অলকানন্দা - পর্ব ১১ - আনিকা রাইশা হৃদি - ধারাবাহিক গল্প

!!৩০!!

"আগামীকাল আমার পরীক্ষা। আগেরদিন খুব টেনশন নিয়ে ঘুমুতে গিয়েছিলাম। রুমানা কে তো চিনেন ভাইয়া?"
"হুম।"
"রুমানার ডাকে ঘুম ভাঙলো আমার। নিজেকে আবিষ্কার করলাম একটা পিচঢালা রাস্তায়। সেই সাথে কিছু অচেনা মুখ। রুমানার মুখে শুনলাম আমি নাকি সিলেট বেড়াতে এসেছি। চৈতির সাথে। রুমানাও ট্রেনে আমাদের সাথে এসেছিলো। দেরি হওয়ায় ও অন্য বগিতে ছিল। বিশ্বাস করুন ভাইয়া আমি কিছুই বুঝতে পারছিলাম না!"
"স্ট্রেঞ্জ!"
চিন্তিত দেখালো রেজওয়ানের মুখ। মাহা একজন মেধাবী মেয়ে। সব সময়ই ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি সামাল দিতে জানে। ওকে এই প্রথম এতটা বিচলিত হতে দেখলো রেজওয়ান। ও যতটুকু জানতো ছুটিতে চৈতির সাথে সিলেট গিয়েছিলো মাহা। মায়ের মুখে শুনেছিলো সে। কা কা করে মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেলো এক ঝাঁক দাঁড়কাক। রেজওয়ান সেদিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
"তারপর?"
"যতক্ষণে বুঝলাম সেটা রুমানাদের বাসা ততক্ষণে জানতে পারলাম চৈতি নিখোঁজ। এত রাতে কোথায় গেলো কেউ বলতে পারছিলো না। মেইনগেটে তালা ছিলো। তারপরই সকালে আপনাকে ফোন দিয়েছিলাম ভাইয়া।"

!!৩১!!

বলেই মাথা নিচু করলো মাহা। পরেরটুকু জানা আছে রেজওয়ানের। মাহার ফোন পেয়ে উৎফুল্ল হয়ে গিয়েছিলো তার অবাধ্য হৃদপিণ্ড। যখন প্রাণপাখিটার কাঁপা কাঁপা ভীতু স্বরের, সিক্ত গলায় ভিজা আওয়াজটা শুনলো! অবাধ্য হৃদয়ের কম্পন বন্ধ হবার উপক্রম প্রায়। রুদ্ধশ্বাসে কেবল বেরিয়ে এসেছিলো একটা বাক্য।
"আমি আছি তো, মাহা।"

কল্পনার ভাসমান জগৎ থেকে বেরিয়ে রেজওয়ান প্রশ্ন করলো,
"গতকাল কি ঘটেছিলো?"
"তখন বোধহয় সন্ধ্যা। হঠাৎ ট্রেন থেমে গেলো। দুইপাশে ঘন জঙ্গল। কিছুই বুঝতে পারছিলাম না কেন কি হলো! গুঞ্জন ভেসে এলো ডাকাত, ডাকাত। আমার সাথে একজন ছিলেন তিনি ট্রেন থেকে দৌড়ে নেমে গেলেন। আমিও তার পিছুপিছু ছুটলাম। ততক্ষণে চিৎকার, চেঁচামেচি শুরু হয়ে গেছে। তার সাথে জঙ্গলের দিকে দৌড় শুরু করলাম এলোমেলোভাবে। সামনে একটা সাঁওতাল বসতি। সেখানে রাত কাটিয়ে ভোরে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম ট্রেনে করে।"

সার্থকের কথাটা ইচ্ছে করেই বলেনি মাহা। বলতে ইচ্ছে করছেনা। যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাটা ঘটেছিলো সেটা ভুলে যাবে সে। একদম ভুলে যাবে। ঘাড়ে চিনচিন ব্যথাটা বেড়েছে আবার। ডান হাতটা উঠিয়ে ঘাড়ে হালকা ম্যাসেজ করলো মাহা। ব্যথাটা হঠাৎ হঠাৎ হয়। আস্তে আস্তে মাথায় ছড়িয়ে পড়ে। 
"তুমি ঠিক আছো? মাহা।"

ঘাড় থেকে হাত সরিয়ে নিলো মাহা। মলিন হেসে বললো,
"আমি ঠিক আছি।"

রেজওয়ানের খুব ইচ্ছে করছে জিজ্ঞেস করতে,
'তিনি টা কি কোনো ছেলে ছিলো?'

মুখে চলে আসলেও নিজেকে সংযত করলো রেজওয়ান। নিরবতা। ঢাকার বিকেলগুলো অবশ্য নিরব হয়না। দূর থেকে বাস, ট্রাকের আওয়াজ ভেসে আসছে। হিম শীতল হাওয়া বইছে। মাথার উপরে দাঁড় কাকের দল উড়ে বেড়াচ্ছে। এদিকটায় কাকের আনাগোনা আজকাল বাড়লো কিনা!

"রুমানা ঢাকা আসবে কবে?"
"ওর মা অসুস্থ। বলেছে তাড়াতাড়ি ফিরবে।"
"সিলেট পুলিশ তোমাদের সবাইকেই তো জিজ্ঞেসাবাদ করেছে?"
"হ্যাঁ।"
"রুমানার সাথে আমার একবার কথা বলা প্রয়োজন মাহা। তুমি আমার পরিচিত তাই এই কেসটায় আমি ইনভলভ হচ্ছি। নয়তো এটা সিলেট পুলিশের অধীনে। যতক্ষণ না পর্যন্ত চৈতির খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত কেসটায় আমি সরাসরি কিংবা অফিশিয়ালি ইনভলভ হতে পারবোনা। তবে ব্যাক্তিগত ভাবে আমি ইনভেস্টিগেট করবো। নিজের সর্বোচ্চটা দেওয়ার চেষ্টা করবো।"

!!৩২!!

"মাহা?"

রেজওয়ানের মুখপানে তাকালো মাহা। হলদে ফর্সা মুখটা, ভারী নেত্রপল্লব, কুঁকড়া চুলগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সারামুখে। মাথায় কালো ওড়না দেওয়া। এমন বিষণ্ণতায়ও কি মায়াবী লাগছে প্রাণপাখিটাকে! ধক করে রেজওয়ানের বুকটা। বেসামাল নিজেকে সামলাতে বারকয়েক শুকনো গলায় কাশলো সে। তখনই বিচলিত দেখালো মাহার মুখ। উঠে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
"পানি খাবেন, ভাইয়া?"
"না, না। আজ আমি উঠি।"

বলেই দাঁড়িয়ে গেলো রেজওয়ান। ডানহাতটা গুঁজে দিলো পকেটে। 
"ভাইয়া, চৈতিকে ফেরত পাবো তো? ওর বাবা অসুস্থ মানুষ। মুন্সিগঞ্জে ওর ফুফুর বাসায় থাকেন। নিজে চলাফেরা করতে পারেন না। ওর ফুফুর সাথেও তো ওর সম্পর্ক ভালো না। ওর ফুফু চেয়েছিলেন ওকে বিয়ে দিয়ে দিতে। মেয়েটা কতটা যুদ্ধ করে এতটুকু এসেছে আমি দেখেছি ভাইয়া। ওর কিছু হলে আমি নিজেকে ক্ষমা করতে পারবোনা।"

বলেই ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো মাহা। ভিষণ কষ্ট হচ্ছে তার। মাহার কান্না যে সহ্য হয়না রেজওয়ানের! 
"প্লিজ মাহা। তুমি কেঁদোনা। আমি আছি তো। আমার সর্বাত্মক চেষ্টা আমি করবো।"

বলেই ছাদ থেকে গটগট শব্দ তুলে প্রস্থান করলো রেজওয়ান। বুকটায় জ্বালা করছে ভিষণ! 

____________________

অন্ধকারে ছেয়ে গেছে ধরা। বারান্দায় দাঁড়িয়ে অন্ধকারের মাঝে যেন নিজের জীবনটা খুঁজে পায় মাহা। তার ভালোবাসার মানুষগুলো সবসময় তার থেকে দূরে সরে যায়। বুঝ হওয়ার আগেই মা চলে গেলেন। বাবা ছিলো আপন। সেই বাবাও পর হয়ে গেলো। চৈতি মেয়েটা ছিলো মাহার অসুন্দর, এলোমেলো জীবনের আলোর দিশা। এক ফোঁটা হাসতো না মাহা। সেই মাহাকে খিলখিল হাসি শিখিয়েছে চৈতি। পরিচয়টা আড়াই বছরেরও কম। সেই তো কিছুদিন আগে এডমিশন কোচিংয়ে লম্বা মতন মেয়েটাকে দেখে অহংকারী ভেবেছিলো সে। মেয়েটা যখন ঘুষি মেরে মিনহাজের নাক ফাটিয়ে দিলো তখন তো রীতিমতো তাকে ভয় পেতো মাহা। ঠান্ডা স্বভাবের, নিরবে বসে থাকা মাহা কিনা বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে গেলো বাচাল, স্বাধীনতাপ্রেমী চৈতির! দুজন তো চান্সও পেলো একজায়গায়। সমাজবিজ্ঞান অনুষদে সবাই ভিষণ অবাক হতো তাদের বন্ধুত্ব দেখে। সবার মনে বোধহয় একটাই প্রশ্ন, 
"তেলে জলেও মিশ খায়?"

এই চৈতির জন্য মাহা কত কথা শুনেছে দিনার। সবকিছু ছাপিয়ে ছিলো তাদের বন্ধুত্ব। সেই প্রাণপ্রিয় বন্ধুটা আজ চারদিন ধরে নিখোঁজ। আর মাহা কিছুই করতে পারছেনা! কিছুই না! দেয়ালে হেলান দিয়ে নিচে বসে পড়লো মাহা। 
"আমার জীবনের প্রিয় মানুষগুলোই কেন হারিয়ে যায়, আল্লাহ? আমার জীবনটা এতো অদ্ভুত কেন?"

আবারো চোখে নেমে এলো জল। ঠান্ডা কপোলে উষ্ণ জলের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। এই জল মুছিয়ে দিতে কেউ কি আসবে?

!!৩৩!!

"হ্যালো, আংকেল?"
"আমি তোমার দিনা আন্টি।"
"আন্টি একটু মাহাকে দেন। ইমার্জেন্সি।"

আজাদ সাহেবের ফোনে হঠাৎই সকালে ফোন এসেছে রেজওয়ানের। মাহা কে চাচ্ছিলো সে। দিনা মুখ বাঁকিয়ে প্রায় মোবাইলটা ছুড়ে দিলেন মাহার পানে। মনটা এমনিতেই খারাপ মাহার। সে সাথে মাথাব্যথা। রেজওয়ান অধৈর্য্য হয়ে বললো,
"হ্যালো, মাহা?"
"জ্বি।"
"একটা খারাপ সংবাদ আছে।"

কি খারাপ সংবাদ! হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে মাহার। মাহা কাঁপা কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলো, 
"কি...কি খারাপ সংবাদ?"
"গতকাল বিকালে সিলেট আগুন পাহাড় থেকে একটা ছিন্ন পা পাওয়া গেছে। সেটা আজ ঢাকা মর্গে পৌঁছেছে। তুমি কি একবার এসে শনাক্ত করে যাবে? আরো কিছু জিনিসপত্রও পাশে পাওয়া গেছে।"

বিদ্যুৎ চমকানোর ন্যায় শব্দ হচ্ছে মাহার আশেপাশে। শরীরটা অসাড় হয়ে আসছে। বোকা মন বারেবারে বুঝ দিচ্ছে। উঁহু, ঐটা চৈতি নয়। ঐটা চৈতি হতেই পারেনা! মস্তিষ্ক মানছেনা। সে যে যুক্তিতে বিশ্বাসী। আবেগ তার বড্ড অপ্রিয়। 

