যদি বলি ভালোবাসি - পর্ব ০২ - ফাবিয়াহ্ মমো - ধারাবাহিক গল্প



-হোয়াটএভার! তোর ভাই নিজে পাঠিয়েছে, তোর সাথে রোমান্স করতে!
-কি আশ্চর্য ! ভাইয়া কেন বলতে যাবে! হাত ছাড়ুন রাদিফ ভাইয়া! অতিরিক্ত করছেন!উফফ হাত ছাড়ুন!

আমি চেচানো শুরু করলে উনি হাত ছেড়ে দেন। রাগে ফুসছেন উনি।। গায়ের জ্যাকেট এই ঝটকায় খুলে ছুড়ে মারেন । শার্টের হাতা টেনেমুচড়ে কনুইয়ের অংশে ভাজ করেন। আমি পিছিয়ে যাচ্ছি উনার কর্মকাণ্ড দেখে। সুযোগ বুঝে যেই দৌড় দিব ওমনেই ভাইয়া হাত টেনে "ঠাসস" করে সজোড়ে থাপ্পড় বসিয়ে দিলেন। থাপ্পড়ের শব্দ পুরো রুমে ঝংকার বাজাচ্ছে। গরম তেলে হাত ডুবালে যেমন পুরে উঠে ঠিক ওরকমভাবে জ্বলছে গালটা। আমি গাল ধরে উনার দিকে তাকালে হুট করে আমার গাল চেপে ধরেন। এতো জোরে চেপে ধরেন আমার দাতের সাথে দাতের পাটি লেগে যাচ্ছে। ঠোট ফুলে উচু হয়ে উঠছে। গালে চড়ের আঘাতে টনটন করছে আবার চেপে ধরেছেন! যন্ত্রণা করছে খুব!! চোখের কোনায় পানি জমলেও নিজেকে কান্না থেকে শক্ত রাখার চেষ্টা চালাচ্ছি...অন্তত উনার সামনে কাদব না। ভাইয়া অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। মায়াজালে ফাসানো চোখদুটো নিমিষেই ভয়ানক রাগে জ্বলজ্বল করছে। উনি আরো জোরে গাল চেপে ধরে বলে উঠলেন-

-হাত ছাড়ার জন্য ধরিনি! না তোকে ছাড়ার জন্য বসে আছি!বেশি বাড়াবাড়ি করলে কি অমানবিক অঘটন ঘটাতে পারি ভালো করে জানিস!  আমি কি জিনিস এলাকার প্রতিটা মেয়ে প্লাস আমাকে চেনা সকল মেয়ে জানে! সাবধান করে দিচ্ছি ফর দ্যা লাস্ট টাইম! বিদেশি কালচারের ভাষা বোঝাতে ব্যকুল করিস না! এতো রাতে যে ভাষা বোঝাবো জন্মেও ভুলবিনা! বি এলার্ট!

উনি আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলেন। জানালার কাছে মুখ ঘুরিয়ে দাড়িয়ে পড়লেন। অন্ধকার আকাশে চোখ মেলে তাকিয়ে আছেন...যতটুকু বুঝলাম।নিজের সাথে ঘটা এমন আচরনে আমি অনেকটা ভয় পেয়েছি। কোমরে হাত রেখে জোরে জোরে শ্বাসকার্য চালাচ্ছি। কিছুটা স্বাভাবিক লাগলে...আস্তে পায়ে উনার পাশে যাই জানালার কাছে দাড়াই। দেখি উনার হাতদুটো বেগতিক কাপছে। ছোটবেলায় দেখতাম,  যখন উনার প্রচন্ডরূপে রাগ উঠতো তখন হাত কাপাকাপি শুরু হয়ে যেত । এখনো ব্যাতিক্রম ঘটেনি। হঠাৎ উনি বলে উঠলেন-

-আমি এয়ারপোর্ট থেকে রাতের আধারে এক্সিডেন্ট হয়ে এখানে আসি! প্রচুর ব্লেডিং অবস্থায় তোর রুমে আসি! হাসপাতালে না গিয়ে তোর কাছে আসি....এখনো বুঝলিনা কেন এসেছি...কার জন্য এসেছি? আমার সাথে অভিনয় করছিস? এখনো কি ওই বাচ্চাই রয়ে গেলি যে কিনা কিছুই বুঝতো না?

