেলো গাড়ি থেকে। রেজওয়ানকে কিছু বলার আগেই গাড়ি থেকে বের হয়ে এলো সে। মাহা গাড়ির পাশটায় দাঁড়িয়ে।
"চলো। তোমাকে বাসায় এগিয়ে দিয়ে আসি।"
"আচ্ছা।"
মাহা, রেজওয়ান পাশাপাশি হাঁটছে। দুইপাশে গাদাগাদি করে বিল্ডিংয়ের সারি। মাঝে পাকা রাস্তা। সেই রাস্তা ধরেই হাঁটছে তারা। রেজওয়ানের বাড়ি থেকে মাহাদের বাড়ির পথ দশ মিনিটের। পথিমধ্যেই পড়ে। বাড়ি অতিক্রম করার সময় রেজওয়ান বললো,
"মা, তোমাকে দেখতে চেয়েছিলেন।"
রেজওয়ানের কথায় তার দিকে মুখ তুলে চায় মাহা। আবার মাথাটা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে সে বললো,
"কালকে আন্টির সাথে দেখা করে আসবো।"
আর কোনো কথা নেই। সকাল প্রায় দশটা বাজে। রাস্তার পাশে দুয়েকটা দোকান খুলেছে। দুয়েকজন মানুষের আনাগোনা। পাঁচতলা বিল্ডিংটার সামনে আসতেই দুজনেই থামলো।
"মাহা, তোমাকে কিছু কথা বলি। মনোযোগ দিয়ে শুনবে।"
"জ্বি।"
"চৈতির মিসিংয়ের ব্যাপারটা একটা ধোঁয়াশা। তারউপর কালরাতের ট্রেনের ঝামেলা। তোমাকে জিজ্ঞেসাবাদের জন্য ডাকা হতে পারে পুলিশ স্টেশনে। তুমি ভয় পাবেনা। আমি আছি। যা সত্য তাই বলবে। আমি এখন একটা কাজে যাবো। এখন বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নেও। আমি বিকেলে আসলে ঠান্ডা মাথায় সব বলবে।"
"ভাইয়া, বাবাকে কিছু বলবেন না দয়াকরে। আমি যতটুকু জানি বলার চেষ্টা করবো।"
মাহার কাতর কন্ঠ।
"তুমি টেনশন করোনা। আংকেল কিছুই জানবেন না।"
"আপনিও বাসায় চলেন?"
"ঐ যে বললাম জরুরী কাজ আছে। এখন যাওয়া সম্ভব না। আসি তাহলে।"
"ঠিক আছে। আল্লাহ হাফেজ, ভাইয়া।"
রেজওয়ান ফিরতি পথে হাঁটা দিয়েছে। বুকটা অসম্ভব কাঁপছে তার। তার মাহাপরী যে বড্ড সুন্দরী! ভয়ার্ত হলদে ফর্সা মুখটায় ঠান্ডা বাতাসে তিরতির করে কাঁপা লাল টকটকে নাক। কুঁকড়া চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সারা কপালময়। চোখটায় কি যে মায়া!
মাহা বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলো। মাহাদের নিজেদের বাড়ি। তারা থাকে চারতলার ডানপাশে। মাহা আর রেজওয়ান কি জানে? চারতলার বামপাশের বারান্দা থেকে এক জোড়া চোখ তাকিয়ে ছিলো তাদের দিকে। বিশেষ করে রেজওয়ানের দিকে!
!!২৭!!
কলিং বেল বাজাতেই দরজা খুললেন দিনা হোসেন। মাহাকে দেখে কপাল কুঁচকালেন তিনি। মাহা মলিন হাসলো। তা দেখেও যেন না দেখার ভান করলেন তিনি। কিছু বললোনা মাহা। সব সয়ে গেছে তার। চারবছর বয়সে মাকে হারিয়ে অনেকটা অনাদরেই বড় হয়েছে সে। ড্রইংরুমের উত্তর দিকে রাখা ডাইনিং টেবিলে বসে নাস্তা করছে মাহার সৎ ভাই মাহিন। মাহার থেকে বছর পাঁচেকের ছোট। অপরপাশে দিয়া। মাহার সৎবোন। বয়স দশ বছর। দিনার মা আমিনা এখানেই থাকেন। তিনিও বসে খাচ্ছিলেন।
"আপু, কেমন আছো?"
মাহিন জিজ্ঞেস করতেই তাকে বিকট সুরে একটা ধমক দিলেন দিনা।
"চুপ! খাবারের সময় কিসের কথা। চুপচাপ খাও।"
মায়ের এমন ধমক খেয়ে আর কিছু বলার সাহস পেলোনা মাহিন। দিয়া এমনতেও মাহাকে পছন্দ করেনা। আমিনাও চুপচাপ খাচ্ছেন।
মাহা কাউকে কিছু না বলেই বাবার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। এদের সাথে কথা বলার কোনো ইচ্ছেই তার নেই।
"দেখছো মা। কি তেজ! একটা কথাও না বলে চলে গেলো!"
"তোর জামাই আহ্লাদে মাথায় তুলছে। দামরা মাইয়া এটারে নাকি পড়াতে হইবো। বিয়ার বয়স শেষ। কেডা করবো বিয়া?"
"উনি আমার কথা শুনেন। মাস শেষে কতগুলা টাকা দেন একাউন্টে। ছেলে মেয়ে দুইটা বড় হইতাছে সেই খেয়াল নাই। উনি আছেন মাহা মা নিয়া। কই দুইদিন ধইরা হসপিটালে। গাঁধার মতোন তো আমিই খাটলাম। আজ আইলো উনার মা!"
মাহা সবই শুনেছে। জবাব দেওয়ার ইচ্ছা জাগলেও জবাব দিলোনা সে। শরীর ক্লান্ত, মন ক্লান্ত। বাবার সাথে আগে দেখা করা প্রয়োজন। গত কয়েকটা দিন ধরে কি পরিমাণ ঝড় তার উপরে বয়ে যাচ্ছে সেই কেবল জানে! আজ যদি মা বেঁচে থাকতো!
__________________
চিরচেনা শহরে পা রেখেই মনটা একটু ভালো হলো সার্থকের। বিশ্বের সবচেয়ে অযোগ্য শহরের মাঝে ঢাকা নাকি একটি। এই অযোগ্য স্থানটাই যে সার্থকের প্রিয়। ভিষণ প্রিয়। তার খয়েরী টয়োটা এলিয়ন গাড়িটা রাস্তা দিয়ে চলছে আপনগতিতে। গুলশান আবাসিক এলাকার দিকে গন্তব্য। মাথাটা পিছনে হেলান দিয়ে বসেছে সার্থক। সামনের সিটে ড্রাইভারের পাশে বসা মুইংচিন। চাইনিজ নাগরিক। কানাডায় সার্থকের সেক্রেটারি ছিল। দেশে আসার সময়ও সাথে এসেছে সে। মুইংচিন পয়তাল্লিশ বছর বয়সী একজন পুরুষ। তাকে দেখলে মনে হয় তার বয়স কেবল বিশ। সার্থক কে পিছনে মাথা হেলিয়ে বসে থাকতে দেখে মুইংচিন বলে,
"সাতক। টুমি কি অনেক টায়ার্ড?"
"হুম।"
গম্ভীর শোনায় সার্থকের গলা। মুইংচিন কিছু না বলেই সামনে ফিরে যায়। সার্থক এমনিতে খুবই হাসিখুশি মানুষ। কিন্তু রেগে গেলে ভয়ংকর। অনেক কষ্ট করেও কন্ট্রোল করা যায়না। সার্থকের রাগের প্রথম ধাপ গুরুগম্ভীর ভাব। দ্বিতীয় ধাপ বড় ভয়ংকর! রেগে সব তছনছ করে দেয় সার্থক। মুইংচিন শান ধর্মাবলম্বী। মাৎসু দেবীর পূজারি সে। মনে মনে দেবীর কাছে সার্থকের জন্য প্রার্থনা করে সে। এতো বছর ধরে ছেলেটার সাথে পরিচয়। বাবা-মা হীন সার্থকের জন্য বড়ই মায়া হয় তার।
.
.
.
চলবে...........................