"হ্যালো, মাহা। তুমি কি শুনতে পাচ্ছো? আমিই আসতাম তোমাকে নিতে। এখানে এখন আমাকে থাকতে হবে। তুমি চলে এসো।"
"আমি আসছি ভাইয়া।"

যে পোশাক পরনে ছিল তা পরেই রওনা দিলো মাহা। ড্রয়িং রুমে টিভিতে সংবাদ দেখাচ্ছে, 
"২০১২ সালের ন্যায় খুন আবারো। প্রায় পাঁচ বছর পর একই রকম শরীরবিহীন পা উদ্ধার করলো সিলেট পুলিশ। ঘটনাটি ঘটেছে সিলেটের আগুন পাহাড়ে। গতকাল বিকেলে একজন স্থানীয় উপজাতি সর্বপ্রথম বিষয়টি অবগত করেন সিলেট পুলিশকে। পা টি নিয়ে আসা হয়েছে ঢাকা মর্গে। কার শরীরের অংশ তা এখনো জানা যায়নি। পুলিশ এ ব্যাপারে মুখ খুলতে নারাজ। বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে আমাদের সাথে যুক্ত হচ্ছেন......

খবর শোনার সময় এখন নয়। দৌড়ে নিচে নেমে একটা রিকশা নিলো মাহা।

রিকশা যতই এগুচ্ছে ততই বুকটা কেঁপে উঠছে মাহার। এই শীতেও তরতর করে ঘাম বেয়ে পড়ছে তার কপালের দুপাশ দিয়ে। ওড়না দিয়ে কপাল মুছলো সে। একটাবারের জন্যও চৈতির ফুফু কোনো খোঁজ নেন নি। সেই যে মাহা একবার জানিয়েছিলো সিলেট থাকতে ফোন দিয়ে। এরপর আর কোনো খবর তিনি নেন নি। দায়সারা উত্তর ছিলো তার,
"কোনো ব্যাটার সাথে ভাগছে মনে হয়।"

জ্যামে আটকে গেলো রিকশা। ভিষণ বিরক্ত লাগছে মাহার। ঢাকার জ্যামকে মাহা মন থেকে ঘৃণা করে।

গাড়ি করে হসপিটাল যাচ্ছে সার্থক। জ্যামে বসে থেকে গাড়ির জানালা খুলে দেয় সে। পাশে তাকিয়েই চমকে উঠে প্রথমে। চোখ থেকে সানগ্লাস খুলে আবার তাকায় সেদিকপানে। হলদে ফর্সা, কুঁকড়া চুলের, অহংকারী মেয়েটা। বারেবারে কপালের ঘাম মুছতে ব্যস্ত। বেশ চিন্তিত তার মুখ। সার্থক তাকিয়ে আছে। একধ্যানে, প্রাণভরে দেখছে সে। যানজট ভালো লাগছে তার। ভিষণ ভালোলাগছে। হঠাৎ.. 

হঠাৎ মেয়েটা চলে গেলো। রিকশাটা হারিয়ে গেলো শতগাড়ির মাঝে। বুকটা কেঁপে উঠলো সার্থকের। এই মেয়েটাকে আবার হাতের কাছে পেলে নির্ঘাত তুলে আছাড় দিবে সে। মুইংচিন সামনে থেকে লক্ষ্য করছিলো তাকে,
"কি ডেখো সাটক?"
"কিছুনা, মুইংচিন।"
"টোমারে আজ জরুরি ডাকালো। পা পাওয়া গেসে।"
"হুম।"

গম্ভীর হয়ে গেলো সার্থকের মুখ। হাসপাতালে জরুরিভাবে ডাকানো হয়েছে তাকে। দেড় বছর পর আবারো সিরিয়াল কিলার মাতব্বর শরীফের খুনের ধরনের মতো খুনের ঘটনা ঘটলো। এটা কি করে সম্ভব? মাতব্বর শরীফ তো জেলে! তাহলে কে ঘটাচ্ছে এসব? কেন ঘটাচ্ছে?
.
.
.
চলবে..........................

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন