মেঘলা দিনে মেঘ ঘন আকাশ। ঢেকে গেছে কালো ধূসরে চারপাশ। বৃষ্টি নামবে নামবে করছে। আমার বৃষ্টিময় অন্ধকার দিন বেশি ভালো লাগে। ব্যতিক্রম আজো ঘটেনি। মনটা সকাল থেকে প্রফুল্লতায় আমেজপ্রবন লাগছে...কেন লাগছে উত্তর নেই। মনিরা খিচুড়ি রান্না করছে, বাসায় ভুনা খিচুড়ির পসরা বসবে!! উফ....এআদৌ ভুলিনি...আম্মুর হাতের গরম গরম ধোয়া উড়া খিচুড়ি....বৃষ্টির ঝুমঝুম ধ্বনি.... আব্বু টেবিলে বসে আম্মুর কাজে খোচা মেরে ঠাট্টাবাজি...কিপ্টা ভাইয়া প্লেটে খিচুড়ি নিয়ে ফু দিয়ে লোকমা তুলে খাইয়ে দেওয়া..একসময় সব হতো। একসময় সবাই একত্রে খোশ আনন্দ করতাম। বাড়ি উঠিয়ে হাসিমাখা দিন কাটাতাম। আর এখন? কিছুই নেই, আমি দূরে, উনারা দূরে...। আব্বু-আম্মু তাদের মেয়েটার খোঁজখবর রাখেনা, রাতের শেষ অংশে মনে পড়লে চোখে ঘুমও আসেনা।।
জানালা দিয়ে একমনে আকাশ দেখছি। মুগ্ধ এক সপ্তাহ পরে আসবে শুনে কাল রাত থেকে কথা বলি না। কল করলেও ফোন মনিরাকে দিয়ে ওয়াশরুমে চলে যাই, কথা বলি না। মনিরা আমার রাগ দেখে মিটিমিটি দাত চেপে হাসে, কেন হাসে জিজ্ঞেস করলে আরো বেশি করে হাসে। হাসির রোল পড়ে হাসে। এজন্য জিজ্ঞেস করাই বাদ দিয়ে দিয়েছি, "তুই হাসছিস কেন??"
মনিরা দুই প্লেট খিচুড়ি এনে বিছানায় যেয়ে বসলো। আমিও খিচুড়ির ঘ্রান টেনে বিছানায় গেলাম। হঠাৎ দরজায় বেল পড়লো। মনিরা বলল,
--আমি খুলি তুই বস। খিচুড়ি খা,
আমি বিছানায় যেয়ে আসন করে বসলাম খিচুড়ি চামচে তুলে ফুয়িয়ে ফুয়িয়ে খাচ্ছি।মনিরা চমৎকার রান্না করেছে। বরাবরই প্রশংসার দাবিদার!!
--"একা একা খিচুড়ি গিলছিস ভুটকি!!আমাকে ডেকে আনলে কি হতো?? নিমোক শয়তান!!"
খিচুড়ি খাওয়া আটকে গেল। চেয়ে দেখি আবির ভাই! ভাই বাসায় এসেছে, এসেই আমার খাওয়া নিয়ে খোটা। প্লেটটা নিয়ে মাথায় ভেঙ্গে দিলে ভিলেনের মতো হো হো করে হেসে লুটোপুটি খেতাম...কিন্তু তা আর হলো না। প্লেট ভাঙ্গলে ভাই উল্টো আমার হাত-পা ভেঙ্গে হাসপাতালের পঙ্গু ল্যাংড়া রোগী বানিয়ে দিবে। বহু কষ্ট!! ভাই আমার পাশে বসলো। মনিরাকে তাচ্ছিল্যের সুরে বলল,
--ওই মনিরা আমি আসছি দেখোস না? খিচুরি কি আমার ভাগে নেই? যা একপ্লেট নিয়ে আয়।
মনিরা হাসিমাখা ভঙ্গিতে মাথা নাড়িয়ে ভাইয়ার জন্য খিচুড়ি আনতে গেল। আমি এক চামচ খিচুড়ি নিয়ে মুখে পুড়ে বললাম,
--ভাই তুমি বিয়ে করবা কবে? আমার কিন্তু বিয়ে খাওয়ার তর সইতেছে না বুঝছো!!বিরিয়ানি খাইনা, বিয়ের ডেগপাতিলে বিরিয়ানি!! তাড়াতাড়ি একটা মেয়ে দেখো, বিয়েশাদি করে স্যাটেল হও। কুমার আর কতোদিন থাকবা?
ভাইয়ার মুখটা হাস্যোজ্জ্বল হলেও চোখ দুটো তীরতীর করে নিচে নেমে গেল। আমার নজর এড়িয়ে চোখ দুটোকে লুকাতে নিলো। আমি চামচটা প্লেটের উপর বাকা করে রাখলাম।
--তুমি মিরা আপুকে মিস করছো, তাইনা? ভাইয়া উনার বিয়ে হয়ে গেছে, সংসার দেখছে। তুমি কেন বিয়ে ছাড়া পিছিয়ে থাকবা? তোমারও তো লাইফ আছে, নিজের একটা দুনিয়া আছে...আপুকে ভেবে আর কতোদিন বিয়ে না করে থাকবা? আমি বলি...তুমি একটা মেয়ে দেখে বিয়ে করে নাও। পরে তোমার বিয়ের প্রতি অনীহা তৈরী হবে। একা একা দিন কাটবে না....
ভাইয়া মাথা উঠিয়ে সিলিং ফ্যানের দিকে তাকালেন। চোখজোড়া ওখানে আবদ্ধ। লম্বা জোরে শ্বাস ছেড়ে মাথাটা নামিয়ে আমার দিকে করলেন। এক চিলতে অনিচ্ছুক হাসি দিয়ে বললেন,
--সিনু...জেঠো ও কাকির সাথে আমাদের সম্পর্কটা নষ্ট হয়ে গেছে রে। উনারা আমাদের দেখতে পারেনা। আব্বু জানোস, জেঠোকে অনেক অপমান করছে। তুই মুগ্ধকে নিয়ে তোর শ্বশুর বাড়িতে উঠলি তার কয়েকঘন্টা পরেই কাকির সামনেই আম্মু মিরার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।আমার কানে কথাগুলা গুলা এখনো বিজলির মতো বাজে! ভুলতে পারিনি! সিনু? তোর বিয়েটা হাসিখুশি মেনে নিলে কি হতো? এতোগুলা সম্পর্ক, এতোগুলা জীবন নষ্ট হতো?....তুই মুগ্ধের সাথে থাকতে পারলেও আমি মিরার সাথে থাকতে পারলাম না। আমার সম্পর্কে ত্যাগস্বীকার করতে হলো....(বলতে যেয়েও থেমে গেলেন)
ভাইয়ার গলার স্বর নিচু হয়ে আসছিলো। আমার সাথে ঝগড়া বিবাদ লেগে থাকলেও ভাই আমার বিপদের বেলায় কাদার মধ্যে নিজেও পা ডুবিয়েছেন। আমাকে বিপদ থেকে উঠিয়ে নিজেই পা আটকে থেমে গেলেন কিন্তু মুখে হাসি দিয়ে আমাকে বিদায় করলেন। নিজের ভালোবাসা অন্যের হাতে তুলে দিলেন। বির্সজন। মনিরা প্লেট নিয়ে দরজায় ওখানে দাড়িয়ে আমাদের দুইভাইবোনের কথা শুনছিলো। ভাইয়ার চেহারা ঢাকতে আমি মনিরাকে ঝারি মেরে বলি,
--তোর কি আমন্ত্রণপত্র লাগবো! ওখানে দাড়ায়া দাড়ায়া কার তামাশা দেখতেছিস! ভেতরে আয়!
মনিরা ভাইয়ার প্লেটটা এনে রাখলো।ভাইয়া স্বাভাবিক হলো। আমরা তিনজন গোল হয়ে বিছানার উপর যার যার প্লেট ত্রিকোণে রেখে বসেছি। মনিরা ঠাট্টামস্করা করে বলল,
--ভাই ভাই শুনো তোমার মাইয়া বান্ধুবী নাই?? একটারে নিয়া বাজায়া তুমি বিয়া কইরা ফেলো!! আমরা ভাবী পামু! তুমি বউ পাইবা!তারপর মধুচন্দ্র করবা....আমরা ভাতিজা ভাতিজা পামু!!
ভাইয়া অট্টহাসিতে হেসে দিলো। মনিরার এনালাইসিস রকেটের গতিতে বায়ুস্তর পেরিয়ে মহাকাশের ব্ল্যাকহোলে প্রবেশ করছে! মানে...ভাই এখনো ছেকা খেয়ে ব্যাকা হয়ে আছে আর ও ভাইয়ার বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে বই ছাপাচ্ছে।। ভাইয়া হাসি ঠেলে বলল,
--তুই আর ভালো মানুষ হলি না মনিরা! তোর জামাই তোরে কেমন টাইট দেয় দেখিস! এইযে নমুনা দেখ...(আমার দিকে তাকিয়ে) দেখ এই ভুটকিরে, কাউকে ভয় পায় না.. আমাকেও না...কিন্তু কিন্তু কিন্তু!! মুগ্ধ রাগলে জবান বন্ধ! বুঝছোস মনিরা??
মনিরা তাল মিলিয়ে বলল,
--আরে হ ভাই হ...তুমি শুনলে বিশ্বাস করতা না!! মুগ্ধ ভাই হোস্টেলে আইসা রুমের মধ্যে যেই কেদানি দিছে, ডিভোর্স কাহাকে বলে!ডিভোর্স কিতা! কুতা থিকা আতিছে! ভুলিয়া গিয়াছে!!!
আমি পুরা বেক্কলের মতো মুখের মধ্যে খিচুড়ি গপাগপ পুড়ছি। ভান ধরেছি আমি কিছু শুনি নি।আমি কিচ্ছুই শুনিনা! দুটো মানুষ আমার ইজ্জতের ফালুদা বানিয়ে হাসাহাসি করছে! উফফফ! সব দোষ মুগ্ধের! আসুক উনি খুনি করবো আমি!
দুপুর বেলা মনিরা আমাদের বেডরুমে শুয়ে আছে। আমি মাথার চুলসহ পা পযর্ন্ত কাথা মুড়ে সটান হয়ে শুয়ে আছি। মনিরা রাফিয়ার সাথে খাতির জমিয়েছে আবরার ভিলায় এখন কি হচ্ছে সেটা জানার জন্য। ফোনে ফোনে যোগাযোগ। রাফিয়ার হাতে ফোনটা মূলত মুগ্ধ কিনে দিয়েছিলেন, মনিরা নাম্বার টুকে ওকে কল বসিয়েছে। কান পেতে আমি কাথা মুড়ি দিয়ে শুনছি...
--রাইফু শুন শুন...বাসার সবাই ভালো আছে?
--...............................
--যাক ভালোই, রাইফেল হালায়? ওই হালার কি হইছে? ওর বউ কেমন?
--...............................
--এক্কেরে হালার ঠিক হইছে! ******হালা! হালার বিয়া করার খাইজ্জানি এক্কেরে মিটায়া দিছে!
--...............................
--বাল পাকনা রূপার কি হইছে? ছেড়ি ওইডার বিদায় হয়নাই? ওর মা গেছে?
--..................................
--উহহুহুহু...দিল খুশ কার দি রাফু! চুম্মা ল!! চুউম্মাহহ...!!
মুখ ঢেকে চোখ বন্ধ করে মনিরার খাসড়ামি পেচাল শুনতেছি। ছি ছি...ফোনের মধ্যে চুমাচুমি? খাচ্চর! মেয়ে মেয়েকে এমনে চুমা দেয়? মুগ্ধ এখন পযর্ন্ত ঢঙ দেখিয়ে ফোনের মধ্যে চুমা মারেনি! মনিরা দশহাত দূরে থেকে চুমার বর্ষন করে দিচ্ছে??? বাহ্ রে বাহ্!! কি দুনিয়া আমার!! মনিরার কথা শেষ, ও আমার কাছে এসে কানের কাছে বলল,
--মম! বান্ধুবী!! গ্রেট নিউজ!!! কাথা সরা!
আমি কাথা আরেকটু টেনে শক্ত করে নিলাম উদ্দেশ্য কাথা না সরিয়ে কথা শুনবো! আমি বললাম,
--মনিরা যা বলবি বল, আমি ঘুমাচ্ছি। চোখে ঘুম। কাথা সরাবো না। তুই বল।
--রাইফেলের বউ ভাইগ্গা গেছে! সুন্দরী বধূর আগেই একটা প্রেমিক পাতানো ছিলো, মাইয়া খাচা ভাইঙ্গা উড়াল পঙ্খি হইছে!!
"রাফিনের বউ পালিয়ে গিয়েছে"--দুনিয়াবি তরিকায় খোদার বিচার শুরু! আমার সাথে নষ্টামি করার চেষ্টায় ছিলো!!এখন নিজের স্টেটাসের উপর নষ্টামির দাগ পড়লো! ও বাড়িতে যাওয়ার পর একদিন শুধু সামনে এসেছিলো, আর আসেনি। আমি নাকি চরিত্রহীনা মেয়ে, আমার সামনে দাড়ালেও ওর লজ্জা করে। কি বিচারের আদালত জমেছে না? খেলা শুরু কেবল..আরো চলবে.....। মনিরা আমার মাথায় আলতো ধাক্কা দিলো, ও ভাবছে আমি ওর কথা শুনছি না, ইগনোর করছি। সত্য এটাই আমি দুইকানে পরিস্কার করে শুনছি। রাফিনের তিরস্কারের জবাব আমি না দিলেও দুনিয়ার মালিক দিয়ে দিলেন। আহ্ শান্তি! ও আবার বলল,
--তুই কি আমার কথা শুনোস?? আমি দেখিস কথা কইতাম না!
--না শুনছি বল।
--তাইলে আরো শুন...বাল পাকনা শিয়ানি রূপার হাত পুইড়া গেছে, ছেড়ি বলে দুইমাস আগে হাসপাতালে আছিলো, এখন বলে গেছে গা। চুলায় বলে দেমাকী দেখায়া রান্না করতে গেছিলো, হাত পুইড়া চামড়া খোয়াইছছে। রূপায় ওদের বাসা রাজশাহীতে গেছে গা।তোর ফুপু শ্বাশুড়ী খালি বাসায় আছে।
রূপা রান্নার কাজে বকলম। রান্নার সময় গরম তেলের মধ্যে পানির ছিটা দেওয়া যায়না...এ সামান্য জ্ঞানটুকু ওর নেই। ফুপু হয়তো আবরার ভিলা ত্যাগ করবেন না, তাই খুটি গেড়েই দিয়েছেন পাকাপোক্তভাবে। আমার ভ্রুক্ষেপ নেই, আমি বর্তমানে সুখী। মনিরাকে বললাম,
--তুই ঘুমা মনু, বকবক আর খবর কম নেস নাই, এখন ঘুমা। সন্ধ্যায় নুডলস রান্না করবো....নিচে থেকে টমেটো সস এনে দিস।
--ঘরে সস শেষ?
--মুগ্ধ সসের যেই বোতল আনছিলো, ওটা কালকে শেষ। সস ছাড়া নুডলস মজা না...সন্ধ্যায় নিচে যাবি দারোয়ান চাচারে টাকা দিয়ে এনে দিস। ঘুমা!
মনিরা আমার পাশে শুয়ে পড়লো। আমি কাথাটা মুখ থেকে সরিয়ে দেখলাম ও ঘুমিয়েছে কিনা। চোখ বন্ধ। আমিও কাথা দিয়ে মুখ ঢেকে নিলাম। বালিশের নিচে আমার ফোন বাজছে। রিংটোন বাজছে, ভাইব্রেশন হচ্ছে। মুগ্ধ কল করবেন। আমি ধরবো না! সকাল থেকে কল করেননি! আমি এখন ধরবো না! তিনবার বাজতে বাজতে বন্ধ হয়ে গেল.. আমি রিসিভ করিনি। হঠাৎ একটু পর একসাথে অনেকগুলো কলিংবেল বাজালো। একনাগাড়ে অনেকগুলো বেল দিলো। আমি মনিরাকে দরজা খুলতে বললাম। মনিরা হাই তুলে আমাকে ঘুম ঘুম চোখে বলল
--কোন হালায় আসলো! মেজাজটা খারাপ লাগে না ক তো! শুইছি! এর মধ্যে উঠা লাগতাছে!
--তুই যা মনিরা। আমার আলসেমি লাগতেছে। যাস না...যা...দরজা খোল...
--খাড়া!
মনিরা দরজা খুলেছে। কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না কে এসেছে। চোখে আমার দুপুরের ঘুম। বৃষ্টির ঠান্ডা দিনে বিছানা থেকে উঠতে ইচ্ছে?? মোটেও না! আহা ঘুম আর ঘুম....মিনিট পাচঁ গেল বুঝি মনিরা পাশে এসে ঘুমালো না। কোনো অতিথি আগমনের সুত্রাভাসও পেলাম না। কাথা সেই যে ঠেসে ঢেকেছি তা নিয়ে এখনো ওভাবেই আছি। হঠাৎ মনিরার গোঙানো আওয়াজ পাচ্ছি! ভয়ংকর ভাবে গোঙাচ্ছে! বিষম খেয়ে ভয় কাবু করলে যেমন কথা ছাড়া গোঙানি শুরু হয়!ওমন শব্দ! হিমেল হাওয়ার শো শো শব্দ আসছে...পিনপিতন স্তব্ধ ঘুমন্তপুরীর পরিবেশ লাগছে। রূপকথার ঘুমন্তপরী!! কাথা সরিয়ে উঠার আগেই কেউ আমার উপর ঝুঁকে ভর ছেড়ে দিলো! কাথার ভেতরে আমি থ! কোনো নড়াচড়া করতে পারছি না! পাথরের মতো কষ্টিফলক হয়ে আছি!! একাত-ওকাত কোনোকাতই ঘুরতে পারছিনা। মুখের কাথা সরাবো কেউ পেচিয়ে ধরলো!