আমি কিছুটা অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। উনি আমার দিকে জবাবের আশায় তাকিয়ে আছেন....চোখে রাগের ভাবটা কম। আমি একটু কেশে শান্ত সুরে বলে উঠলাম-

-রাদিফ ভাইয়া আপনি জার্নি করে এসেছেন তার উপর এক্সিডেন্ট..... এক কাজ করুন আপনি আমার রুমে ঘুমিয়ে পড়ুন আমি আপুর রুমে ঘুমাতে যাচ্ছি। সকালে দেখা হবে। আমি আসি...

-থাম! কোথায় যাচ্ছিস? আমি যেতে বলেছি? বাড়াবাড়ি করছিস না? আর রাদিফ কি হ্যাঁ? কিসের রাদিফ? মুগ্ধ বল! চুপচাপ এখানে থাক! পারলে এক কাপ চা বা কফি নিয়ে আয় মাথাটা বড্ড ঝিমঝিম করছে...

- দেখুন ভাইয়া ছোটবেলার সাথে বড়বেলা যোগ করবেননা। ওটা অতীত ছিলো আর এটা বর্তমান। আপনাকে একসময় মুগ্ধ ভাইয়া ডাকলেও সেটার সাথে বর্তমানের কোনো মিল খোজবেন না। আপনি বসুন। আমি কফি নিয়ে আসছি।

-আসবি? ধোকা দিবি নাতো? সাবধান কাউকে টু শব্দ বলার দরকার নেই। আমি একটু পড়েই চলে যাব।

কোন দামড়া গরুর ঘাস দিতে এখানে আসছেন!খবিশ! থার্ড ক্লাস! বেশশরম!শুধু শুধু আমার সময় নষ্ট! ফালতু বেয়াদ্দব লোক!....মনে মনে চৌদ্দগুষ্ঠি উদ্ধার করে গালিগালাজ করলাম। কিন্তু সমস্যা একটাই আত্মা শান্তি করে গালি গুলো বলতে পারলাম না। বুক ভরা কষ্ট। ডেস্ক থেকে ওড়না নিয়ে গলায় পেচিয়ে নিলাম। আলমারি খুলে লং কটি গায়ে জড়িয়ে রুমের দরজা খুললাম। বাইরে একবার উকি দিলাম। নাহ্ সব ঠিকঠাক। সব রুমের লাইট নেভানো। তার মানে সবাই ঘুমিয়ে। আস্তে করে টিপেটিপে রান্নাঘরে গেলাম। সুইচ অন করেও অন করলাম না। যদি সুইচ অন হয়ে যেতো তাহলে আম্মু লাঠি ফুলদানি নিয়ে ধেয়ে আসতো। বলে রাখি, আম্মুর প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী রাত বারোটার পর কেউ রান্নাঘরে পা দিবে না। তবে তেলাপোকা হলে অন্য হিসাব। তেলাপোকা দেখলে আম্মু আমি আপু তিনজনেই গগনচুম্বী চিৎকার!! এই চিৎকার দেখে কে!! অন্ধকারের মধ্যে কোনোকিছু করা মানে বিরাট ঝামেলা। বায় চান্স তাকের ভুল জায়গায় হাত পড়লে জিনিসপত্র ঠুসঠাস ফ্লোরে ছিটকে হাডুডু খেলবে। কি যে করি! বুকে ফু ফু দিয়ে টর্চ খোজার জন্য হাত বাড়ালাম। অবশ্য নিচের তাকে ম্যাচবাস্কের উপর টর্চ মহাশয় গলাগলি করে থাকে। এখন তাদের আলাদা করার পালা। হাত বাড়ালাম! কপালটা লাখে হাজারে ভালো হাতটা জায়গা মতো টর্চের উপরেই পড়লো। আহা কি শান্তি কি শান্তি!!! মনে মনে লাড্ডু ফুটে টসটস করছে!! পারলে কালা চাশমা গানে উড়াধুরা ড্যান্স মারতাম!! টর্চ জালিয়ে মুখে আকড়ে কফি বানাতে লেগে পড়লাম। পাক্কা দশ মিনিটে কফি বানানো শেষ করলাম। মগ নিয়ে যেই পিছু ঘুরবো ওমনেই টর্চ ফেলে দেই এক চিৎকার!!! চোখ খিচে কাপা হাতে মগ ধরে আছি.... ভয়ে ফিসফিসাচ্ছি ....ভুততত! ভুত! ভুত! আল্লাহ গো ভুত!.... একটুপর মাথায় কেউ জোরে থাবড়া দিল। আমি থাবড়া খেয়ে চোখ খুলে দেখি আবির ভাইয়া! উনি মুখের মধ্যে মেয়েদের মতো কারকোল ফেসিয়াল মাস্ক লাগিয়ে দাড়িয়ে আছেন। টাটকা একটা ভুতের মতো লাগছে! ঠোট আর চোখ ছাড়া পুরো মুখে ফেসিয়াল মাস্ক লেপ্টানো। টর্চের কথা মনে পড়তেই দেখি ভাইয়ার সেটা হাতে স্থান পেয়েছে। চিৎকার দেওয়ার সময় মুখ থেকে টর্চ ছেড়ে দিলে ভাইয়া ওটা ক্যাচ ধের ফেলেন।যাক খোদা! আম্মুর প্রলয় থেকে বেচে গেছি।। ভাইয়া ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন-

-হাদা! কোন আক্কেলে রান্নাঘরে ঢুকেছিস! এখন টর্চটা না ধরলে আম্মু এসে কেলানি দিতো! তখন আচ্ছা এক ধোলাই খেতি! যা রুমে যা!
-ভাইয়া...আম্মু আমার চিৎকার শুনে উঠেনি?
-ঘ্যারঘ্যার করে হাম্বার মতো আম্মু আব্বু দুজনে নাক ডাকছে। দুজনের একজনেও তোর চিৎকার শুনে উঠবে বলে মনে হয়না। আর মিরা তো মরার মতো ঘুমায়। ওই দাড়া!কোন মারা খাওয়ার জন্য এখানে আসছিলি বলে যা! 
-আমার রুমে বন্ধু পাঠিয়ে আমাকেই জিজ্ঞেস করো আমি এখানে কি করছি! তোমার বন্ধু কফি খাবে সে মরা মাটি দিতে এখানে আসছি! যত্তসব! সরো!
-সাবধান! আমার বন্ধুর ব্যাপারে বাজে কথা বলবিনা! বেচারা এতো রাতে দেশে ফিরেছে তার উপর গলা ফাটাচ্ছিস! ওকে ইচ্ছে করে পাঠাইনি। ওর এক্সিডেন্ট হয়েছিলো এজন্য পাঠিয়েছি। আর তুই তো ঘরের ভবিষ্যৎ ডাক্তার। ওকে ট্রিটমেন্ট করবি তাই আর কি.....
-এটা কোন ধরনের নিয়ম ভাই! আমি যে বড় হয়েছি সে জ্ঞান কি তোমার নেই? ছোট বোনের রুমে কেউ বন্ধু পাঠায়!
-হাহ্! "মুগ্দ ভাই মুগ্দ ভাই" করতে করতে সারাবাড়ি চলতি! আর এখন বড়বেলার হিসাব দেখাচ্ছিস! চুল ছিড়ে কাকের বাসা বাধিয়ে দিব বদমাইশ !
-লজ্জা তো তোমার নাই! সাথে আবার বন্ধু নিয়ে কাহিনি শুরু করছো! তাকে তোমার রুমে ডেকে নিলে কোন চুলায় আগুন লাগতো শুনি! আর মুখে কি মাখছো...আয়নায় দেখছো!
-গু মাখছি! তোর সমস্যা! তুই খাবি!
-ছি! সরো! তোমার জিনিস তোমার আঙ্গুলে ডলে খাও! 
-সিনু রে তোরে যদি বকা না খাওয়াইছি!! আম্মু উঠুক! দেখিস বকা না শুনালে আমার নাম পাল্টে দিব!
-নাম পাল্টে সোনাবানু আবিলা রেখো...বায়।

ভাইয়া পেছন থেকে ফিসফিসিয়ে নানাপ্রকার গালি ছুড়লেও আমার সেগুলো কানে নেওয়ার সময় নেই। রুমের আপদটাকে বিদায় করলে বাচি! আমি কফি হাতে রুমে যেয়ে দরজা আটকিয়ে দেই। উনি বিছানায় বসে ফ্লোরে তাকিয়ে কি যেন ভাবছেন। হঠাৎ বলে উঠলেন-

-সিনু রুমটা পরিস্কার করে নিস। রক্তের ছিটেফোঁটায় ভরে গেছে। চাদরটাও পাল্টে নিস।

আমি কফির মগটা উনার দিকে বাড়িয়ে দিলে উনি বিছানা ছেড়ে কফির মগটা নিয়ে সোজা বারান্দায় চলে গেলেন। আমি একটা কাপড় নিয়ে পুরো ফ্লোর পরিস্কার করে ওয়াশরুমে কাপড় রেখে দিলাম। চাদর পাল্টিয়ে আরেক চাদর বিছিয়ে নিলাম। চুলের খোপায় হাত লাগিয়ে বারান্দায় যেয়ে দাড়ালে উনার দিকে চোখ আটকে যায়। দূরবর্তী টাওয়ারের শীর্ষ সীমানায় তাকিয়ে আছেন....থেমে থেমে কফির মগে চুমুক....আমি হাত ভাজ করে দেয়ালে হেলান দিয়ে উনাকে দেখতে লাগলাম..... রাদিফ আবরার মুগ্ধ বিদেশ থাকতে থাকতে আরো ধবধবে ধলা হয়ে গেছে। সবচেয়ে আর্কষনীয় উনার চোখের ভারি পাপড়ি গুলো.....ওগুলো যেন পাপড়ি না প্রতিটা ঈর্ষণীয় মোহ... গুটিকতক চুল সামনে এসে ব্যান্ডেজ ঢেকে দিয়েছে...এক কথায় দারুন! মাথা থেকে রক্ত ঝরার কারনে গালের একপাশে লম্বালম্বি শুকিয়ে রক্তের ছোপ লেগে আছে।  ফর্সা কিছুর উপর লাল রঙের ভেলকি যেমন ফুটে উঠে উনার মাঝেও ফুটে উঠেছে। ঠোট দুটো আলতো ফুলিয়ে ধোয়া উঠা মগের উপর ফু দিয়ে যাচ্ছেন...আবার ফু দেয়া শেষে ঠোট লাগিয়ে নিয়মকরে কফিতে চুমুক। প্রতিটা চুমুকে চোখ বন্ধ করে অনুভব করছেন। আবার চুমুক শেষে তাকিয়ে নিচ্ছেন....শতশত বিবরন দিলেও আমি হয়তো বিশ শতাংশ সৌন্দর্যতার বিবরন দিতে পারব...শতভাগ না...

রাদিফ আবরার মুগ্ধ। আমার আম্মুর কাছের বান্ধবী রাবেয়া আন্টির ছোট ছেলে।বড় ভাই রাফিন আবরার আর ছোট বোন রাফিয়া আফসানা। উনারা আমাদের পাশের বিল্ডিংয়ে থাকেন। আঙ্কেল একজন বিজনেসম্যান। আবার আব্বুর স্কুল ফ্রেন্ডও। ছোট থেকেই মুগ্ধ ভাইয়া আমাদের বাসায় আসা যাওয়া করতেন। এমনকি এ বাসাতেই উনার খাওয়া-দাওয়া, এ বাসাতেই ঘুম, সব কিছু এ বাসাতেই সব। রাফিন ভাইয়া একটু চুপচাপ ভদ্র স্বভাবের, একটুও মিশুক না। কখনো যদি আবির ভাইয়ার কলিজার বন্ধু বলে সাত এলাকা জিজ্ঞেস করা হয় সবাই উত্তর দিবে মুগ্ধ ভাইয়ার দিকে। রাফিয়া ছোট, সবেমাত্র ক্লাস নাইনে উঠেছে। মুগ্ধ ভাইয়ার যাওয়া নিয়ে একটা বড়সড় গন্ডগোল পাকানো রহস্য লুকিয়ে আছে। যা আমরা কেউ জানি না। শুনেছি আঙ্কেলের সাথে ঝগড়া করে ভাইয়া বিদেশ চলে যান। কিন্তু ঝগড়ার কারনটা এখনো অজানা। রাফিন ভাইয়া তারপর থেকে ভাসির্টির হোস্টেলে থাকেন। আর রাফিয়া আঙ্কেল আন্টির সাথে। দুই ভাইয়ের মধ্যে কোনো এক রহস্য আছে।। আমি একটু হলেও এতো বছরে অনুমান করতে পেরেছি। অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু কোনো জটই খুলতে পারিনি। মুগ্ধ ভাইয়ার চলে যাওয়াতে আবির ভাইয়াসহ আম্মু আব্বু কষ্ট পেয়েছিলেন। আসলে আমিও অনেকটা কষ্ট পেয়েছি।  উনার চলে যাওয়াতে মনস্থির করে ফেলেছিলাম ভাইয়া ভবিষ্যতে দেশে ফিরলেও কখনো কথা বলবো না। এখনো সেই কথায় অটল। 

-সিনু কফিটা ভালো বানিয়েছিস। কথা হলো আমাকে ঠিক করতে পারবি?

আমি কপালকুচকে কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম! দেয়াল থেকে সোজা হয়ে দাড়িয়ে প্রশ্ন ছুড়ে বললাম-

-আপনি কিসব কথাবার্তা বলছেন? মাথা ঠিক আছে? 
-তুই জানিস না আমি কি বলছি? ওকে নাথিং! গট লস্ট ! আমি তাহলে কোনো কথা বলতে চাই না!
-শুনুন! আপনি কফি শেষে বিদায় হোন! আপনার আজেবাজে কথার শোনার জন্য আমি বসে নেই। আরেকটা কথা...বাইরের মানুষের জন্য আমি সময় নিয়ে বসে থাকিনা!

উনি কফির মগে চুমুক দিতে গিয়ে থেমে গেলেন। কিছু না বলেই কফির মগটা বারান্দার বাইরে কাত করে ঢেলে দিতে লাগলেন। সব কফি উচু থেকে ঝর্নার মতো রাস্তায় পড়তে লাগল। আমি আরেক দফায় আশ্চর্য! কি করছেন কি উনি! আমি ক্ষীপ্র গলায় বলে উঠলাম-

-আপনার সমস্যা কি বলুন তো? কেন বারবার তামাশা করছেন! নিজে এই রাতে রক্তাক্ত হয়ে এসেছেন! কফি খাবেন বলে আবদার করলেন! এখন সব কফি ঢেলে দিচ্ছেন!!

আমার কথায় উনার টনক নড়লো না। উনি পুরোটা কফি ফেলে দিয়ে আমার হাতটা টেনে মগটা ধরিয়ে দিলেন। বাম ভ্রুটা উচু তুলে চোখ ছোট করে ভাব নিয়ে বলে উঠলেন-

-একচুয়েলি কফির ফিডব্যাক দিলাম ওকে? ইটস ইউর রিভিউ! মানুষ যদি ভালোয় ভালোয় না বোঝে আঙ্গুল বাকিয়ে বোঝানো লাগে ইউ নো?? 

-আপনার দু নম্বরি এটিটিউড জায়গা মতো দেখাবেন রাদিফ ব্রো! আপনি হয়তো ভুলে গেছেন এটা আমার বাসা এন্ড অলসো মাই রুম! "গট লস্ট" ওয়ার্ড টা আমার বলা সাজে আপনার না!

উনি ডোন্ট কেয়ার মুডে তাকিয়ে আছেন। ঘড়ির বাম হাতটা সামনে এনে এক নজর তাকিয়ে বাকা হেসে দিলেন। ঘড়ির ডায়ালে তাকিয়ে স্মিত হেসে এটিটিউড ভাবভঙ্গিতে বলে উঠলেন-

-Oppsss....স্নিগ্ধা মম হেজ চেন্জড!!! "ভাইয়া টু ব্রো" ! মম, ইউ নো...আমাকে রাদিফ বলে কেউ ডাকেনা। মুগ্ধ আমার নাম। সো নেক্সট থেকে মুগ্ধ না বললে, God Knows what will i do with you... ওকে বায় যেতে হচ্ছে...গেমটা পরে খেলতে আসি কেমন? গালটা দেখে নিস, অনেক বছর  চড় পর দিলাম। দেখা হচ্ছে আরো একবার।। 

ভাইয়া চোখের পলকে হঠাৎ একটান মেরে আমার গালের সাথে গাল ঘষে নিলেন। আমি চোখ বড় করে অবাকের ধাপ পার করছি! উনি এটা কি করলেন? চোখ টিপ মেরে মুচকি হেসে রুমের ভেতরে ঢুকে গেলেন। আমি গালে হাত বুলাবো উনার যাওয়ার পানে তাকিয়ে আছি। রুমের দরজা খুলে মাথা ঘুরিয়ে বলে উঠলেন-

-সিনু কাম কুইক! কেউ জেগে উঠার আগেই আমাকে বিদায় দিয়ে দে.....এখন তো গালে গাল টাচ করলাম নেক্সটে বড় ধামাক্কা থাকছে...ওকে?

.
.

ভাইয়াকে বিদায় দিয়ে রুমে শুয়ে আছি। নয়টা বছর পর উনি ফিরে আসলেন। প্রথম দিন এসে যেসব কথা বললেন আমি এটা ভাবতে বাধ্য উনি আমাকে অন্য নজরে দেখছেন। সামনে কি হয় জানে?

সকালে ঘুমিয়ে আছি  দরজায় কেউ ধামাধাম ঠকঠক করছে। এই বুঝি দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকল। "মম দরজা খোল ওই বান্দরনি দরজা খোল! মম উঠ গাধি!"...মিরা আপু দরজার ওপাশে বাপ দাদার নাম নিয়ে দরজা ধাক্কাচ্ছে। আমি হাই তুলে বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলতেই কয়েক হাজার বার ধাক্কানো শেষ। দরজা খুলে দিলে মিরা আপু হুরহুর করে রুমে ঢুকে আমার হাত টেনে বলল-

-মম মম মম মম!!!! জানিস!!! ওই জানিস!! কে এসেছে!!
আমি চোখ কচলে ঘুমঘুম চোখে বলে উঠলাম-
-আপু ককে এসেছে... আমার ঘুমমমম...

আমি চোখ বন্ধ করে ঘুমে ডুব দিতে নিলে আপু কানমলা দিয়ে বলে উঠে-

-সকাল সকাল থাপ্পর না খেতে চাইলে ভালো মানুষের মতো ঘুম ত্যাগ কর!সময় আছে এখনো! ভালো হতে কিন্তু টাকা পয়সা লাগে না!

আমি আপুর এক কানমলা খেয়েই কাবু হয়ে গেলাম!
-এই আপু আপু এই ছাড়ো আল্লাহ! ইশশ কান ছিড়ে ফেলছো তো! আরে আমার বইনা ছাড়ো না প্লিজ! এই দেখো ঘুম নাই...হুশ হুশ হুশ.....চলে গেছে
-যা ছেড়ে দিলাম...এক্ষুনি মুখ ধুয়ে নিচে আয়। মেহমান এসেছে। 
-আচ্ছা যাও..

আপু নিচে চলে গেলে আমি কান ছোয়াতে ছোয়াতে ওয়াশরুমে যাই। মুখ হাত ধুয়ে টিশার্ট পাল্টে একটা কামিজ পরে গলায় ওড়না দিয়ে নিচে চলে যাই। আব্বু নাস্তা করছেন। অফিসে চলে যাবেন। ভাইয়াও নাস্তা করছেন কিন্তু সোফায় বসে। উনিও অফিসে দৌড় দিবেন সবসময়ের মতো লেট হওয়ার তাগিদে। ড্রয়িং রুমে হট্টগোলের আওয়াজ পেয়ে ওখানে গেলে দেখি, মুগ্ধ ভাইয়া, রাফিয়া, আন্টি বসে আছেন। আম্মু উনাদের সাথে গল্প করছেন। আমাকে দেখে রাফিয়া উঠে পাশে এসে দাড়িয়ে বলল-

-মম আপু দেখেন তো চিনেন নাকি????....(রাফিয়া চোখ দিয়ে ইশারা করে মুগ্ধ ভাইয়ার দিকে সংকেত বোঝালো)

মুগ্ধ ভাইয়া মোবাইল হাতে কারোর সাথে ফোনে কথা বলছেন। আন্টি আম্মুর সাথে ব্যস্ত। আমি চিনেও না চিনার ভান ধরে বললাম-

-উনি কি রাফিন ভাইয়া? বাহ্ বেশ তো!! ভাইয়া এতো বছর পর হোস্টেল থেকে  আসলেন? ভালোই হলো।।

আমার কথা শুনে রাফিয়ার মুখ ফুটো বেলুনের মতো চুপসে গেল। রাফিয়া ঠোট নাড়িয়ে কিছু বলতে নেবে আন্টি বলে উঠল-

-টুকটুকি এখানে আসো....দেখো আজকে তোমার সারপ্রাইজ আনলাম!! ছোটবেলায় তো বারবার জিজ্ঞেস করতে "মুগ্ধ ভাইয়া কবে আসবে উনি কোথায়"....এই নাও এই যে... এসে গেছে কুলাঙ্গা। 

ভাইয়া ফোন কানে নিয়ে আমার দিকে তাকালেন। লোয়ার ঠোটটা দাতে চেপে হাতে থাকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে কান থেকে ফোনটা নামিয়ে নিলেন। মুখে গম্ভীরতার ভাব। হঠাৎ উনি ব্যঙ্গ করে বলে উঠলেন-

-পাকনি তুই দেখতে সুন্দর হসনি....আগে কতো কিউট গোলুমোলু ছিলি...নাও লুকিং আগলি....(আন্টির দিকে তাকিয়ে) আম্মু শুনছো? তোমাদের টুকটুকি দেখতে কুৎসিত হয়েছে....তার চেয়ে বরং মিরা সুন্দরী হয়েছে, একটা পরীর মতো সুন্দরী.......মিরাকে বাড়ির বউ বানাতে কেউ পিছপা হবেনা বুঝছো...

আন্টি আম্মু চুপটি মেরে খিলখিলিয়ে হেসে দিলেন। রাফিয়া মুখে হাত দিয়ে হাসছে। আমি বোকা বনে চোখ নামিয়ে তাকিয়ে আছি। সব সহ্য হলেও শারীরিক গড়নের খোটাটা সোজা বুকে গিয়ে বিধে। আমি জানি উনি ফাজলামি করছেন কিন্তু সীমানা ছাড়িয়ে ফাজলামি করে ফেলেছেন...যা উনার কাম্য না। আমি মুখ ফুলিয়ে রুমে চলে আসতে নিলে ডাইনিং রুমে আব্বু বলে উঠলেন-

-মা দাড়া নাস্তা করে যা....কি হলো? সকাল সকাল মেয়েটার মুখের এ অবস্থা কেন?
-কিছু না আব্বু। তুমি নাস্তা করো। আমি পরে করছি। 
-না না কিছু তো অবশ্যই হয়েছে....তোর মুখ তো এমনে এমনেই ল্যাটকে থাকবে না,

-বললাম তো আব্বু কিচ্ছু হয়নি। তুমি নাস্তা করো। তোমার অফিস যেতে দেরি হয়ে যাবে।  

পাশ থেকে ভাইয়া বত্রিশটা দাতের ভেটকি দিয়ে বলে উঠল-
-আব্বু ভুটকির ভোটকামি মুগ্ধ ঢোল বাজিয়ে ল্যাটকা খিচুড়ি পাকিয়ে দিছে!!! কিরে বদমাইশ কাল রাতের  কথা মনে আছে তো?বকুনি খাওয়াবো!!! হা হা হা ...

-কামলার মতো হাসি বন্ধ করো কিপ্টা শয়তান! 

 পরোটায় শেষ কামড়টা দিতে গিয়ে থেমে গেলেন ভাইয়া। আব্বু হুহু করে হাসি!! আমি দৌড়ে রুমে এসে দরজা ঠেলে বারান্দায় গেলাম।। আমি কান্না করিনি। সহজে চোখ দিয়ে পানি ঝরাই না। কিন্তু মনটা অনেক খারাপ হয়ে গেছে। মিরা আপু আসলেই খুব সুন্দরী। রূপে, গুনে পূর্নাঙ্গ। আর আমি? আমার মধ্যে না রূপ আছে, না এক চিলতে গুন। রাগি, বদমেজাজী খারাপ একটা মেয়ে। মিরা আপুর ধারের কাছেও নেই আমি। আম্মু তো আমাকে দুচোখে দেখতেই পারেনা। কারন আমি কোনো কাজই ঠিক করে করতে পারিনা। সবসময় কাজগুলো নষ্টের ক্ষেত্রে বসে থাকতাম। হঠাৎ  মনে হলো কেউ আমার পিছন এসে দাড়িয়েছে। আমার মাথার পেছন প্রান্তে ঠোট ছুয়িয়ে দিচ্ছে। আমি ঘুরতে নিলে সে বলে উঠে-

-স্টপ! ঘুরিস না প্লিজ....ওখান থেকে চলে আসলি কেন? তোকে কুৎসিত বলেছি দেখে চলে আসলি?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন